সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজৈবনিক রচনা ‘সত্যি সাবিত্রী’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদ প্রতিদিনের রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র ‘রোববার’-পত্রিকায়। অনুলিখন করেছিলেন লেখিকা, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক শ্রীমতি লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। ২০১৯ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। সেই বই থেকে প্রকাশকের অনুমতিক্রমে দু’টি পরিচ্ছেদ বাংলালাইভে পুনর্মুদ্রিত হল। মহানায়কের সঙ্গে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ এখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাংলালাইভের তরফে বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ দে’জ পাবলিশিংয়ের কর্ণধার শ্রী সুধাংশুশেখর দে ও শুভঙ্কর দে মহাশয়কে। তাঁদের সহযোগিতায় লেখাটির পুনর্মুদ্রণ সম্ভব হল। বাংলালাইভ সমস্ত বানান ও বাক্যগঠন অপরিবর্তিত রেখে লেখাটি প্রকাশ করছে।
মহারাজ এ কী সাজে!
… দু’দিন পরে অনেক খোঁজখবর করে ভানুদা আমাদের বাড়ি এলেন— আর এলেন অদ্ভুত এক প্রস্তাব নিয়ে।
একবছর আগে যে-নাটকের প্রযোজক আমাকে তাঁর সাতমহলা বাড়ির কক্ষ থেকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, ভানুদা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। তাদের নাটক ‘নতুন ইহুদি’র জন্য তাঁরা একবছর পরে আবার আমাকেই নির্বাচন করেছেন। প্রযোজকমশাই নিজের ইচ্ছায় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, না দলের আর সকলের অনুরোধে কিংবা ভানুদার কথায় বাধ্য হয়ে আমাকে ডাকতে রাজি হয়েছেন— তা নিয়ে ভানুদা মুখ খুললেন না। শুধু বললেন, ‘উনি অনুরোধ করেছেন যেন তোরে নিয়ে যাই। তুই-ই করবি ওই নাটক।’
ভানুদার কথা শুনে প্রথমেই মন বিদ্রোহ করে উঠল। একবছর আগের ভীষণ অপমানের স্মৃতি দগদগে ঘা হয়ে যন্ত্রণা দেয় এখনও। তার ওপরেই আজ যেন কেউ নুনের ছিটে দিল।
মনে হল মারাত্মক সাহস! আমরা রিফিউজি হয়ে এই দেশে আসছি বলে কি আমাদের এত সস্তা ভেবেছেন!
ভানুদার মুখের পর বলে বসলাম, ‘না আমি ওই নাটক করুম না।’
ভানুদা বোঝালেন, ‘দ্যাখ সাবু নাটক যখন মঞ্চস্থ হইব তখন তো লোকে তোরে দেখব, ওই প্রযোজকরে তো দেখব না কেউ! তুই চ্যালেঞ্জ খান ল। যে নাটকে তরে বাদ দিসিল সকলের সম্মুখে অপমান কইরা তাড়াইয়া দিসিল, সেই নাটকখান যে তর লিগ্যাই উতরাইল, হেয়া তুই বুঝতে দে। চোরের উপর রাগ কইরা মাটিতে ভাত খাইস না। মনপ্রাণ দিয়া অভিনয় কইরা প্রমাণ কর ভাগ্য বিপর্যয়ে রিফিউজি হইয়া এই দ্যাশে থাকলেও আমরা বাঙালরা প্রতিভাবান, আমাগো প্রতিভার ধারেকাছে এই দ্যাশের মানুষ আইতে পারে না।’ ভানুদা যত এই কথাগুলো বলছিল ততই যেন কে আমার শরীরের ভেতর আগুনের ছ্যাঁকা দিচ্ছিল। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে যেন আগুন ধরে গিয়েছে। আগুন ধরেছে আমার আত্মমর্যাদায়, আগুন লেগে দাউদাউ করে পুড়ছে আমার আভিজাত্য। না-না, অনাহারে থাকলেও আত্মসম্মানবোধ তো বিসর্জন দেওয়া যায় না! যেমন করে হোক অপমানের জবাব দিতে হবে। আমি যদি চ্যালেঞ্জটাই না নিই তা হলে সেদিনের অপমানের উত্তর দেব কী করে?

