Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর

Pet dogs stories
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

না, আমার সারমেয়-প্রেম সহজাত নয়। বাড়ির উল্টোদিকে রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের দেবদারু-ঘেরা বিশাল আস্তাবল, আর তিনশো মিটারের মধ্যে রেসকোর্স। জ্ঞান হওয়া ইস্তক চোখের সামনে চলতে ফিরতে দেখেছি টানা টানা চোখ আর ঠিকরে-পরা স্বাস্থ্যের অপরূপ অশ্বকুল। নারী পুরুষ নির্বিশেষে। কী তাদের রঙের বাহার! কেউ উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ, তো কেউ শ্বেতশুভ্র। কেউ তামাটে, তো কেউ হালকা বাদামি। আস্তাবল থেকে রেসকোর্সে যাতায়াতের পথে রাজসিক ভঙ্গিতে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায় তারা। সঙ্গের সহিসরা কখনও-সখনও বলে যায়, এর নাম জানো? মাইকা এমপ্রেস, কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত ঘোড়া। কিংবা, ওই দ্যাখো, ডার্বি জেতা ঘোড়া মিডনাইট কাউবয়। নিজে পিঠে বসে ওকে ট্র্যাকে নিয়ে যাচ্ছে রিচার্ড অ্যালফোর্ড। কত ভালোবাসে দেখেছ

বিকেলে ফুটবল খেলতে যাওয়ার পথে আমরা মুগ্ধ হয়ে এসব জ্ঞান আহরণ করি। কিন্তু হেস্টিংসের ওই অশ্ব-মোহিত পাড়ায় বেড়ে উঠছি বলে তখন আমাদের প্রত্যেককে নিয়মিত ঘোড়া-রোগের কড়া প্রতিষেধক দেওয়া হয়। দার্জিলিং কি গুলমার্গের পাহাড়ে না-উঠলে আমাদের অশ্ব-প্রেমের অঙ্কুরোদ্গমই হত না। হ্যাঁ, সেকালে ওই সব পাহাড়ে ছোটখাটো ঘোড়া নিয়ে টুরিস্টদের ডাকাডাকির চল ছিল। সামান্য কিছু টাকা দিলেই সেই ঘোড়ার সঙ্গে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করা যেত। একের পর এক পাহাড় তো এখন অগম্য হয়ে উঠছে। তাই ঠিক বলতে পারব না, এখনও অমন ঘোরাঘুরি সম্ভব কিনা!

পাড়ার প্রান্তে ফোর্ট উইলিয়াম। উপযুক্ত আবাসনের অভাবে সেনাবাহিনী তখনও হেস্টিংসের কিছু কিছু বাড়ি ভাড়া নিয়ে রেখেছে সামরিক অফিসারদের জন্যে। নাকের নিচে হ্যান্ডেলবার গোঁফ আর হাতে ল্যাব্রাডর-বাঁধা চেন নিয়ে তাঁরা মর্নিংওয়কে বেরোন। কিন্তু তাতে আমাদের সারমেয় প্রেম জাগরুক হয় না। কুকুর বলতে আমরা তখনও বুঝি অরণ্যদেবের ডেভিল বা যুধিষ্ঠির-সঙ্গী ধর্মরাজকে। টিনটিন তখনও বাংলা শেখেনি। স্নোয়িকে কেউ কেউ চিনত, কুট্টুসের জন্মই হয়নি তখনও। ঘন্টুদা গল্প বলেন, নরকের দ্বারে অতন্দ্র প্রহরী তেমাথা কুকুর সেরবেরাস-কে কী করে মেরেছিলেন বীর হেরাক্লিস, আমরা চোখ বড় করে শুনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পড়ি,

শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে —
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘণ্টা বাজে। 

Sheroo Lhasha Apso
শেরু এসেছিল পরিণত বয়সে

প্রতিবেশী বন্ধুদের কারও বাড়িতেই তখন, কী আশ্চর্য, কুকুর ছিল না! পাড়ায় কুকুর প্রথম ঢুকল আমাদেরই বাড়িতে, আমার বিয়ের পরপর, স্ত্রী-ধন হিসেবে। সে ত্রেতা যুগের কথা। কপিলদেবের হাতে তখনও বিশ্বকাপ ওঠেনি, দেশের কোথাও চালু হয়নি মেট্রো রেল, ইন্দিরা গান্ধী তখনও প্রধানমন্ত্রী। তখন থেকে চলছে শেরু, পোঁটলা, রাস্কি, আবলুশ…। কুকুর থেকে তারা এক একজন হয়ে উঠেছে আমাদের সুখ-দুঃখের নিবিড় সঙ্গী, পরম বন্ধু, আত্মার আত্মীয়।

