আকাশ তখন ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে। ভোরের ঋষিকেশ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে দিনলিপির পাতায়। এক মধ্য-ত্রিশ পার করা যুবক বসে আছে গঙ্গার তীরে। তার মনের মধ্যেও তখন আকাশের মতোই রঙ বদলাচ্ছে সুর। সেই সুর যার কাছে তার আত্মসমর্পণ ঘটে গেছে সেই শিশু বয়সে। খরস্রোতা গঙ্গা পাথরের কোল ঘেঁষে তার আবর্তন নিতে নিতে এগিয়ে চলেছে আগামীর দিকে। এক অদ্ভুত স্বরপ্রয়োগ তৈরি হচ্ছে সেই আবর্তনে আর যুবক উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে সে দিকে। শিখে নিতে চেষ্টা করছে সেই স্বরপ্রয়োগ। প্রাকৃতিক গমক সৃষ্টি করতে করতে যেন বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা গঙ্গা আর তার পাশে বসা যুবক যেন নিষ্ঠাবান শিষ্যের মতন আত্মস্থ করে নিচ্ছে সেই শিক্ষা। সত্যি কথা বলতে তো তার কাছে পরম গুরু বলতে সেইই ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালোবাসা। যার ডাকে সেই ছোট্টবেলায় তার গুরু এবং পিতাসমান দাদা পণ্ডিত মণিরামের নিভে যাওয়া কন্ঠের নতুন করে জ্বলে ওঠা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সানন্দ-এর মহারাজা জয়বন্ত সিংহের মধ্যস্থতায়, মহাকালীর দেবদেউলে বসে। ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যে নিজের ভেতরের কু-এর হাতছানিকে এড়িয়ে সু-কে খুঁজে পাওয়া, অ-সুরকে এড়িয়ে সুর-কে খুঁজে পাওয়া এই সত্যকে আশ্রয় করেই সেই যুবকের জীবন আবর্তিত হতে থেকেছে চিরকাল।
সেইদিনকার সেই যুবক তার আশি বছরের সঙ্গীত জীবনের শেষতম আবর্তনটি সম্পন্ন করে রঙ বদলাতে থাকা ভোরের আকাশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন গতকাল। সঙ্গীতজগতের রত্নভান্ডার থেকে তার অন্যতম প্রিয় রত্নটি হারিয়ে গেল চিরতরে। দেহ রাখলেন পদ্মবিভূষণ সঙ্গীতমার্তন্ড পন্ডিত জসরাজ। তার প্রিয় দেশের মাটি থেকে বহু দূরে। কিন্তু সুরের তো মৃত্যু নেই। তার প্রক্ষেপিত প্রত্যেকটি সুর বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে আন্দোলিত করে গেছে প্রত্যেক সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতার হৃদয়। করে যাবে। এক অতি সাধারণ ঘরে জন্মেছিলেন তিনি কিন্তু সেই সাধারণের মধ্যেই ছিল অসাধারণ সঙ্গীতের প্রাচুর্য এবং অপরিমেয় সম্ভাবনা। শিশুবয়সে পিতার মৃত্যুর পরে পিতৃতুল্য দাদা পণ্ডিত মণিরামজিকে ঘিরেই তার বেড়ে ওঠা। প্রথাগত স্কুল কলেজের শিক্ষা স্বভাবতই পাওয়া তখন সম্ভব ছিলনা তার। কিন্তু ভারতীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো মন তখনও ছিল সানন্দ-এর মহারাজা জয়বন্ত সিংহের মত মানুষদের।
একদিন হঠাতই সাহস করে দেখা করতে চলে এসেছিলেন দাদু সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে। ওই কন্ঠস্বর ও ঘরানার সংকীর্ণতাবিহীন গায়কী তাঁকে মুগ্ধ করে তুলেছিল এই মানুষটির প্রতি। পরপর একাধিক আসরে তাঁকে ও তাঁর পুত্র মানসকে শুনেছেন তখন জসরাজ।
