ছোট পত্রিকার জন্ম হয়, মৃত্যু হয়। একসময় সম্পাদকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছোট পত্রিকায় লিখলে প্রতিবাদী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখলে সুযোগসন্ধানী। আবার, রাজনৈতিক চেতনায় গড়ে ওঠা পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হলেই সে রাজনৈতিক ক্ষমতালোভী। এই মিথ ভেঙে পাকা ফসলের খেত থেকে ভেসে ওঠে আগুনরঙা ‘মানুষের মুখ’। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Birendra Chattopadhyay) এক মিশ্র সাম্রাজ্য ভাঙতে গিয়ে গড়েছেন তারুণ্যের নিজস্ব চেরাইকল, যেখানে চিরে ফেলা যায় ‘দেশ’, ‘রাষ্ট্র’ এবং দুটির মধ্যের পার্থক্য।
শতবর্ষ পার করলেন মানুষের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
‘একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।’
১৯৪৪ সালে দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠান ঢাকুরিয়া ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনে কর্মজীবন শুরু করার কয়েকবছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন তিনি। এই অবস্থায় ‘ক্রান্তি’ এবং ‘গণবার্তা’য় কাজ শুরু হয়। প্রুফ সংশোধন করেই চলত সংসার। এরপরেই চাকরি পান ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায়। চাকরি পেলেও বেকারত্ব ঘোচেনি তাঁর। মাস শেষে মাইনে আসে না। বেকারত্বের পথ গিয়ে মিশে যায় রেসের মাঠে। ১৯৫২ সালে চায়ের ব্যবসার কাজে যোগ দেন। পূর্ববঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে এসে যোগ দেন পারিবারিক ব্যবসায়। ব্যবসার রীতিনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা না থাকার কারণে তিনি তাঁর প্রাপ্য অংশটুকুও পেতেন না।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডাক নাম ছিল তুরতুরি। লেখার খাতা থেকে চশমা, ভুলে যেতেন প্রায় সবকিছুই। কিন্তু তাঁর উদ্বাস্তু বুক থেকে শব্দের দীর্ঘশ্বাস বেরোতে ভুল হয়নি।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডাক নাম ছিল তুরতুরি। লেখার খাতা থেকে চশমা, ভুলে যেতেন প্রায় সবকিছুই। কিন্তু তাঁর উদ্বাস্তু বুক থেকে শব্দের দীর্ঘশ্বাস বেরোতে ভুল হয়নি। রাজনৈতিক আদর্শে বেড়ে ওঠা পত্রিকা ছাড়াও ‘কবিতা’, ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’ প্রভৃতি পত্রিকায় গেছেন নিয়মিত।
তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথের গ্রাফ ছিল মুক্তিকামী ও প্রগতির পথে উর্দ্ধমুখী। প্রথমে অনুশীলন দলে যোগদান করেন। আদ্যপান্ত বাঙাল হওয়ার কারণে, দলের এক নেতার মুখে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য শুনে দলত্যাগ করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী কর্মকান্ডে। নিজস্ব আদর্শে বেঁচেছেন আজীবন। ব্যক্তিস্বাধীনতায় তাঁর অটল বিশ্বাস ছিল। খাদ্য আন্দোলন থেকে নাট্য নিয়ন্ত্রণবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এমনকি জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁর প্রতিবাদী মেজাজ ছিল তুঙ্গে। এইসময় ক্ষমতার প্রতি শ্লেষ ও পোস্টারধর্মী কবিতা থেকে ইস্তেহার পাঠাতেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯৬৭ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করার কারণে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও জেলে যান। নকশালদের হত্যা করার বিরুদ্ধেও লিখেছিলেন প্রচুর কবিতা। তাঁর সম্পাদিত ‘ব্রাত্য পদাবলী’ নামে কাব্য সংকলনটি সাড়া ফেলেছিল পাঠক মহলে।
স্বাধীনতা : দু-বাংলার বিচ্ছেদের দ্যোতক যখন পাসপোর্ট-ভিসা
‘দেশ’ পত্রিকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। একসময় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সমালোচনা করেন প্রকাশ্যে। কবিতাও প্রকাশিত হয় ‘নীরেন তোমার ন্যংটো রাজা’ নামে। পরবর্তীতে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধেই কবিতা লিখেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়।
আমার কবিতা কোনওদিনই চল্লিশের প্রগতিশীল কবিতা বা কবিদের কাছ থেকে অন্ন বা জল আহরণ করেনি। বরং আমি নিজের কবিতাকে যতটা বুঝি, আমার কবিতার শিকড় অন্যখানে।
বিষ্ণু দে ও বুদ্ধদেব বসু’কে পেয়েছিলেন কলেজের শিক্ষক হিসেবে। কবিতাই ছিল তাঁর কাছে মুক্তির পথ। মনে করতেন, সংস্কৃতির মাধ্যমে বিপ্লব আনা সম্ভব। চল্লিশের দশকের প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বিরোধিতা না করলেও তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমার কবিতা কোনওদিনই চল্লিশের প্রগতিশীল কবিতা বা কবিদের কাছ থেকে অন্ন বা জল আহরণ করেনি। বরং আমি নিজের কবিতাকে যতটা বুঝি, আমার কবিতার শিকড় অন্যখানে। সেখানে আজও যাঁরা জলসিঞ্চন করছেন তাঁরা সবাই দলছুট একক কবি – যেমন জীবনানন্দ, তারপর নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ।’ জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা হলে জীবনানন্দ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, গুণ্ডা দিয়ে তাঁর বাড়ি থেকে ভাড়াটে তুলে দেওয়ার কথা। উত্তরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘তারপর সেই গুণ্ডা যদি আপনাকেও তুলে দেয়?’
সত্তরের উত্তাল দশকের আয়না হয়ে উঠেছে তাঁর লেখা। কেবলই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর? না, আসলে তিনি ছিলেন প্রতিবাদীর নামে মুখোশ খুলে দেওয়ার উচ্চাঙ্গ গণসঙ্গীত।
আজ ২ সেপ্টেম্বর, কবির জন্মদিন…
অলংকরণ : আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
তথ্যসূত্রঃ
১) ‘সোঁতা’ পত্রিকা ২০০১ বইমেলা সংখ্যা (তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার)
২) মিত্রা ঘোষ চট্টোপাধ্যায় -এর লেখা ‘বাবা’ (প্রকাশিত চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম)

অরিন চক্রবর্তী
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।