বেনারসের ঘোষালবাড়িতে আশ্রিত যুবক বিকাশ সিংহ যে লখনউ বেতারকেন্দ্রে আখতারির গজল না শুনে, আড়ি পেতে মগনলালের কথা শুনছিল, এ খবর ফেলুদা কী করে জানল? উত্তর ছবিতেই আছে। ইংরেজিতে ‘আকাশবাণী’ নামের এক পত্রিকায় বিভিন্ন কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের তালিকা দেখে ফেলুদা বিকাশের মিথ্যে ধরে ফেলে। সেই পত্রিকায় শুধু বেতারকেন্দ্র নয়, দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তালিকাও থাকত। কিছু প্রবন্ধ, কিছু কর্মখালির বিজ্ঞাপন মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি হত এই পত্রিকা। কাজেই বেতারের মহিমা তখন ছিল সর্বজনীন। মার্জিত কণ্ঠে ‘দিস ইজ় অল ইন্ডিয়া রেডিও’ শুনতে পাওয়া যেত ঘরে ঘরে।

আজকাল অবশ্য মুঠোফোনের দৌলতে আমাদের জীবনের অনেক ব্যঞ্জনার সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে রেডিওর স্বমহিমায় উপস্থিতি! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, ফোনের এক কোণে তার স্থান হয়েছে। এককালে যা ছিল শৌখিনতা এবং ঐতিহ্যের প্রতীক, অভিজাত গৃহশোভা, আজ কেবলই স্মৃতি আর ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা। তবে একজন সংগ্রাহক হিসেবে এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, যে আজও সংগ্রাহক এবং সঙ্গীত-রসিক মহলে বেতারের গুরুত্ব অপরিসীম এবং তাঁদেরই যত্নে পুরনো বেতার বেঁচে আছে ১৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
সেই নস্টালজিয়ার নব ঘুরিয়ে আজ টিউন করব হারিয়ে যাওয়া সময়ের রেডিও স্টেশন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে গুগলিএলমো মার্কনি রেডিও নামক যন্ত্রটি তৈরি করলেও এর নেপথ্যে ছিল বিগত আরও এক দশকের গবেষণা ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের অবদান এবং বেতার তরঙ্গের আবিষ্কার। ১৯০০ সালের ২৩ ডিসেম্বর, কানাডার বৈজ্ঞানিক রেজিনাল্ড এ. ফেসেনডেনই প্রথম কোনও বৈদ্যুতিক তার ছাড়াই বেতার তরঙ্গের গতিবিধি সফল ভাবে পরীক্ষা করে দেখান এবং তার ছ’বছর পর ১৯০৬ সালের বড়দিনে ইনিই পৃথিবীর প্রথম রেডিও ব্রডকাস্ট করেন।
[the_ad id=”266919″]
তবে এঁদেরও পূর্বসূরি ছিলেন নিকোলা টেসলা, যিনি ১৮৯৮ সালে একটি ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার নিয়ে এই পরীক্ষা করেন। তারও আগে ১৮৯৪ সালের নভেম্বরে কলকাতা শহরে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু সফল ভাবে বেতার তরঙ্গের পরীক্ষা করেন এবং স্বীকৃতি পান। কিন্তু এই আবিষ্কারের কোনও ব্যবহারিক প্রচলনের কথা তিনি ভাবেননি। ফলে প্রথম বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেও আবিষ্কারকের তকমা তাঁর কাছে অধরাই থেকে গিয়েছে। তবে দীর্ঘদিনব্যপী এই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বেতার তরঙ্গ সংক্রান্ত সমস্ত রকম যন্ত্রপাতি একত্রিত হয়ে শেষমেশ যে ম্যাজিক বাক্সের আগমন হয়, তারই নামকরণ হয় ‘রেডিও’।