শেষ পর্যন্ত বললাম, ‘আমি পার্ট করুম।’ বাড়ি থেকে কোনও বাধা এল না। কারণ ভানুদার সঙ্গে আমার, আমাদের পারিবারিক আত্মীয়তার সম্পর্ক। বাবা বললেন, ‘ভানু তুমি যখন দায়িত্ব নিছ তখন আমার কিছু কওয়ার নাই। তয় বুঝতেই পারতেসো সংসার চলে না। বড় অভাবের মধ্যে আছি। দেইখ্যো মাইয়াটা জানি দুইটা পয়সা হাতে পায়।’ ভানুদা আশ্বাস দিলেন টাকাপয়সা নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না।
প্রথম দিন ভানুদার সঙ্গে রিহার্সাল দিতে যাচ্ছি। ভানুদা লক্ষ করলেন আমি খালি পায়ে যাচ্ছি। বললেন ‘কী রে সাবু খালি পায়ে যাইতেছস যে!’
আমি বললাম, ‘আমার তো জুতো নাই। আমার একখানই জুতো। ওই জুতাখান পইরা ইশকুল যাই। জুতাখানের অবস্থা খুব খারাপ। জুতাখান যদি ছিঁড়া যায় তাইলে ইশকুলে যাইতে পারুম না। আপনে ভাববেন না ভানুদা। ইশকুলের বাইরে সব জাগায় আমার খালি পায়ে যাওনের অভ্যাস আছে।’
ভানুদা চলতে চলতে থামলেন। তাকালেন আমার দিকে। তারপর একটা কথা বললেন। যে কথাটা বাকি জীবনে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অত বড় খাঁটি কথা আর কেউ বলেনি আমাকে। ভানুদা বললেন— ‘বুইন রে কইলকাতার রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা যায় না। কইলকাতার রাস্তায় এত কাঁকর। এত খানাখন্দ যে খালি পায়ে হাঁটলে কখন যে তর পা ফসকাইয়া যাইব তার ঠিক নাই। আইর একবার পা ফসকাইলে কইলকাতার মানুষে তরে টাইনা তুলব না। তর দিকে ফিরাও চাইব না। তাই খানাখন্দ বাঁচাইয়া হাঁটতে হইব। কাঁকর বিছানো পথ দিয়া হাঁটতে গ্যালে পাও দুইখান রক্তে ভিজব। তাই তরে জুতো পইরা হাঁটতে হইব। জুতো হইল একখান বর্ম। আয় আমার লগে আয়।’
সাতমহলা বাড়িতে যাওয়ার বদলে ভানুদা আমাকে নিয়ে চললেন জুতোর দোকানে। জুতো কেনা হল। তারপর মহলা-কক্ষ মঞ্চস্থ হওয়ার নাটক। দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল তত সহ-অভিনেতা অভিনেত্রীদের চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারলাম আমার অভিনয় তাঁদের ভাল লাগছে। তাঁরা ক্রমশ এই নাটক নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন। এমনকী, একদিন ওই প্রযোজকমশাই-ও আমার অভিনয় দেখতে দেখতে সম্ভবত মুখ ফসকে বলেই ফেললেন— ‘কেয়াবাত!’ তার এই ‘কেয়াবাত’ আমাকে যুদ্ধের জয়গানে আরও মনোযোগী করে তুলল। আমি বুঝলাম যুদ্ধের মাঠে কাউকে এক ইঞ্চিও জায়গা ছাড়তে নেই। আপাতত এই নাটকের অভিনয়টাই আমার যুদ্ধের ময়দান।
রিহার্সাল রুমে দাঁড়িয়ে আমার প্রত্যেক দিন মনে পড়ত একদিন এই রিহার্সাল রুমে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমাকে মাছি তাড়ানোর মতো করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতেই আমি আরও শক্তিশালী যোদ্ধা হয়ে উঠতে লাগলাম। প্রত্যেক মুহূর্তে আমি নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। আমার লড়াই ছিল প্রত্যেক দিন আগের দিনের আমিকে হারিয়ে দেওয়ার লড়াই। আমি যেন এতদিন পরে এদেশ থেকে পাওয়া সমস্ত অপমান ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করে যেতে লাগলাম আমি। আর এভাবেই একদিন সেই দিনটা এল। আমার জীবনের সেই বিশেষ দিন— বোর্ড রিহার্সালের দিন।
আরও পড়ুন: অংশুমান ভৌমিকের কলমে অভিনেত্রী কাবেরী বসুর কথা
ওই দিন খুব কাছের কিছু লোককে নাটক দেখার নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তাদের মতামত নেওয়া হবে বলে। তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন আমার সেই স্বপ্নের পুরুষ। কিন্তু তাকে চোখে দেখার আগে সেকথা জানতামই না তো!
