ছবি: চালচিত্র – দ্য ফ্রেম ফাটাল
পরিচালনা: প্রতিম ডি গুপ্ত
অভিনয়: টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, শান্তনু মাহেশ্বরী, রাইমা সেন, ব্রাত্য বসু-সহ এক ঝাঁক অভিনেতা
(Cinema)
পাঁচ বছর পর আবার বাংলা ছবি করলেন প্রতিম ডি গুপ্ত (প্রতিম দাশগুপ্ত)। শেষ ছবি করেছিলেন ২০২০ তে ‘লাভ আজ কাল পরশু’।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁর প্রথম ছবি (পাঁচ অধ্যায়, ২০১২) থেকেই প্রতিম তাঁর ছবির মাধ্যমে দর্শকের মনে কৌতুহল জাগিয়ে রাখতে সফল। তাঁর সব চেয়ে জোরের জায়গা হল টানটান গল্প আর চিত্রনাট্য। বিশেষ করে থ্রিলারে যে তিনি কতটা দক্ষ, তার প্রমাণ তাঁর ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এই দেখা গিয়েছে। (Cinema)
আরও পড়ুন: বহুরূপে সম্মুখে তোমার
তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘চালচিত্র – দ্য ফ্রেম ফাটাল’-এও একই কথা প্রযোজ্য। এ ছবি আবারও প্রমাণ করল যে থ্রিলার প্রতিমের খেলার মাঠ-ময়দান। মূলত ‘কপ ইউনিভার্স’-এ নিমজ্জিত ছবির ‘হুডানইট’ গল্প খানিকটা এরকম: শহর কলকাতায় ঘটে যাচ্ছে একের পর এক রোমহর্ষক তরুণী খুন। সে খুন —যাকে বলে স্পেকট্যাকুলার। তরুণীকে মাথায় রড দিয়ে খুন করে যিশু খ্রীষ্টের মতো দুহাতে পেরেক ঠুকে টাঙিয়ে দেওয়া। পরনে লাল টুকটুকে বেনারসি। (Cinema)

গলায় দুলছে রজনীগন্ধার মালা। রক্ত দিয়ে সিঁথিতে লেপা সিঁদুর। এবং এই পুরো অবয়বের পিছনে খাড়া করা একটি চালচিত্র।
খুন হওয়া তরুণীদের মধ্যে তিনটি ব্যাপার লক্ষণীয়। তারা সবাই অবিবাহিত। একা থাকে এবং মাসকয়েক আগে নিজের বিয়ে তারা নিজেই ভেঙেছে।
খুনের তদন্তের ভার পড়ে আইপিএস কণিষ্ক চট্টোপাধ্যায় (টোটা রায়চৌধুরী) এবং তাঁর টিম —নাসির (অনির্বাণ চক্রবর্তী), রীতেশ কুমার (শান্তনু মাহেশ্বরী) এবং বিশ্ব-র (ইন্দ্রজিৎ বসু) ওপর। (Cinema)
পেঁয়াজের খোসা ছাড়াবার মতো পরতে পরতে খুলতে থাকে জট। যার মধ্যে ধাপে ধাপে মোচড়। এর মধ্যেই আমরা চরিত্রদের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে আছে উত্তর কলকাতার এক যৌনকর্মী জবা (প্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়), এক ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম কর্মী (রাইমা সেন), এক জাঁদরেল মায়ের পিএইচডি করা মেয়ে (স্বস্তিকা দত্ত) যার কাজ হচ্ছে —তাঁর বয়ফ্রেন্ডের কথায় —‘ইন্স্টাগ্রামে রিল বানানো’ এবং স্টেজ ফোর সেরিব্রাল অটপ্সিতে আক্রান্ত পুতুল (তনিকা বসু)। (Cinema)

এই চরিত্রদের সঙ্গে চার পুলিশের সম্পর্ক, যাকে বলে, ক্ষুরধার বাস্তবের মাটিতে গাঁথা। সেখানে নেই কোনও অযথা ঘটনার ঘনঘটা বা আশ্চর্য সব চমক। সম্পর্কগুলিকে এতটা বাস্তব তৈরির ক্ষেত্রে পরিচালকের বাড়তি বাহবা প্রাপ্য।