 

আরও পড়ুন: দ্যুতিমান ভট্টাচার্যের কলমে: ইফ আ ডগ লাইকস ম্যান

 

শেরু এসেছিল পরিণত বয়সে। শুভার সহকর্মী যে শিক্ষিকার পরিবারের সদস্য হিসেবে বেড়ে উঠেছিল শেরু, পেশার কারণে দেশান্তরী হতে হয়েছিল তাঁদের। ছিন্নমূল হওয়ার অভিমানেই কিনা জানি না, আদরের অতিথি হয়ে আমাদের বাড়িতে এসেও স্বর্ণকেশর শোভিত সুদর্শন লাসা অ্যাপসো শেরু জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়েছিল প্রায় নির্বাক হয়ে। তখন খবরের কাগজে সাব-এডিটরি করি। শেষ রাতে বাড়ি ফিরে দেখতাম, বসার ঘরে যেখানটায় আমি বসি, ঠিক সেখানেই আসীন তিনি। আমাকে দেখেই তৎপর হয়ে আসন বদল করতেন। 

কিছুক্ষণ কোনও পাঠ্য নিয়ে সময় কাটিয়ে আমি শুতে যেতাম। শেরু তার আগেই আমার পায়ের কাছে গভীর নিদ্রামগ্ন। সময়ের নিয়মে তিনি বৃদ্ধ হলেন। তখন আমি বাড়ি ফিরলেও আমারই আসনে অবিচল তাঁর ধ্যানভঙ্গির কোনও পরিবর্তনই হত না। আমি স্পষ্ট শুনতে পেতাম বোধিদীপ্ত তাঁর অনুচ্চারিত বাণী – যাও অন্য কোথাও বোসো। ঘাঁটাবার সাহস হত না, মহাজ্ঞানী মহাতাপস শেরু যেমন চান, তেমনই করতাম। বসতাম মাটিতেই, যেখানে কিছুকাল আগেও নিদ্রা-সাধনায় মগ্ন থাকতেন শেরু নিজেই।

শেরুর নির্বাণের পর এল পোঁটলা। তুষারশুভ্র অ্যাপসো শিশু, প্রকৃতিতে ঠিক শেরুর বিপরীত। বাড়ির, শুধু বাড়ির কেন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, কাজের লোক, সকলেরই সে খুবই প্রিয়। সদাসন্দিগ্ধ মহামহিম পিসেমশাই থেকে পুরনো খবরের কাগজ-শিশি-বোতল তুলে নিয়ে যাওয়া অতি সরব ফিচেল দম্পতি, বাড়িতে যেই আসুক, আমাদের চোখ কপালে তুলে পোঁটলা সকলেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু! পোঁটলার খবর না নিয়ে কেউ ফোনও ছাড়ে না। ফলে, দিন নেই রাত নেই, বাড়ির চারটি-তলা জুড়ে অবিরাম চলে তার দুরন্ত লীলা।

ponTla Lhasa Apso
বাড়ির চারটি-তলা জুড়ে অবিরাম চলে তার দুরন্ত লীলা

এক্ষুনি ছিল কভার পয়েন্টে, পরের মুহূর্তে মিড উইকেট। রেখে আসা হল থার্ডম্যানে, কিন্তু অনেকক্ষণ বল আসছে না, তাই কাউকে কিছু না বলেই পোঁটলা চলে গেছে লং অন। তার ফলও পাওয়া গেল শিগগির। প্রিয় কাউকে আসতে দেখে এক ছুটে বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে ছোট্ট পোঁটলা অকালে মরল দুর্ঘটনায়, রাস্তায় গাড়ি-চাপা পড়ে। গোটা পাড়া শোকে নিঝুম।

কিছুদিন গেল, এল রাস্কি। আমাদের দাম্পত্যে তখনও কিছু নিভৃতি ছিল। কিন্তু মর্চে-রঙের ডাবল কোট পমেরেনিয়ান রাস্কি তার কুল-পরিচয়ের কাগজপত্র সমেত বাড়ি পৌঁছেই বুঝিয়ে দিল, আমাদের খাটে জায়গা না দিলে সে নিজে ঘুমোবে না, কাউকে ঘুমোতেও দেবে না। লেজ থেকে নাকের ডগা বড় জোর ছ-সাত ইঞ্চি, উচ্চতায় ইঞ্চি চারেক, বন্ধ দরজার ওপার থেকে তার অবিরাম ডাক। এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়! আমাদের গালে হাত।