বোর্ড রিহার্সালের দিন সাজঘরে প্রথম শুনতে পেলাম তিনি এসেছেন। কথাটা শোনামাত্র সবকিছু ভুলে পড়ি কী মরি তাঁকে দেখব বলে ছুটেছি। দরজার পাশে ছিল ড্রেসারের ট্রাঙ্ক। সেই ট্রাঙ্কের একটা কোণ ছিল কাটা। হুড়মুড় করে যেতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম তার ওপর। আর্ত-চিৎকার। সাজঘরের অন্যরা ফিরে তাকাল। পায়ে ট্রাঙ্কের ওই কোণের খোঁচা লেগে দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন। সকলে হইহই করে উঠল। এ বলল ওষুধ লাগাতে হবে, ও বলল ভানুদাকে খবর দে।
আমার তখন অপেক্ষা করার জো ছিল নাকি? ওই রক্তমাখা পায়েই কোনওদিকে না তাকিয়ে সকলের কথা উপেক্ষা করে ছুটে গেলাম। উইংসের কোণ। সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাঁকে।
প্রথম সারিতে দর্শকের আসনে বসে রয়েছেন তিনি। আর তার চারপাশটা যেন আলো হয়ে আছে।
দু’চোখ ভরে দেখছি তাঁকে। আমার ব্যথা উধাও। দুনিয়ার আর সবকিছু ভুলে গিয়েছি তখন। কী অপরূপ সুন্দর মানুষটা! উনি আজ আমার অভিনয় দেখবেন! তখন মনে কী প্রবল ভয়! ওঁর সামনে অভিনয় করতে পারব তো? আমার যে মারাত্মক বুক ঢিপঢিপ করছে। সারা শরীরে হাজার ভোল্টের কারেন্ট। আমি তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছি না। পা দু’টো এমন কাঁপলে অভিনয়টা করব কী করে? আর গলা দিয়েও কি স্বর বেরবে আমার? সারা শরীর এমন কাঁপছে গলা দিয়ে ঠিকমতো কথা বেরবে তো!
আমি যেন মোমের মতো গলে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে। উনি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না শুধু মুগ্ধ হয়ে রক্তমাখা পায়ে আমি দেখে যাচ্ছি ওঁকে। প্রথম বেল পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে কে যেন আমাকে নাড়িয়ে দিল! আমার মনের ভেতর থেকে কে বলে উঠল— আমি যদি ওঁর সামনে ভাল করে অভিনয় না করতে পারি তা হলে আমার কথা ওঁর মনে থাকবে না। তাই আজ আমাকে এমন অভিনয় করতে হবে যাতে আমার অভিনয় দেখে উনি আমাকে মনে রাখতে বাধ্য হন। আর এইভাবেই একদিন ঠিক ওঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটে যাবে আমার। ওঁর কাছে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হবে আমার। আর সেই সৌভাগ্য আমাকেই অর্জন করতে হবে। আমার অভিনয় দিয়ে। মনে মনে কথা বলে চলেছি তখনও… একদিন তুমিও আমাকে ডাকবে, তুমি তো আমার ভগবান। ভক্ত চাইলে ভগবান তাকে না দেখা দিয়ে, না ডেকে পারেন না। তুমিও পারবে না। দ্বিতীয় বেল পড়ল। আমি সাজঘরে ফিরে গেলাম। তৃতীয় বেল পড়ার পরে নাটক শুরু হল।

