আগের পর্বের লিংক- জীবন তো একটাই, জমায়েত, খাই খাই ক্লাব
পুজোর বাজনা যে বেজেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে বয়স্ক কর্তা-গিন্নীদের দেশে ফেরার বহরে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেন, কানাডা, চিন, কাতার- এমন সব স্বপ্নের দেশ থেকে। বিদেশে থাকা ছেলে-বউ, জামাই-মেয়েদের সঙ্গে দেখা করা, তাদের সংসার সামলানো, নাতি-নাতনিকে যতটা সম্ভব ‘সহজপাঠ’ ও ‘আবোল তাবোল’ কিছুটা অন্তত সড়গড় করে দিয়ে আসা। ফলে এখানকার বন্ধু-দলের সঙ্গে দেখা করার দিনক্ষণ সব আগে থেকে ঠিক করে তাঁরা ফিরছেন কুমোরটুলি, মায়ের-ঘাট, পাড়ার স্টল, বনেদি-বাড়ির পুজো, মহালয়ার আগে ঘরদোরের মহা-ঝুলঝাড়া পর্বে প্রবেশ এবং শেষ মুহূর্তে শাড়িতে ফলস-পিকো করানোর বাসনায়। কর্তারা ভাবছেন দেশে ফিরেই চেনা সেলুনে চুল-দাড়ি কাটা, বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা নিত্য ব্যবহারের মেশিনগুলো সার্ভিস করিয়ে নেওয়া এবং পুজো কমিটির হিসেব পত্তরের হার্ড কপিটাতেও সুযোগ মতো অন্তত একবার হলেও চোখ বোলানো। ফলে প্রি-পূজা, পূজা এবং পোস্ট পূজা– সে এক বিরাট এজেন্ডা। শরীর ও মনের লিঙ্ক এবং মাথার সারভার বিগড়োলেই কেলেঙ্কারির একশেষ। ভুলে গেলে চলবে না যে , ষাট পার করা এই বয়সটা কী ভীষণ অভিমানী!
বাজল তোমার আলোর বেণু
বলতে গেলে পুজোর বাজনা শুরু হয় মহালয়ার পর থেকেই। চলন-বলন বা পোশাক-আসাকে যে যতই আধুনিক হয়ে যাই না কেন, ‘মহালয়া’টি কিন্তু শুনতে হবে রেডিয়োতেই। সেজন্য সারা বছর সেটিকে চালুও রাখতে হয়। আজকাল একটা মস্ত সুবিধে এই যে ভোর চারটে মানেই সমস্ত এফ এম চ্যানেলেই শুরু হয়ে গেল মহালয়া। ফলে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কলকাতা ‘ক’ ধরার হ্যাঁপা নেই। হ্যাঁপা হল রেডিয়োর সার্ভিস সেন্টার খুঁজে বার করা; কারণ এখন সেগুলি প্রায় বিলুপ্ত। তবে পাড়ায় পাড়ায় মাইক চালিয়ে জোর করে কানে গোঁজানোর ব্যবস্থা হয়েছে মহালয়ার সকালে। আমি তো অ্যালার্ম দিয়ে উঠে, ঘর বারান্দার জানলা দরজা খুলে দিলাম। রাতের পোশাক ছেড়ে, ডিফ্যুসার জ্বালিয়ে, মাথা আঁচড়ে বসলাম; দু-দু’খানা বালিশে হেলান দিয়ে। হোয়াটস্যাপ খুলে ডাকতেও শুরু করলাম দেশ-বিদেশের বন্ধুদের। ঠাকুমা বলতেন, এমন ঘোর যুদ্ধের সময় ঘুমোতে নেই। সিংহ, সাপ, মহিষাসুরের শিং এবং দেবীর হাতের ওইসব অস্ত্রের খোঁচা গায়ে পায়ে লেগে যাবে। পুজোর সাজটি তো তবে মাঠে মারা যাবে শয়তানের আঁচড়ে! ফলে ঘুম তাড়াতে কানে ‘মহালয়া’ আর, ঘুম-তাড়ানো চোখে মোবাইল স্ক্রিনে পেল্লায় আড্ডা; এও তো সেই সাত-সমুদ্র তেরো-নদীর জলে মায়ের বোধনই বটে। