রবুদা (Pt. Ravishankar) আর শঙ্কর দুজনেই খুব ভূতের গল্পের ভক্ত। ঠিক হয় যদি বলি ভূতের ভক্ত। নেই কথা ওরা ভূতের পরিবার, ভূতের হালচাল, ভূতের সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করে। আমার এসবে খুব আপত্তি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি ভূতে বেশ ভয় পাই। এখনও পাই। একলা থাকতে পারি না। একলা একলা ঘুমাতেও পারি না। মনে হয়, এইসব গল্পের ভূতেরা আমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। অশরীরী আত্মারা, দুম করে এসে আমার সামনে দাঁড়াবে। না, কোনও ক্ষতি করবে বলে ভাবি না। কিন্তু কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব। অকারণ যেচেপড়ে ভূতের কাহিনি পর্যালোচনা করার বা সেই নিয়ে অযথা জীবনে কোনও চাপ নেওয়ার একেবারেই পক্ষপাতী নই আমি। এই যে দু’চার লাইন তেনাদের নিয়ে লিখছি, আশপাশে দুএকটা শাকচুন্নি বা ব্রহ্মদত্যি যে অদৃশ্যে, নিঃশব্দে হ্যা হ্যা করছে না সেটাও কিন্ত জোর দিয়ে বলতে পারছি না। স্পষ্ট শুনলাম বা দেখলাম বড় বারান্দার ধারে যে বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছটা আছে সেখানে লম্বা পা ঝুলিয়ে কোলগেট দাঁত বার করে বিল্লুদত্যিটা আইসক্রিম খেতে খেতে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে আর বলছে ‘— কী রে— সেই তো আমাদের নিয়ে লিখতে বসলি! এতদিন যে বড় দূরে দূরে থাকতি!’
নাহ, আর লিখব না। সত্যি আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। এই মধ্যরাতে (হ্যাঁ এই রাত ১টা-২টো ছাড়া আমার লেখার সময় হয় না।) এইসময় তেনাদের নিয়ে আর বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো, কারণ বাকি রাতের ঘুম তাহলে চম্পট দেবে।

হ্যাঁ, তা যা বলছিলাম, রবুদা আর শঙ্করের ভূতপ্রীতি আমি একদমই ভালো চোখে দেখতাম না। আমি ওদের এইসব আলোচনার সময় নিঃশব্দে সরে যেতাম, এটা শঙ্কর নিশ্চয়ই রবুদাকে বলেছিল। রবুদা খুব জোরে জোরে ভূতের গল্প করতেন, যাতে কিনা দূরের চেয়ারে বসা আমার গোচরে তা সজোরে প্রবেশ করে। এদের সঙ্গে জুটি বাঁধল কটেজের দারোয়ান। সে হঠাৎ একদিন ঘোষণা করল আমি আর শঙ্কর যে কটেজে আছি, এক মেমসাহের সেখানে মারা যান। উফফ! আমার যে তখন কী দশা! মনে হচ্ছে তক্ষুনি সব ছেড়েছুড়ে মা’র কাছে চলে যাই।

রবুদা হঠাৎ বলে উঠলেন, শঙ্কর ইন্দ্রাণীর তো খুব ভূতে ভয়। তুমি ওকে নিয়ে যেন ঘরে যেও না। দরজা খুললেই দেখবে মেমসাহেব খাটে শুয়ে আছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি এরা সব আমাকে নিয়ে মশকরা করছে। সব বুঝেও আমি ক্রমশ ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছি, কমলাদির গা ঘেঁষে আস্তে আস্তে নিজেকে প্রাণপণ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। কমলাদি কাছে টেনে আমার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে বললেন, “এদের কথা একদম বিশ্বাস কোরো না। এসব কিচ্ছু সত্যি নয়। তোমার নিয়ে তামাশা করছে।”
রবুদা হো হো করে হেসে উঠলেন— “আচ্ছা, আচ্ছা, ইন্দ্রাণী তোমাকে একটা গল্পের সিন দেখাচ্ছি, পরশুরামের গল্প।” এই বলে, তেড়ে, বেঁকে, ঝুঁকে, শরীর পেঁচিয়ে, বেঁকিয়ে অদ্ভূত একটা নাকিসুরে কথা বলতে বলতে এমন ক্যারিকেচার শুরু করলেন, আমরা সবাই হাসতে হাসতে অস্থির। আমার তো সত্যি কথা বলতে কী, হাসতে হাসতে একেবারে নাকের জলে, চোখের জলে অবস্থা। রবুদা, পাশে এসে বসে খুব স্নেহমাখা গলায় বললেন, “ইন্দ্রাণী, আর ভয় পাচ্ছ না তো?”

বারবার লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, সত্যি এই মানুষটাকে স্বপ্নে দেখতাম! বিশ্বখ্যাত সেতারশিল্পী— পণ্ডিত রবিশঙ্কর (Pt. Ravishankar)! উনি সত্যিই আমার স্বপ্নে আসতেন। বাড়ির বিরাট রেকর্ডচেঞ্জারে দাদু যখন এঁদের লংপ্লেয়িং রেকর্ডগুলো বাজাতেন, আমি সেই মূর্ছনায় ক্রমশ অন্য জগতে, হালকা মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যেতাম। আজ সেই মানুষটার সামনে আমি বসে আছি, কথা বলছি, গান শিখছি, গাইছি! সত্যি কি?
একদিন ডিনার করছি। কিছু বিদেশি ডাইনিং হলে ঘোরাঘুরি করছেন। আমাদের আড্ডা যথারীতি চলছে। শান্তনু সব ব্যাপারটা দৌড়াদৌড়ি করে দেখভাল করছে। আমার বিয়ের পর পর শঙ্কর আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে একটা ভূতের সিনেমা দেখিয়েছিল, ঠিক দার্জিলিং আসার আগে। ছবির নাম ‘Women’। সেই ছবির থিম ছিল ভূত; কুকুর ভূত। আমি সত্যিটা জানলে কখনোই ঐ ফিল্ম দেখতে যেতাম না। আমাদের সাধারণত মনীষীদের জীবনী নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখানো হত। বিয়ের আগে দাদুর সঙ্গে দেখা হিন্দি ছবি ‘ববি’ আমার- দেখা প্রথম সামাজিক, adult সিনেমা। তখন বিয়ের ঠিক হয়েছে এবং আমাকে যথেষ্ট mature করার পদ্ধতি চলছে। এছাড়াও দেখি ‘Roman Holyday’ — তাও দাদুর সঙ্গে। যাক্, এসব কাহিনি বিস্তারিত পরে জানাব। এখন আসি বিবাহ-পরবর্তী আমার বিড়ম্বনার ঘটনায়।

শঙ্কর তখন রবুদাকে সেই সিনেমা দেখে আমার কী reaction হয়েছিল সেই সমস্ত গল্প হাসতে হাসতে বিস্তারিতভাবে বলছে। কুকুর ভূত! সিনেমার থিম! দেখার পর থেকে আমি কুকুর, এমনকি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনলেও ভয় পেতাম। রবুদা আশ্চর্য হবার ভান করে বললেন, “সে কি গো ইন্দ্রাণী! তুমি সায়েন্স পড়া মেয়ে, তুমি কী করে ভূতে বিশ্বাস কর, ভয় পাও?” ওদিকে নানারকম ভয়ের আওয়াজ করে শঙ্কর ‘Women’-এর গল্প বলছে, রবুদা আমায় আড়ে আড়ে দেখছেন, মিটিমিটি হাসছেন। এদিকে আমি ক্রমশ প্রায় কমলাদির কোলেই উঠে বসি আর কী!
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Freepic
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
বাহ! আজ আবার নতুন পরিচয়ে, ভূত বিশ্বাসী আপনাকে চিনলাম। কত নতুন কথা ও জানতে পারছি। আপনি আরো লিখুন প্লিজ! খুব ভালো লাগছে।