Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors
Pannalal Bhattacharya
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

‘চাইনা মাগো রাজা হতে, রাজা হওয়ার সাধ নাই মাগো…’— কালীপুজোর রাতে আতসবাজির রকমারিত্বের মধ্যে বাতাসে ভেসে আসছে এই গান। মাঝে মাঝে কমছে, কখনও জোরে। এই অনুভূতির কোনও হিসেব-নিকেশ হয় না। কিন্তু গান মানে তো, তা কোনও কণ্ঠবাহিত। বেশিরভাগ বাঙালির কাছে গানটির উল্লেখই গায়ক-নির্ধারণের পক্ষে যথেষ্ট। কারণ, অনুভূতিটি কারওর কাছেই পূর্ণতা পাবে না, কণ্ঠটি পান্নালাল ভট্টাচার্যের না হলে।

মহালয়ার ভোরে বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ এবং শ্যামা মায়ের আরাধনার দিনে পান্নালাল ভট্টাচার্যের শ্যামাসঙ্গীতের সঙ্গে যথাক্রমে দুর্গাপুজো ও কালীপুজো বাঙালিমননে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এ যেন এক অপূর্ব বন্দনানুভূতি!

এক ভক্তিসুরভিত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। কেমন শিল্পী? ছোটভাই পান্নালালের গান সম্পর্কে আর এক অবিস্মরণীয় শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (মেজদা) একজায়গায় বলেছিলেন, ‘…ওর গানের যে পারফেকশন, যে ভাব, তা একেবারে ঐশী ব্যাপার। তার গানের মতো মর্মস্পর্শী গান আমি নিজে গাইতে পারি নি। “আমার সাধ না মিটিল” এবং “ডুব ডুব ডুব ডুবসাগরে আমার মন”— এই গানদুটো পাশাপাশি চিন্তা করলেই বোঝা যাবে তফাতটা। আমার সাধ না মিটিল গানটি যেন সমস্ত শরীর ও মনকে নাড়া দেয়। কিন্তু আমার গান শুনে সবাই বলেন, ভিস্যুয়াল এফেক্টের কথা।’ 

দিবারাত্র সমস্ত সত্তাজুড়ে বয়ে চলা ভক্তি ও প্রেমের হাহাকারজনিত হিল্লোল সুরসমৃদ্ধ কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে যে নিবেদনের জন্ম দেয়, তারই পূর্ণপ্রকাশ ঘটে পান্নালাল ভট্টাচার্যের শ্যামার গানে। এ গান শুনলে সুর-বাণী-তাল-লয়-কণ্ঠপ্রকৃতি সব গৌণ হয়ে, শ্রোতা-হৃদয় কেঁপে ওঠে— কাঁদতে চায়। কেন? কী জন্য? তা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বাংলা গানের একটি যুগ। তাঁর কণ্ঠ জন্ম দিয়েছে অজস্র অসাধারণ ভক্তিসঙ্গীতের। তবুও, শুধুমাত্র শ্যামাসঙ্গীতের ক্ষেত্রে পান্নালাল ভট্টাচার্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। 

Pannalal Bhattacharya smile
একদিকে দক্ষিণেশ্বর অন্যদিকে বেলুড়। মাঝখানে বালি। সেখানেই জন্ম পান্নালালের।

