Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

লোকসাহিত্যের ‘প্রাগ’ দর্শন: শেষ পর্ব

ড. রূপক বর্ধন রায়

মার্চ ১০, ২০২১

Kaleici the historical city
illustration for fortnightly travel column by Rupak bardhan Roy
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

১৩৪২ সালে প্রাগ শহর এক ভয়াবহ বন্যায় বিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৩৫৭ সালে রাজা চার্লস নতুন সেতুটির আনুষ্ঠানিক গোড়াপত্তন করেন এবং নাম দেন, “প্রাগ ব্রিজ” বা “স্টোন ব্রিজ”। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রাগের সাধারণ মানুষ “চার্লস ব্রিজ” নামটা ব্যবহার করা শুরু করেন। এই বিশ্ববিখ্যাত সেতুর প্রধান স্থপতি প্রতিভাবান বাস্তুকার পিটার পারলের। তার সঙ্গে অবশ্য প্রাগ কাসলে অবস্থিত “সেইন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রাল”এর দু’জন ইঞ্জিনিয়ারও ছিলেন। এই সেতু নিয়ে চার্লস এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে তা নিয়ে নানা গল্পের প্রচলন রয়েছে। 

এক মিস্ত্রি নাকি রাজাকে এসে জানান, যে ঢালাইয়ের কাজে চুনাপাথর আর কাঁচা ডিম ব্যবহার করলে ঢালাই বেশি পোক্ত হবে। রাজা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করলেন না। তৎক্ষণাৎ হুকুম জারি হল, বোহেমিয়া-রাজত্বে যে প্রজারই অন্তত একটি মুরগি রয়েছে, তারা যেন সমস্ত ডিম দেরি না-করে সেতুর কাজের জন্য দিয়ে দেন। যেমন কথা তেমন কাজ। রাজ্যের সমস্ত প্রান্ত থেকে বাক্স প্যাঁটরা বোঝাই করে ডিম এসে পৌছতে শুরু করলো প্রাগ সেতুর কাজে।

Velvary city Prague
উত্তর প্রাগের ভেলভারি শহর, আজকের দিনে

উত্তর প্রাগের কাছাকাছি একটা ছোটো শহর, নাম ভেলভারি। এই ভেলভারি সিটি কাউন্সিল, তাদের ডিম যাতে অটুট অবস্থায় প্রাগ শহরে পৌঁছয় তা নিয়ে এতই দুশ্চিন্তায় ছিল, যে তারা ঠিক করে সমস্ত ডিম সেদ্ধ করে পাঠাবে। বুঝুন কাণ্ড! এর পর থেকে নাকি যারাই ভেলভারি থেকে প্রাগে আসতেন তাদের নাম দেওয়া হত “আ বিট হার্ড বয়েলড”!

এ ছাড়াও চার্লস সেতু এতই গুরুত্বপূর্ণ, যে বোহেমিয়ার ইতিহাসে খ্রিস্টধর্মের কাহিনিতেও তাকে নিয়ে নানা কিংবদন্তির প্রচলন রয়েছে। জন অফ নেপোমুখের উপাখ্যান তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। গল্পটা এইরকম:

বোহেমিয়ার স্বর্ণযুগে প্রাগ শহরে “জন অফ নেপোমুক” নামের এক বিখ্যাত কনফেসার (যে পুরোহিত স্বীকারোক্তি শোনেন) বসবাস করতেন। বোহেমিয়ার বহু প্রখ্যাত, শক্তিশালী মানুষ ওঁর কাছে নিজের পাপস্খালনের জন্য আসতেন। সমস্যা হল, কখনওই কোনও দম্পতি একই কনফেসারের কাছে যেতেন না। বোহেমিয়ায় স্ক্যান্ডালের ভয় বোধহয় চিরাচরিত! তৎকালীন রাজা চতুর্থ ওয়েন্সেসলাস এবং রানি সোফিয়াও এ-নিয়মের ব্যতিক্রম নন।

রানির কনফেসার ছিলেন নেপোমুক। রানির সঙ্গে তাঁর এতই সখ্য হল যে কনফেসার নিজের কাজের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বন্ধুত্ব এই দুইই বাঁচিয়ে রাখতে, রাজার হাজার আরজি ও অকথ্য অত্যাচার সত্বেও রানির একটি কথাও তাঁর কর্ণগোচর করেননি। হিতে বিপরীত হওয়ারই ছিল। এক সন্ধ্যায় রাজার সামন্তদল নেপোমুককে প্রাগ সেতু (তখনও চার্লস ব্রিজ নামকরণ হয়নি) থেকে ভ্লাটভা্র জলে ফেলে হত্যা করে।

John of Nepomuk
জন অফ নেপোমুক

ভবিষ্যতে (১৭২৯) অবশ্য রোমান ক্যাথলিক চার্চ নেপোমুককে মরণোত্তর সেন্টহুড দেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, পুরনো প্রাগের দিক থেকে সেতুতে উঠলে দু’পাশে সারি দেওয়া নানা মূর্তি রয়েছে। যদি প্রথম থেকে গুণতি শুরু করেন তবে সামনে আপনার ডানপাশে যে আট নম্বর মূর্তিটা পড়বে, সেটা “জন অফ নেপোমুক”-এর।