ছবিতে নেই কোনও তারকা। সবাই মূলত দক্ষ অভিনেতা। যাঁরা অত্যন্ত নিপুণভাবে ছবির গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। (Cinema)
এর মধ্যে একটি ছোট্ট কিন্তু চমকপ্রদ এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন ব্রাত্য বসু। তাঁর মতো শক্তিশালী অভিনেতা বাংলা ছবির জগতে কমই আছেন। এখানেও ওই স্বল্প পরিসরে তিনি তাঁর জাত চিনিয়েছেন। খুবই উপভোগ্য তাঁর স্যর অ্যান্থনি হপকিন্সের (দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস) ছায়া মাড়ানো এই চরিত্র, যা তিনি নিজের দক্ষতায় অন্য মাত্রা দিয়েছেন।(Cinema)
তবে যিনি চমকে দিয়েছেন তিনি তনিকা বসু। মূলত নাটকের অভিনেত্রী বলেই বোধহয় এত শক্তিশালী অভিনয় তাঁর শরীর-মন মারফত প্রকাশ পেয়েছে।
যৌনকর্মী জবার মধ্যে কম হলেও ছায়াপাত করেছে লুই বুনুয়েলের ক্ল্যসিক ছবি ‘বেল দে জুর’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র সেভেরিন। সেভেরিন জীবনে চূড়ান্ত বোর হয়ে যৌনপল্লিতে স্বইচ্ছায় যোগ দেয়। (Cinema)
পুরনো বছরের নতুন ফেলুদা– ফেলুদা ফেরত রিভিউ
এ ছবিতে জবা তাঁর কাজকে ভালোবাসে এবং কোনও পরিস্থিতিতেই এই কাজ ছাড়তে চায় না। কোনওরকম ‘বেচারী ভিক্টিম’ মনোভাবের বদলে প্রতিমের এই মুক্ত নারীমনের উদযাপন এক ঝলক তাজা প্রাণবায়ুর মতো। প্রতিমের এই চরিত্রায়ণ আমরা তাঁর ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়-অভিনীত চরিত্রেও দেখেছিলাম। (Cinema)
‘চালচিত্র’ শব্দবন্ধের মধ্যেই এসে পড়ে দুর্গার অনুসঙ্গ। ছবিতে খলনায়ক (জিয়াউল ফারুক অপূর্ব) প্রায় মহিষাসুরের মতোই শক্তিশালী এবং ক্ষুরধার। কথায় বলে অসুর যত বলশালী হবে, মা দুর্গার শক্তির প্রকাশ তত তীব্র হবে। এখানে খলনায়ককে বুদ্ধি-মেধায় অতি শক্তিশালী করেছেন প্রতিম। যে প্রায় জিতেই যাচ্ছিল। ছবিতে এই হার-জিতের ব্যলেন্সের খেলা জম্পেশ। (Cinema)
ছবির টানটান চিত্রনাট্যেকে যোগ্য সঙ্গত করেছে অত্যন্ত স্মার্ট ক্যামেরার ফ্রেম এবং চোখা কিন্তু খুব স্বাভাবিক সংলাপ। ঝাঁ-চকচকে মহানগরী কলকাতাকে কবে বড় পর্দায় এত সুন্দর দেখেছি মনে পড়ে না।
তবে সব থেকে যেটা ভাল লাগে তা হল প্রত্যেক চরিত্রের এক সামগ্রিক মানবতাবোধ যা ছবির ভরকেন্দ্র। (Cinema)
রিভিউ: রাজা রবি বর্মা: দুজন পরিচালক, দুটি ছবি
থ্রিলারের সাফল্য অনেকটা নির্ভর করে ছবির সম্পাদকের ওপর। এখানে বলতেই হয় অন্তরা লাহিড়ী দারুণ কাজ করেছেন। দেবজ্যোতি মিশ্রর সঙ্গীত পরিচালনায় ঊষা উথুপের গাওয়া ‘জানি না মানে’ ছবি মুক্তির আগেই হিট করেছিল। ছবির বাকি সমগ্র সঙ্গীতও ভাল।
‘চালচিত্র’কে বলা হচ্ছে ‘নিঃশব্দ সুপারহিট’। এই বাক্যবন্ধকে সেলাম জানিয়েই বুঝি পরিচালক ছবির সিক্যোয়েল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন! (Cinema)
সাংবাদিক