(Binodini Opera)
বিনোদিনী তাঁর ‘আমার কথা’ শীর্ষক আত্মকথনের এক জায়গায় লিখেছেন— ‘থিয়েটার আমার বড় প্রিয়, থিয়েটারকে বড়ই আপন মনে করিতাম…’। উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের অনেকটা জুড়েই বঙ্গরঙ্গমঞ্চের খ্যাত অখ্যাত যত অভিনেত্রী এসেছিলেন, তাঁদের সকলের হয়ে এই কথাটি বলেছিলেন বিনোদিনী। তাঁর লেখার সময়ে এই অর্থবোধ না থাকলেও, পরবর্তীকালে আমরা বুঝি, তৎকালীন রঙ্গমঞ্চ বিষয়ে এ ছিল এক আপ্তকথন। থিয়েটারকে এঁরা ভালোবেসেছেন— আঁকড়ে ধরেছেন। অন্ধকার গলির ঘৃণিত নর্মনটী জীবন থেকে এঁরা এসেছিলেন রঙ্গনটী হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। সেসময়ের এক গানে বলা হয়েছিল— ‘রঙ্গালয় বড় ভালোবাসি/ রাশি রাশি স্বপ্ন স্বাদ নিয়ে/ ফিরে ফিরে আসি’ এঁরা প্রাণপাত করেছেন, আবার প্রতারিতও হয়েছেন। অনেকে নিষ্ঠুর উপেক্ষায় মরেছেন। এইসব অভিনেত্রীদের প্রতিনিধি-স্থানীয়া বিনোদিনী। (Binodini Opera)

(Binodini Opera) ‘রূপ ও রঙ্গ’ পত্রিকা এক সময় সম্পাদনা করতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মলচন্দ্র চন্দ্র। এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিনোদিনীর অনেকগুলো অভিনয়চিত্রও। আর তাঁর স্মৃতিকথাটিও প্রকাশিত হয়েছিল ‘রূপ ও রঙ্গ’-এ। এই পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং গিরিশচন্দ্র বলেন— ‘তাহার সর্বতমুখী প্রতিভার নিকট আমি সম্পূর্ণ ঋণী, একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে আমি বাধ্য। আমার ‘চৈতন্য লীলা’, ‘বুদ্ধদেব’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘নল দময়ন্তী’ প্রভৃতি নাটক যে সর্বসাধারণের নিকট আশাতীত আদর লাভ করিয়াছিল তাহার অন্যতম কারণ আমার প্রত্যেক নাটকে শ্রীমতী বিনোদিনীর প্রধান প্রধান ভূমিকা গ্রহণ ও সেই সেই চরিত্রের চরমোৎকর্ষ সাধন’। এহেন মহানট গিরিশচন্দ্র যাঁর গুরু, তাঁকেও উপেক্ষার অন্ধকারে একরকম অন্তরাল-বাসিনী হয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, ফাদার লাফোঁ, এডউইন আর্নল্ড প্রমুখ যাঁর গুণগ্রাহী, তাঁর স্মৃতিচিত্র জুড়ে হাহাকার আর হাহুতাশ। নিজের জীবনের কিছু কথা প্রকাশ করেছেন বিনোদিনী। অন্যান্য কিছু কিছু সূত্র থেকেও আহরণ করা যায় বিনোদিনী সম্পর্কিত তথ্য। এইসব নিয়েই ‘আঙ্গিক’ নাট্যগোষ্ঠীর নির্মাণ ‘বিনোদিনী অপেরা’, যে-প্রযোজনা খুব অল্প সময়ে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। (Binodini Opera)

