“মুসাফির হু ইয়ারোঁ
না ঘর হ্যায় না ঠিকানা
মুঝে চলতে যানা হ্যায়
বাস চলতে যানা…”
তাঁকে নিয়ে গুলজার বলেছিলেন, “আর ডি যত ভালো সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন ততটাই ভালো একজন কারিগর।”
তিনি, আর ডি বর্মন(R D Burman)। তাঁর সুরে উপোরোক্ত গানটি গেয়েছিলেন, কিশোর কুমার। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘পরিচয়’, এক মিউজিক্যাল হিট মুভি। সঙ্গীত পরিচালনায় সেই রাহুল দেব বর্মন। যদিও এর আগে ‘তিসরি মঞ্জিল’ সিনেমায় রাহুল দেব বর্মন ছাপ ফেলেছিলেন নিজস্ব শৈল্পিক চেতনার, সঙ্গীতের নতুন ভাষার। আশা ভোঁসলে ও মহম্মদ রফির গলায় গাওয়া গানগুলি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় সেসময়। ‘ওহ হাসিনা জুলফো ওয়ালি’, ‘ও মেরে সোনা রে সোনা’ তখন বাজার কাঁপাচ্ছে রীতিমতো। খুঁটিয়ে দেখলে এই সুর মূলত ‘পপ রক’ স্টাইলের। সিনেমার পরিচালক বিজয় আনন্দ, প্রযোজক নাসির হুসেন এবং শাম্মী কাপুর রাহুল দেব বর্মন-এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

‘তিসরি মঞ্জিল’ রিলিজের আগে পর্যন্ত বাবা শচীন দেব বর্মনের সহকারী হিসাবে কাজ করতেন রাহুল দেব বর্মন। মূলত বাবার হাত ধরেই সুরের হাতেখড়ি। এই সময়ে অবশ্য নিজেও কিছু সুর তৈরি করেছেন। যার মধ্যে ‘অ্যাই মেরি টুপি পালট কে আ’, ‘সার জো তেরা চক্রায়ে’ অন্যতম এবং জনপ্রিয়। এরপর থেকেই সুরের জগতে ওঠে এক অদম্য ঢেউ। এই একটি মানুষ প্রায় একা হাতে বদলে দেন প্লেব্যাক সুরের মানচিত্র। এক লক্ষণীয় বিষয় নজরে আসে, সঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে হিন্দি সিনেমা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাহুল দেব বর্মনের সুরে।
আর ডি বর্মন ওরফে পঞ্চম। ছোটোবেলায় তিনি নাকি সুরের পঞ্চম ধ্বনি(‘পা’)ধরে কাঁদতেন, তাই পরিবার তাঁর এই নাম দিয়েছিল। যদিও, ভিন্নমতে বলা হয় অভিনেতা অশোক কুমার করেছিলেন নামকরণ। অন্য একটি নাম ছিল তাঁর ‘টুবলু’। জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৭ জুন, কলকাতায়, জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মন ও মীরা দেব বর্মনের পুত্র ছিলেন পঞ্চম। পিতামহ ছিলেন ত্রিপুরার রাজা। ত্রিপুরার রাজ পরিবার, সঙ্গীতজ্ঞ বাবা ও মা, বাড়িতে যাতায়াত করা সঙ্গীত জগতের দিগ্গজ ব্যক্তিবর্গ সবকিছুই তাঁর অনুকূলে হলেও, নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে উঠতে সক্ষম ছিলেন তিনি। ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ-এর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকার সলিল চৌধুরী’কে গুরু বলে মেনেছিলেন আর ডি বর্মন।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সুরের মূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন শ্রোতাদের। ‘ইঁয়াদো কি বারাত’, ‘শোলে’, ‘আপ কি কসম’, ‘হাম কিসিসে কম নেহি’, ‘খুবসুরত’, ‘সানম তেরি কসম’ প্রভৃতি সিনেমার গানগুলি তাঁর সুরের জাদুতে হয়ে উঠেছিল মানুষের নিত্যদিনের ওঠা-বসার সঙ্গী। গানকে তিনি বিনোদনের থেকেও অনেক বেশি জীবনমুখী ও উন্মুক্ত করে তুলেছিলেন। কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, সঙ্গীত জগতের প্রবাদ প্রতিম গায়ক-গায়িকারা তাঁর সুরে গান গেয়ে মানুষের মনে ঢেউ তুলেছিলেন। প্রায় ৩০০টিরও বেশি হিন্দি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেছিলেন আর ডি বর্মন। পাশাপাশি বেশ কিছু বাংলা, তামিল, তেলেগু সিনেমাতেও কাজ রয়েছে তাঁর। মাঝারি মাপের চিত্রনাট্যকেও কেবল সুরের জাদুতে হিট করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র তাঁর। তাঁর পুজোর অ্যালবামের অপেক্ষায় বসে থাকতেন শ্রোতারা।

