আমরা সকলে বর্তমানে যে যার জীবনে ব্যস্ততার চরম সীমায় রয়েছি। অন্য কারও জন্য তো দূর, কখনও কখনও আমরা নিজেদের জন্যও সময় ব্যয় করতে পারি না। এভাবে প্রতিদিনের ব্যস্ততা জীবনকে ঘিরে থাকলে মানুষের জীবন প্রাণহীন হয়ে উঠতে বাধ্য। আর একটি নিরস জীবনে গতিময়তা থাকলেও প্রাণ থাকে না সবসময়। সেই প্রাণহীনতায়, রোজকার ইঁদুর-দৌড়ে মানুষ নিজেকে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে ফেলে। তাই মাঝেমাঝে এই চূড়ান্ত ব্যস্ততা থেকে বিরতি নিয়ে প্রয়োজন নিজেকে সময় দেওয়া এবং বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলের সঙ্গে হৈ হৈ করে কিছুটা সময় কাটানো। এতে আমাদের মন যেমন একঘেয়েমির হাত থেকে রক্ষা পায়, তেমনি জীবনে স্বাভাবিক সামাজিক বন্ধন বজায় থাকে।
জীবনের ব্যস্ততা থেকে প্রাণের নির্যাস খুঁজে নেওয়ার সবথেকে উপযোগী উপায় হল পিকনিক (Picnic) বা চড়ুইভাতিতে যাওয়া। সাধারণভাবে দেখতে গেলে বনভোজনের অর্থ, বনে গিয়ে ভোজন। আগেকার দিনে দৈনন্দিনতা থেকে একদিন ছুটি নিয়ে বনে গিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে আনন্দ করে রান্না করে খাওয়ার নামই ছিল বনভোজন। বর্তমানে বনভোজনের রীতি খানিক পাল্টালেও তার নাম, চরিত্র ও তাৎপর্য একেবারেই বদলায়নি। কিন্তু একদিনের জন্য পাওয়া এই অবসরে মনের অবসাদ দূর করা সম্ভব নয়। সেই কারণে সকলে মিলে চেনা প্রকৃ্তির বাইরে কোথাও গিয়ে আনন্দের নির্যাস খুঁজে নিলেও তা ব্যস্ত জীবনের চিরাচরিত একঘেয়েমি কাটানোর জন্য সমানভাবে উপযোগী নাও হতে পারে। আর তাই মনের অবসাদ দূর করতে বারে বারে মানুষ আশ্রয় খুঁজেছে সুর, তাল, ছন্দের কাছে।

দীর্ঘকাল ধরে পিকনিক (Picnic) বা বনভোজনের পার্টিতে উৎকৃষ্ট সংগীতের চাহিদা উপলব্ধি করেছেন আমোদপ্রিয় মানুষেরা। মনকে ফুরফুরে রাখতে বিভিন্ন ধরনের খেলার সরঞ্জামের পাশাপাশি গানবাজনার চল ছিল বরাবরই। চল্লিশ থেকে আশি’র দশক পর্যন্ত গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল বিনোদনের মূল সাধন। প্রতিটি পিকনিক বা বনভোজনের আসর মাতিয়ে রাখত রেকর্ডের অনন্য সম্ভার। উদাহরণস্বরূপ, কিছু উল্লেখযোগ্য রেকর্ডের কথা এখানে বলা বাঞ্ছনীয়।
ছোটদের পিকনিককে ঘিরে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যে মাইক্রোগ্রুভ লং-প্লে রেকর্ডটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল, সেটি ‘দ্য পিকনিক পার্টি’। এতে যন্ত্রসংগীতের বিভিন্ন প্যাটার্ন পরিচালিত হয় ‘দ্য পাম কোর্ট থিয়েটার অর্কেস্ট্রা’র দক্ষ কন্ডাক্টরের হাতে। রেকর্ডটিতে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন অর্কেস্ট্রাল পিস্, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘দ্য গ্রাসহপার্স ডান্স’ (১৯০৫), ‘টু লিটল সসেজেস্’ (১৯০৭), ‘ইন দ্য শ্যাডোস’ (১৯১০), ‘হুইসিল ফর মি’ (১৯১২), ‘ফিডলস্টিক্স র্যাগ’ (১৯১২), ‘ডাউন ইন জানজিবার’ (১৯১৭), ‘ইন অ পারশিয়ান মার্কেট’ (১৯২০), ‘দেয়ার্স অ রিং অ্যারাউন্ড দ্য মুন’ (১৯৩১) ইত্যাদি। এই ডিস্কটির সঙ্গে আরেকটি ৭-ইঞ্চি ভিনাইলকে আপন করে নেয় তামাম দুনিয়ার খুদে মানুষ, পিকনিক পার্টিতে বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া এই রেকর্ডের মূল দুটি গান ছিল ‘হাস্ লিটিল বেবি’ ও ‘রক–অ-বাই বেবি’। ‘মিস্টার পিকউইক’ নামের এই ভিনাইল ছোটদের মনে সুগভীর ছাপ রেখে গিয়েছে।

অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারিণী ডেনিস ব্রায়ার পরিবেশন করেছিলেন ‘গোয়িং অন অ পিকনিক’ সংগীতালেখ্যটি যার দুটি ভাগ ছিল যথাক্রমে ‘দ্য ব্রেকডাউন সং’ ও ‘দ্য পিকনিক সং’। এই চমকপ্রদ অ্যালবামের কন্ডাকটর ছিলেন প্রখ্যাত রেডিও জকি ব্যারি গ্রে, যিনি বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নিজের কেরিয়ার শুরু করেন। এই ৪৫-স্পিড মাইক্রোগ্রুভ (7 EG 8417) ‘টুইজল’ সিরিজের অন্তর্গত, যাতে গল্প ও গানের অনুপম সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ সাহিত্যিক ও সুরের কাণ্ডারী রবারতা লেহ্।
কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি পরিচালিত স্ট্যানলি টারেনটাইন-এর মনোমুগ্ধকর স্যাক্সোফোন বাদনের ডিস্ক রেকর্ড একসময় ইউরোপ ও আমেরিকায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এই অনন্যসাধারণ ইপি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করে বিভিন্ন চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানে। ‘অলওয়েজ সামথিং দেয়ার’ অ্যালবামটি ভারতবর্ষে মুক্তি পেয়েছিল এরিয়োলা লেবেলে ১৯৭০-এর এপ্রিল মাসে। মূল গানটি বব লিডো পরিবেশিত ‘দ্য পিকনিক সং’ (১৯৫০) হতে অনুপ্রাণিত। এতে অপূর্ব কাজের নিদর্শন রেখেছিলেন কারমেন ক্যাভালারো ও তার অর্কেস্ট্রা। গীতিকার ও সুরকার ছিলেন যথাক্রমে থেরেসা ডেলো ও কারমেন ডেলো।
‘ডেকা’ লেবেলের শেল্যাক (Decca 27060) পপুলারিটি চার্টের শীর্ষস্থান অধিকার করে। ‘দ্য টেডি বিয়ার্স পিকনিক’ বিশ্বসংগীতের দরবারে এক বিস্ময়কর সংযোজন। ভোকাল কোরাসের সাহায্যে গুণী কম্পোজার হেনরি হল ও তাঁর অর্কেস্ট্রা তিরিশ দশকের গোড়ায় সকল সংগীতপ্রেমী মানুষকে চমকে দিয়েছিলেন। কলম্বিয়া রেকর্ডস থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ৭৮ আর পি এম-এর কাপলিং FB.2816। ১৯০৭-এ কম্পোজার জন ওয়াল্টার ব্র্যাটন প্রথমবার এটিকে শিট মিউজিক ফর্মে পরিবেশন করেন। মূল্যবান নোটেশনগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন জিমি কেনেডি। এছাড়া, ১৯৫৪ সালে ‘দ্য টেডি বিয়ার্স পিকনিক’ গানটি এক নতুন মোড়কে পরিবেশন করেন টনি মটোয়া ও তাঁর অর্কেস্ট্রা। ফিলিপ্স লেবেলে (J.B.100) মুক্তি পাওয়া এই ডিস্ক আজও সংগ্রাহকদের বিশেষ পছন্দের।
ছোটদের খুবই প্রিয় আইটেম– ‘দ্য অরেঞ্জ বার্ড’ রেকর্ডটি (STER-3991) নির্মাণ করেছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও। ‘দ্য পারফেক্ট পিকনিক’, এই অ্যালবামের এক অনবদ্য সংযোজন, যা আপামর মানুষকে খুশির সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অনিতা ব্রায়ান্ট-এর সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলা ও শব্দচয়ন ন্যারেটিভটিকে পৌঁছে দেয় এক অনন্য উচ্চতায়। ‘উইনি দ্য পুহ্ অ্যান্ড টেডি বিয়ার্স পিকনিক’ (১৯৬৬), ৭-ইঞ্চি ভিনাইল সিঙ্গল ডিস্ক হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল সমগ্র বিশ্বে। কেনেথ কোনোর, চেইরিল কেনেডি ও ওয়ান্ডারল্যান্ড সিঙ্গারস্ গ্রুপ নিপুণভাবে সৃষ্টি করেছিলেন আদর্শ পিকনিকের পরিবেশ যা কচিকাঁচাদের মাতোয়ারা করে। ইংল্যান্ডের বিস্ময় ভোকালিস্ট জিম ডেল-এর সুরেলা কণ্ঠের অনুরণনে আনন্দধারা বয়ে চলার নজির আজও বিরল।
