একটা শহরের ভিতরে অনেকগুলো শহর পাশাপাশি বেঁচে থাকে। যেমন, লেক মলের পাশেই রয়েছে রাধুবাবুর দোকান।
লেক মলের ঠিক গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা গিয়েছে, তার নাম জনক রোড। গত প্রায় ৯০ বছর ধরে ওই রাস্তার ৮ নম্বর বাড়িতে রাধুবাবুর চায়ের দোকান। সদানন্দ রোডের বিখ্যাত ভাজাভুজির দোকান ‘আপনজনে’র মালিক প্রভাসবাবু এক দিন বলছিলেন, সত্তর-আশির দশকে ওই এলাকায় রাধুবাবুর কোর্মা, কবিরাজি, কাটলেটের কোনও জবাব ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু ভাজাভুজি তো সন্ধ্যের ব্যাপার! রাধুবাবুকে চিনতে হলে আসতে হবে সকালবেলায়।
রাধুবাবুর দোকানের ঝাঁপ খোলা হয় প্রতি দিন সকাল ৬টা নাগাদ। ছোট্ট দোকান। দু’টো মাত্র টেবিল। এক সঙ্গে বসতে পারেন বড় জোর ৮ জন। অথচ, আপনি যখনই চা খাবেন, দেখবেন আরও অন্তত ৩০জনের হাতেও চায়ের কাপ। রবি বারের সকালে সংখ্যাটা ৫০-৬০ ছাড়িয়ে যায়। খুব কিছু পাওয়াও যায় না তেমন— বাটার টোস্ট, অমলেট, পোচ, চা আর থিন অ্যারারুট বিস্কুট। ওই খেতেই প্রতি দিন উপচে পড়ে ভিড়!

জনক রোডের মুখ থেকে গোটা চত্ত্বরটা জুড়ে প্রচুর প্লাস্টিকের টুল পাতা থাকে। সেখানে বসেই আড্ডা জমান ১৫ থেকে ৮৫। কে নেই সেখানে! পুলিশকর্মী, রিকশচালক, সবজিবিক্রেতা, হকার থেকে শুরু করে দক্ষিণ কলকাতার দাপুটে কাউন্সিলর, মেয়র পারিষদ, বিরোধী নেতা, সিনেমা-থিয়েটারের পরিচালক, টিভি চ্যানেলের দৌলতে মুখচেনা ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক— সব্বাই। রাজনীতি থেকে সিনেমা, স্বাস্থ্য থেকে ফুটবল—গোল হয়ে তর্ক জমায় দক্ষিণ কলকাতা। বয়স্কদের অনেকে হাঁটতে পারেন না, গাড়ি নিয়ে আসেন। গাড়ির মধ্যেই অপেক্ষা করেন তাঁরা। খাবার পৌঁছে যায়। এই কয়েকশো আড্ডাবাজদের অধিকাংশকে নামে চেনেন কাউন্টারে বসা মধ্য চল্লিশের সোমনাথবাবু। কার নরম অমলেট-কড়া টোস্ট, কার উল্টোটা, কে পোচ ছাড়া কিচ্ছু খাবেন না, কার চায়ে চিনি কম, কার বেশি চিনি দিয়ে কড়া চা, কার আবার চিনি চলবেই না— সব মুখস্থ থাকে তাঁর।
রাধুবাবুর দোকানের জন্ম বৃত্তান্তের সঙ্গে লগ্ন হয়ে রয়েছে, অধুনা ঈষৎ আবছা হয়ে আসা পরাধীন ভারতের এক গণআন্দোলনের স্মৃতি। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরুর দিক। সবে মাত্র শেষ হয়েছে গাঁধীজীর আইন অমান্য আন্দোলন। বাঁকুড়া সোনামুখীর যুবক রাধাকিশোর দত্ত তখন জাতীয় কংগ্রেসের কর্মী। আইন অমান্য আন্দোলনে নাম জড়ানোয় পুলিশের খাতায় ফেরার! পুলিশের তাড়া খেয়ে বাঁকুড়া ছেড়ে রাধাকিশোর প্রথমে যান জামশেদপুরের হলুদপুকুর এলাকায়। সেখান থেকে কলকাতা। কোনও রকমে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই জুটিয়ে জনক রোডের এক চিলতে ঘরে শুরু করলেন চায়ের দোকান। সঙ্গে ছিলেন দুই ভাই— বিজনবিহারী এবং চিত্তরঞ্জন। ধীরে ধীরে পসার বাড়ল। চল্লিশের দশকের শুরুতে ক্রমশ জনপ্রিয় হল রাধুবাবুর দোকানের কিমা কারি, পুডিং, কোর্মা, স্ট্যু, কাটলেট। তার পর আর রোখা যায়নি তাঁকে। এখন সন্ধে বেলায় দোকান দেখেন বিজনবিহারীর ছেলে সত্যসুন্দর, সকালের দায়িত্ব সামলান চিত্তরঞ্জনের ছেলে সোমনাথ।
কারা আসতেন দোকানে? সোমনাথ বললেন, ‘‘কারা আসতেন না প্রশ্ন সেটাই! সেই ৪০-৪২ সাল থেকেই আমাদের রান্নার সুখ্যাতি ছিল। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, সুধীরলাল চক্রবর্তী, শ্যামল মিত্র— ক’জনের নাম করব! এক মাথা ঝাঁকড়া চুল নিয়ে পাঞ্জাবি পরে চলে আসতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। রাজনীতির লোকেদের কথা ছেড়েই দিলাম। এমনও হয়েছে মস্কো যাওয়ার আগে এসে চা-টোস্ট খেয়ে তবে বেরিয়েছেন। আমাদের দোকানের ঠিক উল্টো দিকের বাড়িটায় উত্তমকুমার নিয়মিত আসতেন। আমরা খাবার পাঠাতাম।’’ গত ৫০ বছর ধরে রাধুবাবুর দোকানের নিয়মিত ক্রেতা এক বৃদ্ধ বললেন, ‘‘ছোটি সি মুলাকাত ছবিটা দেখেছেন! ওই সময় উত্তমবাবু নিয়মিত আসতেন এই পাড়ায় আড্ডা দিতে। এই দোকান থেকে খাবার যেত ওঁর জন্য। সুচিত্রা সেনও আসতেন। তবে গাড়ি থেকে নামতেন না।’’
সন্ধ্যেবেলায় গেলে আবার অন্য ছবি। হাতে হাতে উড়ে যাচ্ছে কাটলেট, কোর্মা, কবিরাজি, চপ। অফিস ফেরত ভিড়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তারা রোড, সার্দান অ্যাভিনিউ, জনক রোড, সর্দার শংকর রোডের স্থানীয়দের আড্ডা। এই বেলাতেও ভিড় কেবল দোকানে আটকে নেই। ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাস্তা আর দুই পাশের ফুটপাথ জুড়ে।
কয়েক মাস আগের কথা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ একটি কালো গাড়ি থামল রাধুবাবুর দোকানের সামনে। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক নামলেন। কাটলেট, কবিরাজি খাওয়ার পর দাম মেটাতে গিয়ে দিলেন অতিরিক্ত ২০ টাকা! সোমনাথ, সত্যরা তো অবাক। তাঁদের প্রশ্নের মুখে ম্যানচেস্টারের অমল দাশগুপ্ত ভাঙলেন সত্যিটা, “আজ থেকে ২২ বছর আগে দাম দিতে ভুলে চলে গিয়েছিলাম। তখন আমরা কলেজপড়ুয়া। তার পর আর আসা হয়নি। দু-এক বার দেশে ফিরেছি বটে, কিন্তু কলকাতায় এই প্রথম। তাই শহরে নামার পর দিনই এলাম রাধুবাবুর ধার শোধ করতে।”
সকালবেলায় ১০টা, সাড়ে ১০টার মধ্যে দোকানের ঝাঁপ পড়ে যায়। ব্যস্ততা মিটিয়ে একটু হালকা হন সোমনাথ। কথায় কথায় এক দিন বললেন, ‘‘এই দোকানটা আসলে সাক্ষী। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে গিয়ে আমরাও খানিকটা যেন তাই। কত সম্পর্ক গড়তে দেখলাম। কত সম্পর্ক ভাঙল। কত চেনা মানুষকে দেখলাম মরে যেতে। দেখলাম, আঘাত কতটা বদলে দেয় মানুষকে! এই পাড়াটাও কেমন আমূল বদলে গিয়েছে। আরও বদলাচ্ছে। শুধু গাছগুলোর কোনও বদল নেই। সব কিছুই দেখছি। সব কিছুরই সাক্ষী থাকা ভাল।’’