পরিবারটির প্রতিপালনের দায়িত্ব নেন তিনিই। সে’সময় দাদাকে তবলায় সঙ্গত করাই ছিল জসরাজজি’র প্রধান কাজ। কিন্তু তাতেও এক বিপত্তি দেখা দিল, এক অগ্রজ শিল্পী একদিন অপমান করে বসলেন এই বলে যে “মৃত জানোয়ারের চামড়া পেটাচ্ছো!” কথাটা মনে ঘর করে গেল, আঘাত পেলেন খুব, ঠিক করলেন যাই হোক না কেন জীবনে গানই গাইবেন। শুরু হল কন্ঠসঙ্গীতের শিক্ষা ও রিয়াজ। সানন্দ-এর মহারাজা জয়বন্ত সিংহের ভালবাসায় তার সভায় আসা গুণীজনের কবিতাপাঠ, সাহিত্য-আলোচনা, গানবাজনা, সঙ্গীতালোচনা শোনার সুযোগ পেতে লাগলেন নিয়মিত। সেই কৃতজ্ঞতার কথা তিনি সারাজীবনে ভোলেন তো নিই, বরং আরও বেশি বেশি করে বলতেন বারম্বার।
তাঁর জীবন যত এগিয়েছে তাঁর সঙ্গীতকেও তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, নিজেকে পরিমার্জিত করেছেন বারবার। পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূলতঃ কেটেছে এই কলকাতা শহরের ছত্রছায়াতেই। সে’সময়ে ভারতবর্ষের অধিকাংশ বড় বড় নামজাদা সঙ্গীত জলসাই হত এই কলকাতার বুকে। নক্ষত্রখচিত সঙ্গীতজগতের আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছেন পন্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, শ্রীমতি কেসরবাঈ কেরকর, উস্তাদ আমীর খানের মত নাম। বড় বড় সঙ্গীতাসরে যাওয়া এবং শোনা শুরু হল তাঁর অভিভাবিকাসমা ছাত্রী সোম তিওয়ারীর সহায়তায়। যাকে তিনি ডাকতেন “আম্মাজি” বলে। ধীরে ধীরে আশীর্বাদধন্য হতে লাগলেন অগ্রজ দিকপাল শিল্পীদের।

এই সময়েই আমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রথম ওঁর যোগাযোগ ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠা। একদিন হঠাতই সাহস করে দেখা করতে চলে এসেছিলেন দাদু সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে। ওই কন্ঠস্বর ও ঘরানার সংকীর্ণতাবিহীন গায়কী তাঁকে মুগ্ধ করে তুলেছিল এই মানুষটির প্রতি। পরপর একাধিক আসরে তাঁকে ও তাঁর পুত্র মানসকে শুনেছেন তখন জসরাজ। বাড়িতে এসে আলাপচারিতা তাই জমে উঠল অচিরেই। বাবার ছাদের ঘরে একসঙ্গে বসে রেওয়াজ, আড্ডা, মতবিনিময় জমে উঠত মাঝেমাঝেই। তিনি নিজে সেইসময় তরুণ গায়ক হিসেবে নজর কেড়েছেন কেসরবাঈ কেরকর, ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের, প্রশংসিত হচ্ছেন সঙ্গীতমহলে। এরইমধ্যে দাদুর জন্মদিনের সারারাতব্যাপী সঙ্গীতের আসরে গাইলেন তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে। ছোট ভাইয়ের মত বাবাকেও উৎসাহ দিতেন। “তুমি যে গান গাইছ এখন, তা সারা ভারতবর্ষের শোনা উচিৎ। তুমি নিজেকে কলকাতায় আটকে রেখো না। একক অনুষ্ঠান করা শুরু করো।” এই কথা আজকের এই অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার যুগে হয়ত কোনও সহোদর ভাইও ভাইকে বলবে না কিন্তু সে যুগটা ছিল অন্য। তাঁর মতো ঋষিতুল্য শিল্পীরা নিজেদের গান, নিজেদের ঘরানা নিয়ে ভেবেছেন ঠিকই কিন্তু সার্বিকভাবে তাঁদের মনস্কামনা ছিল একটাই – সঙ্গীতের ধারা এগিয়ে চলুক সঠিক দিকে। সত্যিকারের গুণী শিল্পীদের মানুষ শুনুক, চিনুক, জানুক।
