কথা বলবার কথা বাংলার গ্রামীণ লোকনাট্য নিয়ে। কিন্তু সেদিকে যাবার আগে প্রথা মেনে একবার রবি ঠাকুরকে স্মরণ করা দরকার। দেখে নেওয়া দরকার রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধে তিনি নাট্যে দর্শক-কুশীলব সম্পর্কের বিষয়ে কী বলছেন।
“দুষ্যন্ত গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া সখীদের সহিত শকুন্তলার কথাবার্তা শুনিতেছেন। অতি উত্তম। কথাবার্তা বেশ রসে জমাইয়া বলিয়া যাও। আস্ত গাছের গুঁড়িটা আমার সম্মুখে উপস্থিত না থাকিলেও সেটা আমি ধরিয়া লইতে পারি–এতটুকু সৃজনশক্তি আমার আছে। দুষ্যন্ত-শকুন্তলা অনুসূয়া-প্রিয়ংবদার চরিত্রানুরূপ প্রত্যেক হাবভাব এবং কন্ঠস্বরর প্রত্যেক ভঙ্গি একেবারে প্রত্যক্ষবৎ অনুমান করিয়া লওয়া শক্ত, সুতরাং সেগুলি যখন প্রত্যক্ষ বর্তমান দেখিতে পাই তখন হৃদয় রসে অভিষিক্ত হয়; কিন্তু দুটো গাছ বা একটা ঘর বা একটা নদী কল্পনা করিয়া লওয়া কিছুই শক্ত নয়–সেটাও আমাদের হাতে না রাখিয়া চিত্রের দ্বারা উপস্থিত করিলে আমাদের প্রতি ঘোরতর অবিশ্বাস প্রকাশ করা হয়।” – রঙ্গমঞ্চ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমরা যারা শহরে নাটক করি, দর্শকের কল্পনাশক্তির ওপর তাদের বিশেষ ভরসা নেই। তাই আমাদের মঞ্চসজ্জার প্রয়োজন পড়ে। মঞ্চের ওপর আসল চেয়ার টেবিল বাক্স প্যাঁটরা সাজিয়ে অভিনয় করতে হয়। লোকনাট্যে কিন্তু সেটা নেই। খোলা আকাশের নীচে অভিনয়ে চলছে। একই জায়গা কখনও মন্দির তো কখনও রাজবাড়ি আবার কখনও পুকুর পাড়। সবটাই অভিনেতা এবং দর্শকের যৌথ কল্পনায় নির্মাণ করা। দর্শক এবং কুশীলবের এই যৌথ ভূমিকাই লোকনাট্যের সার্থকতা আর প্রাসঙ্গিকতার চাবিকাঠি।
এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি যেখানে বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র হচ্ছে শারীরিক দূরত্ব। আর সেই জন্যেই বিভিন্ন পারফরমিং আর্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই সময়ের প্রাথমিক সঙ্কট কাটলেও মানুষের মধ্যে (দর্শক এবং শিল্পী দু পক্ষেই) একটা ভীতি কাজ করবে। আমরা কতটা কাছে যাব বা আদৌ যাব কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে। শহুরে নাটক জীবনযাপনের কিংবা লোকাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নেই।
খন কুশান আলকাপ – গ্রামীণ নাটক ও সামাজিক লোকাচার
গ্রামীণ নাট্য কিন্তু প্রায় সম্পূর্ণরূপে রিচুয়ালিস্টিক অর্থাৎ লোকাচার নির্ভর। বিভিন্ন পালা পার্বণ পুজো আচ্চার সঙ্গে এর নিবিড় যোগ। অনেক সময় পালার আয়োজন করার ‘মানসিক’ অর্থাৎ মানত করাও হয়। তাই এই পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিতেও এরা সহজে গুরুত্ব হারাবে না। ধর্মীয় স্থান খুলে যেতেই মানুষ দলে দলে নিজেদের অনিশ্চয়তার ভার লাঘব করতে সেখানে যাবে। লোকনাট্যও তেমনই অনায়াসে মানুষকে টেনে নিয়ে আসবে আসরে। আসরই লোকনাট্যের ‘মঞ্চ’। এই আসরের মাঝখানে বাজনদারেরা আর চার দিক ঘিরে দর্শক। কোনও উইং নেই ড্রপসিন নেই, কোনও আড়াল নেই। দর্শকের মাঝখান দিয়েই অভিনেতাদের যাতায়াত।
