বাংলার রাজপাট: নবম পর্ব
বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (Alauddin Husain Shah) এক বহু আলোচিত নাম। অনেকেরই ধারণা যে হোসেন শাহই সুলতানি যুগের শ্রেষ্ঠ সুলতান। এই ধারণার অনেকগুলো কারণের মধ্যে কয়েকটার কথা আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত- চৈতন্যের জন্মের কিছুকাল পরেই হোসেন বাংলার সুলতানি সিংহাসনে বসেন। চৈতন্যের গৌড়-গমন এবং হোসেনের দুই সচিব তথা অমাত্য সনাতন ও রূপ গোস্বামীকে তাঁর সঙ্গী করে নিয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী-কাব্যে হোসেনের প্রসঙ্গ বহু আলোচিত। এখানে অবশ্য একটা কথা মনে রাখতে হবে যে চৈতন্যভাগবৎ, চৈতন্যচরিতামৃত-সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থগুলোতে হোসেন শাহের প্রশংসা যেমন আছে, তেমন নিন্দাও রয়েছে অনেক জায়গায়। কিন্তু চৈতন্যর জীবনের, বিশেষ করে তাঁর ধর্মসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে হোসেন শাহের রাজত্বকালে।
বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, চৈতন্য যখন এক বিশাল ভক্তমণ্ডলী নিয়ে কৃষ্ণনাম সংকীর্তন করতে করতে গৌড়ে পৌঁছন, তখন নাকি হোসেন শাহ (Alauddin Husain Shah) তাঁকে নিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। কিন্তু হোসেনের রাজসভার উচ্চপদস্থ হিন্দু অমাত্যদের পরামর্শে চৈতন্যের গতিরোধ করেননি। এই সমস্ত কারণে বাঙালি জনমানসে হোসেন শাহ এক উল্লেখযোগ্য আলোচিত চরিত্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন। অবশ্য তিনি হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন এমনটা বলা না গেলেও, ইসলাম ধর্মের জন অনেক মসজিদ, ইস্কুল তৈরি করিয়েছিলেন। প্রাপ্ত শিলালিপির বয়ান অনুসারে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সেগুলোর মধে উল্লেখযোগ্য একটা হল, পুরনো মালদহের জামি মসজিদ।

হোসেনের রাজ্যজয়
দ্বিতীয়ত- হোসেন শাহ (Alauddin Husain Shah) ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী সুলতান। তাঁর ২৫-২৬ বছরের রাজত্বকালে (সিংহাসন আরোহন ১৪৯৩—মৃত্যু ১৫১৯) তিনি এক বিশাল রাজত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সিংহাসনে বসবার বছরখানেকের মধ্যেই তিনি দিল্লির সুলতান সিকন্দর লোদীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। যদিও সে যাত্রায় দু’পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়, কিন্তু তার পরেও তিনি সিকন্দর লোদীর অধিকারভুক্ত বিহারের কিছু কিছু অংশ নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। ওই সংঘর্ষের অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। বহুলোল লোদীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকন্দর লোদী দিল্লির সিংহাসনে বসলে, বিহারের শাসনকর্তা হোসেন শাহ শর্কী কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সিকন্দর লোদী বিদ্রোহ দমন করতে বিহারে আসেন। বিহারের শাসনকর্তা হোসেন শাহ শর্কী আদতে ছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহর আত্মীয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহর পুত্র নসরৎ শাহের কন্যা তথা হোসেনের পৌত্রীর সঙ্গে হোসেন শাহ শর্কীর পুত্র জলালুদ্দিনের বিয়ে হয়েছিল। সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর আরেক পুত্র দানিয়েলের নেতৃত্বে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিহারে পাঠিয়েছিলেন হোসেন শাহ শর্কীকে সাহায্য করতে।

শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ না হলেও, ওই সংঘর্ষ বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ হল, ১৩৩৯ সাধারণাব্দে বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহ দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছিলেন। সেই সময়ে ফিরোজ শাহ পাণ্ডুয়া আক্রমণ করেন। তার পর থেকে বাংলার সুলতানি সিংহাসন নিয়ে নিজেদের মধ্যে যতই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়ে থাকুক না কেন, দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসকদের পক্ষ থেকে আর গৌড় আক্রমণ হয়নি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নিজেই তাঁর আত্মীয়কে সাহায্য করতে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন।
হোসেন শাহ তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে দেশ-জয়ের নেশায় বহু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তবে সে সব নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বাংলা ও সংলগ্ন অঞ্চল ঘিরে যে সমস্ত শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এত বেশি পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায় যে হোসেন ঠিক কতগুলো রাজ্য জয় করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত কতগুলো রাজ্যের উপরে নিজের প্রভুত্ব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তা খুব স্পষ্টভাবে নির্ণীত নয়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের বর্ণনা ছাড়াও ‘রাজমালা’, ‘তারখি-ফতে-ই-আশাম’-সহ অন্যান্য আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অবলম্বন করে রজনীকান্ত চক্রবর্তী, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, সুখময় মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ইতিহাসবিদেরা যা লিখেছেন সেগুলোর মাধ্যমে জানা যায় যে হোসেন শাহ বিহার, ত্রিপুরা, আসাম, চট্টগ্রাম, ওডিশা আক্রমণ করেছিলেন। সমস্ত যুদ্ধেই যে তিনি জয়লাভ করেছিলেন তা নয়, তবু ওই সমস্ত রাজ্যের কিছু কিছু অংশ তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।

শিলালিপি, ইতিহাসগ্রন্থ এবং বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলো থেকে হোসেন শাহর ওড়িশা আক্রমণ নিয়ে অনেকরকম তথ্য পাওয়া গেলেও সেগুলো দিয়ে কোনও স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। ‘রিয়াজ-উস-সালতিন’-এর লেখক গোলাম হোসেনের মত অনুসারে, হোসেন শাহ গৌড় থেকে ওড়িশা পর্যন্ত সমস্ত রাজ্য অধিকার করেছিলেন। কিন্তু এই মতের পক্ষে তেমন জোরালো প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি হোসেন ঠিক কবে প্রথম ওড়িশা আক্রমণ করেছিলেন, সেই তারিখও জানা যায় না। তবে বিভিন্ন বিবরণ থেকে বোঝা যায়, অন্যান্য রাজ্যগুলোর তুলনায় ওড়িশার সঙ্গে গৌড়ের বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী ছিল। হোসেন যে শুধু রাজ্য-জয়ের কারণেই বারবার ওড়িশা আক্রমণ করেছিলেন তা হয়ত নয়, সম্পদ লুণ্ঠন করার উদ্দেশ্যও ছিল সেখানে।
বৃন্দাবন দাস রচিত ‘চৈতন্যভাগবৎ’ কাব্য অনুসারে, হোসেন শাহ ওড়িশার পুরী আক্রমণ করে বহু দেবদেবীর মন্দির ধ্বংস করেন এবং পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে রত্ন ও অলংকার লুঠ করেন। মনোমোহন চক্রবর্তী পুরীর মন্দিরের সম্পদ-তালিকা সম্বলিত ‘মাদলা পাঞ্জী’ অনুসরণে হোসেনের সেনাপতি ইসমাইল গাজি ওই লুণ্ঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করলেও সুখময় চক্রবর্তী তা ভ্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন। তার কারণ, অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায়, ইসমাইল গাজি সুলতান বারবাক শাহর সমসাময়িক ছিলেন এবং বারবাক শাহের আদেশেই তাঁর প্রাণদণ্ড হয়েছিল।

একই ভুল করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে। সেখানে তিনি ইসমাইল গাজীকে হোসেন শাহর সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘‘…বাঙ্গালার পাঠান সম্রাটদিগের শিরোভূষণ হোসেন শাহার বিখ্যাত সেনাপতি ইস্মাইল গাজি এই দুর্গ নির্মাণ করেন৷’’ ইতিহাসবিদদের মতে এই গড় আরও প্রাচীন৷ প্রাচীনকালে এই অংশটির নাম ছিল অপার মন্দার৷ বঙ্গদেশের ইতিহাসে সামন্তরাজাদের প্রতিপত্তি সব সময়েই বেশি ছিল৷ রাজা শশাঙ্কের পূর্বে তো বটেই পরবর্তীকালে পাল ও সেন রাজাদের আমলেও সুযোগ পেলেই বিভিন্ন সামন্তরাজা বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন৷ অপার মন্দারও দীর্ঘকাল ছিল তেমনই সামন্তরাজাদের রাজধানী৷ পাল রাজবংশের শেষ পর্বে রামপাল পূর্বপুরুষের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য যে সমস্ত সামন্তরাজার সহায়তা চেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই অপার মন্দারের রাজা লক্ষ্মীশূরের নাম উল্লেখযোগ্য৷ লক্ষ্মীশূরের আগেও শূরবংশীয় সামন্তরাজারা এখানে রাজত্ব করেছিলে বলে জানা যায়৷

