সোমাইয়া আখতার: জন্ম ১৯৭৬ এ মুর্শিদাবাদের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম পার-রঘুনাথপুরে । পড়াশোনা গ্রামের স্কুল পেরিয়ে ডোমকলে। কলকাতার কাশীশ্বরী কলেজ থেকে ইতিহাসে সাম্মানিক স্নাতক। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসেই স্নাতকোত্তর। রাবণ প্রকাশনার কর্ণধার। সম্পাদনা করেন আত্মকথার সাময়িকী ‘রাবণ’। প্রান্তজনের কথা, আরও বিশেষ করে বললে প্রান্তিক নারীর জীবন ও আত্মকথনকে লিপিবদ্ধ করতে বা সংরক্ষণ করতে আগ্রহী। সমান্তরাল ইতিহাস সংরক্ষণের এই কাজ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি করে চলেছেন। (Little Magazine)

সম্পাদকীয়
গোবিন্দভোগ চাল জলে ফেললে, যে মৃদু গন্ধ পাওয়া যায়, তা যেন এক মুহূর্তে পৌঁছে দেয় ছোটোবেলার দিনগুলোয়। বাড়িতে প্রায়ই অনুষ্ঠান লেগে থাকত আর সেই সূত্র ধরে পোলাও-কোর্মা রান্না চলত। ছোটোদাদার (ঠাকুর্দা) ভিতর উঠোনের বড় উনুনে বিশাল হান্ডায় রাঁধুনিপাগল কিংবা গোবিন্দভোগ চালের ঘিয়ে ভেজে সাদা থেকে হালকা বাদামি হয়ে ওঠার সময়কার গন্ধ নাকে এসে লাগে। গন্ধ স্মৃতিকে যেমন জাগিয়ে তোলে, ঠিক তেমনি বোধহয় স্মৃতিও গন্ধকে জাগিয়ে তোলে। বিশ্বদীপ দে-র লেখায় কমলাগাভীর কথা পড়তে পড়তে, গোয়ালঘরের গন্ধ যেন নাকে এসে লাগল। আবার স্মৃতি যে সবসময় পিছন দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, তা-ও নয়। একসময়ের দাপুটে সাংবাদিক, ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক স্বপ্না দেবের স্মৃতি তাঁর সেই প্রতিক্ষণ-এর শুরুর দিন থেকে পরের দিকের কথা, পূর্ণেন্দু পত্রী, ভবতোষ দত্ত, অরুণ সেন, প্রিয়ব্রত দেব— এক আলো ঝলমল প্রতিক্ষণ-এর গল্প ‘রাবণ’ পত্রিকার সম্পাদককে এগিয়ে যেতে খানিকটা স্বপ্ন দেখায় বই কি!
এই সংখ্যায় স্বপ্না দেবের মতো ছুঁদে সাংবাদিকের পাশাপাশি এই সময়ের তরুণ সাংবাদিক বিশ্বদীপ দে-র স্মৃতিকথা রয়েছে। যদিও স্বপ্না দেব ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু বলেননি, যা কিছু স্মৃতি তাঁর প্রতিক্ষণ-কে ঘিরে। আর এই দুই সাংবাদিকের মধ্যবর্তী সময়ের আর এক সাংবাদিক কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত, যিনি প্রথম জীবনে বর্তমান-এ সাংবাদিকতা করেছেন পরবর্তীকালে তিনি আকাশবাণীর সহকারী কেন্দ্র অধিকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। কৃষ্ণ শবরী যখন বলেন, খুব গরম পড়লে বালিশ বগলে করে শুতে যেতেন বাড়ির নীচের পরিত্যক্ত ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরগুলোয়। একুশ ইঞ্চির মোটা নোনাধরা দেওয়ালের বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখিয়ে তাঁর ঠাকুমা বলতেন, ‘এইসব পূর্বপুরুষের
চোখের জল।’ হতাশা, ব্যর্থতা আর বঞ্চনার গল্প সব…। খোদ কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির ইংলিশ মিডিয়াম মেয়ের স্মৃতি কখন যেন মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামের নিতান্ত এক সাধারণ পরিবারের, সাধারণ স্কুলে পড়া মেয়ের স্মৃতিতে মিশে যায়— এভাবেই একজনের গল্প অন্যের হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিভাবকের নিদারুণ অবহেলার কথা, পুরুষতান্ত্রিক কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠার কথা, লিঙ্গ-বৈষম্যের কথা অকপটে বলে গেছেন। অপর্ণায় লেখায় উঠে এসেছে বয়ঃসন্ধিকালের নানা অসহায়তার কথা। এ গল্প আমাদের প্রায় সকলের। বয়ঃসন্ধিকালে বয়স্ক পুরুষের দ্বারা যৌন হয়রানি হয়নি, এমন নারী বোধহয় কমই আছে। রিনি গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবাকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি কখন যেন, ব্যক্তিগত সীমা অতিক্রম করে সেই সময়কে ধরে ফেলে। তাঁর বাবা সত্তরের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় পুলিশের অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হন। রিনি তাঁর বাবাকে নিয়ে মোট আঠারোটি পর্ব লিখেছেন। এসংখ্যায় দশটি পর্ব রাখা হল। জিনাত রেহানা ইসলামের লেখায় উঠে এসেছে ধর্মীয় বিভেদ, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা আর অবমাননার কথা।