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি, আমাদের আবাসন আলোকিত হলে কী হবে, ভাবে ভঙ্গিতে সে তো নিপাট স্যানেটোরিয়াম! কোনও ফ্ল্যাটে না এককুচি আলো, না একটা টুঁ-ট্যাঁ শব্দ।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হওয়ার মুখে পাঁচটা নাগাদ, পরিচারিকা শ্যামলীকে ঘুম থেকে তুলে চা পেলাম। তার সঙ্গে নাড়ু ও ঝুরিভাজা। কুচুর মুচুর করে সব সাবাড় করে ভোরের আলো মেখে, এবার নিশ্চিন্তে তলিয়ে গেলাম ছুটে যাওয়া ঘুমটুকু পুষিয়ে নিতে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলা বেজে উঠতেই একটু বিষণ্ণ লাগল। আবাসন থেকে বেরিয়ে কয়েক পা দক্ষিণ মুখে হাঁটলেই ওঁর বাড়ি। গত বছর চলে গেছেন। বাড়িটাকেও মনে হয় অসুর-জ্ঞানে গুঁড়িয়েই দেওয়া হয়েছে রাতারাতি। তবে দ্বিতীয় পর্বে ঘুম ভাঙতেই মন-খুশ। নব্বইয়ের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো আমার পিঠোপিঠি দুই মাসির শুভেচ্ছা ভিডিও এবং অডিও পেয়ে। সেজোমাসির ছেলের বউয়ের উৎসাহে তাঁর বেয়ানের পাশে বসে, বেঙ্গালুরু থেকে আশীর্বাদ পাঠালেন আমাদের। আর নয়ডা থেকে স্মৃতিচারণ করে ন-মাসি জানালেন, দল বেঁধে শতরঞ্চিতে বসে তাঁদের সেই মহালয়া শোনার গপ্পো। মুছে গেল প্রাচীনা-নবীনার ভেদ এবং সব হারানোর ফ্যাঁচফ্যাঁচানি।
রুটিন চেক-আপ এবং ঔষধ মজুত
মহালয়া পার মানেই পুজো এসে গেল। আর এর অন্য অর্থ হল জরুরি কাজগুলো সারা হতে কতটা কী বাকি, সেটাও একবার মিলিয়ে নেওয়া। ঘর-বাড়ি্র সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরের তদারকি এবং হাল ফেরানো। এই মহা-লয়ের পর মায়ের নাম হয় – ‘সুপর্বা’। ফলে সুন্দর এই পর্বের শুরুতেই প্রধান কাজটি হল, রুটিন চেক-আপ সারতে, পুজোর আগেই ডাক্তার-বদ্যির পাট চুকোনো। ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলে এ সময় পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত কলকাতায় অন্তত কোনও ডাক্তারকেই পাওয়া যাবে না। ফুসফুস, হার্ট, গলা, নাক, কান, ত্বক, কোমর, শিরদাড়া, হাঁটু্ দাঁত, চোখ, স্নায়ু – সব তো আবার আলাদা আলাদা। বেশি করে মজুত রাখতে হবে সুগার, প্রেসার এবং ঘুম পাড়াবার নিত্য ওষুধ। সেইসঙ্গে যে যার নিজের ডাক্তারির সুবাদে ‘যদি লাগে’ – সেই মাথা ধরা, কাশি এবং হজমের ওষুধগুলিও মজুত রাখা। সব চেয়ে জরুরি চোখ দেখিয়ে নতুন ফ্রেমের এক জোড়া চশমা করিয়ে ফেলা। এ বয়সে লাগসই চশমাটিই মুখের জেল্লা বাড়ায়। যাঁদের এখনও ‘চম্মা’ লাগে না তাঁদের লিস্টিতে একখানি কাজ কমল। সঠিক জানা নেই যে পুজোর আনন্দে ভেসে, পুরনো লাঠি, নি-ক্যাপ, গলার কলার, বা কোমর-বন্ধগুলিও বাতিল করে আবার সব নতুন করে কেনা হয় কিনা!