কখনও গ্রামের স্কুলবাড়ির মাঠ কিংবা চন্ডিতলা, অথবা কারুর প্রশস্ত উঠোনেই বসে যেতে পারে আসর। উত্তরবঙ্গ আর আসামের কিছু জায়গায় আবার এই আসরের নাম ধাম বা খলান। যদিও বেশিরভাগ লোকনাট্য খোলা আকাশের নীচেই মঞ্চস্থ হয়, কিছু ক্ষেত্রে চাঁদোয়া টাঙানোর প্রথা আছে – যেমন কুশান পালায়। তবে কোনওরকম আধুনিক শব্দযন্ত্র, মঞ্চসজ্জা, আলোর কারসাজি ছাড়াই দর্শকের একেবারে কাছে পৌঁছে যাবার কৌশল কয়েকশো বছর আগেই রপ্ত করেছে এই আর্ট ফর্মগুলো। মায়াবন্দকী নামের একটা খন দেখেছিলাম। সেখানে এক চরিত্রের খুব টাকার অভাব দেখা দিয়েছে। সে দর্শকের সামনে গিয়ে যখন সেই কথা বলে সাহায্য চাইছে, দর্শক তাকে বিনাবাক্যইইআব্যয়ে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। আবার এমনও দেখেছি যেখানে পুলিশ চোরকে তাড়া করেছে আর তাড়া খেয়ে চোর পালাতে গেলে দর্শক পথ আটকে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে।

এই খন কথাটা এসেছে খন্ড বা কান্ড থেকে। মূলত দেখতে পাওয়া যায় দক্ষিণ দিনাজপুরে। খন সাধারণত দুরকমের হয় – খিসা আর শাস্তরি। খিসা শব্দটা আবার এসেছে কিস্সা অর্থাৎ কেচ্ছা থেকে। যেকোনও স্থানীয় ঘটনা থেকেই খিসা তৈরি হয়ে যেতে পারে। ধরা যাক গ্রামে একজন চাল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পরেরদিনই সেটা নিয়ে একটা খিসা হয়ে যাবে। আর পুরোটাই হবে মুখে মুখে ইম্প্রভাইজ করে। সংলাপ, গান, বাজনা গোটাটাই মৌখিক। কোথাও কোনও লিখিত টেক্সট, ডায়লগ কিচ্ছু নেই। একই গল্প নিয়ে বিভিন্ন আয়তনের খন দেখতে পাওয়া যায় – আধ ঘন্টাও হতে পারে আবার চরিত্র, গান সাবপ্লট বাড়িয়ে সেই গল্পই সারারাত ধরেও চলতে পারে। শাস্তরি খনের গল্প সাধারণত শাস্ত্র থেকে নেওয়া হয়। মহাভারত, রামায়ণ, বকাসুর বধ, নানারকম। একমাত্র পালাতিয়া খনের গল্প একেবারে কাল্পনিক। আর এক ধরনের খন দেখতে পাওয়া যায় হালুয়া হালুয়ানির খন। এর মূল বিষয় জমিতে হাল দেওয়ার নানা গল্প।
খন, কুশান, লেটো, দোতরা, আলকাপ, ডোমনী, এসবই অনুষ্ঠানভিত্তিক। পশ্চিমবঙ্গে আলকাপ মালদা জেলার লোকনাট্য হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় ওই একই নাট্য সংযাত্রা হিসেবেও পরিচিত। কুশান সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুনের মধ্যে – বিশেষ করে নবান্নের আগেপিছে। লবকুশের গল্প থেকে তৈরি পালা বলে এর নাম কুশান। আবার চোরচুন্নী বা চকচুন্দি দেখতে পাওয়া যায় কার্ত্তিক মাসে, কালিপুজোর সময়টায়।
আগেই বলেছি, বেশিরভাগ লোকনাট্যের সঙ্গে লোকাচারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়। যেমন সত্যপীরের গান। এটা বছরের যেকোনও সময়ই হয়। তেমনই বোলান, গম্ভীরা কিংবা বনবিবির পালা। মালদার গম্ভীরা গান-এর আয়োজন হয় চৈত্রমাসে শিবপুজোর সময়। বাংলাদেশে যে গম্ভীরা দেখতে পাওয়া যায় তাতে মুসলিম সমাজের প্রভাবে শিবের বদলে নানা-নাতির চরিত্র প্রধান হয়ে উঠেছে। আর একটু উত্তরদিকে, দক্ষিণ দিনাজপুরে গেলে, পালায় মুখোশের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যাবে। এই মুখোশের নাচকে বলা হয়মুখা নাচ বামুখা খেল। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে এগুলো বেশ জনপ্রিয়।