অনেক পরে এই মান্দারণ ওড়িশার গঙ্গ বংশীয় রাজাদের প্রচেষ্টায় ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত হয়৷ দীর্ঘকাল তা ওড়িশার অধীনেই ছিল এবং সেই সূত্রে গড় মান্দারণের অধিপতিরা হিন্দু সামন্তরাজা ছিলেন বলেই ধরে নেওয়া হয়৷ সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মান্দারণ গড় মুসলমান শাসকদের অধিকারে আসে৷ স্থানীয় লোকশ্রুতি থেকে জানা যায়, যুদ্ধে ঘোড়ার পিঠে থাকা অবস্থাতে ইসমাইল গাজির মাথা কাটা পড়ে৷ তখন তাঁর প্রিয় ঘোড়া ইসমাইল গাজির দেহ নিয়ে চলে আসে গড়ে এবং সেখানেই তাঁর কবর তৈরি হয়৷ আর মুন্ডু কবর দেওয়া হয়েছিল অধুনা বাংলাদেশের রংপুরের কাটাদুয়ার গ্রামে৷

গ্রন্থঋণ:
১। রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, দে‘জ পাবলিশিং কলকাতা ৭০০০৭৩
২। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস (অখণ্ড সংস্করণ), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
৩। নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
৪। কেদারনাথ গুপ্ত, গৌরবময় গৌড়বঙ্গ, সোপান, কলকাতা
৫। সুস্মিতা সোম, মালদহ ইতিহাস-কিংবদন্তী, সোপান কলকাতা
৬। অনিরুদ্ধ রায়, মধ্যযুগের ভারতীয় শহর, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
৭। প্রদ্যোৎ ঘোষ, মালদহ জেলার ইতিহাস: প্রথম পর্ব, পুস্তক বিপণি, কলকাতা
৮। সিদ্ধার্থ গুহরায়, মালদা, সুবর্ণরেখা, কলকাতা
৯। কমল বসাক, শ্রীশ্রীরামকেলিধাম রূপ-সনাতন ও মালদহের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ, উৎসারিত আলো প্রকাশনী, মালদহ বুক ফ্রেন্ড, মালদহ
১০। সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর: স্বাধীন সুলতানদের আমল (১৩৩৮—১৫৩৮), ভারতী বুক স্টল, কলকাতা
১১। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (মধ্যলীলা), শ্যামলাল গোস্বামী কর্তৃক সংশোধিত ও বিনোদবিহারী গোস্বামী কর্তৃকসম্পাদিত ও প্রকাশিত, বাণীপ্রেস, কলকাতা
১২। Creighton Henry, The Ruins of Gour described and represented in eighteen views; with a topographical map, Londan
১৩। John Henry Ravenshaw, Gaur its Ruins and Inscriptions, C. Kegan Paul & Co. London.
১৪। Khan Sahib M. Abid Ali Khan, Memoirs of Gour and Pandua, Bengal Secretariat Book depot, Calcutta.
১৫। Ghulam Husain Salim, The Riyazu-S-Salatin: A History of Bengal, Asiatic Society, Calcutta
(মূল বইটা ফার্সি ভাষায় লেখা। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন Maulavi Abdus Salam.)
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia, Wikimedia Commons
*পরবর্তী অংশ প্রকাশ পাবে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
গৌতম বসুমল্লিকের জন্ম ১৯৬৪ সালে, কলকাতায়। আজন্ম কলকাতাবাসী এই সাংবাদিকের গ্রামে গ্রামে ঘুরে-বেড়ানো আঞ্চলিক ইতিহাস-চর্চার সুবাদে। মূলত কলকাতার ইতিহাস নিয়ে কাজ করলেও, এখনও বাংলার বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ান ইতিহাস, স্থাপত্য বিষয়ক তথ্য সংগ্রহের জন্য। সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ [UGC, Human Resource Development Centre (HRDC)]-র আমন্ত্রিত অতিথি শিক্ষক হিসেবে পড়াচ্ছেন দীর্ঘকাল। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘কলকাতার পারিবারিক দুর্গাপুজো’।