তিনি ছিলেন এমন একজন শিল্পী যিনি আসলে সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির আধারে পেয়েছিলেন সারাজীবন। একটি “ওম” দিয়ে তিনি চারপাশের বিক্ষিপ্ততা থেকে নিজে পৃথক করে নিতেন। স্বপ্নে পাওয়া বন্দিশের মুখড়া নিয়ে মধ্যরাতে উঠে পড়ে স্ত্রী মধুরাকে জাগিয়ে বলতেন লিখে নাও স্বরলিপি।
আসলে তিনি ছিলেন এমন একজন শিল্পী যিনি আসলে সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির আধারে পেয়েছিলেন সারাজীবন। একটি “ওম” দিয়ে তিনি চারপাশের বিক্ষিপ্ততা থেকে নিজে পৃথক করে নিতেন। স্বপ্নে পাওয়া বন্দিশের মুখড়া নিয়ে মধ্যরাতে উঠে পড়ে স্ত্রী মধুরাকে জাগিয়ে বলতেন লিখে নাও স্বরলিপি। মেওয়াটি ঘরানার পুরোধা’র আসন আজ শূন্য হল ঠিকই, কিন্তু তিনি যে অগুনতি সঙ্গীতের বীজ ছড়িয়ে গেলেন তা অঙ্কুরিত হতে থাকবে আবহমানকাল ধরে। তাঁকে যতবার শুনেছি আসরে বা রেকর্ডিং-এ বারবার একটাই কথা মনে হয়েছে। প্রতিটি স্বরের প্রতি যেন তার আত্মনিবেদন, প্রতিটি মুড়কি, প্রতিটি গমকে যেন রাগের মধ্যে দিয়ে তিনি সর্বময়ের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করছেন; যে সমর্পণের মধ্যে অতি বিনয়ের ভণিতা নেই, নিবেদনের মর্যাদা রয়েছে। রয়েছে বিশ্বাস – নিজের সঙ্গীতের প্রতি, যে প্রকৃতি তাকে এই সঙ্গীত দিয়েছে তার প্রতি।
এ’লেখা যখন লিখছি তখন মুম্বইয়ে তাঁর সঙ্গে হওয়া শেষ দেখা মনে পড়ে যাচ্ছে, আসরের পায়ের ধূলো মনে পড়ে যাচ্ছে, মাথায় একটা ভারী সঙ্গীতময় ভালোবাসার হাত মনে পড়ে যাচ্ছে, গোরখকল্যাণের মন্দ্র সপ্তকের মধ্যম থেকে মধ্যসপ্তকের মধ্যম ছুঁয়ে, ঋষভ, কোমল নিষাদ, ধৈবতকে আন্দোলিত করে ষড়জে ন্যাস করছে এক কিংবদন্তীর কন্ঠস্বর। অবশেষে বলে উঠছেন যেন “জয় হো”।
সঙ্গীতজ্ঞ মানস চক্রবর্তীর সুযোগ্যা কন্যা শ্রীদর্শিনী উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন এক্কেবারে শিশুবয়স থেকে। সঙ্গীত তাঁর শিরা-ধমনীতে। টাইমস মিউজিক থেকে বেরিয়েছে গানের সিডিও। মুম্বইয়ের ইন্ডিয়ান আইডল অ্যাকাডেমিতে মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন শ্রীদর্শিনী। লেখালিখিও তাঁর পছন্দের বিষয়।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'শীতের অব্যর্থ ডুয়ার্স', 'এসো বৃষ্টি এসো নুন', 'রাজা সাজা হল না যাদের' এবং 'জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলো' পাঠকমহলে সমাদৃত।
2 Responses
আহা ….
মন ভরে গেল – সুরের মূ্র্ছনা আর লেখার বিন্যাসে ।
সঙ্গীতের ধারায় তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আগামী গায়কীর উচ্চারণে।