চার্লস ব্রিজের গল্প যখন বলছিই তখন ব্রুঞ্চভিকের (Bruncvik) কথা না বললে অন্যায় হবে। 

ব্রুঞ্চভিক ছিলেন গ্রিক গ্ল্যাডিয়েটরদের উত্তরসুরি। হেন কোনও ডুয়েল অথবা টুর্নামেন্ট নেই উনি জেতেননি। কিন্তু ব্যাপার হল, ব্রুঞ্চভিকের এই যে বীরত্ব, তার পিছনে তাঁর নিজের কেরামতি বিশেষ ছিল না বললেই চলে। তাঁর কম বয়সে এক তপস্বী তাঁকে একটি তরবারী দেন। সেই তরোয়াল নাকি যে কোনও লড়াইতে নিজের খেয়ালেই শত্রু নিধন করত। কাজেই ব্রুঞ্চভিকের বিশেষ কৃতিত্ব থাকত না।  

bruncvik
চার্লস সেতুতে ব্রুঞ্চভিকের মূর্তি। হাতে তরবারি

ব্রুঞ্চভিক কিংবদন্তির শুরু অবশ্য অন্য একটা গল্প থেকে। এটা এমন একটা সময় যখন যুবক ব্রুঞ্চভিক নিজের ভাগ্যান্বেষণে ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছেন। এমনই একদিন এক জঙ্গলে ঝোপের আড়াল থেকে দেখতে পেলেন দারুণ লড়াই জমেছে এক বাঘ আর সিংহের মধ্যে। লড়াই চলল সারাদিন। সন্ধ্যে হওয়ার আগে-আগে বিরক্ত হয়ে বাঘ হঠাৎই লড়াই ছেড়ে পালিয়ে গেল জঙ্গলে। সিংহ আহত অবস্থায় পড়ে রইল একই জায়গায়।

রক্তস্নাত সিংহকে দেখে ব্রুঞ্চভিকের করুণা হল। নিজের চেষ্টায় সুস্থ করলেন প্রাণিটিকে। কাজেই সিংহ তাঁর সঙ্গ নিল। ব্রুঞ্চভিক যেখানেই যান সিংহও পিছন পিছন যায়। কাজেই প্রাগ-সহ বোহেমিয়ার সর্বত্র ব্রুঞ্চভিকের বীরত্ব আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে লাগল। রাজা নিজে তাঁকে মাঝেমধ্যেই প্রাগ ক্যাসলে নিমন্ত্রণ করতেন। এবং শুধু তাই নয়, প্রাগের “কোর্ট-অফ-আর্মস”-এ যে সিংহের ছবি ব্যবহার করা হয় তা ব্রুঞ্চভিকের সেই সিংহ।

এখন প্রশ্ন হল, সেই দৈবশক্তি বাহক অস্ত্রটির কী হল? বলা হয়ে থাকে, সেই তরোয়াল চার্লস সেতুর কোনও এক পাথরে লুকিয়ে রাখা আছে এবং তরোয়াল নাকি সেই দিনের অপেক্ষায় আছে যেদিন ডিউক ওয়েন্সেসলাস নিজের সাদা ঘোড়ায় চেপে ব্লানিক পাহাড় থেকে নেমে আসবেন। সেইদিন চার্লস ব্রিজ দ্বিখণ্ডিত হয়ে দেখা দেবে তরবারী এবং তা হাতে নিয়ে ওয়েন্সেসলাস বলবেন “Off with all their heads!” সঙ্গে সঙ্গে একে একে প্রাগের সমস্ত শত্রুর নিধন ঘটবে।

আড্ডা দিতে দিতে অনেকটাই এসে পড়েছি। ব্রিজ পার করে মিনিট দশেক হাঁটার পরেই টিন-এর মতোই একটা চৌকোনা ঝলমলে চত্বর পড়েছিল। এখন যদিও রাজ্যের রেস্তোরাঁ আর দোকানপাটে ভরে গেছে জায়গাটা, তবে ওইটেই মালা স্ট্রানার মধ্যাংশ। সেখান থেকে বাঁয়ে অনেকখানি ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এলে যে নীল চুড়োটা দেখা যায়, সেটাই প্রাগ কাসলে অবস্থিত ওয়েন্সেলাসের আদেশে তৈরি সেন্ট ভিটাস ক্যাথিড্রাল।

St Vitas Cathedral
উনিশ শতকের সেন্ট ভিটাস গির্জা

সেন্ট ভিটাস ইউরোপের এক খ্রিস্টান পাদ্রি। রোমান সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান যখন গোটা ইউরোপ জুড়ে খ্রিস্টান-নিধনে ব্যস্ত, সেই সময় প্রাণ হারান সেন্ট ভিটাস। ডিউক ওয়েন্সেসলাসের হাত ধরেই ভিটাসের নাম বোহেমিয়ায় এসে পৌঁছয়। রাজা ঠিক করেন, ভিটাসের সম্মানার্থে এমন এক গির্জা তৈরি করবেন যা প্রাগের সমস্ত গির্জার থেকে উঁচু হবে। প্রাগ দুর্গের ভিতরেই একটি গোলাকার চত্বরে গির্জার ভিত স্থাপন করা হয়।

