রান্নার কি কোনও দর্শন আছে? রান্নাঘরের দালানটিতে বসে বসে যিনি খুব সুচারু হাতে কুটনো কোটেন,মশলা বাটেন– তাঁর হাতে লেগে থাকা কষ, হলুদের ছাপ ক্লান্ত চোখে কি কেবল কোনও বিষাদ প্রতিমা জেগে থাকে? তা তো নয়! কেউ কেউ ভালোবেসেও রান্নাঘরের দাওয়াটিতে ফিরে আসেন। এই ফিরে আসার মধ্যে শ্রম মেধা আর শ্রদ্ধাও মিলেমিশে থাকে বইকি। তখন আর রান্নাঘরকে কেবল বিকেলের মরা আলোয় পতঙ্গভূক পাখিদের মতো বিবর্ণ বলে বোধ হয় না। বরং জীবনের নানা উত্তাপে তাকে মানুষেরই সহচর বলে বোধহয়। যে মানুষ কবি, দার্শনিক, শিল্পী! সেই তো সময়ে সময়ে জীবনের দাবি নিয়ে রান্নাঘরে এসে পৌঁছায়! ডাল ভাত চচ্চড়িও কেমন করে শিল্পসুষমায় মুড়ে দিতে হয় সেকথাও জানেন কেউ কেউ। তাঁদের কাছে রান্না একটা উদযাপন। জীবনের দাবি নিয়ে জেগে উঠবার গান। অনেকদিন পর আশ্বিনের সকালে জ্বর ছেড়ে গেলে পথ্যির বাটি হাতে যিনি বিছানার পাশটিতে এসে দাঁড়ান তাকে আমরা কেবল শুশ্রূষার ভাষাতেই ডাকব! মানুষের পথ্যি কেমন করে রাঁধতে হয়, কোন অসুখের পরে কালোজিরে বাটা দিয়ে ভাত মেখে খেতে হয়, কোন অসুখে কাহুদির (পানি টেঙা) স্পর্শ লাগে সে কথাও তো শিখতে হয়, জানতে হয়!
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী লিখেছেন কেমন করে পোড়ের ভার রাঁধতে হয়। নতুন মালসায় পুরনো দাদখানি চালে জলে সে রান্না নিতান্তই সামান্য। ঘুঁটের আঁচে আস্তে আস্তে ফুটে ফুটে সে ভাত নরম সুসিদ্ধ হয় জীবনকে ভালোবেসেই। আমরা চিনা জাপানি রান্না নিয়ে যত কথা বলি, সেসব রান্নার দর্শন বা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যত চর্চা করি তার ছিটেফোঁটাও করিনি আমাদের মাসি পিসি বা ঠাকুমাদের পথ্যি রান্নার হাতযশ নিয়ে। অথচ করাই যেত। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর মতো সে যুগে যাঁরা রান্নার খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ কিন্তু রেসিপি বাতলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসব খাবারের খাদ্যগুণ পুষ্টিগুণ বা ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কেও সচেতন করে দিতে চেয়েছেন বারবার। প্রজ্ঞাসুন্দরীর যারা সচেতন পাঠক তারা নিশ্চয়ই পড়েছেন, কেমন করে ইলিশ মাছ বানাতে (কাটতে) হয়। আসলে নিছক খাদ্য নয়,তাঁরা খাদ্যগুণের কথাও ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই। এতদিন পরে ফিরে তাকালে তাই দেখি কিরণ লেখা রায় বা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী যেভাবে রান্নার ভিতরের দর্শনটিকে ছুঁতে চেয়েছিলেন তেমন করে সবাই কিন্তু ছুঁতে পারেননি। এই দর্শনের ভিতরে তলিয়ে গিয়ে কেউ কি ফিরে আসেন না রান্নাঘরে? আসেন তো।
সারা পৃথিবীতেই রান্না নিয়ে কত রকমের যে কাজ কাজ করছেন কতজন! কোরিয়ান বৌদ্ধ শ্রমণ থেকে শুরু করে ইথিওপিয়ার প্রান্তে রান্নার গল্প প্রতিদিন নতুন করে রূপকথা লিখছে। সেসব রূপকথার পাতা ওল্টাতে গিয়ে একদিন দেখা হয়ে গেল সামান্থা গোয়িং (Samantha Gowing)-এর সঙ্গে। পৃথিবীর রাঁধুনিদের গল্প যাঁরা নতুন করে বলতে চাইছেন প্রতিদিন, সামান্থা তাঁদেরই একজন। সুষম আহারের সঙ্গে পুষ্টির সূত্রগুলো জুড়ে জুড়ে ও রান্নার বিনুনি বোনে প্রতিদিন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ওর রেস্তোরাঁ। আজ থেকে কয়েকবছর আগেও রেস্তোরাঁয় গিয়ে স্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে নাও চাইতে পারতেন মানুষেরা কিন্তু সামান্থা হাল ছাড়েননি। ওঁর ভাষায় –