গীতা মাইতি আর রাঙা নায়েক— এই দু’জন অক্ষরের জগতের বাইরের মানুষ। তাঁদের জীবনের নানা ওঠাপড়ার কথা, নিজের পায়ের নীচে শক্ত জমি তৈরির কথা তাঁদের কথা তাঁদেরই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ করেছেন অমিতা পট্টনায়ক। গীতা মাইতির এই লেখাটি মানুষকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ফেলে দেয়। তাঁর মৃত ছেলেকে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা রীতিমতো রোমহর্ষক। তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর ছেলে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও রয়েছে, স্মৃতি হারিয়ে। গুণিনের কথায় বিশ্বাস রেখে আজও তিনি পথ চেয়ে আছেন— জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের এক ধূসর এলাকা। সেখানে প্রবেশ করলে থই মেলে না।
সবশেষে আসি পত্রিকার প্রথম বিভাগ পুনর্মুদ্রণ বিভাগে। বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ও প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের বাবা প্রকাশচন্দ্র তাঁর স্ত্রী অঘোরকামিনী দেবীর অকাল প্রয়াণের পরে এক আশ্চর্য স্মৃতিকথা লেখেন। ‘অঘোর-প্রকাশ” নামে রচিত সেই গ্রন্থটি ‘আশ্চর্য এই কারণেই যে, গোটা বইটি লিখিত হয়েছিল স্ত্রীকে সম্বোধন করে দ্বিতীয় বা মধ্যম পুরুষে। গোঁড়া ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী প্রকাশ্চন্দ্র এই বইতে উন্মুক্ত ভাবেই তাঁর দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেছলেন। কেশবচন্দ্র সেন রচিত ব্রাহ্ম সমাজের সর্বজনীন পথ-নির্দেশিকা
‘নবসংহিতা’-র বিধান অনুযায়ী তাঁরা দাম্পত্যজীবন যাপন করতেন। স্বপাক
আহার ও অন্যান্য নানা কৃচ্ছ্রতা তাঁরা মেনে চলতেন। ‘ভালোবাসা’ সম্পর্কে এক রকমের দেহাতীত অনুভূতির ধারণা প্রকাশচন্দ্র পোষণ করতেন। গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি যৌনানুভূতিকে ‘পশুত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং পরলোকে ভালোবাসাকে স্থায়ী করার জন্য এমন মন্তব্য করছেন— ‘শরীরের সম্বন্ধ ত্যাগ না করিলে ভালবাসা স্থায়ী হয় কি না তাহা কিরূপে বুঝিবে? এখন আমাদের সম্মুখের অবস্থায় চক্ষের ভালবাসা থাকিবে। তারপর দৃষ্টি যখন থাকিবে না তখন কেবল আত্মার ভালবাসা থাকিবে।’ বলাই বাহুল্য এক ধরনের ট্রান্সেন্ডেন্টাল লাভ’-এ এমন বিশ্বাস একান্ত ভাবেই ভিক্টোরীয় নৈতিকতা ও সেখান থেকে জাত দাম্পত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রাহ্ম সমাজের নৈতিক নির্দেশনার পাশাপাশি যৌনতার বোধকে ‘পশুত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করার মধ্যে কোথাও কি গর্ব অনুভব করেছিলেন প্রকাশচন্দ্র বা তা তাঁর মতো অন্যান্য পুরুষরাও ? মনে রাখতে হবে এই স্মৃতিকথা প্রকাশচন্দ্রের লেখা। অঘোরকামিনী এ নিয়ে কী ভাবতেন, তা জানার কোনো উপায় নেই। কারণ এই স্মৃতিকথায় তাঁর যে পরিচয়টুকু পাওয়া যায়, তা একান্ত ভাবেই তাঁর স্বামীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অঘোরকামিনী মারা যান। তত দিনে তিনি ছয় সন্তানের জননী। কাজেই দাম্পত্য ও শরীরী প্রেম নিয়ে তাঁর বক্তব্য কী ছিল, তা জানা যাবে না কোনোদিনই।
সোমাইয়া আখতার
ফেব্রুয়ারি, ২০২২
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।