আশির দশকে আমি ‘গ্রন্থালয়’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করতাম। সেই সময় আমাদের সংস্থা ফটো টাইপ সেটিং যন্ত্র বসিয়ে নিজেদের এবং বাইরের, বিশেষ করে বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজ করত। আমি এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। আর সেই সুবাদে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার দফতরে আমাকে যেতে হত। এর মধ্যে ছিল প্রবাদপ্রতীম অ্যাডগুরু রাম রায়ের ‘রেসপন্স’ সংস্থা। সেই সময় ওখানে এক শ্যামলা দোহারা চেহারার এক যুবককে দেখতাম। তার চেহারা চোখে পড়ার মতো না হলেও, একটা হালকা সৌন্দর্য ছিল। চোখে বড় ফ্রেমের চশমা, এক মাথা বড় বড় কোঁকড়ানো চুল। তখন ওর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। পরে জেনেছিলাম ওর নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ, চলচ্চিত্র নির্মাতা।
এরপর আড্ডার ফাঁকে একসময় ঋতুপর্ণ শিবাজীকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমাকেও ওই ঘরে ডেকে নিল। ঘরে যেতেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঋতুপর্ণ আমায় বলল “এই চেয়ারটায় একটু গা এলিয়ে বস তো।”
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঋতুপর্ণর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয় আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সুপণ্ডিত অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন প্রায় প্রতি শনিবারই ঋতুপর্ণ শিবাজীর কাছে রবীন্দ্রনাথ পড়তে যেত। ঠাকুর পরিবার নিয়ে ওর একটা ছবি করার পরিকল্পনা ছিল, যেটার চিত্রনাট্য লিখছিল শিবাজী। আমিও সেই সময় শনিবার করে শিবাজীর বাড়ি যেতাম আড্ডা মারতে। সেই আড্ডার মধ্যমণি ছিল শিবাজী নিজেই। কিন্তু ঋতুপর্ণ আসার পর ওই-ই আড্ডার কেন্দ্র হয়ে উঠল।
সেবছর সন্দেশ পত্রিকার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে সংগ্রাহক পরিমল রায় ও শিল্পী কাজী অনির্বাণ একটা ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছিলেন। পয়লা বৈশাখে শিবাজীর বাড়ি গিয়েছি সেই ক্যালেন্ডারের একটা কপি ওর হাতে তুলে দিতে। গিয়ে দেখি ঋতুপর্ণও হাজির। ভাগ্যিস সঙ্গে করে দু’একটা ক্যালেন্ডার বেশি নিয়ে গেছিলাম, তার থেকেই একটা ঋতুপর্ণকেও দিলাম।
[the_ad id=”270088″]
আমার শ্যুটিং-এর তারিখ দিল ৩০শে এপ্রিল আর ১লা মে। ২৬শে এপ্রিল খুব ভোরে মোবাইলে মেসেজ করে জানিয়ে দিল শ্যুটিংয়ের আগে যেন আমি দাড়ি না কামাই। এদিকে ২৯শে এপ্রিল আমার ভাগ্নের বিয়ে। অগত্যা দাড়ি নিয়েই বিয়েবাড়ি গেলাম। ৩০ তারিখ ভোর পাঁচটায় আমি যখন লেকে প্রাতঃভ্রমণ করছি তখন ওর ফোন এল। জিজ্ঞাসা করল অল্প অল্প সাদা দাড়ি বেরিয়েছে কিনা আর বড় ঘেরের পাজামা পরি কিনা। তেমন পাজামা আমি পরি না শুনে বলল “ঠিক আছে। কোনও চিন্তা নেই, আমি প্রোডাকশনকে বলে দিচ্ছি তোমার পাজামার ব্যবস্থা করতে।”
কী কারণে সেদিন ওকে কে যেন দিদি বলে ডেকেছিল। আমি তো ভেবেছিলাম ও খুব রেগে যাবে, কিন্তু হল উলটোটা। ওই ডাকে ঋতু এত খুশি হয়েছিল যে সঙ্গে সঙ্গে হেয়ার ড্রেসার রীনা মণ্ডলকে ডেকে বলল ওকে সুন্দর করে কাজল আর লিপস্টিক পরিয়ে দিতে।
ওর সত্যান্বেষী ছবিতে আমি যে চরিত্রে অভিনয় করেছি, সেটা একজন মহারাজার। আমি মাঝারি উচ্চতার সাধারণ চেহরার মানুষ। আমাকে কেন যে ঋতুপর্ণ ওই চরিত্রটার জন্য পছন্দ করল সেটা জানার কৌতূহল ছিল। সরাসরি ঋতুপর্ণকে প্রশ্নটা করে উঠতে পারিনি তাই শিবাজীকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছিলাম, ঋতুপর্ণ নাকি আমার চেহারায় কোথাও একটা আভিজাত্যের ছাপ খুঁজে পেয়েছিল। আর আমার স্বাভাবিক সাদা চুলটাও ওর ওই চরিত্রের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছিল।
