‘তা হলে, মাধবীলতা এখন কার?’
‘আগে আমার ছিল। এখন তোমার হয়ে গিয়েছে।’
বছর চোদ্দো আগের কথা। নন্দন ও আরও সতেরোটি হলে মুক্তি পেয়েছে সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’। পরিচালনায় গৌতম ঘোষ। ছবির অসাধারণ সাফল্যের পর এমনই কথা হয় দু’জনে। সদ্য প্রয়াত লেখক সম্পর্কে বলতে গিয়ে গৌতম ফিরে গেলেন সেই ‘কালবেলা’তেই।
অথচ ‘কালবেলা’ তৈরি হয়েছিল আট পর্বের দূরদর্শন ধারাবাহিক হিসাবে। শুটিং শুরু হয় ২০০৭-এ। গৌতম বললেন, “ধারাবাহিকটি অনুমোদনের জন্য দূরদর্শনের স্ক্রিনিং কমিটিতে ছিলেন মৃণাল সেন, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়। একদিন ম্যাক্সমুলার ভবনে সব ক’টি পর্ব দেখে তাঁরা বলেন, ‘এটাকে সিনেমা হিসাবে বানালে না কেন?’…”
তখন গৌতম ছ’ঘণ্টা সময়সীমার ধারাবাহিককে সম্পাদনা করে আড়াই ঘণ্টার ছায়াছবিতে নিয়ে এলেন। আগে ছবি মুক্তি পায়, দূরদর্শনে ধারাবাহিকটি দেখানো হয় অনেক পরে।

সেই সময় দূরদর্শন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কিছু আঞ্চলিক লেখা ছোট পর্দায় ধারাবাহিক হিসাবে দেখানো হবে। যোগাযোগ করা হয় আদুর গোপালাকৃষ্ণন, অমল পালেকর, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকদের সঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের তালিকা থেকে গৌতম নির্বাচন করেন ‘কালবেলা’কে। সেই খবর পেয়ে খুশি হন সমরেশও। গৌতমকে বলেন, “তুমিই পারবে।”
কিন্তু ‘কালবেলা’ই কেন? গৌতমের কথায়, “এ আমার যৌবনবেলারও গল্প, তাই সহজেই অনুভব করতে পারি। এই উপন্যাস সেই সময়ের দর্পণ। সেখানে মধ্যবিত্ত সমাজ আছে, খেটে খাওয়া মানুষ আছে, রাজনৈতিক নেতা আছে। সব থেকে বড় কথা, এটা একটা দারুণ প্রেমের গল্প। এই ছবির মাধ্যমেই বিশাল পরিচিতি হয় পরমব্রত, পাওলি ও রুদ্রনীলের।”
আরও পড়ুন: বরুণবাবু ঠিক করেছিলেন শারদীয়া বর্তমান হবে নিটোল পারিবারিক পত্রিকা
গৌতম মনে করেন, সমরেশ মজুমদারের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর তীক্ষ্ণ লেখনী ও বলিষ্ঠ চরিত্র-চিত্রণ। এর পাশাপাশি, তাঁর বাস্তবধর্মী সংলাপের সঙ্গে মিশে থাকত কবিতার অনুসঙ্গও।

চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য গৌতমের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘দখল’-এর রিভিউ করেছিলেন সমরেশ মজুমদার। আবার ২০১৩ সালে গৌতমের আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি ‘শূন্য অঙ্ক’র ভাবনা ও চিত্রনাট্যের অংশীদারও ছিলেন সমরেশ।
শুধু একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল। গৌতমের কথায়, “আমাদের অভিজ্ঞতা এত ভালো মিলে যেত। খুব চাইতেন আমি ওঁর ‘গর্ভধারিনী’ নিয়ে ছবি করি। সেটা হল না।”
একটু আসি ‘কালবেলা’র শেষটায়। “এখন অনিমেষের দু’হাতে একতাল নরম কাদা, যা নিয়ে ইচ্ছে মতন মূর্তি গড়া যায়।” সেই নরম কাদা, অনিমেষ-মাধবীলতার সন্তান অর্ক যখন বছর পনেরো, তখন শুরু ‘কালপুরুষ’। সেখানে তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তির বাসিন্দা অর্ক ঘুমচোখে তার বাবাকে বলছে, “ফোট তো, ন্যাকড়াবাজি করো না।” আবার অর্কই একদিন বস্তির পরিত্রাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই উত্তরণের গল্পই পরিচালক রাজা দাশগুপ্ত ধারাবাহিক হিসাবে তুলে ধরেছিলেন দূরদর্শনের পর্দায়— ন’য়ের দশকের গোড়ায়, সপ্তাহে একদিন করে।