গোড়ার দিকে রেডিওতে মূলত শর্ট-ওয়েভ (SW), মিডিয়াম-ওয়েভ (Amplitude Modulation – AM / MW) এবং লং-ওয়েভ (LW)-এর মাধ্যমেই অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। যুদ্ধ বা মিলিটারি কার্যকলাপের জন্যেও রেডিওর যে ব্যবহার ছিল বা আছে, সেই সব কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) সাধারণ রেডিওযন্ত্রের নাগালের বাইরে। মিডিয়াম-ওয়েভ-এর মাধ্যমে নিজের দেশের এবং শর্ট-ওয়েভের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর কণ্ঠস্বর ভেসে উঠত আমাদের বসবার ঘরের রেডিও সেটে। বাড়িতে বসেই সারা বিশ্বের খবরাখবর পাওয়ার এই প্রথম বন্দোবস্ত! ক্রমে রেডিও নামক এই অভিনব, অত্যাশ্চর্য যন্ত্রটি হয়ে উঠল অভিজাত শ্রেণির ‘অপরিহার্য বিলাসিতা’ ও বিনোদনের অঙ্গ। ইংল্যান্ড, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে প্রায় সমস্ত দেশই মেতে উঠল রেডিও তরঙ্গে!

সেই সঙ্গে সুদৃশ্য হতে লাগল রেডিওর আকৃতি এবং অঙ্গশয্যা। একেবারে গোড়ার দিকে ধাতুর তৈরি বাক্সের মতো নেহাতই যান্ত্রিক অবয়ব হলেও ক্রমেই রেডিও সেজে উঠলো শৈল্পিক মহিমায়। কাঠের সুসজ্জিত ক্যাবিনেটের ওপর কারুকার্য, প্রস্তুতকারক কোম্পানির চিহ্ন বা বাহারি লোগো, কাচের ডায়াল এবং চালনা করবার জন্যে নানারকমের নব। ডায়াল ল্যাম্পের আলো জ্বলে উঠলেই এক অদ্ভুত আনন্দ! এ যেন ম্যাজিক! অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর আওয়াজের মাধ্যমে রেডিও জানান দেবে সে প্রস্তুত… আর তার পরেই নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মনমতো স্টেশনে টিউন করলেই বেজে উঠবে নানা সুর বা মানুষের গলা! নিজের দেশ হোক বা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের!

গত শতকের বিশের দশকে রেডিওর আকার অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আসবাবের মতন – যাকে ‘কনসোল রেডিও’ বলা হত। সেই সঙ্গে ছিল টেবলটপ বা পোর্টেবল রেডিও। অন্য দিকে, যখন চাবি দেওয়া গ্রামোফোন থেকে ইলেকট্রিকাল টার্নটেবল ও রেকর্ড প্লেয়ার আসছে, সেই ব্যবস্থা রেডিওর সঙ্গে জুড়ে হয়ে গেল ‘রেডিওগ্রাম’ – একদিকে রেডিও, আর একদিকে রেকর্ড চালানোর ব্যবস্থা এবং সঙ্গে ভারী স্পিকার। এই কনসোল রেডিও এবং রেডিওগ্রাম ছিল অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানার শোভা!

সারা বিশ্বে তখন অগণিত সংস্থা রেডিও তৈরি করতে শুরু করেছে, যাদের মধ্যে কিছু নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। ইংল্যান্ডের মার্কনিফোন (মার্কনি এবং এইচএমভি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগ), বুশ, মারফি, একো, কসর, ফেরান্তি, মুলার্ড, পাই… হল্যান্ডের ফিলিপস… জার্মানির গ্রান্ডিগ, টেলিফাংকেন, সিমেন্স, ব্রন… আমেরিকায় RCA (রেডিও কর্পোরেশন অফ আমেরিকা), ফিলকো, স্টুয়ার্ট-ওয়ার্নার, জ়িনিথ, ওয়েস্টিংহাউজ়, জিই, মোটোরোলা, অ্যাডমিরাল, অ্যাটওয়াটার-কেন্ট ইত্যাদি। ক্রমে রেডিও অভিজাতের বৈঠকখানা ছাড়িয়ে এসে পড়ল মধ্যবিত্তের নাগালের আওতায়। তবে সেটা কিন্তু বিদেশের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর নিরিখে। ভারতে অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণীর প্রবর্তন হয় ১৯৩৬ নাগাদ। চারের দশক থেকে সাতের দশকেও এ দেশে রেডিও ছিল একটি অত্যন্ত দামি যন্ত্র, সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে।
[the_ad id=”270084″]
রেডিওর যান্ত্রিক দিকটার গপ্পো বলতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, ছয়ের দশক পর্যন্ত রেডিও কিন্তু ভালভ-সিস্টেমেই চলত। ইলেকট্রনিক্সে ভালভ-সেটের নির্ভরযোগ্যতা, প্রায় প্রবাদপ্রতিম! ভালভ নির্মিত রেডিও সেটের আওয়াজও ছিল অসম্ভব ভালো। ভালভ গরম হতে সময় লাগত কয়েক সেকেন্ড আর তারপর আস্তে আস্তে খোলতাই হতো আওয়াজের মেজাজ। আর গাঢ় সবুজ ম্যাজিক আই ভালভে বোঝা যেত স্টেশন ঠিকঠাক টিউন হয়েছে কিনা!