মঞ্চে ঢুকলাম আমি। আমার কাছে আর সব মিথ্যে হয়ে গেল। দর্শকদের আসনে আমি শুধু একজনকেই দেখতে পেলাম। আমার আশেপাশে, সামনে-পেছনে আমি শুধু একজনেরই অস্তিত্ব টের পেলাম। আমি শুধু তাঁর উদ্দেশে তাঁর জন্য অভিনয় করে যেতে লাগলাম। আমার সমস্ত সংলাপ আমি তাঁকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলাম। ভুলে গেলাম আমার রক্তপাতের কথা। ভুলে গেলাম পৃথিবীর আর সবকিছু। ঘড়ির কাঁটা থমকে গেল।
আমি নিশ্চিত পৃথিবীতে যেন তখন খুব গোপনে দু’টো মানুষের ভেতর এক তরঙ্গ কাজ করছিল। কোনও ফুল ফোটার প্রক্রিয়া চলছিল। আমি সংলাপ বলতে-বলতে বুঝতে পারছিলাম খুব শিগগির আমার জীবনে একটা বদল আসতে চলেছে। খুব শিগগির কিছু একটা ঘটে যাবে আমার জীবনে। আমার এতদিনকার দীন-হীন জীবনের খোলনলচেটা কে যেন তার জাদুকাঠির ছোঁয়ায় একটু একটু করে বদলে দিচ্ছে… আমার মলিন জীবনটা বদলে যাচ্ছে। দর্শকের আসন আলো করে কে বসে আছেন তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন পাঠক বন্ধুরা। তবু বলছি তার নামটা উচ্চারণ করতে আজও আমার গায়ে কাঁটা দেয়।
তিনি উত্তমকুমার। আমার স্বপ্নের পুরুষ। আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালবাসা।
এ কি সত্যি না কি অন্য!
আমার মন বলছিল এ সবে দেখার শুরু হল। এখন থেকে উত্তমকুমারের সঙ্গে আমার দেখা হবে। কী করে হবে আমি জানতাম না। কিন্তু দেখা যে আমাদের হবেই এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। মনে আছে তখনকার দিনগুলো যেন হাওয়ায় গড়িয়ে যেত। অভাব ছিল কিন্তু অভাবের অনুযোগ ছিল না। হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল কিন্তু শরীর এবং মন কখনও ক্লান্ত হত না। একটা মানুষকে একবার দেখার পর থেকে জীবনটাই যেন বদলে গেল আমার! কটাদিন কাটতে না কাটতেই এক বর্ষার বিকেলে আমাদের নাটকের দলে এলেন তিনি। উত্তমকুমার। আমার গলা শুকিয়ে আসতে লাগল, বুকের মধ্যে আবার ধুকপুকুনি। তিনি যে এবার আর কারও সঙ্গে নয় আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন। আমি তো জানতাম এই দিনটা আসবে। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি এল, তখন আমার স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল।
রিহার্সাল শেষ করে আমি ওঁর কাছে গেলাম। দলের সকলের কাছে ওঁর কত খাতির! সবাই ওঁকে ঘিরে কত কী বলছে। কারও কথাই আর শেষ হচ্ছে না। অথচ আজ তো উনি অন্য কারও সঙ্গে নয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। শুধু আমার সঙ্গে। ঈশ্বর চাইলে আমার মতো এক সাধারণ মেয়ের কপালেও রাজদর্শন ঘটে যায় বইকি! আমি সকলের শেষে দাঁড়িয়ে আছি। কুণ্ঠিত ভীরুভাবে। এমনিতে আমি মোটেই ভীরু নই— যথেষ্ট সাহসী হয়েছি এতদিনে। লজ্জাবতী লতা তো কোনওকালেই ছিলাম না। উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা না হলে আমি বোধ হয় কোনওদিনই জানতে পারতাম না, আমিও তার ছোঁয়ায় কতটা লজ্জাবতী লতা হয়ে উঠতে পারি!