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আলোচনার মুখপাতেই বলে রাখা প্রয়োজন: এই প্রযোজনাকে ঘিরে এক অর্থে ‘বিনোদিনী আন্দোলন’ গড়ে তুলতে চেয়েছেন পরিচালক অবন্তী চক্রবর্তী সহ এই প্রযোজনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুরসভা হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারকে ‘বিনোদিনী থিয়েটার’ নামাঙ্কিত করেছেন। আমাদের মনে পড়বে, ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর, বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় স্টার থিয়েটার। ২০০১ সালে কলকাতা পুরসভা এই ঐতিহ্যবাহী রঙ্গমঞ্চের দায়িত্বভার গ্রহণ করে পুনরুজ্জীবন ঘটান। সম্প্রতি স্টার বদলে বিনোদিনী থিয়েটার। ((Binodini Opera))
ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ‘বিনোদিনী থিয়েটার’ নিয়ে কলকাতা পুরসভা কী ভাবছেন, সেবিষয়ে উৎসুক ‘আঙ্গিক’ নাট্যদলের অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলা-কুশলীরা এবং আমরাও।
সুদীপ্তা চক্রবর্তী (বিনোদিনীর চরিত্রে), সুজন মুখোপাধ্যায় (গুরমুখ রায়ের চরিত্রে), অবন্তী চক্রবর্তী (পরিচালক) এঁদের প্রশ্ন, বিনোদিনী চেয়েছিলেন তাঁর নামে গড়ে উঠুক সাধারণ রঙ্গালয়। হাতিবাগান পাড়ায় অন্যান্য নাট্যাঙ্গনগুলির অস্তিত্বহীনতার মধ্যে স্টার বা বিনোদিনী থিয়েটার এখনও জাগরূক। কিন্তু রঙ্গালয় কোথায়? এক সময় চলতি কথায় সিনেমা হলকে থিয়েটার বলা হত— বিষয়টা কি সেইরকম? কলকাতা পুরসভার মুখপত্র ‘কলকাতা পুরশ্রী’ পত্রিকা স্টার সাধারণ সংখ্যা এবং স্টার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে নাট্যামোদী মানুষের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ‘বিনোদিনী থিয়েটার’ নিয়ে কলকাতা পুরসভা কী ভাবছেন, সেবিষয়ে উৎসুক ‘আঙ্গিক’ নাট্যদলের অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলা-কুশলীরা এবং আমরাও। একটি সিনেমা হলকে রঙ্গালয় বলে চালানো হবে আর কতদিন, এ নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তুলেছেন সুদীপ্তা, সুজন, অবন্তী প্রমুখ। এই প্রশ্ন কলকাতার নাট্যানুরাগীদেরও। (Binodini Opera)

গুরমুখ রায় তখনকার দিনে বিনোদিনীকে দিতে চেয়েছিলেন অর্ধ লক্ষ টাকা। আবার হলের মালিকানার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন এই ধনাঢ্য ব্যক্তি। সেসময় গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীর মাকে বলেন, নাটকের হলের মালিকানা মানে বিস্তর ঝঞ্ঝাট। অতএব ওপথে না যাওয়াই ভাল। এ বিষয়টি দেখিয়েছেন নাট্য-ইতিহাসবিদ শঙ্কর ভট্টাচার্য। এরপর গুরমুখ রায় প্রস্তাব করেন, বিনোদিনীর নামের আদ্যাক্ষর ‘B’ শব্দটি সহযোগে থিয়েটারের নামকরণ হোক। কিন্তু তৎকালীন সমাজ, সামাজিকতা ভয়ে ভীত নাট্যদলের অন্যান্যরা এই প্রস্তাব কার্যকর করতে পারেননি। এর কিছু পরে বিনোদিনী রঙ্গালয় থেকে অবসর নেন। তাঁর অভিনেত্রী-জীবন মাত্র বারো বছরের। জন্ম ১৮৬৩ সালে এবং অবসর গ্রহণ ১৮৮৭তে। মাত্র ২৪ বছরের তরুণী বিনোদিনী কেন অবসর নিয়েছিলেন তা নিয়ে আজও শত শত প্রশ্ন রয়েছে। (Binodini Opera)