বলিউডের প্লেব্যাক মিউজিকে যন্ত্র সঙ্গীতের বহুল ব্যবহার, প্রাকৃতিক শব্দের ব্যবহার অথবা হাই নোটের সুর জনপ্রিয়তা পায় তাঁর রাজত্বেই। এমনকি জ্যাজ মিউজিককে বলিউডে ইন্ট্রোডিউস করেন তিনি। পঞ্চম ‘বাহারোঁ কে সপনে’-তে টুইন ট্র্যাক এফেক্ট চালু করেছিলেন। যা পরে তিনি ‘ইজাজাত’ সিনেমার ‘কাতরা কাতরা মিলতি হ্যায়’ এবং আরও বেশ কয়েকটি গানে ব্যবহার করেন ভবিষ্যতে।
অভিনেতা হিসাবে আর ডি বর্মন মেহমুদের ‘ভূত বাংলা’ সিনেমার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন। এই সিনেমায় ‘আও টুইস্ট করে’ গানটি তিনি নিজে কম্পোজ করেছিলেন এলভিস প্রেসলির ‘টুইস্ট ড্যান্স’-এর আদলে।
কোথাও কাচে চামচ ঠোকার শব্দ, কোথাও রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে ক্লাসরুম থেকে ডেস্ক তুলে আনা, অদ্ভুত সব জিনিসকে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন গানে। তাঁর এক্সপেরিমেন্ট চলতে থাকত। একবার বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ পাওয়ার জন্য, বাড়ির বারান্দায় একটি গোটা বৃষ্টির রাত কাটিয়েছিলেন সুর অনুযায়ী শব্দ রেকর্ড করতে।
শোনা যায় পঞ্চম মানুষ হিসেবে অধৈর্য ছিলেন, চা খেতে দিলে গরম চায়ে জল মিশিয়ে নিতেন তাড়াতাড়ি ঠান্ডা করার জন্য। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে যেন হয়ে উঠতেন ধৈর্যের দেবশিশু।
আর ডি বর্মন, ১৬ বার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও ‘সনম তেরি কসম’, ‘মাসুম’, ১৯৪২-এ লাভ স্টোরি মাত্র এই তিনটি ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। ‘১৯৪২-এ লাভ স্টোরি’ সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার আগে তাঁর মৃত্যু হয়। ভেঙে পড়ে সঙ্গীতের আকাশ, সলিল চৌধুরী একটি এলিজি লিখেছিলেন অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে।

আর ডি বর্মন সর্বপ্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতে ব্রাজিলিয়ান বোসা নোভা ছন্দের প্রবর্তন করেন ‘পতি পত্নী’ সিনেমার ‘মার ডালেগা দর্দ-ই-জিগার’ গানে, আশা ভোঁসলে গেয়েছিলেন গানটি। এই ছন্দ পরবর্তীতে চলচ্চিত্র সঙ্গীতের জন্য সীমাহীনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ পপ তারকা বয় জর্জ-এর সঙ্গে আর ডি বর্মন ‘দ্য গ্রুপ’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে গান গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে, বয় জর্জ। এখানে আর ডি বর্মন ব্রাজিলিয়ান সাম্বা বিটে মিউজিক তৈরি করেন, যা থেকে বোঝা যায় তাঁর বিস্তৃত ও বহুমুখী প্রতিভা।
তিনি কি সত্যিই সঙ্গীত জগতের নক্ষত্র? না, নক্ষত্র নন। হয়তো তার থেকেও বেশি কিছু। বিখ্যাত বাবার ছায়া কাটিয়ে হয়ে ওঠা মহীরুহ রাহুল দেব বর্মন প্লেব্যাক মিউজিকের এক স্বর্ণযুগের নাম।
তথ্যসূত্র
১ পঞ্চম অনলাইন ডট কম
২ ইউটিউব ডকুমেন্ট্রি

অরিন চক্রবর্তী
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।