উত্তমকুমার চিরদিনই অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। তাঁর ভদ্রতার কোনও জুড়ি ছিল না। উনি ধৈর্য ধরেই সকলের সব কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। একসময় সবার সঙ্গে কথা বলা শেষ হলে তার সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে ডাকলেন।
‘আপনার নাম তো সাবিত্রী?’
তাঁর গমগমে গলার স্বরে আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। মাথা নিচু করে বললাম, ‘হ্যাঁ।‘
উনি সময় না নিয়ে সরাসরি বললেন— “আপনি আমাদের দলে নাটক করবেন? আমাদের দলের নাম ‘কৃষ্টি ও সৃষ্টি‘। আমরা ভানু চট্টোপাধ্যায়ের একটা নাটক করি। আমাদের দলে আপনার মতো একজন সু-অভিনেত্রী চাই।’
কথা শেষ করে উনি পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমিও ওঁর দিকে তাকিয়ে আছি। জানি এত দীর্ঘ সময় কোনও মেয়ের কোনও পুরুষমানুষের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা অশোভন। উনি হয়তো কিছু ভাবছেন। কিন্তু আমি যেন একটা চৌম্বকক্ষেত্রে আটকে গিয়েছি। আমি নিজের ইচ্ছেতে যেন চোখ নামাতে পারছি না। উত্তমকুমারও তাকিয়ে আছেন আমার চোখের দিকেই। মাঝখানে যেন সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবিচল, অনড়।
উনি আমাকে কী জিগ্যেস করেছেন সে-কথা আমি ভুলে গিয়েছি। যখন আমার দৃষ্টি সরল তখনও তাঁর মুখই আমার চোখে ভাসছে।
উত্তমকুমার এই পরম আকাঙ্ক্ষিত নৈঃশব্দ্য ভাঙলেন। বললেন, ‘আমি দলে বলে এসেছি আপনার মত জেনে আসব।’
আমি খুব আস্তে বললাম, ‘আমি কিছু জানি না। আপনি আমার বাবার সঙ্গে কথা কইবেন।’ উত্তমকুমার মৃদু হাসছেন। আমার মুখে বাঙাল কথা শুনে নাকি আমার বাবার কথা বলায়— জানি না। আমি কী করব, আমাদের বাড়িতে যে ওরকমই শাসন ছিল। নিজের ব্যাপারে নিজের কিছু বলার অধিকার ছিল না। বাবা যা ঠিক করে দিতেন, তা-ই হত।
চলে আসতে আসতে ভাবছিলাম, এত বড় একটা সুযোগ হেলায় হারালাম। এ-জীবনে আর কোনওদিন কি আর এমন সুযোগ আসবে আমার জীবনে? উত্তমকুমারের প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ না বলে তাকে আমি আমার বাবা দেখালাম। বয়ে গিয়েছে তার আমার বাবার কাছে এসে দরবার করতে। আমার মতো মেয়ে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর উনি হয়তো আমার ওপরে এমন বিরক্ত হয়েছেন যে, আর কখনও ফিরেও তাকাবেন না আমার দিকে।
মনখারাপ নিয়ে শুয়েছিলাম। পরের দিন রিহার্সালে যাইনি। কিছুই যেন ভাল লাগছিল না। মা বারবার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করছে, নিজেই বলছে, ‘আর জ্বর তো গায়ে নাই। তয় কী হইছে তর?’ বারবার একই কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হয়ে খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘কইতাছি তো কিছু হয় নাই। এমনে শুইয়া থাকতে পারুম না একটা দিন?’
মা চুপ করে চলে গেল। বাবা বললেন, ‘হইছে কী তর? মায়রে খেঁকাইলি ক্যান?’