তত দিনে সমরেশ সরকারি চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর টিভি প্রযোজক। দুই নাট্য ব্যক্তিত্ব— রমাপ্রসাদ বণিক ও অরিজিৎ গুহ’র সঙ্গে গড়ে তুলেছেন টেলিফ্রেম সংস্থা। রাজা দাশগুপ্তর আজও মনে আছে, একদিন রূপায়ণ কালার ল্যাবে একটা তথ্যচিত্রের কাজ করছেন, হঠাৎ খবর এল সমরেশ মজুমদার দেখা করতে এসেছেন। বাকিটা রাজার বয়ানে— “সমরেশদা বললেন, তিনি চান আমি তাঁদের জন্য ‘কালপুরুষ’ করি। অন্য দিকে শুনেছিলাম পরিচালক রাজা সেনও এই ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু সমরেশদা জানালেন রাজা সেন ব্যস্ত থাকায় এটি করতে পারছেন না। পরে রাজাও আশ্বস্ত করায় এই কাজে নেমে পড়ি। সেই থেকে সমরেশদার সঙ্গে আমারও জমে গেল।”
অনিমেষের চরিত্রে প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে আগেই বেছে রেখেছিলেন সমরেশ। বাকিরা সব রাজার পছন্দ। মাধবীলতা হলেন অনসূয়া মজুমদার, অর্ক কৌশিক সেন, ছোটমা চিত্রা সেন, জ্যাঠামশাই সুনীল সরকার, পিসিমা ভারতীদেবী, জুলিয়েন দেবতোষ ঘোষ, পরমেশ রমাপ্রসাদ বণিক। শিল্প-নির্দেশক অশোক বসুর তত্ত্বাবধানে কসবায় একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কার্ডবোর্ড কারখানা রূপান্তরিত হল বেলগাছিয়ার বস্তিতে। আর কিছু আউটডোর শট নেওয়া হল সমরেশের পাড়া, উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে। কয়েকটি শট নেওয়া হয়েছিল দমদম বিমানবন্দরের কাছে নারায়ণপুরেও।

প্রতিদিন সেটের পাশে শামিয়ানা খাটিয়ে থাকত এলাহি খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। শুটিং দেখতে সমরেশ কখনও কখনও বিকেলের দিকে সেটে চলে আসতেন। একটি পর্ব শুট করতে লাগত তিনদিন। চারটি পর্বের কাজ শেষ হলে এক সঙ্গে জমা দিতে হত দূরদর্শন ভবনে। মোট ১৬ পর্বে ‘কালপুরুষ’ দেখানো হয় দূরদর্শনে।
সব থেকে আশ্চর্যের, ‘কালপুরুষ’ করার আগে ট্রিলজির অন্য দুটি উপন্যাস, ‘উত্তরাধিকার’ ও ‘কালবেলা’ রাজা পড়েননি। কিন্তু একবার বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে গাড়িতে করে জলপাইগুড়ি যাওয়ার পথে সমরেশ রাজাকে যে বর্ণনা দেন, তাতে তাঁর মনে হয় ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটাই বোধহয় গোটা পড়া হয়ে গেল। বিবরণ তো নয়, ঠিক যেন টুকরো টুকরো ছবি। সেই গয়েরকাটা চা বাগান আর আংরাভাসা নদী। আরও একবার, গাড়িতে সমরেশ রাজাকে যে গল্প শোনান, সেটিই এক পুজো সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করে ‘ভিক্টোরিয়ার বাগান’ নামে।

