১৯৪৮ সাল। ষোলো বছরের এক কিশোরী তাবড় দুই সুরকারের সুরে প্রথম প্লেব্যাক করল। রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘অঞ্জনগড়’ ও রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘সমাপিকা‘ ছবিতে। তার আগেই অবশ্য সঙ্গীত জীবন শুরু হয়ে গেছে– ১৯৪৫-এ প্রথম বেসিক আধুনিক গান সে-ই গেয়েছে রেকর্ডে, গিরিন চক্রবর্তীর কথায়-সুরে। তবে তার হৃদয়-ছোঁয়া গায়নে মানুষের মনোযোগ আকর্ষিত হল ‘সমাপিকা’–র একাধিক গানে, ‘মানুষের মনে ভোর হল আজ’ বা ‘দেবতা চেয়েছি প্রতিমা গড়িয়া’ (কথা: শৈলেন রায়)। এক প্রতিশ্রুতিময়ী শিল্পীর উদয় হল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, যিনি অচিরেই সমস্ত সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে এগিয়ে চললেন। দীর্ঘ কয়েকদশক ধরে বাংলা গানকে শাসন করলেন সম্রাজ্ঞীর মতো। কত ধরনের গানই যে তাঁর ডালিতে ছিল। প্রধান অবশ্যই আধুনিক আর সিনেমার গান। তাঁর মূলধন সুরময় শীলিত কণ্ঠ, খুঁতহীন অলঙ্করণ, সেইসঙ্গে নাটকীয়তা, যা সিনেমার গানে খুবই দরকারি। এখানে আপাতত তাঁর ছায়াছবির গানের কথাই সংক্ষেপে আলোচনার প্রয়াস করছি।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নামটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যে-দুটি গান প্রথমেই মনে আসে, তা হল, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির (১৯৫৪) -র ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ বা ‘পথে হল দেরি’ ছবির (১৯৫৭)-র ‘এ শুধু গানের দিন’। এই দুটি গানের সুরকার সন্ধ্যার গানের দুটি বড় স্তম্ভ: অনুপম ঘটক ও রবীন চট্টোপাধ্যায়। ‘অগ্নিপরীক্ষা’–র পরিচালক গোষ্ঠীর (অগ্রদূত ) বিভূতি লাহা চাইছিলেন না ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটি সিনেমায় থাকুক। কিন্তু সঙ্গীত পরিচালক অনুপম ঘটক তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, এই গানটিই থাকবে। থাকলও তাই। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গান সন্ধ্যার কণ্ঠ ছুঁয়ে আজও অমলিন। সুরের জটিল চলন, সুকঠিন স্বরবিন্যাস কি অনায়াস নৈপুণ্যে রূপায়িত করেন সন্ধ্যা! গানের একটি জায়গা ‘কুহু’–তে গলার সুনিয়ন্ত্রিত আন্দোলন বুঝিয়ে দেয় শিল্পীর অসামান্যতা। একইরকম দুরূহ কিন্তু শ্রুতিসুখকর ওই ছবিরই ‘কে তুমি আমারে ডাক’ বা ‘দৃষ্টি‘ ছবির ‘ডাকে কোয়েলা‘ (শ্যামল মিত্রের সঙ্গে)।

রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে প্রিল্যুড- ইন্টারল্যুডে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানের অনবদ্য পার্টসমেত ‘এ শুধু গানের দিন’ মন মাতিয়ে দেয়। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরও সবসময় সহজ পথে হাঁটে না, তবে তারই মধ্যে মেলডি অটুট। সন্ধ্যাও তাকে সেইভাবে রূপ দেন। যেমন, ‘জানি না ফুরাবে কবে’ বা ‘ঘুম ঘুম চাঁদ’ (সবার উপরে)। পাশে কীর্তনভঙ্গিম ‘ও মন কখন শুরু’ (কমললতা, শ্যামল মিত্রের সঙ্গে) বা ‘হরেকৃষ্ণ নাম দিল’ (জয়া)-তেও সন্ধ্যা সফল।
‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’ বা ‘পথে হল দেরি’–তেই তৈরি হল সেই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের সুচিত্রা সেন-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জুটি, অর্থাৎ সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যার কণ্ঠ। একইভাবে অন্য ছবির সূত্রে উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই দুই পরস্পরের পরিপূরক জুটির সর্বোত্তম প্রকাশ অবশ্যই ‘সপ্তপদী’ ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রার বাইকে সওয়ার হয়ে নেপথ্যে হেমন্ত-সন্ধ্যার আনন্দ-উচ্ছল ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাইতে গাইতে পথেই হারিয়ে যাওয়া। রোমান্টিকতার শেষ কথা। সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত-সন্ধ্যার আরেকটি দ্বৈত গান ‘হংসমিথুন’ ছবির ‘আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে’ মনেও রঙ ছড়ায়, তবে নায়ক নায়িকা এখানে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন। হেমন্তরই সুর। হেমন্ত ছবির সিচুয়েশনটা দারুণ বুঝতেন, আর তাঁর সুরে এমন একটা সহজ মাধুর্য আছে যা হৃদয়স্পর্শী। হেমন্তর সুরে সন্ধ্যার এমনই কয়েকটি মনে রাখার মতো গান, ‘আকাশের অস্তরাগে’ (সূর্যমুখী) বা ‘কী মিষ্টি দেখ মিষ্টি’, ‘কেন এ হৃদয়’ (নায়িকা সংবাদ)।
অনিল বাগচি যখনই সুর করেন, তা অনেকটাই রাগভিত্তিক। তবে তার মধ্যেই একটা অন্য প্রসাদগুণ থাকে। সন্ধ্যার রাগসঙ্গীত-চর্চিত কণ্ঠ তার প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করতে পারে, যেমন, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’–র সুখ্যাত ‘আমি যে জলসাঘরে’ বা ‘তুঁহু মম মন’ গানে। ‘চম্পা চামেলি’ও চমৎকার। ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরে ‘বাঁধো ঝুলনা’– তে রাগের ব্যবহার অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। অসামান্য এই গান সন্ধ্যা গেয়েছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিখুঁত দক্ষতায়। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গোপেন মল্লিকের সুরে ‘জীবন মৃত্যু’ ছবির ‘কোনও কথা না বলে’।

আর এক বিশেষ তালিমপ্রাপ্ত শিল্পী মান্না দে-র সঙ্গে এ গান অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় খুব বেশি সুর করেননি ছবিতে, কিন্তু তার মধ্যেই তাঁর মুন্সিয়ানাটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। মানবেন্দ্রর বৈচিত্র্যময় সুরে সন্ধ্যাও স্বমহিম। ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে ‘ও বকবক বকবকম বকম পায়রা’ গানের নাটকীতাকে স্ফূর্তির সঙ্গে রূপায়িত করেন সন্ধ্যা। ‘জয়জয়ন্তী’ ছবিতে এক একটি গান একেকরকম। পাশ্চাত্য সঙ্গীতভিত্তিক ‘আমাদের ছুটি ছুটি’ বা ‘কে প্রথম চাঁদে গেছে’, তার পাশেই জয়জয়ন্তী রাগে ‘কেন ডাক’। পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুরেও ‘পিতা পুত্র’ ছবিতে নানা মেজাজের গান। সন্ধ্যার কণ্ঠে মেলডির ওপর ‘তীরবেঁধা পাখি আর’, ‘তুমি কত সুন্দর’ বা হেমন্তর সঙ্গে মিষ্টি দুষ্টুমিতে ভরা ‘রাগ যে তোমার মিষ্টি’।

সন্ধ্যা মন মাতিয়ে দেন শ্যামল মিত্রের মধুর সুরে ‘দেয়া নেয়া‘ ছবিতে ‘এ গানে প্রজাপতি’ বা রাজেন সরকারের সুরে ‘নতুন জীবন’–এর ‘আমি তোমারে ভালবেসেছি’ গানে। রাজ কাপুরের ‘একদিন রাত্রে’ ছবিতে সুরকার সলিল চৌধুরীকে অন্যভাবে আবিষ্কার করা যায় সন্ধ্যার অসীম নৈপুণ্যে গাওয়া ‘সে গান আমি যাই যে ভুলে’ গানে। এ গানের আমেজই আলাদা। নচিকেতা ঘোষের সুরে স্বরবিন্যাস ও ছন্দবিন্যাসে যে একটা স্বকীয়তা আছে, তা ধরা যায় ‘চিরদিনের’ ছবিতে ‘তুমি আমার চিরদিনের’ (মান্না দে-র সঙ্গে) বা ‘নিশিপদ্ম’–তে ‘আমার সকল সোনা মলিন হল’ গানে। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে আবার বিদেশি সুর-ছন্দের আবেশ ‘জীবন সৈকতে’–র ‘কেন যে কে জানে’ গানে। বিভিন্ন সুরকারের স্বতন্ত্র ধরনকে আত্মস্থ করে যেভাবে সন্ধ্যা বিভিন্ন গানকে প্রাণদান করেছেন তা অতুলনীয়। এই বিচিত্রতাই একজন শিল্পীকে সঠিকভাবে চিনিয়ে দিতে পারে। তাঁর গানে গানে জেগে উঠেছে স্বপ্ন-ছড়ানো ইন্দ্রধনু।
*ছবি সৌজন্য: ABP, Pinterest, Indiannation
স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l