‘কখনও কখনও তুমি স্বপ্নের ভেতর কোরিয়ান ভাষায় কথা বল। কখনও খুব মিষ্টি লাগে শুনতে। কখনও ভয় করে। মনে হয়, তোমার স্বপ্নের ভেতর আমি ঢুকতে পারছি না। সেখানে একটা বিরাট পৃথিবী আছে। সেখানে আমি পৌঁছতে পারছি না। তাই আমি তোমার ভাষাটা শিখতে চেয়েছিলাম। জানি, তুমি বিরক্ত হও। তবু, যদি ওভাবে তোমার কাছাকাছি আসা যায়।’
কোরিয়ান-কানাডিয়ান পরিচালক সিলিন সং-এর ডিরেক্টোরিয়াল ডেবিউ। অতীত, বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাতকাহন। ২০২৩-এর ছবি ‘পাস্ট লাইভস’ (Past Lives)। যা সম্পর্কের মেলোড্রামাকে যথেষ্ট তীব্রভাবে, সোচ্চারে ছোঁয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও একেবারেই না ছুঁয়ে মূলত কথাহীনতার ওপর ভিত্তি করে এগোনো এক গল্প। আর সেখানেই সিলিনের মাস্টারটাচ।

ছোট্ট করে গল্পটা হোক। কোরিয়ান দুই পরিবারের দুটি ছেলেমেয়ে না ইয়ং এবং হি সুং আর তাদের কৈশোর প্রেম, মিষ্টি এক প্লটের ভেতর বড় হতে হতে হঠাৎই ঘটে ছন্দপতন। না ইয়ং-এর পরিবার থেকে কানাডায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কেন? উত্তরে এক নারী অন্য নারীকে বলছেন অনেকটা মনোলগ ধরনের কিছু – ‘কিছু হারাতে গেলে হয়তো কিছু পাওয়াও যায়’। ঠিক তখন কোরিয়ান স্থাপত্যের অদ্ভুত সিনেমাটোগ্রাফিক মুহূর্তে মগ্ন দুই ছেলেমেয়ে। তারা জানেও না ভবিষ্যৎ।
অতঃপর ১২ বছরের ব্যবধানে সেই গল্পের মোচড়। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সূত্রে নাম পাল্টে যাওয়া নিউইয়র্ক নিবাসী চিত্রনাট্যকার-লেখক না ইয়ং ওরফে নোরাকে একদিন খুঁজে পায় সিওল ছেড়ে বেরোতে না পারা ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র হি সুং। ভার্চুয়াল যোগাযোগ, স্কাইপ ইন, রাতের ভিডিও কল – সব সেরেও কোথাও এক অবিরাম দূরত্বের ভার। দুজনেই বোঝে দুজনের কাছাকাছি চলে যাওয়ার অন্তত নিকটবর্তী কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই। আবারও বিরতি। বারো বছর। ততদিনে নোরার মার্কিন স্বামী, সুখ, সংসার, যদিও তাঁর লেখকসত্ত্বা টাল খায়নি এতটুকুও। সেই নোরাকে দেখবে বলে একেবারেই না বদলানো হি সুং-এর নিউ ইয়র্ক ট্যুর। সেভাবে স্পয়লারের জায়গা না থাকলেও, বাকিটুকু, গল্পের শেষটুকু অব্যক্ত থাকুক আলোচনায়।

স্থাপত্য একটা ছবিতে কীভাবে আসতে পারে? কীভাবে সম্পর্কের মাঝে সে নিজেই এক চরিত্র হতে পারে? কোরিয়ায় থাকাকালীন দুই কিশোর-কিশোরীর মাঝে স্থাপত্য নৈকট্য হয়ে এসেছে। তাদের খেলা, হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, নিষ্পাপ আনন্দ, বিস্ময়ের মাঝে অদ্ভুত কিছু হাই-অ্যাঙ্গেল শট – স্থাপত্য এখানে সম্পর্ককে ধরে রাখে কাছাকাছি। আর ঠিক এখানেই গল্প সম্পূর্ণ বিপরীতে ঘুরে যায় নিউ ইয়র্কের দৃশ্যে। নোরা-হি সুং-এর রিইউনিয়নে সেইসব স্কাইস্ক্র্যাপার, ব্রিজ এখানে দূরত্ব তৈরি করে। ওরা যখন কথা বলে না, যখন বলে, যখন হাঁটে, বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে দূরে, আসলে নিজেদের ভেতর – সেখানে স্থাপত্যের স্কাইলাইন, জ্যামিতি, সম্পর্কের হওয়া না হওয়া-হতে পারার ভেতর নিজেই এক স্কাইলাইন টানে। উডি অ্যালেনের ‘ম্যানহাটান’ (১৯৭৯) বা কোগোনাদার কোরীয়-মার্কিন ছবি ‘কলম্বাস’ (২০১৭)-এর কথা মনে পড়ে যায় প্রাসঙ্গিকভাবে, অন্তত ম্যানহাটানের সরাসরি একটি ট্রিবিউট চোখে পড়ে নোরা-হি সুং-এর রিইউনিয়নের দৃশ্যে। স্থাপত্য এভাবেই সংজ্ঞায়িত করে সম্পর্ককে। নোরা এবং তার মার্কিন স্বামী আর্থারের সম্পর্ক, যোগাযোগ তৈরির পেছনেও একটি বাড়ি, তার ইন্টেরিয়র, এক্সটেরিয়র। এখানে একটি দৃশ্যে তারকোভস্কির ‘মিরর’ ছবিতে ল্যান্ডস্কেপ এবং মারগারিটা তেরাকোভার বসে থাকার সেই সিগনেচার দৃশ্যের সরাসরি উপস্থাপনা। সম্পর্ক বুননে পরিচালক সিলিন এভাবেই ছুঁয়ে গেছেন কিছু অতীত মাইলস্টোনকে (Past Lives)।

