(Rabi Ghosh) তাঁর অভিনয়দক্ষতা সম্পর্কে খোদ উত্তমকুমার বলেছিলেন, ‘আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর ও হয়তো কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে, যে গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, আর লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে’। আবার বিখ্যাত পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘সব অভিনেতা, সব শিল্পী আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। কিন্তু ও তা পেয়েছিল।’ তাঁর বিচিত্র চরিত্রায়ণ চমকে দিয়েছিল সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে অমিতাভ বচ্চনকেও। সেই চমক কাটেনি আজও, তাঁর অভিনয়ে এখনও মুগ্ধ আট থেকে আশি। পর্দায় তিনি আসা মানেই নির্ভেজাল আনন্দ, তিনি বাংলা চলচ্চিত্র ও মঞ্চের কিংবদন্তি অভিনেতা রবি ঘোষ! (Rabi Ghosh)
১৯৩১ সালের ২৪ নভেম্বর কোচবিহারে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার, যদিও তামাম দুনিয়া তাঁকে চিনল রবি ঘোষ নামেই। ছোটবেলায় ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে একটু বড় হয়ে শরীরচর্চা – সব জায়গাতেই নিষ্ঠা আর পরিশ্রম যেন উপচে পড়ত। ১৯৪৯ সালে সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন দক্ষিণ কলকাতার আশুতোষ কলেজে। সেখানে পড়ার সময়ে কলেজের ব্যায়ামাগারেই নিয়মিত শরীরচর্চা শুরু করেন। ভেবেছিলেন ভারোত্তোলক হবেন, অথচ ভাগ্যের ফেরে ছোটখাটো চেহারার এই লোকটা অচিরেই হয়ে উঠলেন বাংলা সিনেমার ‘শো-স্টপার’। (Rabi Ghosh)
এক সময় মিনার্ভা থিয়েটার হাউসফুল করতেন একাই, লোকে বলাবলি করত, রবি ঘোষ মানে ‘একাই একশো’! কলেজে পড়াকালীন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গড়ে তোলেন নাটকের দল ‘বন্ধুমন’। মহড়া চলত আশুতোষ কলেজের ছাদে। এই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ উৎপল দত্তের। উৎপলের পরিচালনায় ‘সাংবাদিক’ নাটকের মধ্যে দিয়ে রবির অভিনয়জীবনের সূচনা। মঞ্চে মাত্র ৩০ সেকেন্ড এক ‘সংবাদপত্র বিক্রেতা’র চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন তিনি। অতটুকু সময়েই নজর কাড়েন পরিচালক মৃণাল সেনের। (Rabi Ghosh)
১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শো। নাটকে সনাতনের ভূমিকায় ছোটখাটো মানুষটা খনি থেকে উঠে উচ্চস্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘আমি একজন ভূতপূর্ব লোক।’ দর্শকের মন কেড়েছিল সেই সংলাপ। এই নাটকের জন্য ‘উল্টোরথ’ পুরস্কারও পান রবি আর ‘অঙ্গার’ নাটকে অভিনয় দেখেই পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিনহা ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ডাকেন তাঁকে। (Rabi Ghosh)
ভিডিও: মেঘে ঢাকা অনিল : জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। ১৯৫৩ সালে কলকাতা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সেই অধ্যায় চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসাবে বেছে নেন রবি ঘোষ। উৎপল দত্ত-র ‘মেঘ’, অসিত সেনের ‘আগুন’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’ ছবিতে ডাক পান। যদিও রবির অভিনয় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’। এই ছবিতে অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই বাংলা ছবির দর্শকের মনের মণিকোঠায় চিরতরে ঠাঁই পেয়ে যান ‘ধনঞ্জয়’ ওরফে রবি ঘোষ স্বয়ং! তাঁর চলচ্চিত্র জীবনে নানা ছবির নানা চরিত্রে সুযোগ থাকলেই দেখিয়েছেন, সিরিও-কমিক, ডার্ক কমেডি, স্যাটায়ার কমেডি সহ আরও নানান অভিনয়ের সার্থক রূপায়ণ। কৌতুকের বাইরেও বেশ কয়েকটি অন্যরকম চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। (Rabi Ghosh)
যেমন, বিজয় বসু পরিচালিত ‘বাঘিনী’, যেখানে রবি ঘোষকে পরিচালক ভিলেনের চরিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। আবার পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘ছায়াসূর্য’ ছবিতে এক বধির মানুষের চরিত্রে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয়ও ভোলার নয়। একে একে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিতে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। (Rabi Ghosh)
‘অভিযান’ ছবিতে ট্যাক্সি ক্লিনার, ‘জন অরণ্য’ ছবিতে মিস্টার মিত্র, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিতে আমিনুদ্দিন, ‘আগন্তুক’ ছবিতে রঞ্জন, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-য় জ্যোতিষীসহ তাঁর অভিনীত বহু চরিত্র আজও ভুলতে পারেননি সিনেপ্রেমীরা। সত্যজিৎ থেকে তপন সিনহা, দীনেন গুপ্ত থেকে অঞ্জন চৌধুরী, সব ধারার ছবিতেই দশকের পর দশক রবি ঘোষ অনন্য !
১৯৫৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মোট ২০৬-টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার এবং ‘গুপীবাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বিএফজে পুরস্কার পেয়েছিলেন রবি। হিন্দিতে ‘সত্যকাম’, ‘সবসে বড়া সুখ’, ‘আজ কি রবিন হুড’, ‘পতং’ ছবিতে এবং মঞ্চে ৩৯-টি নাটকে অভিনয় করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু নাটক এবং সিনেমাও পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর পরিচালনায় ‘নিধিরাম সর্দার’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার।
নিজের সম্পর্কে রবি ঘোষ লিখেছিলেন, ‘আমি হতে পারতাম সার্কাসের দলের জিমন্যাস্ট, হতে পারতাম ওয়েট লিফটিং-এ বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন, পুলিশ কোর্টের কেরানিবাবু হয়েও জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম— প্রত্যেকটিরই তুমুল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আর পাঁচজনের মতো জীবনের সহজ সরল গতিতে ভেসে যেতে পারলাম না। জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে, বহু উত্থান আর পতনকে অঙ্গীকার করে আজ আমি অভিনেতা রবি ঘোষ।’ আজ অনন্যসাধারণ এই অভিনেতার জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।