মহাভারতের আদিপর্বে দুষ্যন্ত (Dushyanta) যখন মালিনী নদীর তীরে কণ্বের আশ্রমে যান কণ্ব তখন আশ্রমে ছিলেন না। শকুন্তলার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে রাজা খানিকক্ষণ আশ্রমটা ঘুরে দেখছেন।
এক জায়গায় দেখেন, পণ্ডিতদের মধ্যে বেদ-বেদাঙ্গ (Sanskrit) নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে উপনিষদ, ন্যায়দর্শন নিয়ে, ঊহ নিয়ে। বিদ্বজ্জনরা কথা বলছিলেন রসায়ন নিয়ে, আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা নিয়ে। পশুপাখিদের ভাষা বোঝা নিয়ে। দারুণ একটা অ্যাকাডেমিক পরিবেশ।
এর মধ্যে ঊহ কী? ঊহ হল পরিবর্তনের পদ্ধতি। ঊহ একটা বিরাট ব্যাপার। ধরুন আপনি শিবকে প্রণাম জানানোর সময় বলছেন, শিবায় নমঃ। নমঃ যোগে চতুর্থী। নরায় শব্দের মতো করে। বেশ। এবার ভগবানকে প্রণামের সময় কী বলবেন? ভগবানায় নমঃ?
না। ‘ভগবান’ শব্দ যেহেতু সংস্কৃতে শিবের মতো নর শব্দকে মেনে চলে না, শ্রীমৎ মেনে চলে, তাই শ্রীমতে ধরে ভগবতে নমঃ বলবেন। এটা হচ্ছে ঊহ। এটা একটা সাধারণ দৃষ্টান্ত। অনেক বড় ব্যাপার আছে, যেখানে ঊহ প্রয়োগ করতে হয়, বিশেষত যজ্ঞে।
আরও পড়ুন: কলকাতার কাঠ খোদাই (পর্ব ১২): চিৎপুর আছে চিৎপুরেই
তখন ব্যাকরণ তো জানতে হবেই, কিন্তু ব্যাকরণ ছাড়িয়ে যেটা আসলে বুঝতে হবে, সেটা হল একটা তত্ত্ব বা তার প্রয়োগ – যত উৎকৃষ্ট হোক – ভিন্ন পরিস্থিতিতে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কেমন পাল্টে যেতে পারে। কারণ ঊহ অনেক জায়গাতে হওয়া সম্ভব।
এটা আমরা প্রায় কেউই করতে পারি না। আমরা যেটা করি সেটা হল, একটা ভাল কিছু পেলে সেটা অন্ধের মতো অনুসরণ করে চলি। কিন্তু চারদিক যখন বদলায়, সেই তত্ত্বের পুনর্বিচার করা দরকার হয়ে পড়ে কখনও।
সমস্যা হয় এখানে যে, পুনর্বিচারটা করবে কে? যে করবে তার যে ভুল হবে না তার নিশ্চয়তা কী? ফলে সবাই মোটের ওপর মেনে নেন যে, যা চলছিল তাই চলুক। কী দরকার বাবা রদবদলে? তাতে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
এর মধ্যে ঊহ কী? ঊহ হল পরিবর্তনের পদ্ধতি। ঊহ একটা বিরাট ব্যাপার। ধরুন আপনি শিবকে প্রণাম জানানোর সময় বলছেন, শিবায় নমঃ। নমঃ যোগে চতুর্থী। নরায় শব্দের মতো করে। বেশ। এবার ভগবানকে প্রণামের সময় কী বলবেন? ভগবানায় নমঃ?
তাঁদের আশঙ্কা একেবারে সত্য। কিন্তু এটা সব থেকে ভাল না, যাকে বলে মন্দের ভাল। সেই জাতিই শ্রেষ্ঠ, যারা চারদিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই তত্ত্বটিকে যথার্থ প্রাসঙ্গিকতায় সর্বতোভাবে বুঝতে পারে, এবং কাল, সমাজ, সভ্যতা বিষয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞ হওয়ার সুবাদে, সঠিক ক্ষণে সঠিক ঊহ প্রয়োগ করে সেই তত্ত্বটিকে বাঁচিয়ে রাখে। শুধু বাঁচিয়ে রাখে না, নব নব জীবনীয় রসের ধারায় সঞ্জীবিত করতে পারে। অন্যথায় তত্ত্ব যত উৎকৃষ্ট হোক, শুকিয়ে গিয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
মনে রাখতে হবে, দোষ সেই তত্ত্বের নয় কখনই। দোষ তাদের যারা তত্ত্বটা অন্ধের মতো মেনেছে, পরিবর্তনশীল কালের প্রেক্ষাপটে না বুঝে ঊহ প্রয়োগ করতে পারেনি।
ঊহ কত বড় ব্যাপার সে কথা পতঞ্জলি মহাভাষ্যে লিখেছেন। বলেছেন বেদচর্চা যদি অব্যাহত রাখতে হয় তবে ঊহ জানতে হবে, এবং প্রয়োগ করতে হবে। আপনি বেদ ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ বা তত্ত্বও ধরতে পারেন, অসুবিধে নেই, ব্যাপারটা একই।

কে ঊহ করার ক্ষমতা রাখেন বুঝব কী করে? তিনি, যিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শেষ কথা বলতে পারেন। এরকম যদি কাউকে পান, জানবেন তিনিই যোগ্য লোক।
দুষ্যন্ত আরও একটা দারুণ জিনিস দেখেছেন আশ্রমের ওই পড়াশোনার জায়গায়, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। সেটাও ভাবার, খুবই ভাবার, আজকের দিনে বিশেষ করে। পড়ে বুঝলাম মহাভারত কেন অত্যাধুনিক একটা সাহিত্য।
চলবে
ছবি সৌজন্য: Quora
সংস্কৃত অনুরাগী দীপ্তসুন্দর মুখোপাধ্যায় কয়েক বছর ফেসবুকে লিখছেন। ভালবাসেন সংস্কৃত শাস্ত্র আর সাহিত্যের অধরা তাৎপর্য খুঁজতে, তার সঙ্গে আজকের সভ্যতার যোগসূত্র নতুনভাবে ভাবতে, বিশ্বসাহিত্যে সংস্কৃতের অবস্থান নির্ণয় করতে। যেখানে যান, বই কলম হাইলাইটার আর বুকমার্ক সঙ্গে থাকে।
One Response
Stimulating