সত্যি সত্যি ভিটাস ক্যাথেড্রাল প্রাগ শহরে উচ্চতম। মিনারের উচ্চতা ৯৯ মিটার এবং তার চুড়োয় রয়েছে ১৮ টন ওজনের একটা ঘণ্টা, যার নাম “জিকমুণ্ড”। বুঝতেই পারছেন, ১৬০০ শতাব্দীতে ওরকম একটা ঘণ্টা ১০০ ফুটের কাছাকাছি টেনে তোলা যেমন তেমন কথা ছিল না। শোনা যায়, পাহাড় বেয়ে প্রাগ দুর্গ পর্যন্ত নিয়ে যেতেই নাকি ১৬ জোড়া ঘোড়ার দরকার পড়েছিল। কাজেই তা নিয়ে কিংবদন্তি তৈরি হবে, এ আর আশ্চর্য কী?

St Vitas Cathedral inside
আজকের সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রালের অন্দর

প্রাগ দুর্গে পৌঁছলেও কিছুতেই গম্বুজের মাথায় তোলা যাচ্ছিল না ঘণ্টা। রাজামশাই বিপাকে। শেষে হাল ধরলেন রাজকন্যা। কয়েকদিন সময় চেয়ে নিয়ে রাজকন্যা তাঁর পরিচারিকাদের নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিলেন। প্রত্যেকে নিজেদের কয়েক গাছি করে চুল কেটে তৈরি করলেন এক আশ্চর্য দড়ি। তাছাড়া নিজের তদারকিতে রাজকন্যা শহরের শ্রেষ্ঠ কামার ও ছুতোর ডাকিয়ে এক বিরাট পুলি তৈরি করালেন। কয়েকদিনের মধ্যেই রাজকন্যার দড়ি ও যন্ত্র ভিটাস গির্জার সামনে এল। 

ভোর হতেই সারা শহরের মানুষ হাজির হলেন দুর্গে। শুরু হল কাজ। ধীরে ধীরে মজবুত দড়ির টানে ঘণ্টা উঠতেও শুরু করল। বেশ খানিকক্ষণ পর রাজা-সমেত শহরের সমস্ত মানুষ হাঁ করে দেখলেন ৯৯ মিটার মিনারের একেবারে চুড়োয় তুলে ঘণ্টা দিব্যি ঝুলিয়ে দেওয়া হল।

গল্প বলতে বলতে খেয়ালই করিনি, কখন সন্ধ্যে নামার জোগাড় হয়েছে। পরে না হয় আর একদিন আমরা পাউডার টাওয়ার, ইহুদি কোয়ার্টার, শিশু যিশুর গির্জা বা অন্যান্য জায়গাগুলোর গল্প করতে করতে আরও একটা ওয়াকিং ট্রেইলে বেরব? বলা তো যায় না, আপনার চোখেও পড়ে যেতে পারে নতুন কোনও কিংবদন্তির ইঙ্গিত, বা নেহাতই এক আধটা বোহেমিয়ান স্ক্যান্ডাল! কে বলতে পারে, আপনিই হয়তো হয়ে উঠলেন স্বপ্ন নগরী প্রাহার আগামী শতাব্দীর লোকসাহিত্যিক!

Prague city
প্রাগ কাসেল থেকে প্রাগ শহর


বিঃ টিকাঃ
ডিউক ওয়েন্সেসলাসের (৯০৭ – ৯৩৫) হাতেই আধুনিক বোহেমিয়ার জন্ম। এছাড়া প্রাগ কাসলের ভিতর অবস্থিত সেন্ট ভিটাস ক্যাথিড্রালও তাঁর নির্দেশেই তৈরি। মৃত্যুর পর ওয়েন্সেসলাসের দেহ সেন্ট ভিটাসেই সমাহিত হয়। দশম শতাব্দীতে ডিউক ওয়েন্সেসলাসকে সেন্ট উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর কাজ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত নানান কিংবদন্তি আজও চেক প্রজাতন্ত্রের মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

Wenceslas Seal
রাজা ওয়েনসেসলাসের শিলমোহর


প্রাগ কাসল থেকে ফেরার পথে মালা স্ট্রানা শহরতলির এক পুরনো বইয়ের দোকানে যে যখের ধনের খোঁজ পেয়েছিলাম তার নাম “Old Prague Legends”, লেখিকাঃ Magdalena Wagnerova, ISBN 978-80-86523-87-3, প্রকাশকঃ Nakladatelstvi Plot

*ছবি সৌজন্য: লেখক ও alamy.com
 আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১][পর্ব ২]

Author Rupak Bardhan Roy

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

Picture of ড. রূপক বর্ধন রায়

ড. রূপক বর্ধন রায়

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।
Picture of ড. রূপক বর্ধন রায়

ড. রূপক বর্ধন রায়

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস