(May Day)
ওরা কাজ করত। হে-মার্কেটের উত্তাপ থেকে শতাব্দী পেরিয়ে নিজস্ব জ্বর, প্রবহমানতা, পারদ টাউনশিপের গলিতে উঠত নামত। এবং এখানেই শ্রমের ক্রনোলজি। একটা সাইকেল এবং দীর্ঘদেহী সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। কীভাবে যাবেন এতটা দূর? বাজার? কটা টাকা বাঁচবে? সবজির দাম, মাছ সপ্তাহান্তে এক-আধবার হলে কোথায় কত আনা কম দাম? পিতামহ জানেন। পিতামহরা সব জানেন। সাইকেলের রডে তৃতীয় প্রজন্ম। পাড়ার সবাইকে চেনেন পিতামহ। তৃতীয় প্রজন্মের আশ্চর্য বিস্ময়ে, মোহে দৃশ্যরচনা। ‘কিগো কাকা, আজ কোথায়, কোন পাড়ায় দর কমল?’ সেই কাকা স্মিত হাসেন। মোড় ঢুকলে দৃশ্যের জন্ম হয়, মোড় বাঁকলে মৃত্যু। তবে, তখনও পারিবারিক মৃত্যুবোধ, চেতনায় সেভাবে বাড়বাড়ন্ত না হওয়ায় দাদুর ঠোঁটে শতাব্দীপ্রাচীন বসতভিটের গর্ব। আমরা যাইনি মরে আজও। কোনওদিন গেছ কি? মরে গিয়ে প্রেতের মতো আজও কি দরকষাকষি? সাইকেলে প্রেতবৎ নিশ্চল এক বৃদ্ধ, বয়স বাড়ে না, বয়স চিত্রার্পিত ভেক্টর। সত্তোরোর্ধ বেঁচে থাকার, অসীম বেঁচে থাকার রোগ ছড়ায়। (May Day)
চিরদিন থাকে সেবাহীন, ভাঙ্গা দেউলের দেবতা: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
রোগ-আরোগ্যের অন্যদিকে বৃদ্ধারা একাই। তাঁদের শ্রমে একটা বড় হলুদ মুড়ির কৌটো। আজ ক’জন পাত পাড়বে? ক’জন? উনুন এক চিরন্তন শিখা, বাড়িটা ভেঙে গেলেও জীর্ণ লক্কড়, বালি-কাদায় কোথাও না কোথাও বড় হয়, বুড়ো হয় দু’তিনটে কয়লা, উনুন খোঁজে, সারারাত, ক্ষুধার্ত শীতের রাতে উনুন খোঁজে। পিতামহীরা উঠোনের এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে প্রেতবৎ ঘোরেন। হাতে প্রিয় সংসারের মিনিয়েচার পেন্টিং। আতপ চালের দানার ভেতর। ‘উঠোনে জ্যোৎস্না ঝিঙে ফুল আর চন্দনা পাখি! তাহলে কোথায় হারাল সেসব ক্ষণঝঙ্কার? কুকুর ছুটেছে বাগানের দিকে– পিছু নেব নাকি?’ বৃদ্ধা শ্বাপদের পিছু নিয়েছিলেন কী না জিজ্ঞেস করা হয়নি, তবে নিশির ডাকের পেছনে যাওয়ার তীব্র বিধিনিষেধ ছিল। প্রেত-মানুষের সহাবস্থান। আসলে কে প্রেত, কে মানুষ জানা নেই। নিদাঘ দুপুরে প্রতিচ্ছায়ার শরীরের রিভার্স টার্ন।
ওই দেখ, মাথা নিচে, পা ওপরে। প্রেতের এত শ্রমের প্রয়োজন? ভেনেশিয়ান জানলা সোজা-উল্টো সমান, মরচে ধরা শিক দিয়ে দেখা ওপাড়ার প্যালাডিয়ান ম্যানসন, ছাদ নিচে, আকাশ ওপরে। কেন এত শ্রম? নিশি সকালে কী করে? কাগজ বেচে? প্রাচীন নাপিত হয়ে চুল কাটতে আসে সবেমাত্র অশৌচ-কাটা আলুথালু পৃথিবীর? শোনপাপড়ি-দানাদার-চন্দ্রপুলির স্বরে হকারির বোরডম খোঁজে? দুপুরবেলা একটু ঘুমিয়ে নেয়? নাহলে তাকে রাতে বেরোতে হয় কেন? স্বল্প আয়ে পোষায় না বলেই কি শিকার, এত শিকার? প্রথম প্রজন্ম কাজের ব্যস্ততায়, বয়সের দূরত্বে এসব বোঝেনি। শ্রম, তীব্র শ্রমের ভেতর সন্ধেয় গোল হয়ে বসে পারিবারিক দুর্ঘটনা, মৃত্যুর ফেটাল এক আলোচনাচক্র, দূরদর্শন, রোববারের বইয়ের মতো লেগে থাকা চোনা। ওইটুকুই শ্রমবিরতি। (May Day)

রাতে শোওয়ার বিছানায় আলাদা দীর্ঘশ্বাস, টান, এই বুঝি বটবৃক্ষ পড়ে যাওয়ার শব্দ, নাকি পাড়ার অশ্বত্থ, কে পড়ে গেল? বৃদ্ধা দেখে আসতে যান। একা, অন্ধকার সদর পেরিয়ে রাস্তায় ঋজু এক বৃক্ষের সামনে বিগতযৌবনা এক নারী। গাছের শ্রমে পাতার সজ্জা, শাখার কোষে কোষে নিরলস টিকে থাকার অভ্যাস। বৃক্ষ এবং বৃদ্ধার শ্রমের কথোপকথন। শেকড় থেকে জল, খনিজ আহরণ করে পরের প্রজন্মে তুলে দিতে গেলে সহ-অনুভূতি প্রাপ্তির জন্য মৃত্যুকালের প্রয়োজন হয়। নচেৎ, এই শ্রম, এই মনে রাখার তীব্র আকুতি বাকি প্রজন্মের বিরক্তির কারণ হয়। ঘনঘন টেলিফোন বিরক্তির কারণ হয়। টেলিফোন না থাকা ঘরে এপাড়া ওপাড়া করা বৃদ্ধার উঞ্ছবৃত্তি মূল্য পায় না। অশ্বথের নিচে সেই শ্রম ন্যূনতম মূল্যে বিকোয়। খুচরো কত পান বৃদ্ধা? সেই অর্থে নকুলদানা হয়? (May Day)
তৃতীয় প্রজন্ম অপেক্ষা করে। গুলি কেউ খায়নি। তবে বাড়িটা খেয়েছিল অনেক পরে। খাকি রঙের পোশাকে সময়, শরিকি কাউন্টার-লেবার গুলিটা করে ফেলেছিল। ট্রিগার টেপার পর ফেরত কীভাবে হবে? তৃতীয় প্রজন্ম কিন্তু বলেছিল আগেই।
বাকি পরিবারের শ্রমে সময়বোধ। তৃতীয় প্রজন্ম বুঝতে পারে না। একটা খারাপ কলকাতা থেকে টাউনশিপের পাতায় আসতে কারফিউ নামের শব্দ। কারফিউতে গুলি চলে? কাকে মারবে পুলিশ? কেউ তো খারাপ কিছু করেনি! গোটা দিনের হাড়খাটুনি শ্রমের পর সে নেহাত ফেরার ট্রেনের, সাইকেলের, ঘরের ওম চেয়েছে। তৃতীয় প্রজন্ম অপেক্ষা করে। গুলি কেউ খায়নি। তবে বাড়িটা খেয়েছিল অনেক পরে। খাকি রঙের পোশাকে সময়, শরিকি কাউন্টার-লেবার গুলিটা করে ফেলেছিল। ট্রিগার টেপার পর ফেরত কীভাবে হবে? তৃতীয় প্রজন্ম কিন্তু বলেছিল আগেই। ওই লোকটা, ওই কাকাটা ভাল না। ওর থেকে দূরে থাকো। তৃতীয় প্রজন্ম বুঝতে পারে। শ্রমের ভোরে, তীব্র পক্ষীশব্দে প্রবীণেরা বোঝেননি। বুঝিয়েছে শুধু কোলগেট থেকে শ্বেতশুভ্র স্নেহ বেরিয়ে গেলে সেসব আর ভেতরে ঢোকে না, অধ্যবসায়ের সময় পেরিয়ে গেলে এ গ্রহের কোনও শ্রম অর্থ পায় না। (May Day)

কারণ চাকরির জন্য একটা বয়সসীমা আছে। তৃতীয় প্রজন্ম বুঝতে পারে না বাবারা কোথায়? কোন মফস্বলে, গাঁয়ের রাস্তায় কিসের শ্রমে আলাদা? কেন সপ্তাহান্তের প্রতীক্ষা? তৃতীয় প্রজন্মের চিন্তায় প্রাচীন স্কিজোফ্রেনিয়া। একজন দীর্ঘদেহী তামাটে মানুষ সপ্তপদীর নায়কের মতো গোটা গ্রাম ঘুরছেন। কিন্তু পিতা তো চিকিৎসক নন। তাঁর এত কী কাজ! বৃদ্ধার কাছে তোলা প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা নারী। ভাঁজ করা হাতে হাত রাখা। ক্রমশ আনমনায় নখর বসে যাওয়া। আঃ, লাগছে। সেইসব নখে আগাম চলে যাওয়ার ক্রোধ, বয়স গোনার ক্রোধ। জপের মালা গোনা, কর গোনার নিখুঁত শ্রম আসলে যে দিনান্ত পেরোনোর রূপক, তৃতীয় প্রজন্ম অনেক পরে বুঝতে পারে। ততদিনে পারিবারিক মৃত্যুবোধ আসতে শুরু করেছে। ট্রেন দুর্ঘটনায় তস্য-কাকাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরা কয়েকটা মুখ প্রশ্ন করেছিল, কী হয়েছিল দাদা, পড়ে গেছিলেন কেন?
কাকার অন্তিম শব্দে শ্রম, তীব্র শ্রম। ‘খুব খাটুনি যাচ্ছিল দাদা, ঘুমে জড়িয়ে গেছিল চোখ, পারিনি, পারিনি জেগে থাকতে’। সেই চোখ ঘুমে জড়িয়ে গেল। আরামে জড়িয়ে গেল। জাগল না। কোনওদিন জাগিবে কি আর? পিতামহের কোমরে ব্যথা হত? হাঁটু ধরে কোনওদিন শুয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা? গাঢ় বেদনার ভারে শ্রম নুয়ে পড়েছিল কখনও? (May Day)
ডিসেন্ট ইনটু মাইসেলফ: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
সময় সচরাচর প্রশ্নবোধক। সময় দ্বিতীয় প্রজন্মের নারীদের মিস্টিক ছায়ায় সাদাকালো সীমান্তরেখা। ওদের শ্রম ছবি ওয়াশ করার আগের নেগেটিভ। মুখগুলো বোঝা না গেলেও আকারে-অভিব্যক্তি-অভিনয়ে স্পষ্ট হয় মা-কাকিমার চুল, অলক্তদাগ, শাঁখাশব্দ। রিনরিন চুড়ি। কে আগে ঘণ্টা বাঁধবে, কে আগে? প্রবীণ মার্জার প্রাচীর থেকে প্রাচীরে ঘোরে। শিকার ও শিকারীর ভেতর অন্তর্বর্তী দূরত্বে স্বাধীনতা শব্দের বিকাশ, বসত গড়া। ছবি আঁকা, রং করা, সেই ছবিটা নষ্ট করা। কোন জনা, কোন জনা? অনন্ত জিজ্ঞাসার ভেতর তাদের শ্রম। অফিস, ঘরকন্না, সন্ততির লেখাপড়া। প্রজন্ম পেরোলেও এই তিন চত্বরে যুগপৎ হাঁটাহাঁটির ছবি নিরলস। তৃতীয় প্রজন্ম ছোট থেকে বড় হয়ে বুড়ো হয়ে শ্রমের ভেতর ভুল বোঝার অস্পষ্ট আয়ত দেখতে পায়। (May Day)
আবার সেই পাহাড়ে ওঠা। শ্রম তখন যুগপৎ বিকল্পহীন শাপ, বিকল্পহীন ত্রাতা।
সিদ্ধান্তে এদিক থেকে ওদিকে না হওয়ার আমৃত্যু আক্ষেপ দেখতে পায়। শ্রম তখন লেগ্যাসি থেকে, ইতিহাস থেকে চকিত টার্নে ঘুরে গিয়ে ব্যক্তিগত হয়ে যায়। শ্রম, তুমুল শ্রম, অবিশ্বাস্য শ্রম তখন মাল্টিপল চয়েসের এক, দুই, তিন। শ্রম তখন তুঁহু মম মরণেচ্ছা। একটা আধুলি ছুড়ে দেওয়া পাহাড় থেকে তীব্র গতিতে নেমে আসা। ‘আধুলিটা অন্ধকারে প্রজ্জ্বোলিত হয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে থামে শ্রমিক পায়ের কাছে এসে’। ওঠা, আবার সেই পাহাড়ে ওঠা। শ্রম তখন যুগপৎ বিকল্পহীন শাপ, বিকল্পহীন ত্রাতা। শ্রম তখন ১৮৭৮-এ অ্যামহার্স্টের এক হলুদ রঙের বাড়ি থেকে মিসেস স্যামুয়েল বাওলসকে লেখা চিঠির অংশ- ‘Work is a bleak redeemer, but it does redeem; it tires the flesh so that can’t tease the spirit.’ (May Day)
(কৃতজ্ঞতা: জীবনানন্দ দাশ, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, ওশেন ভুয়ং, এমিলি ডিকিনসন)
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
অনির্বাণ ভট্টাচার্য পেশায় প্রসারভারতীর অধীনে দিল্লি দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। লিখেছেন গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ। বিশেষ আগ্রহ - চলচ্চিত্র, প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির-শিল্প এবং ক্রীড়াজগত।