‘মিশন সিভিলিত্রাসে’।
ইংরেজি তর্জমায় হোয়াইট ম্যানস্ বার্ডেন। ঔপনিবেশিক শক্তির অনুগ্রহজনিত কর্তব্যের বিখ্যাত শব্দবন্ধ। উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, বিশেষত মানব মূলধনের শর্তপুরণের জন্য দায়ভার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের কায়েম করা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটেই প্রথম প্রযুক্ত হয় এই ধারণা।
ভারতবর্ষে, ইন্দো-চায়নায়, গিনিয়ায় এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসন স্থাপনের সময় ফরাসি এবং ইংরেজ শাসকেরা যুক্তি দিতেন যে এই ‘নেটিভ’ বা অশিক্ষিত মানুষদের ‘সভ্য’ করে তোলার দায়িত্বের জন্যই তাদের রাজত্ব স্থাপন। পঞ্চাদশ–ষোড়শ শতাব্দী থেকেই তাই জন্ম নেয় এই ‘মিশন সিভিলিত্রাসে’।
ভারতবর্ষে ইংরেজ ঔপনিবেশিক রাজপাটের মধ্যবর্তী সময়কাল থেকে এই ধারণার প্রভাব দেখা যায় বিভিন্ন প্রশাসনিক পরিকাঠামোগত ও সমাজ সংস্কারমূলক সিদ্বান্তে। ১৮৫৩ সালে শুরু হয় রেলপথের কাজ, ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন হয়, এবং ১৮৫৪ সালে শিক্ষাসংক্রান্ত উডস্ ডিসপ্যাচ।
বোর্ড অফ কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট চার্লস উড ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত তুলে ধরেন। ভারতবর্ষে ইংরেজরা ততদিনে ভালমতই শক্ত করে ফেলেছে পায়ের তলার জমি। এই উপনিবেশ বহুদিনের জন্য ইংরেজের অধীন হতে চলেছে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে খুব বেশি প্রয়োজন এক করণিক শ্রেণীর, যারা ইংরেজি ভাষা কাজ চালানোর মতো বলতে বা লিখতে পারে। করণিক শ্রেণী সৃষ্টির যে ইতিহাস উল্লেখ, পুনরুল্লেখ হয়– উডস সাহেবের এই সুপারিশের গর্ভেই তার জন্ম।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নড়েচড়ে বসে এই সুপারিশে, বিরাট অর্থ মঞ্জুর হয় আর তা উডস্ ডিস্প্যাচ নামে এসে পৌঁছয় ভারতবর্ষে, ১৮৫৪ সালে– যখন জ্যোতিবা আর সাবিত্রী গড়ে তুলছেন একের পর এক স্কুল। আমরা আগের পর্বেই দেখেছি তাদের অবাক করে দেওয়া ছাত্রী সংখ্যা। বেথুন স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা যখন মাত্র ২১, সেখানে পুণের তিনটি স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা ১৫০।
বম্বে প্রেসিডেন্সিতে জ্যোতিবা-সাবিত্রীর প্রতিষ্ঠিত স্কুল ছিল আরও পনেরোটি, তা আগেই জেনেছি। ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য মহিলা শিক্ষয়িত্রী, আধুনিক পরিকাঠামোর স্কুল, পড়ানোর ব্যবস্থা জ্যোতিবা-সাবিত্রীর স্কুলকে এত জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এত উন্নত ব্যবস্থার অর্থ আসত কোথা থেকে?
আমরা দেখেছি, জ্যোতিবা সাবিত্রী নিচু জাতের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর অপরাধে বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত, ওসমান শেখের বাড়িতে আশ্রিত, তত্তসাহেব শিন্ডের দেওয়া বাড়িতে তাঁদের স্কুলের সূচনা। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে এতগুলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন তাঁরা, কীভাবেই বা তৈরি করলেন পরিকাঠামো, রক্ষণাবেক্ষন, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনোর সরঞ্জামই বা এল কোথা থেকে?
উত্তর ছিল, উডস্ ডিসপ্যাচ ফান্ড। ১৯৫৪ সালে অর্থ অনুমোদিত হয়। জ্যোতিবা-সাবিত্রী স্কুল প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শুরু করেছেন তার মাত্র কয়েক বছর আগে। জ্যোতিবা মিশনারি স্কুলে পড়েছিলেন, প্রশাসনিক স্তরে বেশ কিছু যোগাযোগ ছিল তাঁর। ক্রমাগত আবেদনপত্র পাঠানো, প্রশাসনিক উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করা ছিল জ্যোতিবার নিয়মিত কাজ। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান, মেয়েদের পড়াশুনো, দলিতদের পড়াশুনো– উডস ডিসপ্যাচ অন্তর্গত অনুমোদনের সবক’টি প্রয়োজনীয় শর্তই ছিল জ্যোতিবার স্কুলে। তাই সরকারি অনুদান পেতে কোনও অসুবিধে হয় না।