ট্রানজ়িস্টর টেকনোলজি এল পাঁচের দশকের মাঝামাঝি, এবং পোর্টেবল ট্রানজ়িস্টর রেডিওর রমরমা ছয়ের দশক থেকে। আর এই ট্রানজ়িস্টর এসেই রেডিওকে অন্দর থেকে নিয়ে এল বাইরে… পার্টি, পিকনিক থেকে খেলার মাঠে !
আজকের দিনে রেডিও বলতে অবশ্য আমরা বোঝাই মূলত এফএম-কে (FM- Frequency Modulation), যার আবিষ্কর্তা মার্কিন বৈজ্ঞানিক এডউইন আর্মস্ট্রং। ১৯৩০-এর শেষ দিকে আমেরিকায় এফ এম তরঙ্গে সম্প্রচার শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই চলে আসে ইউরোপে। তবে ভারতবর্ষে ১৯৭২ সালে প্রথম এফ এম এলেও, এর প্রকৃত প্রচলন হয় অনেক পরে – ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে, অর্থাৎ আবিষ্কারের প্রায় ৫০ বছর পর! এবং এফ এম চ্যানেলগুলি জনপ্রিয় হয় একুশ শতকে পৌঁছে!

সেই পাঁচের দশক, বা সেই সময়ের এফএম-ওলা ভালভ রেডিও সেট এবং সাত বা আটের দশকের জাপানি এফএম টিউনার আজকের দিনে সংগ্রাহক এবং সংগীতপ্রেমীদের অত্যন্ত কাঙ্খিত বস্তু! বিশেষ করে ভালভের এফএম রেডিও সেট। কলকাতায় এবং ভারতে এই রেডিও দুষ্প্রাপ্য।