ক্যাশ এবং কড়ি
ঘর বলে একটু বেশি টাকাও তো তুলে রাখতে হবে! পুজোর ক’দিন তো ব্যাঙ্ক বন্ধ। চোখে দেখে নাড়াচাড়া করা ক্যাশ মনোবল বাড়ায়। চাবি বন্ধ দেরাজ থেকে গুনে গুনে টাকা বার করাতেই তো সেই চেনা চেনা কর্তৃ্ত্ব । তাছাড়া সবাই কি আর এ. টি. এম কার্ডে তেমন সড়গড়! তার ওপর আছে প্যানিক। পুজোর সময় নাকি বেশিরভাগ মেশিনেই টাকা থাকে না। এ. টি. এম তো কয়েনের খুচরোও দেবে না। প্রণামী এবং দক্ষিণা মানেই নোটের-সঙ্গে একটি করে বেজোড় ধাতুমুদ্রা প্রদানও। সে সবও মনে করে বটুয়ায় ভরে, আগে থাকতে সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ আমাদের মতো এখনকার গিন্নীদের না আছে আঁচল, না পেটিকোটের ঘেরে লুকনো পকেট বা আঁচলের খুঁটে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা এক-আনি, দু-আনি বা চার আনা!
নতুন জুতো…….নতুন জামা……
তবে আসল উত্তেজনা জুতো-জামা কেনায়। একেবারে যেন সেই ছোট্ট বেলার মতোই। এদিকে ভিড় ঠেলে কেনাকাটাও রীতিমতো বিপদসঙ্কুল । তাই ভরসা সেই কিছু কিছু ধরাবাঁধা প্রদর্শনী বা শৌখিন হাট। আর নয় তো আশপাশের চেনা বুটিক । শাড়ি, ড্রেস, কুর্তি, নাইটি সব মিলবে। আর আমার মতো আটপৌরে মেঠো হলে, ভবানীপুরের ভবানন্দের পাইকারি দোকান– যেখানে সেই ‘আলপিন টু এলিফেন্ট’ সব একেবারে পাইকারি দামে। উঁচু টুলে জমিয়ে বসে, সর-পড়া এবং কড়া মিষ্টি এক গেলাস দুধ-চায়ে চুমুক দিতে দিতে, গৃহ দেবতা রাধাকান্ত-রাধারাণীর শাড়ি, ধুতি, উড়নি থেকে রান্নাঘরের হাত গামছা– সব কেনা হয়ে যাবে। আর যদি সে সময় কপাল জোরেই বস্তা হাতে তাঁতিরা কেউ এসে পড়ে, তো মিলবেই মিলবে মনের মতো কোরা-তাঁতের কালো ঢালা পাড়ের সরেস ধুতি, বা ধনেখালির সাদা ও রঙিন থান; অথবা গঙ্গা-যমুনা , খড়কে ডুরে, কস্তা পাড়ের শাড়ি । জমে যাবে ষষ্টির সকাল। আমার তো চেনা দর্জি প্রকাশও আছে বাড়ির হাতায়। নতুন সব পিসের সঙ্গে, খান কয়েক বাতিল শাড়ির আঁচল দিয়ে ব্লাউজ আর খাপি মার্কিনে বানানো নাইটি ও পাজামাও এলো বলে ; তবে সবই প্রায় এক ডিজাইনে; ঢোলা এবং সাইজ জাম্বো। এখন এক মহা সুবিধে এই যে সকলকেই টাকা ধরে দেওয়া যায়। আগে খামে খামে ভরে, ওপরে নাম লিখে রাখা হতো; এখন সবই ‘পেপার-লেস’; তাই ফান্ড- ট্রান্সফার। যাঁরা শিখে নিতে পেরেছেন, তাঁদের তো পোয়াবারো। Beneficiary, NEFT, IMPS, RTGS, Deposit Transfer, GPay, Phone Pay, Pin, OTP – এই নতুন সিলেবাসে কত যে না-জানা শব্দ! তবে শেখার পরেও প্রয়োগে একটু হুঁশিয়ারি চাই। তা বলে নেট-চোরদের ভয়ে হাত গুটিয়ে রাখব! না কি, ভয় ও অনিচ্ছেটাকে একটু চেষ্টা করে, সাহস এবং ইচ্ছেতে বদলে নিয়ে অন্তরীক্ষ থেকে দেখব যে বিপুলা এ পৃথিবীও কেমন হাতের মুঠোয়! আর অন লাইন কেনা কাটায় কিছু পছন্দ হলেই উপহারটির স্ক্রিন শট শেয়ার করে দেওয়া; মেয়ে, জামাই, বেয়ান O.K করলেই অর্ডার। দোকানে দোকানে ঘুরতেও হল না, আবার হাতে করে উপহার দেওয়ার সুযোগটুকুও মিলল।