আলকাপ পালার বৈশিষ্ট হচ্ছে এর হাস্যরসের প্রাচুর্য আর নৈতিকতার পাঠ। সাধারণত আলকাপ নাটকগুলোয় একটা সমস্যার উদভাবনা করা হয় এবং তার সমাধান খোঁজা হয়। এই সমাধানের বিধান কখনও আসে মোড়লের চরিত্রের কাছ থেকে আবার কখনও স্বয়ং ভগবান মহাদেব শিবের কাছ থেকেও। আসর বন্দনা, ছড়া, কাপ, বৈঠকী গান আর খেমটা পালা – এই পাঁচ ভাগে আলকাপ পরিবেশনা করা হয়।

বিবর্তনের পথ
লোকনাট্যের যে ফর্মগুলো আমরা এখন দেখতে পাই তার বেশিরভাগই কয়েকশো বছর ধরে এই একই ধারায় বয়ে চলেছে। এমনকি প্রযুক্তির ব্যবহারও বিশেষ দেখা যায় না। বড়জোর রাতের পালায় হ্যাজাকের পরিবর্তে আজকাল হ্যালোজেন দেখা যায়। তবে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হল মহিলাদের অংশগ্রহণ। অতীতে তো বটেই এমনকি এখনও সিংহভাগ লোকনাট্যেই মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেন পুরুষ অভিনেতারা।
তবে এই ট্রাডিশন একটু একটু করে বদলাচ্ছে। খন নাটকের প্রথম মহিলা শিল্পী আকুলবালা সরকার। আকুলবালাদিকে দেখে এখন একজন দুজন করে মহিলা অভিনয়ে আসছেন। দিনাজপুরের অভিনেতাদের নিয়ে যখন আমরা হয়বদন মঞ্চস্থ করি, অনেক মহিলা স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এর একটা বড় কারণ অবশ্যই নিরাপত্তার অভাব, যা এখন রাস্তাঘাটের উন্নতির সঙ্গে বেড়েছে। আগে এক একটা নাটকের দল এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করত, মাঠেঘাটে রাত কাটাত – এই ব্যবস্থায় হয়তো মহিলারা স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। এটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু কোচ, সাঁওতাল, মেচ, রাভা, রাজবংশী ইত্যাদি যে জনজাতিদের মধ্যে এইসব লোকনাট্য প্রচলিত তাদের মধ্যে পর্দা প্রথা সে অর্থে নেই। মহিলারা চাষবাস এবং ঘরে বাইরের অন্যান্য সমস্ত কাজে পুরুষদের চেয়ে কম পারদর্শি নন। শুধুমাত্র নাট্যশিল্পে তাদের পিছিয়ে থাকার আর কোনও কারণ দেখি না।
লোকনাট্য যেহেতু সারা বছর চলে না, এর শিল্পীদের প্রায় প্রত্যেকেরই অন্য জীবিকা রয়েছে। বেশিরভাগই চাষবাস করেন। কেউ কেউ আছেন হরদার মতো। বীরভূমের হর গুপ্ত লেটোর গান করেন আর একটা কারখানায় হিসেবের খাতা লেখেন। শহরের এক শ্রেণীর মানুষ হয়তো এটা শুনে সহানুভূতিশীল হয়ে পড়বেন। কিন্তু এই পরম্পরা আজকের নয়। বরাবরের। বরং যখনই লোকশিল্প শহুরে নাটকের মতো রিচুয়াল কানেক্ট হারিয়ে ফেলবে, লোকাচারের নাড়ি ছিঁড়ে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠবে, শেকড়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। লোক শিল্পের পরিসর যত ছোট হয়, তত বেশি তার দর্শকের সঙ্গে যোগ। আর এই যোগাযোগ যতদিন বহাল থাকবে, লোকনাট্য থাকবে। লকডাউন থাকলেও থাকবে, না থাকলেও থাকবে।
অনুলিখন: পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়
নাটকের জগতে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচিত নাম। উইঙ্কল টুইঙ্কল, ব্রেন, ড্রিম ড্রিমের মতো একাধিক জনপ্রিয় ও সমাদৃত নাটকের পরিচালক। সম্প্রতি চলচ্চিত্র ও শর্ট ফিল্ম পরিচালনার কাজেও হাত দিয়েছেন।