[the_ad id=”270086″]
শ্যুটিং-এ আমার প্রথম শটটা দু’বার তুলতে হয়েছিল কারণ আমি অতি উৎসাহে গড়গড়িয়ে সংলাপ বলতে শুরু করেছিলাম। তখন ঋতুপর্ণ আমাকে মাইকের মাধ্যমে জানাল যে ও মাইকে যেভাবে সংলাপ বলবে আমাকে সেটা শুনে ওইভাবে সংলাপ বলতে হবে। এই দৃশ্যের জন্য ঋতুপর্ণ নিজে হাতে আমার মেকআপ করে দিয়েছিল, যার জন্য আমি অভিনয়ে বাড়তি উৎসাহ পাই।
ঋতুপর্ণ নরম স্বভাবের মানুষ ছিল। চলনে বলনে একটা কোমল ভাব ছিল। কিন্তু প্রয়োজনে উঁচু গলায় কথা বলতে বা বকাবকি করতে পেছপা হত না। লক্ষ্য করেছিলাম, সেটের প্রত্যেকে ওকে যেমন সমীহ করত, তেমনই ভালবাসত। সেটে ওর সহকারীরা ওকে ঋতুদা বলেই ডাকত। কী কারণে সেদিন ওকে কে যেন দিদি বলে ডেকেছিল। আমি তো ভেবেছিলাম ও খুব রেগে যাবে, কিন্তু হল উলটোটা। ওই ডাকে ঋতু এত খুশি হয়েছিল যে সঙ্গে সঙ্গে হেয়ার ড্রেসার রীনা মণ্ডলকে ডেকে বলল ওকে সুন্দর করে কাজল আর লিপস্টিক পরিয়ে দিতে। তারপর আবার নিজেই একটা লাল টিপ কপালে লাগিয়ে নিল। আর কস্টিউম ডিজাইনারের কাছ থেকে একটা লাল ফেজ টুপি চেয়ে নিয়ে সেটা বাঁকাভাবে মাথায় বসিয়ে শ্যুটিং করতে লেগে গেল।

ছবির একাদশ দৃশ্য এবং আমার পঞ্চম ও শেষ দৃশ্যটা ছিল সেদিনকার শ্যুটিং-এর সবচেয়ে কঠিন দৃশ্য। সেখানে আমি অর্থাৎ রাজা খুবই অসুস্থ, প্রায় মৃত্যুশয্যায়। ঋতুপর্ণর কাছে শ্যুটিং-এর সময় জেনেছিলাম যে ছবির ওই দৃশ্যটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেন জানি না, এই দৃশ্যে অভিনয় করার আগে ও আমায় বুঝিয়ে বা অভিনয় করে দেখিয়ে দেয়নি, যা অন্যান্য দৃশ্যের বেলায় করেছিল। শ্যুটিং-এর শেষে আমার কাজের প্রশংসা করে আমার চিত্রনাট্যের কপিতে ‘অনিন্দ্যকে অরুণাংশুর সাফল্যে ঋতুপর্ণ’ লিখে দিয়েছিল। অরুণাংশু ছিল আমার অভিনীত চরিত্রের নাম। তাছাড়া প্রথম শটটা ছাড়া বাকি সব শটই একবারে ‘ওকে’ হওয়ায় ও খুব খুশি হয়েছিল। ফলে পরের দিন আর আমায় শ্যুটিং করতে হয়নি।
[the_ad id=”270085″]
শ্যুটিং-এর ঠিক এক মাস বাদে, অর্থাৎ ৩০শে মে ২০১৩-এর সকালে কাজী অনির্বাণ ফোন করে জানাল ঋতুপর্ণ আর নেই। কাজী সবসময় খুব ঠাট্টা তামাশা করে বলে ওর কথা প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু টিভি চালিয়ে দেখি খবরটা সত্যি। তার দু’দিন আগেই অসুস্থ অবস্থায় আমায় ফোন করে বলেছিল দুমদাম করে যেন বিদেশ চলে না যাই, কারণ ক’দিনের মধ্যেই ডাবিং করতে হবে। সেদিন কাজীই আমাকে এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঋতুর বাড়ি। দেখলাম শোবার ঘরে কারুকার্য করা চার ছত্রির পালঙ্কে ও চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। ওই দৃশ্য দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল। আমি ওর ছবিতে আমার শেষ দৃশ্যে ঠিক ওইরকম পালঙ্কে শুয়ে ওইরকম কাঁথা গায়ে মৃত্যুশয্যায় রাজার অভিনয় করেছি একমাস আগে। তাহলে কি ঋতুপর্ণ বুঝতে পেরেছিল যে ওই দৃশ্যটা ও একবারই করবে? একেবারে নিজের জন্যে! কাউকে দেখাতে নয়, কাউকে দেখিয়ে দেবার জন্য নয়। এক-দু মিনিটের বেশি ওর সামনে থাকতে পারিনি, শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে এসেছিলাম।
সরোদবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পরিচিত নাম। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি চলে পড়াশোনা ও লেখালেখি। 'আপনাদের সেবায়', 'প্রসঙ্গ ঠুমরি', 'সুরের গুরু' ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। সরোদচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয় করেন বাংলা ছবিতে।
4 Responses
চমৎকার লাগলো। কত সুখের মূহুর্তের ছবি।
শুধুই স্মৃতি আজ।
খুব সুন্দর লেখা। মূল্যবান স্মৃতি।
খুব ভাল লাগল। সুন্দর উপস্থাপনা। মুল্যবান স্মৃতি ।
Chamotkar.