‘পিকনিক অ্যাট হ্যাঙ্গিং রক’ লং-প্লে, (PB 6038) আর সি এ ভিক্টর কোম্পানির এক অসামান্য সংযোজন হিসেবে খ্যাত সারা বিশ্বে। রেকর্ডটি প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সাত বছর পর এটির দ্বিতীয় ভার্সন রিলিজ করেছিল ইউরোডিস্ক লেবেলে। স্পেশাল পারপাস সিরিজের অন্তর্গত আর সি এ ভিক্টর প্রকাশ করে ‘দ্য পিকনিক সং’ (20-3808-A)-এর এস পি ডিস্ক, ব্র্যাডফোর্ড ও রোমানো’র সুরেলা কণ্ঠে। জনি ডেসমন্ড পরিবেশিত ‘দ্য পিকনিক সং’ গানটিতে একটি অতিরিক্ত অন্তরা শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন রে চার্লস সিঙ্গার্স গ্রুপ, যারা মূলত ভোকাল হারমোনির ওপর জোর দেন। অর্কেস্ট্রা পরিচালনায় নিজের জাত চিনিয়েছিলেন কিংবদন্তি টনি মটোলা। ‘পিকনিক—আ ব্রেথ অফ ফ্রেশ এয়ার’ (১৯৭০) বহুদেশে সমাদৃত এক অনন্য অ্যালবাম। এর অসাধারণ ট্র্যাকগুলি বহু উৎকৃষ্ট বনভোজনের সম্পদ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। হারভেস্ট লেবেলে মুক্তিপ্রাপ্ত এই মাইক্রোগ্রুভ রেকর্ড (SHSS ½) ফোক রক, হার্ড রক ও সিম্ফনিক রক মিউজিকের মেলবন্ধন।
হিন্দি ফিল্মি সংগীতে পিকনিক বা চড়ুইভাতিকে বিষয় করে প্রথম জনপ্রিয় গানটি ১৯৫১ সালে মুক্তি পাওয়া দেবানন্দ, মধুবালা অভিনীত ‘নাদান’ ছবির— ‘দিলোঁ কে মেলোঁ কা নাম পিকনিক, নজর কে খেলোঁ কা নাম পিকনিক’… পরিবেশন করেছিলেন গীতা রায়, চিতলকর (সংগীত পরিচালক সি রামচন্দ্র) ও কোরাস। ছবিটি আগে মুক্তি পেলেও, ফিল্মের গ্রামোফোন রেকর্ড রিলিজ করে ১৯৫২ সালে। এ এক বিরল ঘটনা। এই ফিচারে সুরারোপ করেছিলেন সি রামচন্দ্র ও চিক চকোলেট (অ্যান্টনিয় জেভিয়ার ভাজ)। বিজয় ফিল্মস প্রযোজিত ছায়াছবি ‘পিয়া মিলন কি আস’ (১৯৬১) তৎকালীন সময়ের এক মনোরঞ্জক সামাজিক ছবি। মনোজ কুমার ও অমিতা অভিনীত এই ফিল্মে মান্না দে, গীতা দত্ত ও কোরাস-এর কণ্ঠমাধুর্যে পরিবেশিত হয়েছিল ‘পিকনিক মে টিক টিক করতি’ গানটি। সুরকার ও গীতিকার যথাক্রমে ছিলেন এস এন ত্রিপাঠী ও ভরত ব্যাস। এছাড়া, বেশ কিছু হিন্দি বেসিক গানে পিকনিকের নানা আনন্দঘন মুহূর্তের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
রমাপদ চৌধুরীর কাহিনি অবলম্বনে ইন্দর সেনের ফিল্ম ‘পিকনিক’ মুক্তি পেয়েছিল সত্তর দশকের প্রথম ভাগে। এক চড়ুইভাতিকে বিষয় করে তোলা এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির নাম দীপক, অতীশ, সোমনাথ, রাখী, নন্দিতা ও ইতু। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পিকনিকের জায়গাটি দেখে সকলেই উল্লসিত হয়। তারপর বিস্তর টানাপোড়েনের শেষে ছায়াছবিটি পৌঁছয় তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। এই ফিচারের সংগীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্ত এক নির্ভেজাল চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানকে মাথায় রেখে গড়ে তুলেছিলেন চমকপ্রদ সাঙ্গীতিক আবহ। ছবির চারটি গানই প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কণ্ঠ প্রদান করেছিলেন মান্না দে ও আশা ভোঁসলে। গানগুলি— ‘কাশ্মীরেও নয় শিলংএও নয়’, ‘কেন সর্বনাশের নেশা’, ‘মন মেতেছে মনময়ূরীর কী খেলা’, এবং ‘একদিন দল বেঁধে’…
পিকনিক একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা যা আমাদের শহুরে জীবনের বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচতে এবং প্রকৃ্তির প্রশান্তিকে আলিঙ্গন করতে সাহায্য করে। আসুন আমরা চড়ুইভাতির আনন্দ উপভোগ করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই সুযোগ তৈরি করে দিই।
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।