(Binodini Opera) বিনোদিনী তাঁর জীবন-বৃত্তান্তের এক জায়গায় স্পষ্ট বলছেন, তাঁর দিদিমা তাঁর ভাইকেই সর্বাধিক স্নেহ করতেন। কারণ তাঁদের পরিবার মানেই ‘মেয়ের মেয়ে, তাহার মেয়ে এই নিয়েই সব ঘর’। যে পরিবারে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে অল্প বয়সে মারা যায় সেই পরিবারের মেয়েদের দুঃখ চিরকালীন হয়ে ওঠে। ১৪৫ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে খোলা চালার ঘরে তাঁর জন্ম। তাঁর মা এবং দিদিমা তাঁদের যৎসামান্য অলংকার বিক্রি করে সংসার নির্বাহ করতেন। এর পর দাসীবৃত্তি। অসুস্থ ভাইকে নিয়ে যেতে হয়েছিল দাতব্য চিকিৎসালয় এবং দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল ডাক্তারের জন্য। দারিদ্র্যে ঘেরা বিনোদিনীর জীবন এই প্রযোজনায় সেভাবে উপস্থিত নেই। তাছাড়া ‘মেয়ের মেয়ে তাহার মেয়ে’ এই সমস্যাটির দিকেও দৃষ্টি দেননি পরিচালক। গঙ্গাবাইজির কাছে গান শেখা এবং রঙ্গালয়ে প্রবেশ করা বিনোদিনীর যেন ভবিতব্যই ছিল। আলোচনার সুবিধার জন্য বিনোদিনীর অভিনয়-জীবনকে এক নজরে দেখা যেতে পারে—
১) গ্রেট ন্যাশনাল (ডিসেম্বর ১৮৭৪ – এপ্রিল ১৮৭৬ এবং অক্টোবর ১৮৭৭);
২) বেঙ্গল থিয়েটার (এপ্রিল ১৮৭৬ – আগস্ত ১৮৭৭);
৩) ন্যাশনাল (ডিসেম্বর ১৮৭৭ – ১৮৮৩);
৪) স্টার (১৮৮৩ – ১ জানুয়ারি ১৮৮৭)।
বিনোদিনীর অভিনয়-জীবন সম্পর্কে গিরিশচন্দ্র বলেন— ‘আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি যে, রঙ্গালয়ে বিনোদিনীর উৎকর্ষ আমার শিক্ষা অপেক্ষা তাহার নিজ গুণে অধিক’।
(Binodini Opera) বিনোদিনীর অভিনয়-জীবন সম্পর্কে গিরিশচন্দ্র বলেন— ‘আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি যে, রঙ্গালয়ে বিনোদিনীর উৎকর্ষ আমার শিক্ষা অপেক্ষা তাহার নিজ গুণে অধিক’। রূপসজ্জা, পোশাক, কেশবিন্যাস এবং নৃত্যগীতেও পটীয়সী ছিলেন বিনোদিনী। তাঁকে প্রাইমা ডোনা অফ দ্য বেঙ্গলি স্টেজ, ফ্লাওয়ার অফ দ্য নেটিভ স্টেজ প্রভৃতি বলা হয়ে থাকত। বিনোদিনী তাঁর লেখায় তাঁর শিক্ষক নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্রকে বারে বারে বিনতি জানিয়েছেন। গিরিশবাবুর কাছেই দেশ-বিদেশের নাটক, কবিতা প্রভৃতি বিষয়ে চর্চার সুযোগ পেয়ে নিজেকে পরিশীলিত করেছিলেন, একথার স্বীকারে কোথাও তাঁর দ্বিধা নেই। অ্যালেক্সান্ডার পোপ, গ্রে কলিন্স কুপার, শেক্সপিয়র, মিল্টন প্রমুখ মহারথীর ছায়া পড়েছে সেই আলোচনাচক্রে। সেইসঙ্গে ভারতীয় নাট্যলেখকদের নিয়েও আলোচনা সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ এই প্রযোজনায় বিনোদিনী যখন গিরিশচন্দ্র-সমীপে প্রথমবার, গিরিশবাবু তাঁর পরীক্ষা নেন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এ — ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে—/ জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল রক্ষপুরে! হায়, উচিত কি তব/ এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী, / সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলীশম্ভুনিভ/ কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসবিজয়ী?/ নিজ গৃহপথ, তা ত, দেখাও তস্করে?/ চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?…’