একইরকম দুষ্প্রাপ্য সেই যুগের রেডিও ম্যাগাজিন, যা আকাশবাণী এবং আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হত। রেডিওর প্রথম যুগে বাড়িতে রেডিও রাখতে হলে লাইসেন্সের প্রয়োজন হত… সেই দলিলও আজ সংগ্রহ-বস্তু!
[the_ad id=”266918″]
ভারতের নিরিখে বলা যায়, রেডিও যন্ত্র হিসেবে ক্রম-অবলুপ্তির পথে এগিয়েছে। বাড়ির এককোণে ধুলোমাখা অবস্থায় পড়ে থেকে থেকে ক্রমে অবাঞ্ছিত, অবহেলিত এবং তারপর বিকল হয়ে হারিয়ে গিয়েছে কালের গহ্বরে বা হাত বদল হয়ে চলে গিয়েছে শহর বা দেশের বাইরে। আত্মবিস্মৃত বাঙালি তথা ভারতীয়রা মেতে উঠেছি নতুন খেলনা মোবাইল ফোন নিয়ে। অথচ ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ইউরোপের বহু দেশে গড়ে উঠেছে অনেক সংস্থা এবং জাদুঘর, যারা পুরনো ঐতিহ্যবাহী রেডিও সংরক্ষণ এবং সংগ্রহ নিয়ে নিয়মিত কাজ করছে। আছেন অসংখ্য সংগ্রাহক, যাঁদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়! আজও তাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন শতাব্দী-প্রাচীন অনেক রেডিও সেট।
[the_ad id=”270085″]
বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ব্রিটেন এর ‘বিভিডাব্লিউএস’ (BVWS) – British Vintage Wireless Society। এদের উদেশ্য হল সারা বিশ্বের রেডিওপ্রেমীদের একত্রিত করা। নিয়মিত রেডিও এবং ওয়্যারলেস যন্ত্রের নিলাম করে এরা। প্রতিবছর ‘এনভিসিএফ’ (NVCF) – National Vintage Communications Fair নামে সংগ্রাহকদের জন্য বেতার-যন্ত্রের একটি মেলার আয়োজন করে। সেখানে বিক্রির পাশাপাশি চলে থাকে ‘Swap-Meet’, অর্থাৎ সংগ্রাহকরা নিজেদের মধ্যে জিনিস বিনিময়ও করে থাকেন! এক বিশাল চত্বরে অসংখ্য স্টল। বিভিন্ন সময়ের রেডিও, টেলিফোন, গ্রামোফোন, রেকর্ড-প্লেয়ার, টেপ-রেকর্ডার থেকে শুরু করে সেই সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, ভালভ, স্পেয়ার-পার্টস, বই, ক্যাটালগ, ইত্যাদি যাবতীয় জিনিসপত্র। সে এক অন্য জগৎ, স্বপ্নের মতো! ন্যায্য মূল্যে পেতে পারবেন প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন যন্ত্র… ঝকঝকে, ব্যবহারযোগ্য অবস্থায়! এ ভাবেই এরা অতীতকে ধরে রেখেছে বর্তমানে, ভবিষ্যতের জন্যে। এটাই কালের বিবর্তনে সভ্যতার মূল সুর। পুরনোকে নস্যাৎ করে নয়। Radiomuseum বলে একটি ওয়েবসাইটও আছে, যেখানে পাওয়া যায় অনেক মূল্যবান তথ্য। এক ক্লিকেই বেতার-জগৎ হাতের মুঠোয়!

আমাদের কলকাতা শহরেও আছেন কিছু সংগ্রাহক যাঁরা সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন রেডিওকে। এখনও সগৌরবে বেজে চলেছে ১৯৪৭ সালের রেডিও, এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেকার (১৯৩৯) সময়ের রেডিওসেট-ও! কে জানে, হয়তো এর থেকেও আরও প্রাচীন যন্ত্র, এখনো জীবিত আছে! তবে এসব মানুষ সংখ্যায় হাতেগোনা, কারণ এই শখ বা প্রয়াস চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। তার মূল দু’টি কারণ হল, পুরনো রেডিও মেরামত করবার দক্ষ কারিগর এবং রেডিওর যন্ত্রপাতি – এই দু’য়ের অভাব।

বিগত এক দশকে বন্ধ হয়ে গেছে কলকাতা শহরের অনেক পুরনো দোকান, যেখানে রেডিও সংক্রান্ত অনেক দুষ্প্রাপ্য যন্ত্রাংশ এবং ভালভ পাওয়া যেত। এর মধ্যে উল্লেখ্য ডালহৌসি চত্বরে ‘নান কোম্পানি’ যা ২০১১ সালে বন্ধ হয়ে যায়। পুরনো দিনের অভিজাত প্রতিষ্ঠান – কাঠের শো’কেসে রাখা থাকত আদ্যিকালের অজস্র রেডিও ভালভ, IF (Intermediate-Frequency) Coil, গ্রামোফোনের বিলিতি HMV পিনের প্যাকেট, এবং বহু মূল্যবান যন্ত্রাংশ, যা আজকের দিনে দুষ্প্রাপ্য। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ওই দোকানে বহুবার গেছি এবং প্রায় প্রতিবারই, সে যুগের রেডিও, গ্রামোফোন এবং ক্যামেরা সংক্রান্ত দরকারি এবং শখের জিনিসপত্র কিনে ফিরেছি।
চাঁদনি চত্বরেও ছিল অনেক পুরনো দোকান যেখানে রেডিওর যন্ত্রাংশ পাওয়া যেত, যেমন ‘রেডিও প্রডাক্টস সাপ্লাই স্টোর্স’, ‘জিৎ ইলেকট্রনিক্স’-এর মতো দোকান। এই সমস্ত দোকান বোঝাই থাকত যাকে বলা হয় – NOS (New Old Stock) – অর্থাৎ পুরনো আমলের অব্যবহৃত সামগ্রিতে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা এসে সেসব কিনে নিয়ে যেতেন রেডিও Restoration বা পুনরুদ্ধারের জন্যে। আজ পুরোটাই শুধু স্মৃতি।