আমার কী হয়েছে তা তো আমি কিছুতেই কাউকে বলতে পারব না। আমার মন হারিয়েছে এই প্রথম।
হঠাৎ খুব কান্না পেল। পৃথিবীটা বিধ্বস্ত মনে হতে লাগল। মনে হল বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই। কী হবে বেঁচে থেকে আমার? শরীরের ভেতর উথালপাথাল কষ্ট-কান্না। আমাদের একটা খড়ের বাড়িতে তো মন খুলে কান্নারও উপায় নেই। কারওর না কারওর চোখে পড়বেই সে চোখের জল। তখন আরও হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া। একটা ছেঁড়া কাঁথা নিয়ে মুড়ি দিয়েছি সারা শরীর। মাথা-মুখও ঢেকে নিয়েছি ওই কাঁথায়। এবার আমার কান্না আড়াল পড়েছে। সারা শরীর ফুলছে কান্নায়। আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমার যেন কী হারিয়ে গিয়েছে। খুব মূল্যবান কিছু।

ঠিক এই সময় আরতিদি বাইরে থেকে ছাত্র পড়িয়ে ঘরে ঢুকছে। কাকে যেন নিয়ে এসেছে। আরতিদির গলা শুনতে পাচ্ছি, ‘আসেন ভিতরে আসেন।’ এই ভরবিকেলে কে এল আবার! আমাদের বাড়িতে তো তেমন কোনও অতিথি আসে না আমরা গরিব বলে।
বাবা জিগ্যেস করলেন, ‘কেডা? আইছে কেডা?’
আরতিদি বলল, ‘উত্তমবাবু আইছেন। আসেন ভিতরে আসেন। ভাঙা বাড়ি। আপনের খুব কষ্ট হইবো।’ আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মেঘে মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশে যেন হঠাৎ রামধনু জেগে উঠল। আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলাম। উত্তমকুমার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। বাবা বললেন, ‘বইসো বাবা। এই খাটেই বসতে হইবো, আমাগো বাসায় একখান চেয়ারও নাই।’ আমাদের এই নিদারুণ দারিদ্র উত্তমকুমার দেখে ফেললেন বলে আমি যেন আর লজ্জায় বাঁচি না। মজার কথা, আজ উত্তমকুমার আমার সঙ্গে কোনও কথা তো বলছেনই না, ফিরেও তাকাচ্ছেন না আমার দিকে।
তিনি বাবাকে প্রস্তাব দিলেন— ‘আপনার মেয়েকে চাইতে এসেছি আমাদের নাটকের দলের জন্য।’
বাবা কিছুক্ষণ ভাবলেন। আমার তখন প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে এক যুগ! এদিকে উত্তমকুমার বাড়িতে এসেছেন বলে দিদিরা দোকানে গিয়ে মিষ্টি কিনে এনেছে। মা আর দিদিরা যথাসাধ্য যত্ন করতে লাগল তাঁকে।
উত্তমকুমারের মতো অমন অমায়িক মানুষ আমি আমার জীবনে আর দেখিনি এ-কথা হলফ করে বলতে পারি।
উনি আমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে ওই অল্প সময়ে এত সুন্দরভাবে মানিয়ে নিলেন, বাড়ির সকলে তো রীতিমতো মুগ্ধ! মায়ের দু’চোখে প্রশংসার ঝিলিক। দিদিদের মুখে ক’টাদিন উত্তমকুমারের কথা ছাড়া আর কোনও কথা নেই।
বাবা ভাবনাচিন্তা করে উত্তমকুমারকে জানালেন, ‘হ্যায় যাইতে পারে কিন্তু নিজে যাইতে পারবো না। আমি তো ওরে একা ছাড়ুম না। ওরে তোমাগো নাটকের দলে লইতে হইলে তোমাগো কাউরে আইস্যা লইয়া যাইতে হইবো, আবার বাড়ি পৌছে দিতে হইবো।’
উত্তমকুমার বললেন, ‘ওইজন্য ভাববেন না। আমি প্রত্যেক দিন নিজে এসে ওকে নিয়ে যাব, আবার নিজে পৌঁছে দিয়ে যাব।’

ওহ ঠাকুর, পৃথিবীটা এত সুন্দর! বেঁচে থাকার এত আনন্দ! একটু আগেই গভীর বিষাদ আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল যে, মনে হচ্ছিল মরে যাই। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পৃথিবীটাই যেন সবুজে সবুজ হয়ে উঠল।