এজাতীয় সংলাপ বলার ক্ষেত্রে গিরিশ চরিত্রের অভিনেতা এবং বিনোদিনী চরিত্রাভিনেত্রী দুজনেই আঢ়ষ্ট। ঠিক এই অংশ উদ্ধৃত হয়তো হয়নি, তবে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের অংশ থেকেই সংলাপের অন্তর্গত অংশ আমরা শুনেছি। তৎসম শব্দবহুল সংলাপ বলার ক্ষেত্রে বিশেষত মহাকবি গিরিশচন্দ্রের চরিত্রাভিনেতা ‘নিজ রচিত কাব্যে নিজেই অপটু’। সুদীপ্তা চক্রবর্তীর অভিনয়ের বেশ কিছু অংশ প্রশংসনীয় হলেও ‘মেঘনাদ কাব্য’ বা গিরিশ্চন্দ্রের নাটকের সংলাপ বলার ক্ষেত্রে তিনি যে অনভ্যস্ত, এটা বোধহয় বলা প্রয়োজন। (Binodini Opera)

(Binodini Opera) আমাদের মনে পড়বে, বেশ কিছু বছর আগে ঢাকা থিয়েটারের পক্ষে ‘বিনোদিনী কথা’ মঞ্চস্থ করেছিলেন শিমূল ইউসুফ। গোটা ‘বিনোদিনী কথা’ উপস্থাপিত হত তাঁর একক অভিনয়ে। সংলাপের ক্ষেত্রে ‘মেঘনাদ বধ’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘বুদ্ধদেবচরিত’, ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘সধবার একাদশী’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রভৃতি নাটকের অংশ ব্যবহৃত হত। সংলাপ বিন্যাসকে তিনি সাজিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি স্তরে। বিনোদিনীর সময়কালের বাংলা– করেচেন, গেসলেন প্রভৃতি। আবার সূত্রধর হিসেবে সাম্প্রতিককালের বাংলা। মূল কাহিনি বিবৃত হত সাম্প্রতিক বাংলায়, সেখান থেকে তিনি ফিরে যেতেন বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ থেকে সংলাপে— সেই সূত্রে প্রবেশ করতেন ‘দক্ষযজ্ঞ’ বা ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এ, এবং বিনোদিনী-রচিত কবিতাও বলতেন এই অভিনেত্রী। দুটি প্রযোজনার তুলনামূলক আলোচনা এখানে অবান্তর। কেবলমাত্র সংলাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাষার সঙ্গে স্থানকালের যোগাযোগ বিষয়টি যে অপরিহার্য, তা কিন্তু ‘বিনোদিনী অপেরা’ দেখে বোঝার উপায় নেই। তার পরিবর্তে রয়েছে প্রায়শই উচ্চকিত যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার। (Binodini Opera)
বিনোদিনীর ‘আমার কথা’-এ কুমার বাহাদুর হিসেবে যিনি পরিচিত, তিনি একজন তরুণ। বিশেষত তরোয়াল হাতে বিনোদিনীর ওপর চড়াও হওয়া এবং বিনোদিনীর কৌশলে নিবৃত্তি পাওয়ার অংশটি পড়লে তাই মনে হয়।
বিনোদিনীর ‘আমার কথা’-এ কুমার বাহাদুর হিসেবে যিনি পরিচিত, তিনি একজন তরুণ। বিশেষত তরোয়াল হাতে বিনোদিনীর ওপর চড়াও হওয়া এবং বিনোদিনীর কৌশলে নিবৃত্তি পাওয়ার অংশটি পড়লে তাই মনে হয়। সেই ‘তরুণ’ রায়বাহাদুরের সন্ধান মিলল না। দীর্ঘ চুল, চাপ দাড়ি, গোলাপ-হাতে যে-চরিত্রটির উপস্থাপন, তার উন্মোচন ঘটেছে কি? নাটকের একটি অংশে জানা যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিনোদিনী বিষয়ে কৌতূহলী। তাঁর ‘সরোজিনী’ নাটকে বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং বিনোদিনীর যোগাযোগ বিষয়ে পরিচালক ভবিষ্যতে কোথাও আলোকপাত করলে দর্শক উপকৃত হবেন। অমৃতলাল বসুর চরিত্রে অভিনয়কারীর গান এবং অভিনয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। (Binodini Opera)