কিন্তু, নিজেদের জুতোর ব্যাপারে এখনও সেই অপেক্ষা– কবে বেরোবে কাগজের পাতা জুড়ে ‘পুজোয় চাই বাটার জুতো’র সেই বিজ্ঞাপনটা। তবে, মনের সুখ মিলিয়ে যায় যখন মনে পড়ে যে কত্তা-গিন্নী নির্বিশেষে এখন বরাদ্দ শুধুই Doctor’s Sole’, Dr. Ortho, Non-Strain, Acupressure, Posture, Comfort, Extra Soft, Cork, Diabetic – মানে একগাদা দাম দিয়ে বৃদ্ধদের ডিজাইনে চোখ রাখা। হাল্কা চালে হাঁটার ব্যাপারটা তো আগেই হাতিয়ে নিয়েছে সময়। একটাই যা কমন তা হল বাড়ির কর্তা, ছেলে, জামাই, মেয়ে এবং বউমাদের মতো স্নিকার পরা। এমন কি শাড়ির সঙ্গেও অবলীলায়!
এত সুবিধেতেও মন উদাস হয়; যখন দেখি, পুজোর পাব্বণী পাওয়া মাত্র, আমার পরিচারিকা শ্যামলী, তার বোন রুপাকে ফোন করে বলছে— ‘যাদবপুর সুপার মার্কেটে চলে আয়; এক-সঙ্গে কেনাকাটা করব’; বা ড্রাইভার পিন্টু ছুটি নিচ্ছে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে ‘গড়িহাটে’ মার্কেটিং করবে বলে। ঘুরে ঘুরে বাজার করতে এবং ফুটে বসা চপ-ফুচকা-রোল খেয়ে যে আনন্দ – সে সবের জন্য অল্প বয়সটাই সেরা।
প্যান্ডেল - অঞ্জলি - মহাপ্রসাদ
এটা এখন সম্পূর্ণ বুড়ো-বুড়িদের রাজত্ব। সব পাড়াতেই সেই বয়স্ক উৎসাহীর দল আছেন যাঁরা একথা ভেবেই খুশি থাকেন যে তিনি না থাকলে পুজোর যোগাড়, ফল কাটা, পুষ্পপাত্র সাজানো, পঞ্চপ্রদীপের তেল-সলতে, ঝুড়ি ভরে রাখা একশো আটটা পদ্ম ফোটানো, সন্ধি পুজোর প্রদীপ গোছানো, পুরোহিতের হাতে সময় মতো এটা ওটা এগিয়ে দেওয়া – এ সব করবে কে! বয়স্ক পুরোহিত এবং বয়স্ক ঢাকিও তাই ভাবেন। এখন তাঁদের সঙ্গেও যাঁরা সাহায্য করতে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু আর তাঁদের ছেলে বা ভাইপো-ভাগনা নন। মাইনে করা কর্মচারী। কেটারিং সার্ভিস, প্যান্ডেল বাঁধা বা পুজোর কাজ– অর্থ-মূল্যে সবেতেই এঁদের পাওয়া যায়।

আমাদের আবাসনে দফায় দফায় ভিড়ের চরিত্র বদলে যায়। সকাল বেলা বয়স্ক কিন্তু সচল কত্তা-গিন্নীর ছোট দল; বেলা বাড়লে আয়া নিয়ে আসা অসাব্যস্ত কিন্তু উৎসাহী কত্তা-গিন্নীদের কুচো জটলা। অঞ্জলির সময় সব বয়সের ভিড়েও হুইলে চেয়ারে বসা কয়েকজন। আর সন্ধে বেলার বিচিত্রানুষ্ঠানে থিকথিকে ভিড়েও গাদা খানেক ঝলমলে বুড়ো-বুড়ি……(থুড়ি থুড়ি)। এক একটা জমাটি বাড়ির সব বয়সের প্রায় সকলকেই দেখি রীতিমতো মহড়া দিয়ে নাচ, গান , আবৃত্তি ও নাটকে অংশ নিতে। শ্বশুর ও বউমাকে যথাক্রমে নায়ক-নায়িকা এবং শাশুড়িকে কর্পোরেট বসের চরিত্রে দেখে আমি তো আর হেসে বাঁচি না। খুব আনন্দ হয় যখন ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি সকলে মিলে ধুনুচি নাচে যোগ দেয়। দেখেই বোঝা যায় যে কতখানি জড়তা মুক্ত এবং কী সুন্দর সাবলীলও ! তার মধ্যে অবশ্য এর-ওর-তার পাঞ্জাবি, শাড়ি্, জিন্স , জুতো – এসব দেখিয়ে দাম এবং ব্র্যান্ডের তারিফও।
আর একদিকে রান্নার ঠাকুরের সঙ্গে জম্পেশ হৈ হৈ-তে মেতে থাকেন মূলত বর্ষীয়ান কর্তারা। রান্নার স্বাদ এবং মানের তদারকি সে-কি এত সোজা! এই মস্ত হ্যাঁপা সামলাবার জন্য ‘সেই সব’ বুড়োদের তেমন সংখ্যায় পাওয়া গেল না বলে, এবছর তো বাতিলই হয়ে গেল আমাদের আবাসনের প্যান্ডেল-ভোজ। চাঁদা তুলতে গিয়ে বকুনি খাচ্ছে বেচারা পুজো কমিটি। একই টাকা, অথচ তিনদিনের এবেলা-ওবেলা খাওয়া বাদ! বিশেষ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে গিন্নীদের জটলায়; ফোনে ফোনে বা কমন কাজের লোকের মাধ্যমে। ফলে রাগী বুড়ো-বুড়িরা (senior citizens) যেটা সহজে পারেন– টকাস করে চাঁদা বয়কট। তবে নরম সরম মৃদু মেজাজের বয়স্করাও তো আছেন; যাঁরা বলছেন, পেট-পুজো বাদ গেলেও আসল পুজোটাতো হচ্ছেই; আনন্দে ভাঁটা না পড়লেই হল।
যদি কপালে থাকে
বেশ কিছুকাল যাবৎ রেওয়াজ হয়েছে বাড়ির সকলে মিলে বাইরে খাওয়ার। অন্য সব অনুষ্ঠানের মতোই পুজোতেও অন্তত একদিন । ভালো ভালো হোটেলে গিয়ে জমিয়ে খাওয়া; নাতি, নাতনি, ছেলে, বউ, মেয়ে, জামাই, বেয়ান, বেয়াই-সমেত। ছোটরাই সব ব্যবস্থা করবে। খরচও করবে তারাই। ওদের কল্যাণে জানা যাবে ‘অ-জানি , দেশের না-জানা কী’– menu, serve, spread, decor, ambience, parcel- এমন সব বিস্ময়কর উচ্চারণ। এখানে যোগ দেওয়া মানে, নিজেকে একটু সামলে সুমলে রেখে, চেয়ার টেনে হাসি হাসি মুখে বুঝে সুঝে খাওয়া।

পুজোর নির্ঘণ্ট
এও এক মস্ত ব্যাপার। নাতির প্রোগ্রাম হল দেরি করে ওঠা, বাড়িতেই গাঁতিয়ে থাকা এবং কোথাও না বেরোনো। মেয়ের প্রোগ্রাম— শরীরে কুলোলে বন্ধুদের সঙ্গে প্রহরে প্রহরে ঠাকুর দেখে বেড়ানো এবং একা একাই বিভিন্ন রকমের puja- walk; সেই সঙ্গে আবার বদলে বদলে জম্পেশ সাজাও। আর জামাই তো তার নিজের Program নিয়ে স্টেজ কাঁপাতে মশগুল। তার তো আবার ক্যামেরা–লুক চাই। ফলে সমস্ত সাজা-গোজা এবং পোশাক নির্বাচনেই এ ছেলের মাথায় ঘোরে stage- light- camera আর sound। অন্যদিকে আমার তাল হল, ওদের প্রোগ্রামের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে নিজের মতো নির্ঘণ্ট করে , তাল ঠুকতে ঠুকতে পুজোর সময় বাড়ি ছেড়ে পালানো। তবে এবার একটু অন্য রকম। এক, বেশ ক’বছর পর মেয়ে কলকাতায়; তাই