শতাব্দীর মূল্যবোধে ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর – পরিবর্ধিত সংস্করণ
মন্দার মুখোপাধ্যায়
দে’জ পাবলিশিং
২৯৯ টাকা
বাংলা বই লিখতে গিয়ে ‘সমাপতন’ শব্দটি ব্যবহার করেননি এমন বুদ্ধিজীবি বাঙালির সংখ্যা প্রায় অগণ্য বলা চলে। বিদ্যাসাগর মশায়ের জন্মমৃত্যুর রহস্যটাও বোধ করি একটা আশ্চর্য সমাপতন। তাঁর জন্ম স্পর্শ করে উনিশ শতকের আলস্যত্যাগী এক জাগরণের সূচক হিসেবে এবং তাঁর জীবদেহের নশ্বরতা আগামী শতকের নবজাগরণকে আরও জাগ্রত করে। আর এই কালটা মহাকাল এবং এর কালপুরুষ মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র।
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলে এক ভদ্রলোক তাঁর এক ক্ষণজন্মা সন্তানকে কেমন ধারায় বড় করে তুলবেন ভাবতে ভাবতে বীরসিংহা (এটাই তাঁর জন্মভূমির আসল নাম) থেকে হেঁটে ছেলেকে কখনও হাত ধরে কখনও শীর্ণ কাঁধে চড়িয়ে কলকাতায় এলেন সে সময়ের জীর্ণ সমাজ-শিক্ষাকে সবল করে দিতে। সঙ্গে এলেন তাঁর শৈশবের শিক্ষক মশাই কালীকান্তবাবু। দুর্লভ ঘটনা। দু’টাকা মাইনের পিতামহাশয় স্বেচ্ছাবসর নিলেন দশ টাকায়। যাঁর ছেলে নিজের হাতে পরিবারের রান্নাবান্না করে দীর্ঘ পথ হেঁটে সংস্কৃত কলেজে পড়তে এলেন– কী পড়বে ছেলে– সংস্কৃত না ইংরাজি তর্কের মধ্যে যখন তাঁর জন্মের মাত্র ক-বছর আগে ইংরেজি শিক্ষার পীঠস্থান হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
তাতে হয়েছেটা কী। সংস্কৃত আর ইংরেজি– দুটো ভাষা এবং তাঁর কালের বিদ্যা-অর্ণবকে ধাতস্থ করে একটা বিস্ময় সৃষ্টি করে। আমার সবচেয়ে বিস্ময় লাগে তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পাওয়া। এটা কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রদত্ত নয়– শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের আশীর্বাণী। তাঁর শিক্ষকেরা এই শংসাপত্রে সই করে তাঁকে এই উপাধি দিয়েছেন– সেক্রেটারি রসময় দত্তের সইটি একেবারে শেষে থাকলেও। পাশ করে তিনি পড়াতে ঢুকলেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে– যার পড়াশুনো ভারত শাসন করতে আসা ইংরেজপুঙ্গব-কাম-সিভিলিয়নদের পড়াবার জন্য। পড়ার বাড়িটা হল রাইটার্স বিল্ডিংস– যার প্রিন্সিপাল উইলিয়ম কেরি– ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি তিনটি বিভাগের। মন্দার ঈশ্বরচন্দ্র ধর্মপাঁড় ছিলেন কিনা তা নিয়ে অক্ষর খরচ না করে প্রথম বই ‘বাসুদেব চরিত’ নিয়ে তথ্যাদি নিবেদন করে বৈতাল পাঞ্চশীর হিন্দি কাহাঁনিয়া কে ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’তে অনুবাদ করে তাঁর চাকুরিস্থলের মর্যাদা রেখেছিলেন। চাকরির পদের নাম সেরেস্তাদার। যাঁদের পড়ালেন তাঁরা উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়ে আবেদন করেছিলেন বিদ্যাসাগর যেন