সম্পর্কের বুননের দুটো দিক। আসলে দুই টাইমজোনের দুটো দিকে সম্পর্ক এগোতে পারলেও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এখনও অনেক কিছুই পারে না— ভাষাগত, বা সাংস্কৃতিক সুতো নির্মাণের সেই না-পারা বুকে হাওয়া হয়ে জমে। কাছে আসতে দেয় না। নোরা বুঝতে পারে তার ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে তার কালচারাল আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। সে হি সুং-এর কাছে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেয় যে সে মা’র সঙ্গে ছাড়া আর কারও সঙ্গে কোরিয় ভাষায় কথা বলে না। আর্থারের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্বাভাবিক ঘরোয়া কাজের মুহূর্তে নোরা বলে, ছেলেটির সঙ্গে তার সময়টুকু ভালো কাটলেও মূলগত এই কালচারাল ডিফারেন্স থেকে যাচ্ছে। ‘I feel not so Korean when I’m with him.’
আরও পড়ুন: ‘ফায়ার অফ লাভ’ – সেলুলয়েডে পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন শোনার গল্প
একদিকে নোরার কোরিয়–আমেরিকান মিশ্র সংস্কৃতি, অন্যদিকে হি সুং-এর ভেতর নিজের দেশের প্রতি অন্তরলীন এক সম্পর্কবোধ – দুই সাংস্কৃতিক, কৃষ্টিগত দূরত্বে নৈকট্যে আসতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার এখানেই কন্ট্রাস্ট। স্ত্রীকে বুকের মধ্যে রেখে স্বামী আর্থার তার ভয়ের কথা জানায়, যা দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল। ‘You dream in a language that I can’t understand. It’s like there’s this whole place inside of you where I can’t go.’ এখানেই আর্থার চরিত্রটি বড় বেশি চোখে পড়ে দুই প্রোটাগনিস্টের মূল প্লটের পাশে। অভিনেতা জন ম্যাগারোর ঈর্ষানীয় আন্ডার-অ্যাক্টিং। যোগাযোগ বা সম্পর্কস্থাপনের মুহূর্ত রচনা, স্ত্রীর প্রাক্তন বন্ধু/প্রেমিক আসবে জেনে নিরাপত্তাহীনতার মিতবাক চাদর, রেস্তোরার ভেতর তাদের নিজস্ব কথোপকথনের ভেতর অসহায় অথচ মুখে এক নিষ্পাপ হাসি রেখে দেওয়া এনিগম্যাটিক শান্ত মুহূর্ত, ছবির শেষমুহূর্তে আলো অন্ধকারের মধ্যে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর অদ্ভুত শূন্য চাহনি – সবকিছুতেই আর্থার এখানে নিজেই গল্প, সিকুয়েল।

একটা সিদ্ধান্ত, যে সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদের নয়, আলো ফেলে, বলা ভালো অন্ধকার ফেলে দুটো চরিত্রের ওপর। এবং এমন একটা সময়ে যোগাযোগ হয়, যখন একটি চরিত্র স্বীকার করে নেয় নৈকট্যের শূন্যতা। অন্যজন নির্বাক স্বাগত জানায় মাত্র; করার, বলার কিছুই থাকে না। নোরাকেই মূলত পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখেছেন সিলিন। ভার্চুয়াল আলো, তার নিজস্ব পৃথিবী, সহকর্মী, প্রেম, দাম্পত্য – চরিত্রায়নে অসম্ভব নিখুঁত অভিনেত্রী গ্রেটা লি। তুলনায় হি সুং-এর ভুমিকাভিনেতা টেও ইউ-র চরিত্রবিকাশের সুযোগ প্লটে বেশ কিছুটা কম হলেও, টেও কোথাও খামতি রাখেননি। তার নিষ্পাপ, মিতবাক প্রেমিকসত্তা, বন্ধুসত্তায় দর্শক মিল পাবেন অনেকটাই। কারণ হি সুং আসলে তারা। না-পাওয়া বোধ আসলে স্থায়ী, নোরা বরং সেই তুলনায় অনেকটা দূরে, ব্যক্তিগত লড়াইয়ে জয়ী, কিছুটা হলেও। তাই সিওলে মেট্রোর ভেতর প্রেমিক-প্রেমিকার খুনসুটি, নাইটপাবের আলো – ওয়াংকার ওয়াই-এর ছবির মতো সেই অনন্ত না-পাওয়া বোধ রিলের ব্যাটন পায় হি সুং-এর হাত ধরে। একটা স্রেফ সাধারণ ভিনদেশি ট্যুর শেষ করে তার খেদ বেড়ে যায় ইন দ্য লং রান। ট্যাক্সি আসে, সে আসছি বলে উঠে চলে যায় …
*ছবি সৌজন্য: লেখক, IMDB
অনির্বাণ ভট্টাচার্য পেশায় প্রসারভারতীর অধীনে দিল্লি দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। লিখেছেন গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ। বিশেষ আগ্রহ - চলচ্চিত্র, প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির-শিল্প এবং ক্রীড়াজগত।