আমি কথা বলতে পারছিলাম না। উত্তমকুমার আমার সূত্রেই আমাদের বাড়িতে এসেছেন অথচ আমি ওঁর সঙ্গে একটা কথাও বলিনি এতক্ষণ। উনিও আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে চেনেন এমন আভাস দেননি। অভিমান হচ্ছিল মনে মনে। মনে মনেই যত ঝগড়া করলাম ওঁর সঙ্গে। একা একাই।
যাওয়ার সময় উত্তম বাবাকে বললেন, ‘তা হলে এই কথাই রইল। আমি কাল থেকেই আসছি। কালই ওকে নিয়ে যাব। আমি ঠিক চারটের সময় চলে আসব। আসি তা হলে।’
বাবা থামালেন, ‘আমার যে আরও একখান দরকারি কথা কওয়ার আছে।’
উত্তম থামলেন। আবারও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম, হে ঠাকুর দেইখ্যো, বাবায় যেন মানী মানুষটারে টাকাপয়সার কথা কইয়া অপমান না করে।
যা ভেবেছিলাম তাই হল। বাবা বললেন, ‘আমার মাইয়া যে নাটক করতে যাইবো, তারে তো এমনি এমনি ছাড়তে পারুম না।’
আমার মনে হচ্ছিল, হে ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু বাবা যখন একবার শুরু করেছেন তখন তো আর শেষ না করে ছাড়বেন না! বাবা বলে চলেছেন— ‘সংসারে এত অভাব। ভাল কইরা প্যাট ভইরা খাওয়া জুটে না। আমাগো তো লজ্জা নিয়া বইয়া থাকলে চলে না। তাই তোমারে খোলাখুলি কইতাছি, টাকা না দিলে আমার মাইয়ারে ছাড়ুম না।’
আমার দু’কানে কেউ যেন গরম ঘি ঢেলে দিচ্ছে। উত্তমকুমার জানতে চাইলেন, ‘ঠিক কত টাকা হলে ও পারবে?’ বাবা দ্বিধাহীন গলায় বললেন, ‘পঞ্চাশ টাকা আগাম দিয়া যাইতে হইবো। মানে রিহার্সালে যাওনের আগে পঞ্চাশ টাকা দিতে হইবো আগাম। তাইলে ও রিহার্সালে যাইবো।’
উত্তমকুমার তক্ষুনি নিজের পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে বাবার হাতে দিলেন।
জীবনে অনেক অপমান সয়েছি তবে সেদিনের অপমানের বোধ হয় কোনও তুলনা আজও পাইনি।
উত্তমকুমার চলে যেতেই বাবার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম—‘ক্যান উত্তমকুমারের মতো একজন মানুষের নিকট টাকার কথা কইতে গেলা তুমি! ক্যান? কও?’
বাবা অবিচল। বললেন, ‘প্যাটে খিদা মুখে লাজ লইয়া কী হইবো। উত্তমকুমার বইল্যা তো আর আমার অভাব কমবো না! যা করছি, ঠিক করছি। অভাবে না পড়লে কি তোমারে আমি নাটক করতে দিতাম না কি? নাটক করতাছো পয়সার লিগ্যা, তাইলে পয়সার কথা কমু না ক্যান?’
বাবার যুক্তি অকাট্য। এরপর আমার আর কিছু বলার রইল না। তবু বারবার মনে হতে লাগল মানুষটা কী ভাবলেন। ছিঃ, ছি ছি ছি! কী করে মুখ দেখাব কাল ওঁর কাছে!
*চিত্রসৌজন্য: Celebrityborn, Cinestaan, Pinterest, Youtube
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বাংলার সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীদের একজন। তিনি এক লড়াইয়ের মুখ। পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিক্রমপুর থেকে শৈশবে কলকাতায় এসে ক্রমে নাটক ও পরে ফিল্মে অভিনয়ের মাধ্যমে খ্যাতির চূড়ায় ওঠেন। অভিনয় করেছেন অজস্র বাংলা ছবি ও নাটকে। টিভি ধারাবাহিকে এখনও দাপটের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। প্রথম জীবনের অপমান, লাঞ্ছনা, দারিদ্র উপেক্ষা করে তৈরি করেছেন নিজের অবিসংবাদী স্থান, ঘটিয়েছেন এক নিঃশব্দ মহাবিপ্লব।