ব্যস, খুল্ যা সিমসিম। রাস্কি প্রথমে একটু কুন্ঠার সঙ্গে জায়গা করে নিল শুভার পায়ের দিকে। কয়েকদিন পর ঘুমের মধ্যে আমার পায়ের আঙুলে ঘ্যাঁক। হয়তো আমার পা লেগেছিল রাস্কির গায়ে, হয়তো নেহাতই আতঙ্ক। শিশু-কুকুরের ব্লেডের মতো ধারালো দাঁত, আমার পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত। রাস্কিকে বিস্তর বকাবকি হল, তাতে সে শোবার জায়গা বদল করল। আর পায়ের কাছে নয়, শুভার বালিশের ওপরে, খাটের হেডবোর্ডের সঙ্গে সেঁটে নিজের জায়গা করে নিল রাস্কি, যেখানে পদাঘাত আতঙ্কে তাকে ভুগতে হবে না। 

dog-pomeranian-portrait-
বুদ্ধদেব বসু পড়ে রাস্কির জ্ঞানচক্ষু খুলে গিয়েছিল

রাস্কিকে একা বাড়িতে বন্ধ রেখে মেয়ে নিয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্যে বেরিয়েছি, ফিরে দেখি সে খুব মন দিয়ে শোবার ঘরে রাখা ‘সঙ্গ, নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ’ চর্চা করছে। সামনে-পেছনের মলাটের অংশ সমেত স্পাইনের নিচের দিকটা উধাও। শুভা বলল, সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে ছবি আঁকার সময় মিকেলেঞ্জেলোর সঙ্গে থাকত একটা পম। রাস্কিও তোমার মহৎ শিল্পের জন্যে নিজেকে তৈরি করছে। তা সত্যিই করেছিল রাস্কি। বুদ্ধদেব বসু পড়ে তার জ্ঞানচক্ষু খুলে গিয়েছিল।

শুভা মাস্টারনি বলে ছাড় পেয়েছে, অন্য সকলকেই ধমক-ধামক দিয়ে রাস্কি নিজের কাজ করিয়ে ছাড়ত। আমি বাজারের থলে হাতে নিলেই সে পথপ্রদর্শক হয়ে আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ত। গাড়ির দরজার হাতলের কাছে তুলে ধরলে, দরজা খুলতে হাতলে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করত। যতক্ষণ বাজার করতাম, রাস্কি গাড়িতে বসে মন দিয়ে ম্যানওয়াচিং করত। সত্যিকারের কুকুর না পুতুল বুঝতে না-পেরে গাড়ির বাইরে ভিড় জমে থাকত। বাজারের পর গঙ্গার ধারে চা খেতে গেলে রটউইলারকেও পাত্তা না দিয়ে রাস্কিকে তার মুখের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে দেখেছি। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা বিভ্রাটে মারা গেল রাস্কি, মাত্র এক রাতের অসুস্থতায়। লোকে কি আর এমনি এমনি কুকুর নিয়ে পিজি ছুটতে চায়!

 

আরও পড়ুন: সুপ্রিয় চৌধুরীর কলমে: না-মানুষী গোয়েন্দা গল্প

রাস্কির পর মস্তান-এ-জঙ্গ হিজ় হাইনেস স্যর আবলুশ। জাতিতে বিশুদ্ধ স্পিট্জ, চেহারাটা ছোটখাটো গোলগাল, হাবেভাবে একটু যেন ভালুকছানা। কুচকুচে কালো বড় আর ঘন লোমে ঢাকা শরীরের চার পায়ে যেন চারটে সাদা মোজা আর গলার কাছে বিমানবাহিনীর অফিসারের মত নিপুণ করে বাঁধা সাদা স্কার্ফের ভি। মুখের কাছে লোমগুলো খানিকটা ছোট, তাই স্পষ্ট দেখা যায় দুটো ঝকঝকে চোখ। প্রবল ফুর্তিবাজ, অফুরান প্রাণশক্তি আর ছোটে লাফিয়ে লাফিয়ে। আগেই বলেছি, আমরা কলকাতার শ্রেষ্ঠ অশ্বকুলের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। স্কুলের শেষ পরীক্ষার জন্যে তৈরি হতে হতে একদিন বিকেলে কন্যা প্রমা খুব চিন্তিত মুখে বলল, “আবলুশের বোধ হয় একটা পার্সোনালিটি ক্রাইসিস হচ্ছে। ঠিক করতে পারছে না, ও কুকুর না ঘোড়া!”