আমিও আমার বাড়ি এবং তার বাড়িতে মিলিয়ে মিশিয়েই কাটাব। দ্বিতীয়ত, হাঁটু বদলে পায়ের ব্যথা সেরে হাঁটা চলা স্বাভাবিক হয়েছে; সেই আনন্দে আমাকেও খেলতে ডেকেছে মেয়ে। ষষ্ঠী সকালে তার সঙ্গে গঙ্গাবিহারে যাব। যার পোষকি নাম হল ‘Shoshti Breakfast Cruise’। এরকমই কোথাও সেরে নেওয়া হবে Shoshti-land lunch। ফলে মেঘ ফুঁড়ে আকাশে ফুটে ওঠা ‘স্বর্গত’ ছোটমামা, নতুন মেসো বা ভালোদার ফক্কুড়ে হাসি উপেক্ষা করে, আমিও শাড়ি-গয়না গোছাতে বসেছি। আর কোনও কারণে তা বাতিল হলেও, ষষ্টি- সকালটা মেয়ের সঙ্গে কাটানো জারি রইল। আছে আমার সেই ধরাবাঁধা প্রোগ্রামও।
মহালয়া হয়ে গেলেই কুমোরটুলি এবং কালীঘাটের পোটো পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দেখব শেষ মুহূর্তের রৈ রৈ। এখানকার মাটি, রং, গর্জন-তেল, শোলা, সলমা জরি আর ঠাসাঠাসি-ঘেঁষাঘেঁষির ম….ম করে ওঠাতেই তো সেই পুজো পুজো গন্ধ। ষষ্ঠীর সন্ধেতে ঘুরে বেড়াব যাদবপুর, লেক মার্কেট বা ভবাণীপুর; ফুটপাথ জুড়ে ফুলওয়ালি মাসিদের আনা ঘাস, পাতা, ফুল-মালা এসব দেখতে। শ্বাস-প্রশ্বাসে জড়িয়ে যাবে রাস্তার ধারে ধারে, তারার মতো ফুটে থাকা থোকায় থোকায় শরৎ-বিলাসী ছাতিম। ইদানীং শিউলি গাছ বাড়ন্ত হলেও শহর জুড়ে এখন ছাতিম ফুলের সমারোহ। সপ্তমীর দিন বাপের-বাড়ি খড়দা যাওয়া। এখানেই আবার মামারবাড়ির পাড়ায় ভটচায্যি-বাড়িতে সাবেক পুজো। সেখানে বসে পুজো দেখতে দেখতে আড্ডা জমাব নিজেরই কচিবেলার সঙ্গে। অষ্টমীতে দু’ই বেয়ানে নেমন্তন্ন পেয়েছি মেয়ের বাড়ি ,তার হাতের রান্না খাওয়ার। নবমীতে ইচ্ছে আছে সকাল সকাল বারুইপুরের দিকে ধেয়ে গিয়ে, দু’চোখ ভরে শুধু দেখা; হাটে মাঠে ফুটে থাকা কাশ আর বিছিয়ে থাকা শিউলি ফুলে শারদ রোদের ঝিলমিল। তবে দশমীতে বাটা নগর; নুঙ্গির পাড়ে গিয়ে জেটিতে বসে বসে বিসর্জন দেখবই। দেখব ওপারের সারেঙ্গা ও এপারের নুঙ্গিতে নৌকো চেপে পারাপার করা মানুষের ঢল। সেই সঙ্গে ঘটি গরম, ডিম-চপ আর ম্যাঙ্গো-সবুজ কাঠি আইসক্রিম।

তবে আমাদের সত্তর ছুঁতে চলা সেমন্তী বৌদি এক অভিনব প্রোগ্রামের সামিল হয়েছে। চারজনের দলে অন্যতম একজন হয়ে যোগ দিয়েছে মহিলা পুরোহিতের দলে। অন্নপ্রাশন, বিয়ে, গৃহ প্রবেশ, শ্রাদ্ধ সামলে গত দু’বছর ধরে তারা ডাক পাচ্ছে টানা চারদিন ধরে সার্বজনীন দুর্গা পুজো করারও। সৌখিন ঘরোয়া জীবনের বৃত্ত থেকে ক্রমশ সে এগিয়ে চলেছে পেশাদারি কাজে; সারা বছরের প্রস্তুতি এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা ছাড়া যা প্রায় অসম্ভব। মুগ্ধ হয়েই দেখার যে বয়স, একাকীত্ব এসব আতঙ্ককে পাশ কাটিয়ে, অসম্ভব দক্ষতায় নিজেকে কেমন পুনর্বাসিত করে চলেছে সে!