বিনোদিনীর লেখায় বহু মজার প্রসঙ্গ এসেছে, যেমন সাহেবের মোচার ঘণ্ট দিয়ে পাউরুটি খাওয়া বা মিউনিসিপালিটির উড়িয়াভাষী এক কর্মীর কথা। এক দিকটি পরিচালক ভেবে দেখেননি। পূর্বতন রূপবানী সিনেমা হলের পার্শ্ববর্তি যে রাস্তায় বিনোদিনী বাস করতেন, তার পাশের বাড়ির বর্ষীয়ান এক ভাড়াটিয়ার ১৯৬৪ সালে লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, বিনোদিনী ও তারা সুন্দরী থাকতেন পাশাপাশি। বিনোদিনীর কন্যা শকুন্তলা গত হন অল্প বয়সে। তারা সুন্দরীকে কেন্দ্র করে বিনোদিনীর সঙ্গে স্টার কর্তৃপক্ষের যে মনোমালিন্য তা বোধহয়য় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। (Binodini Opera)
প্রসঙ্গত, ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর, গেরেসিম লেবেদেফের ‘The Bengali Theatre’-এ ‘The Disguise’ মঞ্চস্থ হয় ‘কাল্পনিক সংবদল’ নামে। এই প্রযোজনায় স্ত্রীচরিত্রে নারীদের দিয়েই অভিনয় করিয়েছিলেন লেবেদেফ। এক্ষেত্রে তাঁর ভাষা-শিক্ষক গোলোকনাথ দাসের ভূমিকা অপরিসীম। অধুনা শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে নবীন বসুর থিয়েটারেও স্ত্রী-ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বারাঙ্গনারা। ১৮৫৮-৫৯ সালে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ মঞ্চায়নের সময়ে আবার পুরুষরাই নেমেছিলেন স্ত্রী-চরিত্র চিত্রণে। এ-প্রসঙ্গে জানা যায়, নাট্যপরিচালক কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা পথে বেরিয়ে পড়তেন নারী-চরিত্রে অভিনয়ে সক্ষম পুরুষদের সন্ধানে। তথাকথিত effeminate নয়, তবে মুখভঙ্গির কমনীয়তা, হাতে-পায়ের নরম ভাব সন্ধান করতেন তাঁরা। প্রখ্যাত নাট্যকার মনমোহন বসু ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বলেছিলেন, সত্যকার রমণীকে রমণী সাজাইলে দেখিতে-শুনিতে সর্বপ্রকারেই ভাল হয়। (Binodini Opera)

১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ন্যাশনাল থিয়েটার, যেখানে পুরুষরাই অভিনয় করেছিলেন স্ত্রী-চরিত্রে। তৎকালীন এডুকেশন গেজেটে ক্ষেত্রনাথ ভট্টাচার্য অভিনেত্রীদের দিয়ে নারী চরিত্রে অভিনয় করানোর পক্ষে প্রবন্ধ রচনা করেন। এরপর বেঙ্গল থিয়েটারের শরৎচন্দ্র ঘোষ এবং বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় অভিনেত্রীদের দিয়ে কাজ শুরু করেন। অভিনেত্রী নিয়োগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বেঙ্গল থিয়েটারের উপদেষ্টা সমিতির সভা আহুত হয়েছিল। বিরোধিতা করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এসব সত্ত্বেও ১৮৭৩ সালের ১৬ আগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ মঞ্চস্থ হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই প্রযোজনায় অভিনেত্রীরাই স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয় করেন। ফলে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে নারী চরিত্রের আগমন বিষয়ে উথাল-পাথাল যথেষ্ট। স্বয়ং গিরিশচন্দ্রকে লিখতে হয়— ‘যাহারা বিনোদিনীর ন্যায় অভাগিনী, কুৎসিত পন্থা ভিন্ন যাহাদের জীবনোপায় নাই, মধুর বাক্যে যাহাদিগকে ব্যভিচারীরা প্রলোভিত করিতেছে, তাহারাও মনে মনে আশ্বাসিত হইবে যে, যদি বিনোদিনীর মতো কায়েমনে রঙ্গালয়কে আশ্রয় করি, তাহা হইলে এই ঘৃণিত জন্ম জন-সমাজের কার্যে অতিবাহিত করিতে পারিব। যাহারা অভিনেত্রী, তাহারা বুঝিবে– কীরূপ মনোনিবেশের সহিত নিজ ভূমিকার প্রতি যত্ন করিলে জন-সমাজে প্রশংসাভাজন হইতে পারে’। (Binodini Opera)