প্রযুক্তির গুঁতো খেয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অনেক সৌন্দর্য্য হারিয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে রেডিও অন্যতম! নিজস্ব, স্বাধীন উপস্থিতি থেকে ক্যাসেটের যুগে টু-ইন-ওয়ান, সিডির সঙ্গে মিলে থ্রি-ইন-ওয়ান আর তারপর মুঠোফোনের এক কোণায় স্থান হয়েছে রেডিওর। তবে একশো বছর পরেও কিন্তু রেডিও বেঁচে আছে তার মূল সুরটি নিয়ে, অর্থাৎ ব্রডকাস্টিংয়ের মজা… আজ এফএম-এ অনর্গল কথা এবং অজস্র বিজ্ঞাপনের মাঝে ক্লান্ত হয়েও অপেক্ষা থাকে – কখন একটি পছন্দের গান বেজে উঠবে! অথবা মিডিয়াম ওয়েভে টিউন করে আকাশবাণীর খবর শোনা কিংবা রাত্রিকালীন সংগীতানুষ্ঠান!
আর মহালয়া শোনার অপার্থিব আনন্দ কি কেউ কোনওদিন ভুলতে পারবে?!
[the_ad id=”270086″]
বাঙালির সাত রাজার ধন এক মাণিক, সত্যজিৎ রায় রেডিওতে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বুলবুল সরকার সঞ্চালিত রেডিও কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেন যার বিষয় ছিল, ‘The Music I live by’। সেখানে উনি নিজের সাংগীতিক পছন্দ নিয়ে আলোকপাত করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের অনেক বাজনাও শুনিয়েছিলেন গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ‘Mozart & I’ এবং ‘What Beethoven means to me’ নামক রেডিও অনুষ্ঠান করেন। এরকম আরও অসংখ্য মণিমাণিক্য ছড়িয়েছিল সে যুগের রেডিওর পরতে পরতে, যা আজ হাজার খুঁজেও হয়তো মিলবে না।
তাই আমাদের অনেকের কাছেই রেডিও – যন্ত্রের গন্ডি পেরিয়ে, স্মৃতি, অনুভূতি, জীবনের অঙ্গ। ইতিহাস ও হারিয়ে যাওয়া সময়ের সঙ্গে যোগাযোগ ও বর্তমানের সঙ্গে অতীতের মেলবন্ধন। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ভিন্টেজ গাড়ির যৌক্তিকতা যেমন আর মাইলেজ দিয়ে বিচার হয় না, তার ব্যঞ্জনা অন্যত্র, ঠিক তেমনই সেই অতি পুরাতন রেডিও সেটটির আবেদনও হৃদয়ের, ভালোবাসার। রেডিও সেটের আকৃতি এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে তার অবস্থান, ডায়ালের আলো, এবং সর্বোপরি নব ঘুরিয়ে, ঘুরিয়ে স্টেশন খুঁজে টিউন করার আনন্দের কোনও বিকল্প নেই। এই ভালো-লাগা আর টান হল মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের আত্মিক সম্পর্ক ও ‘টিউনিং’য়ের গোড়ার কথা… হাতে হাত রেখে প্রেমের পদ্য লেখার মতো।
আলোকচিত্র-শিল্পী অনির্বাণ মিত্রর ক্যামেরায় ধরা থাকে বনেদি বাড়ির অন্দরমহল, রাজ-ভবন এবং ইংরেজ আমলের কলকাতা। তুলতে ভালোবাসেন পোর্ট্রেটও। দেশ বিদেশের বিখ্যাত গ্যালারিতে একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। বইও প্রকাশিত হয়েছে। নিমাই ঘোষ এবং সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তথ্যচিত্র দিয়ে সেলুলয়েডের যাত্রা শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। তাঁর একটি অনলাইন গ্যালারিও রয়েছে।