টেলিফ্রেমের অন্যতম অংশীদার এবং অভিনেতা অরিজিৎ গুহ মনে করিয়ে দিলেন, তাঁদের ব্যানারে আটের দশকে দূরদর্শনের জন্য নির্মিত হয় ‘উত্তরাধিকার’, যেখানে অনিমেষের ঠাকুরদা সরিৎশেখরের চরিত্রে ছিলেন তিনি স্বয়ং। সমরেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সেতু ছিল থিয়েটার।
অরিজিৎ বললেন, “সেটা আটের দশকের মাঝামাঝি। একদিন সমরেশ ‘দেশ’ পত্রিকার নাট্য সমালোচক হিসাবে আমাদের নাট্যদল চেনামুখের ‘আগশুদ্ধি’ দেখতে এসেছিলেন। সদ্য শেষ হয়েছে জোছন দস্তিদারের সোনেক্স সংস্থার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘তেরো পার্বণ’। গল্প সমরেশেরই। তবু তিনি সোনেক্স ছাড়তে চাইছিলেন। এর পরই সমরেশ, রমাপ্রসাদ আর আমি মিলে গড়ে তুলি টেলিফ্রেম।”
দু’দশকে তৈরি হয় প্রায় আঠারোটি ধারাবাহিক, বেশিরভাগই দূরদর্শনের জন্য। কেবল টিভি তখন অনেক দূরের ব্যাপার। প্রায় সব গল্পই সমরেশের লেখা। প্রথম ধারাবাহিক, ১৯৮৬ সালের ‘মুক্তবন্ধ’ দিয়েই বিনোদন জগতে প্রবেশ রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের। সমরেশের গল্প ও স্ক্রিপ্ট নিয়ে পরের ধারাবাহিক ‘কলকাতা’ এত জনপ্রিয় হয় যে এটি দূরদর্শনই মোট ছ’বার দেখায়।
অরিজিৎ বললেন, “সেটি ছিল এক ফ্ল্যাটবাড়ির গল্প। সেখানে যে সব পরিবার বাস করে, তাদের প্রত্যেকের ভাষা, রুচি, সংস্কৃতি আলাদা। আর ছিলেন সেই বাড়ির কেয়ারটেকার নিবারণ ঢোল।” এই চরিত্রে ছিলেন সুনীল সরকার, যাঁকে সবাই চেনে ‘হীরক রাজার দেশে’র ফজল মিঞা বা ‘সোনার কেল্লা’য় মুকুলের বাবা হিসাবে।
‘উত্তরাধিকার’-এর পর টেলিফ্রেমের ব্যানারেই ১৯৯০ সালে নির্মিত হয় ‘কালপুরুষ।’ অরিজিৎ কিছুটা তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, “আজ আমরা আর টিভি প্রযোজনায় নেই বটে, কিন্তু আমাদের মাধ্যমেই বহু প্রতিভাবান শিল্পী প্রথম কাজের সুযোগ পান।”

সময়টা ১৯৮৫। বাংলা টেলিজগতে আত্মপ্রকাশ করল দুটি ধারাবাহিক, ‘সোনার সংসার’ ও ‘তেরো পার্বণ’। প্রথম ধারাবাহিকটির গল্প শংকরের লেখা, আর দ্বিতীয়টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে সমরেশ মজুমদারের নাম। এর বৈশিষ্ট্য ছিল এটি ধারাবাহিক হওয়ার অনেক পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই ধারাবাহিকটির চতুর্থ পর্ব থেকে জড়িয়ে ছিলেন পরিচালক জোছন দস্তিদারের ভাইপো এবং আজকের বিশিষ্ট তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার।
তাঁর কথায়, “পণ্ডিতিয়ার বাড়িতে তখন সাজো সাজো রব। সমরেশদা ও ছোটকাকা ‘ফ্যামিলি ড্রামা’র উপর জোর দিয়েছিলেন। দু’জনেই ছিলেন নাটক-অন্ত প্রাণ। ছোটকাকা যেমন টেনশন করতেন, কাকিমা ছিলেন ঠিক তেমনই ঠান্ডা। বেণু (সব্যসাচী চক্রবর্তী) প্রযুক্তি ব্যাপারটা এত ভালো বুঝত, যে ওকে আগে এই ধারাবাহিকের নায়ক হিসাবে ভাবাই হয়নি। প্রথম কয়েকটি পর্ব সল্ট লেকে শুট হলেও, যাতায়াতের সুবিধার জন্য পরে সাদার্ন এভিনিউয়ের একটি বহুতল বেছে নেওয়া হয়। তবে ‘তেরো পার্বণ’ যখন নব কলেবরে ফিরে আসে তখন সমরেশদা সোনেক্স ছেড়ে নিজের প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করেছেন।”
সেই ৮০-এর দশকে বাঙালি দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘তেরো পার্বণ’। পরবর্তীকালেও একের পর এক জনপ্রিয় টেলিসোপের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে সমরেশ মজুমদারের। এই জনপ্রিয়তা খুব বেশি লেখক পাননি। সেদিক থেকে দেখলে বলা যায়, একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাণিজ্যসফল টিভি সিরিয়ালের অন্যতম প্রধান কাহিনিকার ও প্রযোজক ছিলেন সমরেশ মজুমদার। সমাজ, রাজনীতির উত্তাল প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প উপন্যাসকেও তিনি অনায়াসে সাহিত্যজগতের গণ্ডি পেরিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরের চৌকাঠে নিয়ে এসেছিলেন, আর সেখানেই তাঁর সার্থকতা।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Wikipedia, লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ।
দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।