”আমি একটা পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম। নব্বইয়ের দশকে একটা গ্যোস্ট্রো পাবে স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা সহজ ছিল না। মরসুমি ফল-মাছ-সবজি, কিচেন গার্ডেন, ওষধি গাছগাছালি নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, মানুষকে এটা বোঝানে দরকার, স্বাস্থ্যকর খাবার মানেই ব্রাউন রাইস আর ডাল নয়। তাই আমি ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট হবার ট্রেনিং নিলাম এবং নিজের অরগ্যানিক রান্নার স্কুল শুরু করি। নাম দিই ‘ডোন্ট প্যানিক ইটস অরগ্যানিক’।
(I wanted to make a change. In 90’s, it wasn’t feasible to introduce a healthy menu to an old gastro pub. Seasonal produce, kitchen gardens and growing medicinal leaves weren’t really a thing. But I had a gut feeling. I wanted to help people realise that healthy food didn’t have to be just brown rice and lentils. So, I retrained to become a Qualified Clinical Nutritionist and began my organic cooking school called ‘Don’t Panic,it’s Organic. …)

সামান্থা আয়ুর্বেদ থেকে শুরু করে চৈনিক দার্শনিকদের আলোচনা পড়েছে, দেখেছে পৃথিবীর ইতিহাসে রান্নার সঙ্গে বিজ্ঞান আর শরীরচর্চার কী নিবিড় যোগ। এসব আলোচনায় কখনও ঢুকে পড়েছে শরীরবৃত্তীয় আরও কত না অনুষঙ্গ। কোনও কোনও খাবার শরীরকে ঠাণ্ডা করে, কোনওটা আবার করে তোলে উষ্ণ। সেসব খুবই সাধারণ উপাদান হয়তো বা ধরা যাক এই আমাদের অতি চেনা শসা, আদা বা সেলেরির মতোই। সেসব ব্যবহারের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে সামান্থা। রান্না যে কেবল খুন্তি নাড়া নয় সেকথা আগেও বলেছি হয়তো, সামান্থাও বিশ্বাস করে মানুষে মানুষে খাদ্য প্রতিক্রিয়া বদলে বদলে যায়। একেকজনের শরীর একেক রকমের। সেসব বুঝেই তো রান্না করতেন আমাদের মা মাসিরা। কোল পোঁছা পেটরোগা ছেলের জন্য সেসব মায়েদের ভাবনার অন্ত ছিল না। বয়াম ভরে পুরনো তেঁতুল, শুকনো পাটপাতা, পলতা পাতা মজুত করে রাখতেন তারা। আসলে তারা ব্যক্তি মানুষের গ্রাহ্য-গ্রাহকের বোধকে প্রাধান্য দিতে জানতেন।
বিশ্বায়ন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে সন্দেহ নেই, নিয়েওছে অনেক কিছু। আঞ্চলিক খাদ্য-খাবারের শৃঙ্খলকে সে প্রতিদিন ভেঙেচুরে দিয়েছে। সামান্থা একটি বাণিজ্যিক রেস্তোরাঁয় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে শাক পাতা সামুদ্রিক শ্যাওলার স্বাদ। আপাতভাবে দেখতে গেলে সুনির্বাচিত ক্যালোরি মাপা প্লেটিং সেসব। কিন্তু সামান্থা চেয়েছে, মানুষ সুষম আহারের সু-স্বাদকে চিনে নিক। চিনতে শিখুক। কোন শাকে ম্যাগনেসিয়াম বেশি, কোন শাক কাঁচা না খাওয়াই ভাল এসবও তো শিখতে হয়! ক্লিনিক্যাল কুকিং স্কুলের বাইরেও তার একটা বৃহৎ ক্ষেত্র ছিল আমাদের অতীতে। পাটপাতাকে আমরা তখন কুলিং এজেন্ট বলেই চিনতাম। এই চেনাজানা অভ্যাস থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি বলেই আজ আলাদা করে সুপার ফুড (super food) খুঁজতে হয়।
সামান্থার সঙ্গে আমার কোনওদিন দেখা হবে না বোধহয়। তাঁকে তাই আর বলাও হবে না, আমাদের মায়েরাও নিজেদের মতো করে বহু বছরের অভ্যাসে খাদ্য খাবারের মেডিসিনাল প্রপার্টিগুলো (medicinal property) চিনেছিলেন। গরমের দিনে তারা কালোজিরে ফোড়ন, ঝিঙে দিয়ে বাটা মাছের হলুদ ঝোল রাঁধতেন যেমন, তেমনই বর্ষার গা ম্যাজম্যাজে দিনে কালোজিরে বাটা আর দু ফোঁটা সর্ষের তেল দিয়ে ভাত মেখে দিতেন প্রথম পাতে। সেই কালোজিরেরই কিন্তু প্রয়োগ কত আলাদা দেখুন! সামান্থাকে মানুষ চেনেন জানেন। ওঁর কাজ ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে। মানুষ আরও খানিক নিষ্ঠায় আর বিশ্বাসে খাবারের থালাটির পাশে এসে বসুক। এইটুকুই তো। বাঙলির পথ্যি নিয়ে একখানা বই কি লেখা হবে না!
ছবি সৌজন্য: Pinterest
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।