হুগলির বালি এলাকাটি যেন তীর্থক্ষেত্রের মতো। গঙ্গার ওপারে দক্ষিণেশ্বরে দেবী ভবতারিণীর অধিষ্ঠান। আর এপারে দক্ষিণে এগোলে গঙ্গার পাড়েই স্বামীজীর গড়া গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের অধিষ্ঠানক্ষেত্র— ‘বেলুড় মঠ। এই পরিমণ্ডলে ঘেরা বালির বারেন্দ্রপাড়ায় জন্ম পান্নালালের। যেন মায়ের বিচরণভূমিতে পুত্রের আগমন। পান্নালাল ভট্টাচার্যের পক্ষে একেবারে আদর্শ জন্মস্থানই বটে। বড়দা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য ও মেজদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের অনুপ্রেরণা ও শিক্ষার মাধ্যমেই পান্নালালের গান শেখার শুরু। এরপর, ধনঞ্জয় ভাইকে সঙ্গীতাচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতশিক্ষার জন্য নিয়ে যান। সবকিছুর পরেও, যা মনে হয়, পান্নালালের তৃষ্ণার্ত-হৃদয় এক অন্য দুনিয়ায় পড়ে থাকত, যা সম্ভবত নজরে এসেছিল ধনঞ্জয়বাবুর। তাই চিরাচরিতভাবে আধুনিক বাংলা গান গেয়ে সঙ্গীতজীবন শুরু করলেও মূলত মেজদার পরামর্শেই ভক্তিসঙ্গীতে নিজেকে সঁপে দিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। মনের কথা সুরাশ্রয়ে ব্যক্ত করার আসল সঙ্গীতরূপের সন্ধান যেন পেলেন তিনি।

‘মা গো আনন্দময়ী…’, ‘কোথা ভবদারা…’, ‘বসন পরো মা…’, ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে…’, ‘আসার আশা ভবে আসা…’— পান্নাকণ্ঠ নিঃসৃত এরকম আরও অনেক শ্যামাসঙ্গীত যেন কালী-আরাধনার মন্ত্রোচ্চারণের রূপধারণ করেছে বলা যায়। এ গান শুধুমাত্র ‘সরগম’ চর্চা করে সুর তুলে ফেলার মধ্যে দিয়ে গাওয়া যায় না। তখন তা শুধু গাওয়া হয়। পরিবেশনও হয় না। নিবেদন তো দূরের কথা।

গত কয়েক দশক জুড়ে যুক্তি ও হিসেবের দুনিয়া যেভাবে ভক্তির পৃথিবীকে নস্যাৎ করে দিতে উদ্যত, তাতে মাঝেমাঝে মনে হয়, অনেক কিছুই বোধহয় আজ দূর অস্ত ভাবা ছাড়া কোনও গতি নেই। পরক্ষণেই ভাবি, আজও কালীপুজো আর পান্নালালের ‘মায়ের গান’ একাকার হয়ে আমাদের মনে হানা দেয় কীভাবে? এ অত্যন্ত গুলিয়ে যাওয়া বিষয়। আসলে একটা দেশ তথা স্থানের বহুদিন থেকে গড়ে ওঠা বেশকিছু চিন্তাধারাগত সংস্কৃতি বোধহয় এক অর্থে নিত্যতা-সূত্র মেনে চলে। যুগ অনুযায়ী রূপ পালটালেও, কোনওদিন বিলুপ্ত হয় না।

ভক্তিসঙ্গীতের ঐতিহ্য বহুকালের। শুধুমাত্র রেকর্ডের দুনিয়ায় শ্যামাসঙ্গীতের ক্ষেত্রে বলা যায়, লালচাঁদ বড়াল— কে. মল্লিক— ভবানী দাস— মৃণালকান্তি ঘোষ থেকে শুরু করে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য— রামকুমার চট্টোপাধ্যায়— নির্মল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অজস্র শিল্পী (পুরুষ) ভক্তির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন বাংলা গানের জগতে। কিন্তু, একথা অনস্বীকার্য, সকলের মধ্যে শ্যামার গানে বাঙালিমনে পান্নালাল ভট্টাচার্য এক স্বতন্ত্র আসন দখল করে আছেন।