(Noti Binodini) প্রশ্ন হল, এই ‘ব্যভিচারী’ কারা? দ্বিতীয়ত, অভিনেত্রীদের তবে কি গিরিশচন্দ্র বারাঙ্গনাদের থেকে পৃথক করতে চাইছিলেন? রঙ্গালয়কে আশ্রয় করেই চূড়ান্ত অবহেলা অপমান সহ্য করতে হয় বিনোদিনী দাসীকে। তিনি অবসর গ্রহণের পরও নিয়মিত থিয়েটার দেখতেন, একথা রয়েছে অহীন্দ্র চৌধুরীর লেখায়। আধ্যাত্মিক প্রণোদনা কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল সে কথা ভিন্ন প্রসঙ্গ। থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ যে তাঁর শেষ হয়ে যায়নি, তা তো জানা যাচ্ছে অহীনবাবুর সাক্ষ্য থেকে। বিনোদিনীর চেয়ে বয়সে কিছু ছোট মারাঠি অভিনেত্রী দুর্গা খোটেও বিনোদিনীর জীবৎকালেই অভিনয় করেছেন কলকাতায়। নিউ থিয়েটারস্ স্টুডিওতে তাঁর আগমন-বার্তা প্রকাশিত হত সংবাদপত্রে। স্পষ্ট লেখা হত— ‘First actress from a respectable family to act in films’ এজাতীয় বাক্য। তিনি প্রথম যখন অভিনয় করতে আসেন তখন বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল— ‘Introducing the daughter of the famous solicitor Mr. Laud’। (Binodini Opera)


মঞ্চে এবং চলচ্চিত্রে অভিনয়ে অংশগ্রহণকারী নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে তবে কি বাঙালি সমাজ কিছুটা পিছিয়ে ছিল? না কি মাধ্যম-ভেদে রক্ষণশীলতার তারতম্য ঘটে? ১৯২৯ সালের ছবি ‘Throw of Dice’-এ চুম্বনের দৃশ্য দেখা গিয়েছে। এরপর ১৯৩৪-এ ‘Karma’ ছবির চুম্বনের দৃশ্য আলোড়িত করে আসমুদ্র-হিমাচল ভারতকে। বিনোদিনী তখনও জীবিত। নিউ থিয়েটার্স, বম্বে টকিজ-এর ছবি মুক্তি পেয়েছে কলকাতায়ও। দুটি সংস্থারই কর্ণধার বাঙালি। মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিনোদিনী বিদায় জানান মঞ্চকে। তাঁর পরবর্তী জীবনের কথা আমরা এত কম জানি যে, কোন বিষয়ে কী ভেবেছিলেন তিনি, তা জানা অত্যন্ত কঠিন। নির্ভর করতে হয় শুধুমাত্র লোকশ্রুতির প্রবাহে। (Binodini Opera)


এই প্রযোজনার পরিচালক অবন্তী চক্রবর্তী ইতিপূর্বে পরিচালনা করেছেন গিরিশ কারনাডের ‘নাগমণ্ডল’। আমাদের মনে পড়বে, শ্যাম বেনেগলের ‘ভূমিকা’ ছবির জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন গিরিশ। হংসা ওয়াডকরের আত্মজীবনী আধারিত হলেও, গত শতকের তিন, চার এবং পাঁচের দশকের বিভিন্ন অভিনেত্রীদের জীবনকথার নানা অনুষঙ্গ তিনি কীভাবে কার্যকরী করেছিলেন চিত্রনাট্যে, তা ছবিটি দেখলেই বোঝা যায়। (Binodini Opera)
স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষ কেবল ‘বিনোদিনী’ নামকরণ করে একটি সিনেমা হলকে রঙ্গভূমি বলে কীভাবে চালাবেন, তা আগামী দিনে আমরা দেখব। বিনোদিনীকে নিয়ে আরও বহুমাত্রিক কাজের প্রত্যাশাতেও আমাদের অপেক্ষমান থাকতে হবে। (Noti Binodini)
পড়েছেন তুলনামূলক সাহিত্য। বাদল সরকার ও গিরিশ কারনাডকে নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। দৃশ্য ফিল্ম কালেক্টিভ ও পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। কাজ করেছেন কলকাতা পৌর সংস্থার মুখপত্র 'কলকাতা পুরশ্রী' সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ-এর প্রাক্তন প্রজেক্ট ফেলো।