মালিহাটির বিতর্ক সভা চলেছে ব্রজদেবের অনুপস্থিতিতেই। অনুপস্থিত বলার কারণ তিনি আছেন প্রচ্ছন্নে। স্বশরীরে অবতীর্ণ হওয়ার মতো সুস্থতা অর্জন করেননি এখনও।
ব্রজদেবপন্থী উড়িষ্যার তরুণ হর্ষরথ বলে, ওই যার কথা আপনারা পরিত্যাগ করতে পারেন না, সেই পণ্ডিত রূপ গোস্বামী নাকি স্বকীয়া ও পরকীয়া বিভেদ করেছিলেন? তা এই ললিতমাধব নাটকে কী দেখি আমরা? নাটকীয়ভাবে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে সে। প্রশ্নাতুর মুখ তার কাম্য।
[the_ad id=”266918″]
উড়িষ্যায় চৈতন্যপন্থীদের ক্ষমতা নেই নেই করেও আছে। এই বিতর্ক সভার উপর হর্ষরথের নিজের ক্ষমতা পরীক্ষাও নির্ভর করছে। হেলান দেওয়া অবস্থায় কর্তৃত্বের সুরে ফের সে বলে, কী দেখলাম আমরা “ললিতমাধব”-এ? কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামারূপী রাধার বিবাহ হচ্ছে। যিনি রাধা, তিনিই সত্যভামা! আবার ‘বিদগ্ধমাধব”-এ অভিমন্যু গোপের সঙ্গে রাধিকার বিবাহ সত্য বিবাহই নয়! আয়ানকে বঞ্চনা করার জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণর নিত্য প্রেয়সীর লীলামাত্র! তাহলে তো মেনে নিতেই হচ্ছে রাধাই সত্যভামা! এরপর আর তর্কের কী প্রয়োজন?
হর্ষরথের প্রত্যয়ী ভাষণের শেষাংশ কেড়ে নিয়ে এইবারে সুবাহু উঠে দাঁড়ায়। উত্তেজিত সুরে বলে, পণ্ডিত আপনি ইচ্ছামতো বক্তব্য ব্যবহার করছেন মাত্র। দয়া করে বক্তব্য আরোপ করবেন না। শ্রী রূপ গোস্বামী ঠাকুর, উপপত্যেই যে শৃঙ্গারের চরম উৎকর্ষ দেখিয়েছেন, প্রচ্ছন্ন কামুকত্বেই যে মন্মথের পরমারতি, তা তিনি স্বীকার করেছেন। সাধারণের জন্য তা লঘু হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের অবতারের জন্য লঘু হবে কেন?
বাঁকা হাসি খেলে গেল হর্ষরথের কণ্ঠে। বললেন, আমি তো শুনেছি বাংলার বৈষ্ণবরা ব্যক্তিগত জীবনে আচরণ অভ্যাস করেন! গোদা অন্ডাল আর মীরাবাঈয়ের মতো নিজেরাই কৃষ্ণপ্রেমিক হয়ে উঠছেন! এ সম্বাদ পূর্বে গোচরে ছিল না! সভাস্থলে উপস্থিত রাধামোহনপন্থীরা বুঝলেন, এ সুবাহুকেই আক্রমণ। ব্রজদেব যে সুবাহুপত্নী শিখীর আত্মীয়সমান, এ সংবাদ তাদের অজানা নয়। সুবাহ আক্রমণ সামলে কিছু বলার আগেই রাধামোহন তাকে ইঙ্গিতে থামিয়ে বলতে ওঠেন এবার, সভা ক্ষণিকের জন্য শান্ত হয়।