কুচকুচে কালো রঙ, ভারিক্কি শরীর আর পিলে-চমকানো ডাকের জন্যে আবলুশের ব্যক্তিত্বে একটা ভীতিপ্রদ ব্যাপার আগাগোড়াই ছিল। আবলুশ বড় হতে লাগল এই ব্যক্তিত্বের সুনিপুণ চর্চা করতে করতে। কিছুদিনের মধ্যেই লোককে ভয় দেখানোর ব্যাপারে আবলুশ এম ফিল করে ফেলল। কেউ দরজায় এসে ঘণ্টা বাজালেই আবলুশ একটা বক্তব্য পেশ করে। পরিবারের কেউ হলে, “এত বাইরে বাইরে ঘোরা কিসের? বাড়িতে ভাল্লাগে না বুঝি?” আর বাইরের কেউ হলে, “আবার কে এল জ্বালাতে? যত লোকের যত কাজ, সবই কি এ বাড়িতে?” লোক, সিচুয়েশন এবং আবলুশের মেজাজ অনুযায়ী তার বক্তব্য পাল্টাতেও থাকে। আমরা সেটা সহজেই বুঝে নিতে পারতাম, কিন্তু প্রমার সদ্য-যুবক বন্ধুরা সবাই পারত না। বীরত্বের কত যে স্ফূরিত গাথা আবলুশ-মোকাবিলায় ধূলিমলিন হয়েছে, এক প্রমা যদি তার হিসেব রেখে থাকে! আমাদের বেশ ভয় ছিল, বাড়িতে জামাই এলে কী হবে? সে-দিন যখন সত্যিই এল, মনে হল আবলুশ যেন নচিকেতাবাবুর পাশে বসে বিয়ের যজ্ঞ করছে। প্রমা-প্রমিত তার গা ঘেঁষে নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আবলুশের মুখে টুঁ শব্দটি নেই। জানি না প্রাক-বিবাহ পর্বে আবলুশ বশীকরণের কী কী কায়দা প্রমিত কাজে লাগিয়েছিল!

german-spitz-lee-ann-shepard
মস্তান-এ-জঙ্গ হিজ় হাইনেস স্যর আবলুশ জাতিতে বিশুদ্ধ স্পিট্জ

অপছন্দের লোক হলে দরজা খোলার আগেই আবলুশ বেশ এক প্রস্থ ঝাড়ত। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল আক্রোশে তেড়ে যেত তার দিকে। আবলুশের জন্যে আমাদের বাড়ির কাজের লোকেদের পাড়ায় বীরত্ব পুরস্কার দেওয়া হত বলেও শুনেছি। যথেষ্ট ভয় পাওয়াতে না পারলে আবলুশ চটে গিয়ে কামড়েও দিত কাউকে কাউকে। হ্যাঁ, তাতে রক্তপাতও হত! রক্তাক্তের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পকেট খালি তো হতই, দীর্ঘ অনুপস্থিতিও মেনে নিতে হত। দূরের লোকেদের কথা পরে, শুভার যমজ বোন রাজলক্ষীও রেহাই পায়নি সে আক্রমণ থেকে। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড রাজ-শুভাকে গুলিয়ে ফেললেও, খুব ছোটবেলায় দু-একবার ছাড়া আবলুশের সে ভুল তেমন হয়নি। কিন্তু দুটো মানুষের ভিস্যুয়াল আইডেন্টিটি হুবহু এক, ভোকাল আইডেন্টিটিতেও তফাত নেই, কিন্তু গায়ের গন্ধ সম্পূর্ণ আলাদা, কোনও স্বাভিমানী সারমেয়র পক্ষে এটা সব সময় মেনে নেওয়া সম্ভব?

যদিও আবলুশের বিশেষ পছন্দ ছিল ভারী সিলিন্ডার দু’হাতে ঘাড়ের ওপর আঁকড়ে ধরে থাকা গ্যাসওয়ালা। গ্যাস পাওয়ার জন্যে ‘আবলুশ বাঁধা আছে’ বলে টিভি-তে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাই যা বাকি রেখেছি আমরা। তবে এসবের একটা ভাল দিকও ছিল। সকাল থেকে কাগজওয়ালা, দুধওয়ালা, সাফাইওয়ালা, কেবলওয়ালা, ধোপা, বাড়ির নানা কাজের লোক ও অন্যান্যদের বাজানো দরজার ঘণ্টার সঙ্গে আবলুশের হুঙ্কারের সিম্ফনিতে কাকলিত হতে হতে আমরা দরজা বন্ধ করাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। একটা উইকেট গেট বসানো হয়েছিল এমনভাবে যাতে আবলুশ বেরিয়ে যেতে না-পারে, আবার বাড়ির ভেতরে যাদের ঢোকার কথা, তারা নিজেরাই গেট খুলে ভেতরে চলে আসতে পারে। তাতে লাভ হয়েছিল দুটো। এক, আবলুশের ডাকেই আমরা বুঝতে পারতাম কোনও অপিরিচিত লোক দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর দুই, চোর-ছ্যাঁচোড় তো দূরের কথা, মশা-মাছিও সে গেট পেরিয়ে ঢুকতে ভয় পেত।  