পান্নালাল ভট্টাচার্যের ভাইপো, ধনঞ্জয়পুত্র দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এক নিবন্ধে তাঁর কাকার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, শেষদিকে পান্নালাল প্রায়শই শ্মশানে বসে থাকতেন, আর ‘দেখা দে মা’ বলে হাহাকার করতেন। এ যেন এক তীব্র অন্বেষণ। এই অকথিত টানাপোড়েন সহ্য করতে না পেরেই সম্ভবত ১৯৬৬-র ২৭ মার্চ আত্মহননের পথ বেছে নেন শিল্পী। পান্নালালের জন্ম ১৯৩০। তাঁর থেকে সাত বছরের বড় দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ভাইয়ের এভাবে চলে যাওয়ায় অসম্ভব ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘…চলে যাওয়ার অনেক কারণই থাকতে পারে। তবে সত্যিকারের মাতৃদর্শন কিন্তু ওরই হয়েছিল। আধারটা তৈরী হয়নি বলে ধরে রাখতে পারল না। এসব জিনিসকে ধরে রাখবার জন্য একটা আধার দরকার। সে আধার তৈরী করতে হলে নিজেকে মুক্ত করতে হয়।’ 

এছাড়া, ‘পান্নালাল গেছে চলে’ নামের একটি ছোট কবিতায় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছিলেন— 

‘শ্যামা মায়ের কোলের ছেলে
আত্মাভিমানে গেলেন চলে
ঐ শ্যামা মারই কোলে
আপনজনে ফেলে।
মা কে কাছে না পেলে
কী মূর্তি ধরে ছেলে
জানলো সবে সাতসকালে
পান্নালাল গেছে চলে।’

Pannalal Bhattacharya with wife and daughter
স্ত্রী ও শিশুকন্যার সঙ্গে পান্নালাল ভট্টাচার্য

এক সাধক-শিল্পীর বিষয়ে আর এক সাধক-শিল্পীর মনোভাবের কী যন্ত্রণাময় মর্মস্পর্শী প্রকাশ! এহেন শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য শ্যামাসঙ্গীত-সম্রাট হবেন না তো, কে হবেন? শুধু শ্যামার গান কেন, ভক্তিসঙ্গীত হলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পান্নালাল অদ্বিতীয় হয়ে উঠতেন। রজনীকান্তের ‘তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে…’ গানের শেষকথা যে হয়ে উঠেছেন পান্নালাল ভট্টাচার্য, তা বলাই যায়। লাইভ সম্প্রচারের যুগে ১৯৫৫ সালে বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র শিল্পী তালিকাতেও পান্নালাল ভট্টাচার্যের নাম উল্লিখিত আছে। তাঁর সঙ্গীতকণ্ঠের চলাচলের ধরনে দাদা ধনঞ্জয়ের ছায়া থাকলেও, এক নিজস্ব পেলব-মধুরতা পান্নালালের গায়নভঙ্গিকে অনন্য করে দেয়। পর্দা থেকে পর্দায় কণ্ঠবিচরণের মাধ্যমে যেন ভক্তিপথের অন্বেষণে মেতে ওঠে পান্নালাল ভট্টাচার্যের সঙ্গীত পরিবেশন। যেমন সুদৃঢ় সঙ্গীতশিক্ষা, ততোধিক ভক্তিময় অনুভূতিতে ভরা ছিল তাঁর সঙ্গীতকণ্ঠ।।

পাথর-পান্নার রঙ সবুজ। কিন্তু, শক্তিরূপের প্রকাশ রক্তবর্ণে। তাই বোধহয় ‘শক্তিরূপী সনাতনী’-র আরাধনার মুহূর্তে যে বরণীয় সাধকশিল্পীর কণ্ঠনিঃসৃত ‘মায়ের গান’ উজ্জ্বল হয়ে উঠে শ্যামাপূজাকে যেন এক অর্থে পরিপূর্ণ করে তোলে, সেই ‘পান্না’ হয়ে যান ‘লাল’— পান্নালাল ভট্টাচার্য।

 

*ছবি সৌজন্য: calcuttaweb, facebook, abpnews
*নিবন্ধের অংশবিশেষ ইতিপূর্বে ‘মাতৃশক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত

Author Avik Chattopadhyay

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

Picture of অভীক চট্টোপাধ্যায়

অভীক চট্টোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।
Picture of অভীক চট্টোপাধ্যায়

অভীক চট্টোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস