হায়দ্রাবাদে শঙ্কর রবুদার (Pt. Ravishankar) বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ রাখতে উড়ে যাবে, অমি গেলাম ওকে বিমানবন্দরে সি-অফ করতে। প্লেন উড়ে গেল। সি-অফ-জোন থেকে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানালাম। তখন সেই ব্যবস্থা ছিল। খুব খারাপ লাগছিল কমলাদি আর অন্নপূর্ণা শংকরের জন্য। কেন, বলতে পারব না। পরে অবশ্য অন্নপূর্ণাদি ওঁর এক ছাত্রকে বিয়ে করেন। আর কমলাদি একা হয়ে ক্রমশ একাকিত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে একদিন এই জগৎ ছেড়ে চলে যান। অন্নপূর্ণাদিও চলে গেলেন কালের নিয়মে। তবে এঁদের দু’জনের আগেই রবুদা ইহজগৎ ত্যাগ করেন। রেখে গেলেন তাঁর দুই অতি প্রতিভাময়ী কন্যা— আনুষ্কা, নোরা এবং তাঁদের দুই মা’কে।

ও হো দার্জিলিং-এর অনেক কথা তো এখনও বলাই হয়নি। রবুদা (Pt. Ravishankar) আর শঙ্কর খুব আমোদ করে ‘Women’ সিনেমার কুকুর ভূতের গল্প করছে। রবুদা আমাকে আড়ে আড়ে দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। আমি কমলাদির গা ঘেঁষে মুখ মলিন করে পাহাড়, আর তার গায়ে জোনাকির মতো বিন্দু বিন্দু আলো দেখতে দেখতে মনটা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সত্যিই তো, এত ভয় পাওয়ার কী আছে! ভূত বলে তো কিসস্যু নেই। কেন আমি ঐসব বিশ্বাস করে নিজের শান্তি নষ্ট করছি?

সিনেমার গল্প প্রায় ক্লাইম্যাক্সে, হঠাৎ “আর য়্যু রাভিশংকর?”
খুবই উত্তেজিত, উৎসাহিত তিনজন সাহেব, মেম রবুদার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
—”ইয়েস”, রবুদা শান্তভাবে হেসে উত্তর দিলেন।
আর যায় কোথায়! তিনজন বিদেশি প্রায় জড়িয়ে ধরে রবুদাকে। সারা শরীর ঝাঁকিয়ে হ্যান্ডশেক করে নিজেদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তারা ছড়িয়ে দিল ডাইনিং হলে নৈশভোজে ব্যস্ত মানুষদের মধ্যে। সবাই এক এক করে এসে তাদের সম্মান জানালো রবুদাকে। কেউ প্রণাম করছে। কেউ দুহাতে জড়িয়ে ধরছে। কেউ আনন্দে দুহাতে মুখ ঢাকছে। চারপাশ আনন্দে যেন গান গেয়ে উঠল…
“মধু সমীর দিগঞ্চলে-
আনে পুলকপূজাঞ্জলি
মম হৃদয়ের পথতল
যেন চঞ্চল আসে চলি।…”
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ভূতের গল্প অর্ধসমাপ্ত রেখে অগত্যা আমরা চারজন যে যার কটেজের দিকে রওয়ানা দিলাম, সাহেবরাও ‘Good Night’ জানিয়ে হাঁটা দিল।

নিঃশব্দে বিদেশিদের ধন্যবাদ দিয়ে আর কমলাদি, রবুদাকে শুভরাত্রি জানিয়ে আমাদের নতুন বাসস্থানের দরজা বন্ধ করলাম। আহ্। কী শান্তি! নরম বিছানায়, গরম কম্বল মুড়ি দিয়ে রুম হিটারের উষ্ণতা শরীরে নিয়ে গভীর আরামে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ বাইরে থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। আবার প্রচণ্ড ভয় আমাকে পেয়ে বসল। কথা বলতে পারছি না। গলা শুকিরে যাচ্ছে। সাইড টেবিলে রাখা বোতলের জল গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে দুবার দু-গ্লাস খেয়ে ফেললাম। প্রচণ্ড নাক ডাকিয়ে শঙ্কর ঘুমাচ্ছে। আমি দুতিনবার ক্ষীণ স্বরে ওকে ডাকার চেষ্টা করলাম। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না। ঘেউ ঘেউ তো থামছেই না।

ঘরে নাসিকা গর্জন। বাইরে কুকুরের তর্জন। কী করি! কী করি! আমার অবস্থা তখন ন যযৌ। ন তস্থৌ। চোখ বন্ধ করে সজোরে শঙ্করকে ধাক্কা মেরে বললাম, “শুনছেন… শুনছেন!”
ও ধড়মড় করে উঠে বলল, “কী হল? কী হল?”
—”বাইরে, ঐ যে ঘেউ ঘেউ করছে…”
— “তাতে কী হল?” চশমাটা বালিশের তলা থেকে খুঁজে বার ক’রে চোখে পরতে পরতে ও জিজ্ঞাসা করল, “কী হল! ঘুমাওনি…?”
— “হ্যাঁ। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল তো। দরজার বাইরে কুকুর ডাকছে, শুনছেন না!”
— “উফফ! ও চলে যাবে। ঘুমাও…”
— “আরে! যান না, ওটাতে তাড়িয়ে দিয়ে আসুন। ঘুমাতে পারছি না তো…
এর মধ্যে সারমেয়টি একেবারে বিবিধ স্বরে ডাক ছাড়তে শুরু করেছে।
— “ও চলে যাবে। তুমি ঘুমাও তো। অত ভয় পাবার কী আছে! ওর হয়ত ঠান্ডা লাগছে। তাই ওরকম করছে। একটু পরেই চলে যাবে। তুমি শোও। শোও…”
— “নাআআ… যান না ওটাকে তাড়িয়ে দিন…”

ব্যাপারটা প্রায় কান্নাকাটির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে শংকর লেপ, কম্বল সরিয়ে পায়ে চটিটা পরতে পরতে দরজার দিকে হাঁটা দিল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। কুকুর ডেকেই চলেছে।
শঙ্কর দরজা খুলেছে কী খোলেনি, স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম হাতদুটো মুখের কাছে চোঙার মতো ধরে রবুদা, বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত রবিশংকর ঘেউ-উ-উ-উ করে আওয়াজ করছেন। শঙ্কর প্রথমে স্তম্ভিত। তারপর হা হা করে প্রচণ্ড জোরে হাসতে শুরু করল। আমি বিছানা ছেড়ে ধড়মড় করে খালি পায়ে দৌড়ে গেলাম দরজার দিকে। ওই ঠান্ডায় রবুদা এতক্ষণ ধরে আমাকে ভয় দেখাবার জন্য কুকুর ডাকছেন! হে ঈশ্বর!
— কী ইন্দ্রাণী! কেমন ভয় দেখালাম?”
ভূতগ্রস্থ আমার দিকে হাত নেড়ে হো হো করে হাসতে হাসতে রবুদা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
বিভ্রান্ত, বিমূঢ় আমাকে দেখে শঙ্করের হয়ত করুণা হল। হাত ধরে বলল— “শুয়ে পড়।”
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Getty Image
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
দারুন ভালো লাগছে পড়তে। আরো লিখুন প্লিজ! অনেক কিছু ছবির মত দেখতে পাচ্ছি। অপূর্ব আপনার লেখা।