১৮৫৪ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই গ্রান্টের মাধ্যমেই মোট আঠেরোটি স্কুল তৈরি ও তার রক্ষনাবেক্ষণ করেছিলেন জ্যোতিবা-রা। শিন্ডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নতুন স্কুলও তৈরি হয় অনুদান পাওয়ার ফলেই। শুধু ছাত্রী তো নয়– দলিত ছাত্ররাও তো ছিল! তাদের জন্যও পুণে এবং বম্বে প্রেসিডেন্সির অন্যান্য জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয় স্কুল।
সেক্ষেত্রে ফের প্রশ্ন উঠতে পারে, যে বেথুন স্কুলও তো একই সরকারি অনুদানের সুবিধা পেত। বম্বে প্রেসিডেন্সির মিশনারি স্কুলও পেত একই সুবিধা! কিন্তু তা উঠে যায় দু’বছরেই মধ্যে। কেন অমিল ছিল ছাত্রী?
বাস্তবিকই, প্রচুর পরিমাণ অনুদান পেত বেথুন সাহেব প্রতিষ্ঠিত স্কুল। স্কুলের বোর্ডে ইংরেজদের সংখ্যাধিক্য, ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান, মেয়েদের শিক্ষা– উডস্ ডিসপ্যাচের শর্তপূরণ করেছিল বেথুনস্কুলের পরিচালনও। অনুদানও পেয়েছিল প্রচুর। ছাত্রী অনুপাতে অনুদানের পরিমাণ এত বেশি হয় যে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ পরবর্তীকালে ১৮৭৮ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় বেথুন স্কুলের সঙ্গে।
তাহলে, ছাত্রীসংখ্যার এই বিস্ময়কর তারতম্যের কারণ নিশ্চয়ই অনুদানের পরিমাণ নয়? অনুদানের ফলে গড়ে ওঠা পরিকাঠামোর চাকচিক্য কম-বেশি একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, তবে সামাজিক বিষয়টিকে এর দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। মেয়েদের শ্রেণীগত বিন্যাস ও তার থেকে তৈরি হওয়া কম বা বেশি পর্দাপ্রথা, শিক্ষা বা জীবিকার উৎসাহের যে বিষয়টি আমরা আগের পর্বে বলেছি– তাও আংশিক কারণ, সমগ্র নয়।

সামগ্রিকতার বিচারে, স্কুল পরিচালনের ধর্মীয় অবস্থানকেই গুরুত্ব দিতে হয়। মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মান্তকরণের চেষ্টা সমসাময়িক সমাজে একপ্রকার ভীতির সঞ্চার করেছিল। এরূপ ধর্মান্তকরণের বহু নিদর্শনও সামনে আসতে থাকে। তাই ইংরেজ মিশনারির প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ছাত্র পাঠাতেও ভীত হন অভিভাবক সমাজ, ছাত্রীপ্রেরণের বিষয় তো দূর অস্ত।
জ্যোতিবা-সাবিত্রীর স্কুলে সে ভয় ছিল না। দলিতদের স্কুল, উচ্চবর্ণের স্কুল, ছাত্রীদের স্কুল সবই ভিন্নভাবে বিন্যস্ত ছিল। সম্ভবত অভিভাবকদের কিছু অংশের বিশ্বাসও অর্জন করতে পেরেছিলেন জ্যোতিবা-সাবিত্রী। নিজেরা মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও, সেই সংস্রবকে স্কুলের কাছাকাছি আসতে দেননি।
এর পরে আসে ১৮৫৭, মহাবিদ্রোহ। এবং ভারতীয় সেপাইদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের রাজাদের পরাজয়, মৃত্যু, মৃত্যুদণ্ড। কোম্পানির শাসন গিয়ে রানির শাসন এল। রানির ঘোষণায় নির্দিষ্টভাবে বলা রইল, ভারতীয়দের ধর্ম-ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।
এদিকে রেলচলাচল শুরু হয়ে গেছে, বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, বাংলায় সতীদাহ প্রথা রদ করারও আইন হয়েছে। এরা প্রত্যেকে ভারতের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করেছিল নিঃসন্দেহে। বিভিন্ন জাতের মানুষের একসঙ্গে রেলপথে চলাচল, সতীদাহ-বিধবাবিবাহের মত ভারতীয় কুসংস্কারের শিকড়ে আঘাত করা আইন, বিশাল ও গভীর জন-অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল। ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ, শুরুতে সিপাহী বিদ্রোহ হলেও তার মহাবিদ্রোহের আকার ধারণ করার পিছনে এই জন-অসন্তোষের ভূমিকা কম ছিল না।

কিন্তু রেল চলাচল বন্ধ করা যাবে না। প্রণীত আইন ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়। বাকি থাকল শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কার। মেয়েদের পড়াশোনা শেখাবার চেষ্টায় সরকারি অনুদানের বিষয়। মেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর বিষয়টিও যে সনাতন সমাজ ভাল চোখে দেখেনি, তা বলাই বাহুল্য। রানির শাসনে অসন্তোষের সব কারণ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের স্কুল বন্ধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু সরকারি অনুদানের সাহায্য তো বন্ধ করা সম্ভব। তাই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে বম্বে প্রেসিডেন্সি ও পুণের ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় বন্ধ হয়ে গেল জ্যোতিবাদের স্কুল। সবকিছু শান্ত হলে স্কুল আবার খোলার সময় হল।
কিন্তু তখনই বিনামেঘে বজ্রাঘাত। রদ করা হল উডস্ ডিসপ্যাচ ফান্ড। বন্ধ হয়ে গেল শিক্ষার অনুদান। ১৮৫৮-র মধ্যে ১৮টি স্কুল গিয়ে দাঁড়াল মাত্র দু’টিতে। কী করবে এখন জ্যোতিবা? কী করবে সাবিত্রী? দলিতশিক্ষার আন্দোলন, মেয়েদের শিক্ষার এত চেষ্টার ইতিহাসের কি এখানেই ইতি?
*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ
*আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩]
* তথ্যঋণ:
‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্ অফ্ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।