রাধামোহন শান্তভাবে বলেন, ব্যক্তিগত আলোচনা প্রসঙ্গ বহুদূর নিয়ে যায়, তাতে কীভাবে বাধা পড়ে যায় কে জানে! কে বলবে, তা বৈধ না অবৈধ? বিশেষত স্বয়ং ভগবানের জীবনে। মহারাজ পরীক্ষিতের প্রশ্নের উত্তরে শুকদেব বলেছিলেন, তেজস্বীগণের পক্ষে কিছুই দোষনীয় নয়, যেমন সর্বভুক অগ্নিকে মালিন্য স্পর্শ করে না, ঈশ্বরের বাক্যই হল সত্য, আচরণ সর্বদা সত্য নয়। যে আচরণ তাঁদের বচনের সঙ্গে সঙ্গত, বুদ্ধিমান ব্যক্তি শুধু সেই আচরণই অনুসরণ করবেন। ঈশ্বরের প্রক্ষেপ যদি ব্যক্তিজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে তাতে দোষের কী? শ্রীরাধা পরকীয়া নায়িকা হলে ক্ষতি কী, বলুন পণ্ডিত? চৈতন্যচরিতামৃতে স্পষ্ট বলা আছে “পরকীয়া রসে অতি ভাবের উল্লাস।” পরকীয়া প্রেমই হল নিকষিত হেম। কারণ এ প্রেম সর্বত্যাগী, সর্ব সংস্কারমুক্ত, সর্ব লজ্জা বাধা ভয় নির্মুক্ত। এ শুধু প্রেমের জন্যই প্রেম। সুতরাং এই হল বিশুদ্ধ রাগাত্মিকা ভক্তি।
এই পর্যন্ত বলে কিঞ্চিৎ শ্বাস নেন রাধামোহন। সভা স্তব্ধ। আড়চোখে দেখেন সুবাহুর মুখে সমর্থনের হিল্লোল। বিপক্ষ শিবিরও উত্তেজিত। বজ্রদেবের পক্ষ থেকে আর এক পণ্ডিত বলতে ওঠেন। তাঁর চোখে-মুখে আক্রমণের চিহ্ন স্পষ্ট। বলেন, তা গোস্বামী মশাই, তাহলে সমাজে বিবাহিতা পত্নীর প্রয়োজনই নেই, সম্মানও নেই? আপনার ব্রাহ্মণী সে কথা মানবেন নাকি? চন্দ্রাবলী পরকীয়া নায়িকা, তাকে আপনারা মানেন না কেন? সেও তো আয়ান ঘোষের বন্ধু গোবর্ধন মল্লের স্ত্রী?
[the_ad id=”266919″]
দ্রুত উঠে দাঁড়ায় সুবাহু। বলে, পণ্ডিতের জ্ঞানের অভাবে আমি বিস্মিত হচ্ছি! রাধিকার প্রেমে আত্মসুখেচ্ছার লেশমাত্র নেই। কিন্তু চন্দ্রাবলীর কৃষ্ণপ্রীতির ভিতরে আত্মপ্রীতির বোধ আছে। তাই তাকে গ্রহণ করা হয়নি। এটুকু জানেন না! এ তো আমরা ভাবতেই পারছি না!
কথায় কথা বাড়ে। বাণের উত্তরে বাণ। বাক্যের উত্তরে প্রতিবাক্য। অদূরে সুউচ্চ মঞ্চে সসম্মানে উপবিষ্ট শেখ বদরুদ্দীন, সৈয়দ করমউল্লাহ, শেখ হিঙ্গান, কাজী সদরউদ্দিন যথারীতি ক্লান্ত মুখে শুনে যাচ্ছেন, লিপিবদ্ধ করছেন মতামত। মুর্শিদকুলির আদেশে এঁরা এসেছেন জয়-পরাজয়ের হিসাবরক্ষক হিসেবে। উপরওয়ালার কাজ মানে বিনা প্রশ্নে হুকুম তামিল। পালা করে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে এঁদের। নবাবমহল ছেড়ে অজগ্রামে পড়ে থাকার ইচ্ছা নেই কারওরই, ব্যতিক্রম ওই পাগলা মুসাব্বির আহসান খাঁ! শেখ হিঙ্গান লক্ষ্য করলেন আজকেও সামান্য একটু দর্শন দিয়ে অন্তর্হিত হয়েছেন বর্ষিয়ান খাঁ সাহেব!
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।