সেই আবলুশ ১৪ বছরে পা দিয়ে নিতান্তই বুড়ো হয়ে গেল। শান্তিনিকেতনে গিয়েও আবলুশ আর তখন সারাদিন বাগানে ঘুরে বেড়ায় না। বাড়ির সামনের গোল বারান্দাই তখন তার প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। তখনও রাত্তিরে শোবার ঘরে ঢোকে আমার সঙ্গে, বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার পর। কিন্তু পায়ের জোর কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে খাটে উঠে শুভার পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমনো। তাকে তুলে নেওয়াতেও তার আপত্তি, কারণ তাতে রাতে নিজের ইচ্ছে এবং প্রয়োজনমতো প্রাকৃতিক কাজকর্মের স্বাধীনতা থাকে না। খাট থেকে নামার সময় ঠিক যেখানে আমার পা-পড়ার কথা, সেই জায়গাটাই পছন্দ হল আবলুশের রাতে ঘুমোনোর জন্যে। আলো না-জ্বালিয়ে আর খাট থেকে নামার উপায় নেই, মৃদুস্বরে ফুরফুরে নাক ডাকে তখন আবলুশের।

 

আরও পড়ুন: হিন্দোল ভট্টাচার্যের কলমে: লালু ভুলুর কিসসা

 

শেষ বসন্তের এক দুপুরে অফিসে ভাইয়ের স্ত্রীর ফোন, খুব কাঁদছে আবলুশ। তোমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় তালা, বাইরে থেকে বুঝতেও পারছি না কী হয়েছে, শুধু শুনতে পাচ্ছি তার আর্তনাদ। কর্তা-গিন্নি দু’জনেই ছুটলাম কাজ ফেলে। দেখলাম, পেছনের পায়ে আর একটুও জোর পাচ্ছে না সে, দাঁড়াতেই পারছে না সোজা হয়ে। ফোর্ট উইলিয়ামের পাশেই থাকি বলে সেখানকার পশু হাসপাতালে আবলুশের চিকিৎসার দুর্লভ ব্যবস্থা হল আমার ছোট ভাইয়ের যোগাযোগের সূত্রে। সেনাবাহিনীর পোষ্যদের জন্যে ছোট্ট, পরিছন্ন, ছায়া-সুনিবিড় অতি-আধুনিক পশু হাসপাতাল। দেখলাম ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল তো বটেই, এমনকি কাঠবিড়ালিরও চিকিৎসা হচ্ছে সেখানে। সেবাকর্মী থেকে ডাক্তার, সকলেই দায়িত্ববান, অতি যত্নশীল। টানা এক সপ্তাহ কোনওরকম খরচ ছাড়াই সেখানে আবলুশের চিকিৎসা চলল। দু’বেলা স্যালাইন, সঙ্গে নানা ওষুধ। 

স্কুল, পরীক্ষার খাতা, প্রশ্নপত্র তৈরি, সিলেবাস কমিটির মিটিং, জাপানি বোষ্টুমীদের সংকীর্তন, সব ভুলে শুভা আবলুশের সঙ্গে লেগে রইল একটানা। সুস্থ হয়ে চার পায়ে দাঁড়াল আবার আবলুশ, কিন্তু খুব বেশি দিনের জন্যে নয়। নতুন বর্ষার এক মায়াময় ভোরে শুভার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজল আবলুশ। আমরা তাকে রেখে এলাম শান্তিনিকেতনে ফলবতী আম্রপল্লীর ছায়ায়। পাশের ফুলবনে এখনও নিত্য ফোটে হলুদ জবা, ছাতারকুলের নিত্য সভা আজও বসে সেই প্রাঙ্গনে।

 

*ছবি সৌজন্য: fineartamerica, Shutterstock, Pinterest

Author Dhurbajyoti Nandi

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

2 Responses

  1. আপনার লেখা পড়ে কান্না-হাসির দোলায় মন ভুললো ! বাড়ে বারে আমার পুত্র চেন্জিরা, যার নাম চেন্জি রায় তার কথা মনে পড়ছিল! তার সঙ্গে শেরুর খুব মিল! বড় ভালো লাগলো এই রোদন ভরা বসন্তের গল্প!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস