অধিবাস্তব কবিতা: Surrealism-এর বাংলা। পরাবাস্তব নামেও অভিহিত। বিদেশি কাব্য–আন্দোলনগুলির মধ্যে এত ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অন্য আর কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এ–তত্ত্বের প্রভাব পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার কাব্যে দেখা গেছে।
ফ্রান্সে এই ধারণার উদ্ভব। রাঁবো (Jean Arthur Rimbaud : ১৮৫৪–৯১), লোত্রেয়ামঁ (Comte de Lautre’amont: ১৮৪৬–৭০) প্রমুখ কবিরাই এই দর্শনটির পূর্বসূরি। তবে ‘সাররিয়ালিজ়ম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন আপোলিনের (Guillume Apollinaire : ১৮৮০–১৯১৮)। তবে ফরাসি কবি ও নাট্যকার আঁদ্রে ব্রেতঁকেই (Andre Breton ১৮৯৬–১৯৬৬)-কেই তত্ত্বটির প্রধান প্রবক্তা বলা হয়। ১৯২৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘মানিফেস্ত দু স্যুররেয়ালিজ্ম’(Manifest du Surrialisme) অর্থাৎ পরাবাস্তবতার ইস্তাহার।
[the_ad id=”266918″]
এ তত্ত্বের মূল কথা হল, বাস্তবের ঘটনার অভিঘাতে ব্যক্তিমানুষের মানসিকতায় একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ঘটে, সেই প্রতিক্রিয়া থেকে যে উচ্চারণ ও রূপকলা তৈরি হয়, সেটা উচ্চতর বাস্তব। উচ্চতর এ–কারণে যে, বস্তুজগতের ঘটনা নিরপেক্ষ, কিন্তু তার অভিঘাতে তৈরি প্রতিক্রিয়াটি মানবিক। অধিবাস্তববাদীদের উদ্দেশ্য ছিল– বস্তুজগতের বাস্তবতাকে ভেঙে ফেলে অন্য এক সমান্তরাল বাস্তবতা সৃষ্টি করা। ফ্রয়েডিয় তত্ত্বের ভিত্তিতে অধিবাস্তববাদীরা তাঁদের ধারণা ব্যাখ্যা করলেন। লুই আরাগঁ (Louis Aragon: ১৮৯৭–১৯৮২), পল এলুয়ার (Paul Eluard: ১৮৯৫–১৯৫২), জাঁ ককতো (Jean Coctean: ১৮৮৯–১৯৬৩) এরকম সব কবিরাও এ–তত্ত্বের সঙ্গে সহমত হন।
ক্রমশ সাহিত্য থেকে চিত্রকলায় এ–আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই ক্ষেত্রে এটি আরও আলোড়ন সৃষ্টি করে। থিয়েটার, সিনেমাতেও পরাবাস্তব–শৈলী গৃহীত হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই আন্দোলন লাতিন আমেরিকা, স্পেন, পশ্চিম এশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও হইচই ফেলে দেয়। যুক্তি ও যুক্তিহীনতা, চেতন ও অবচেতনের মধ্যে সীমারেখা মুছে ফেলাটাই এ–আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল।
[the_ad id=”270086″]
পৃথিবীর সব ভাষার মতোই বাঙালি–কবিরাও প্রভাবিত হয়েছেন এই ধারণায়। ১৯৫০-এর দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখ, পরবর্তীকালে তুষার চৌধুরী, অনন্য রায় তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
অধীরা: অলংকার শাস্ত্রের নায়িকাবিশেষ। অধীরা নায়িকা দু’রকম। (১) মধ্যা অধীরা; (২) প্রগল্ভা বা প্রৌঢ়া অধীরা। মধ্যা অধীরা আবার দু’রকম: জ্যেষ্ঠা এবং কনিষ্ঠা। প্রগল্ভা অধীরাও দুই প্রকারের।
অনন্বয়: একটি অর্থালংকার। এই অলংকারে উপমেয় এবং উপমান একই বস্তু। অর্থাত কোনও উপমানের সঙ্গে যখন উপমেয়ের সাদৃশ্য় সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হয় না, সেটিই অনন্বয়।
অন্বয়: কাব্যে অন্বয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্বয় মানে, চরণে, কবিতার পঙ্ক্তিতে পদের সঠিক অবস্থান। অন্বয়ে যথার্থ জ্ঞান থাকলে তবেই পরিকল্পনামাফিক বা উদ্দেশ্য়প্রণোদিতভাবে অন্বয়–বিপর্যয় বা অন্বয়বিচ্যুতি ঘটানো সম্ভব। তাতে কবিতার রসের হানি ঘটার বদলে তা ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।
[the_ad id=”270085″]
অনুকরণ: কবিতা লেখার একেবারেই শুরুতেই সাধারণত একজন কবি তাঁর প্রিয় কোনও কবিকে অনুকরণ করতে চান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘বিহারীবাবুর মতো কাব্য লিখিব।’ জীবনানন্দের কাব্যে প্রথমদিকে ছিল নজরুলের অনুকরণ। শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনুকরণ করেছেন জীবনানন্দকে। কাব্যতত্ত্বে এটাই অনুকৃতিবাদ। অনুকরণ থেকেই একজন প্রকৃত কবি পরবর্তীকালে খুঁজে পান নিজের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। তাই, অনুকরণ কখনওই নিন্দনীয় নয়। অনুকরণের ভেতর দিয়েই মৌলিকত্ত্ব তৈরি হয়।
প্লেটোর মতে, কলার সৃষ্টিই হচ্ছে অনুকরণ, ইংরেজিতে ইমিটেশন (imitation) বা মাইমেসিস (mimesis)। তিনি বলেছেন, অনুকৃত কলা মূল থেকে কিছুটা পৃথক হয়ে ওঠে, যেটা হল আদতে সত্যের বিকৃতি। মূল থেকে অনুকৃত কলার সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার মধ্যে এরকম বিকৃতি তিনবার ঘটে। যেমন: একটি আদর্শ কাব্য, কবি তার অনুকরণ করে শব্দ, পঙ্ক্তি, ভাব আত্মস্থ করেন, তারপর তা লিপিবদ্ধ করেন, তারপর পাঠকের হৃদয়ে তার একটা প্রভাব তৈরি হয়। অর্থাৎ কাব্যের সত্য বাস্তব সত্য থেকে পৃথক। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে ব্যাপারটি বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, কলার সাধারণ ধর্মই হচ্ছে অনুকরণ; বিশেষের মধ্যে যে সামান্যের (সাধারণ–অর্থে) সম্ভবনা, তাকে ফুটিয়ে তোলাই হল অনুকরণ। কবি জন ড্রাইডেন (১৬৩১–১৭০০) অনুকরণের তিনটি স্তরের উল্লেখ করেছেন। উদ্ভাবন (invention), পরিবৃত্তি (variation, moulding ect), যথার্থ শব্দসংস্থান। উদ্ভাবনায় প্রকাশ পায় কল্পনার গতিবেগ, পরিবৃত্তিতে (বা বলা যেতে পারে পরিশিল্পনা) প্রকাশ পায় সমৃদ্ধি, সৌষ্ঠব প্রকাশ পায় ঠিকঠাক শব্দ সংযোজনায়।
বিশেষ কালের অভিজ্ঞতা কলায় মূল্যবান মর্যাদায় ভূষিত হয়, এই সত্যটুকু আর একটি সাধারণ সত্যকে ইঙ্গিত করে— ‘কাব্য জীবনের অনুকরণ’, এই সত্য। বাস্তবে যেমন, কাব্যেও তেমন, সেটা নকল, অনুকরণ নয়। রোম্যান্টিক কবিরা অনুকৃতিবাদকে আক্রমন করে আবেগের স্বতঃস্ফুর্ততাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ‘নব্য সমালোচনা’পন্থীরা অবশ্য অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুকরণের ব্যাখ্যা করেছেন।
একটি কথা এখানে অবশ্য স্বীকার্য, কাব্যের অনুকরণ প্রক্রিয়া ঠিক নিয়ম মেনে চলে না। ভাব–আবেগ দিয়ে পরিণত হয়।
অনুকূল: একটি অপ্রধান অর্থালংকার। উপমানের অনুকূলে উপমেয় যখন স্থিত হয়, তখন এই অলংকার হয়। ‘গীতগোবিন্দ’ থেকে উদাহরণ (১০/৩)।
“ঘটয় ভুজবন্ধনং জনয় রদখণ্ডনং
যেন বা ভবতি সুখজাতম্ (প্রিয়ে)”।।
[প্রিয়ে, আমাকে বাহুপাশে বেঁধে দাঁত দিয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত কর, কিংবা, যাতে আনন্দ পাও, তাই কর] এই একই ভাব রয়েছে বিদ্যাপতির পদাবলিতেও।
“ভুজপাশে বান্ধি জঘন পর তাড়ি।
পয়োধর পাথর হিয়ে দেহ ভারি।।
জন্ম গড়শিমুলা গ্রামে (অধুনা জামতাড়া জেলা)। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ২০০১ সাল থেকে লেখালেখির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ২০০৯ সালে অনুবাদের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার। এ ছাড়াও পেয়েছেন অন্যান্য সম্মান ও পুরষ্কার। রয়েছে বারোটির বেশি প্রকাশিত গ্রন্থ।