মহাভারত আদিপর্বে দুষ্যন্ত দেখেছিলেন কণ্বের আশ্রমে পড়াশোনার চর্চা চলছে। কণ্ব যদিও তখন সোমনাথ মন্দির গিয়েছেন, কিন্তু আশ্রমে বেদ, বেদাঙ্গ, দর্শন, রসায়ন, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা চলছে। তাঁদের কাছে বিশাল বিশাল সব বই। সনাতন শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা আলোচনারত আর তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন প্রধান নাস্তিকরা।(Sanskrit)
নাস্তিক? শুদ্ধ ধর্মীয় বাতাবরণে নাস্তিক? যেখানে যজ্ঞের ধোঁয়া উঠছে, সেখানে নাস্তিক? বেদ দর্শন চর্চার মধ্যে নাস্তিক্যবাদ? সনাতনীদের মধ্যে নাস্তিকেরা? দ্রুত এর শুদ্ধকরণ প্রয়োজন।
আর কণ্বেরই বা কেমন কাণ্ডজ্ঞান? তিনি না হয় অনুপস্থিত, কিন্তু তাঁর আশ্রমে নাস্তিকরা অনুপ্রবেশের সাহস পেয়েছে কী করে?
অবশ্য, নাস্তিক শব্দটা মূলে নেই, আছে ‘লোকায়তিক’। তাদেরকেই নাস্তিক বলা হচ্ছে। চার্বাকদের বোঝাতে কৌটিল্য, ‘লোকায়ত’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। এখানে চার্বাকরাই নাস্তিক। পরে হরিদাস ‘লোকায়ত’ শব্দটা ভেঙে লিখেছেন – লোকেষু আয়তং(যার মানে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়) সুবোধত্বাদ্(সহজে বোঝা যায় বলে) অতিবিস্তৃতম্(ব্যাপক প্রচলিত)। এভাবে ব্যাখ্যা করার মানে, আস্তিক দর্শন বেশ কঠিন। তুলনায় নাস্তিক দর্শনের তত্ত্ব সহজ বলে মানুষ দৈনন্দিন সাধারণ জীবনযাপনে নাস্তিকতাকেই বেশি করে আপন করেছে।
এই নাস্তিক্যবাদের একটা মত লিখেছেন হরিদাস – অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমিবার্যনলানিলাঃ, মানে ভূত বা পদার্থ চারটে – ভূমি (অন্য দর্শনে ক্ষিতি), বারি(অপ), অনল(তেজ), অনিল(মরুৎ)।
আস্তিক্যবাদে পঞ্চ ভূতের ‘ব্যোম’ অর্থাৎ ‘আকাশ’ এর উল্লেখ নেই, সেখানে শূন্যস্থান। চার্বাকরা বা নাস্তিক্যবাদ শূন্যস্থান মানেনি। চার্বাকরা এরকম অনেক তত্ত্ব গ্রহণ করেছেন যা আস্তিক্যবাদীরা মানেন না, উল্টোটাও সত্যি, যেমন নাস্তিকেরা ঈশ্বর, স্বর্গ, বেদ কিছুই মানেননি যা আস্তিকেরা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন।
তাহলে এখানে নাস্তিকদের সঙ্গে একাসনে বসে আস্তিকরা কণ্বের আশ্রমে আলোচনা করছেন কেন?
সংস্কৃত: আজকের চোখে (পর্ব ১): ঊহ – দীপ্তসুন্দর মুখোপাধ্যায়
কারণটা অনুমান করা শক্ত নয়। যার যে মতই থাক, আপন মতের সঙ্গে না মিললেই তার কণ্ঠরোধ করতে হবে, তাকে বিরত করা হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে– এমনটা নয়। বরং সবাই সবার কথা শুনে, একে অপরের ধ্যানধারণার সঙ্গে কোথায় মেলে, কোথায় মেলে না, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কোনখানটায় একে অপরের থেকে আলাদা আর কেনই বা তা, সেটাই খতিয়ে দেখে নেওয়ার সুযোগ।
সৌজন্যপূর্বক আলোচনা ব্যাপারটা আসলে কী? এ হল সেই চেতনাবোধ যা যুগযুগান্তর ধরে ভারতবাসীকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুর শুনিয়েছে। আমাদের শৌর্য ও ধৈর্য্যের মেলবন্ধন।
শিক্ষা-সংস্কৃতিতে মনুষ্যত্বের উৎকর্ষে কারও একাধিপত্য হয় না, সে কথা গ্রহণ করেই মনুষত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়।
সাধারণভাবে মেলবন্ধন এর বিপরীত হল ‘বিবাদ’, এই শব্দেরও দুরকম মানে হয় –একাধারে ‘কলহ’ বা ‘ঝগড়া’ হয়, আবার অন্যধারে শাস্ত্র আলোচনাও হয়। পাণিনি লিখেছেন, ‘বিবদতি’ এবং ‘বিবদতে’ দুটো রূপই সিদ্ধ। ‘বিবদতি’ মানে শাস্ত্র আলোচনা করা আর ‘বিবদতে’ মানে কলহ বা বচসা করা।
এখন চার্বাক তথা নাস্তিক দর্শনের জনপ্রিয়তার ব্যাপারটা কী? এটা নিয়ে পরে বলার চেষ্টা করছি।
সংস্কৃত অনুরাগী দীপ্তসুন্দর মুখোপাধ্যায় কয়েক বছর ফেসবুকে লিখছেন। ভালবাসেন সংস্কৃত শাস্ত্র আর সাহিত্যের অধরা তাৎপর্য খুঁজতে, তার সঙ্গে আজকের সভ্যতার যোগসূত্র নতুনভাবে ভাবতে, বিশ্বসাহিত্যে সংস্কৃতের অবস্থান নির্ণয় করতে। যেখানে যান, বই কলম হাইলাইটার আর বুকমার্ক সঙ্গে থাকে।