তাঁদের পরিদর্শক হন। ছাত্র যখন শিক্ষক নির্বাচন করেন, তখন কী যে হয়– তার জন্যে চণ্ডীচরণ বিহারীলাল এমনকি শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন পড়ার দরকার নেই, এমনকি ইন্দ্র বিত্র-ও নয়, দুশো আট পৃষ্ঠায় লেখা মন্দার মুখোপাধ্যায়ের বইটা পড়লেই হয়। আমি পণ্ডিত নই কিন্তু পড়ুয়া-পড়িয়ে যে তার গৌরব করতে পারি। বাংলায় যত জীবনী লেখা হয়েছে তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগর ও তার প্রসঙ্গে নিয়ে বোধ করি সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে, তার মধ্যে মন্দারের বইটার নাম ‘শতাব্দীর মূল্যবোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ বইটিকে আমি অন্যতম সেরা বই বলতে পারতাম, যদি একটা বাড়তি শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন। কারণ এই সংখ্যাবাচক শব্দটি মন্দার পাঠককে বুঝিয়েছেন। পাঠক এই শব্দটির জন্য অভাববোধ করবেনই। শব্দটি হল ‘বহু’। ‘বহু শতাব্দীর মূল্যবোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’। যেমন অনেকে শ্রদ্ধা করে বিদ্যাসাগর মশায়কে ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ বলে থাকেন। আসলে তিনি শুধুমাত্র সকালবেলাতেই স্মরণীয় নন, তিনি নিত্য স্মরণীয়। অন্তত মন্দারের বইটা পড়বার পর পাঠক হরীনামের মালা জপ করার চেয়ে সর্বক্ষণ জপের জন্য এই নামটি বলে মালা ঘোরাবেন।
বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বই লেখার বিষয় বিচিত্র। তাঁকে লিখতে গেলে তাঁকে অক্ষরে পরিণত করে সেই অক্ষর দিয়ে অযুত-নিযুত-সঙ্খ-মহাসঙ্খ পৃষ্ঠার বই লেখা যেতে পারে। গ্রন্থ নির্ণেতা তাঁর জীবনীকারেরা যেসব ভুল লিখে গেছেন– তার অনুসন্ধান না করে তাঁর জীবন সম্পর্কে যেসব কথা না বললে ভুল হবে– সেগুলোই ওই ‘বহু শতাব্দী’কে মন্থন করে সারামৃত পরিবেশন করেছেন। তাতে শিক্ষা-সমাজ-সংস্কার-বিতর্ক-রসিকতা ছাপিয়ে মানুষ বিদ্যাসাগরকে ভাবিয়েছেন। নইলে কলকাতা থেকে নিজের জন্মভূমি– মা ভগবতী ক্রোড়স্থল ছেড়ে একেবারে কর্মাটাঁড়ে গিয়ে হাজির হতেন না– যার বাসিন্দারা তাঁকে বিদ্যেসাগর বলতেন আদর করে।
এই বইয়ের কাঠামো তৈরি করতে গিয়ে মন্দার অবশ্য উল্লেখযোগ্য বইগুলির উচ্চারণ করেছেন, বর্ণ পরিচয় থেকে পরে প্রাড়বিবাককে বর্জনীয় ভেবে বাংলা গদ্যের পরিমার্জনায় এসেছেন– সেই পরিমার্জিত সংস্করণে মন্দার পারিজাত হয়ে উঠেছেন।
বারিদবরণ ঘোষ একজন খ্যাতনামা লেখক ও সম্পাদক। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০; সম্পাদনা করেছেন ৯০-এর ওপর বই। শ্রীগোপাল ব্যানার্জী কলেজ ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে অবসর নিয়েছেন।
One Response
ধন্যবাদ বারিদবরণ বাবু, আমাদের প্রিয় বারিদদা।আপনার এই অমূল্য অক্ষর যাপনে আমি শুধু আমার প্রণামটুকুই জানাই।