খাজনা ও খরচ
বয়স হলে পুজোর আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়ে যায়, টাকা-পয়সার চিন্তায়। রিটায়ার্ডদের (retired) বাজেট বেড়ে গেলেই মুস্কিল এবং উদ্বেগ। একে তো সমস্ত কাজের লোকেদের মাইনে, প্লাস আরও এক এক মাসের বাড়তি মাইনে ধরে দিতে হবে, পুজো বলে । তার সঙ্গে তিনদিনের ছুটিও। সপ্তমী অষ্টমী এবং নবমীর জন্য বাড়তি টাকা দিয়ে বদলি লোকের ব্যবস্থা। উপরন্তু দুনিয়ার বখশিস! হেসে কথা বলেছ কী হাত উপুড় করতেই হবে। ফলে এসো-জন বসো-জনের ভিড়ে খুশি উপচে ওঠার আর উপায় কোথায়? অরুচি হয় সেন্টার থেকে ড্রাইভার নিয়ে হিসেব কষে ঘন্টা মেপে উড়ে বেড়ানোতেও।
চলো বেরিয়ে পড়ি
বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক ছাড়াও, নিজের বাড়িতে থাকা বুড়ো-বুড়িদের নিয়েও পুজোয় বেড়াবার দেদার বন্দোবস্ত হয়েছে। আকর্ষক সব নামে বাস-ট্রেন-গাড়ি ও স্টিমারে। হলই বা সবাই অচেনা! পুজো দেখা, সাজা, আড্ডা, অবাক হওয়া এবং জমিয়ে খাওয়াটা তো অটুট রয়ে যাবে!

পুজোর দিনগুলোয় ঝামেলা এড়াতে শহর ছেড়ে বেড়াতে বেরিয়ে যাবার চলও শুরু হয়েছে। তাছাড়া বেশ কিছু ট্র্যাভেল এজেন্টও তো পাওয়া যায়, যাঁরা শুধু সিনিয়র সিটিজেনদেরই ট্যুর করান; যে যাঁর সামর্থ মতো এজেন্ট বেছে নেন। চেষ্টা করেন পঞ্চমীর দিনে বেরিয়ে, একেবারে লক্ষ্মীপুজো পার করে ফেরা। আমি অবশ্য এ দলে পড়ি না; কারণ, হোটেলে থাকায় অরুচি। তাই, কাছে-পিঠে বা নানা প্রদেশে যে সব বন্ধু বা বাবা-মায়ের বন্ধু ও পরিচিতদের ছেলে-মেয়েরা আছেন তাঁদের কাছেই চলে যাই। কত জায়গার কত রকম দুর্গাপুজো এবং মেলা যে দেখেছি! মন করলেই, পায়ের তলায় সর্ষে। আমার বেশ কিছু বন্ধু এখনও আছে, যারা শহর ছেড়ে নিয়ম করে পৌঁছে যাবে দেশ-গ্রামের বাড়িতে, তাদের সাবেক পুজোয়; বৈদারা, ইঁদাই-হাট, হাট-সেরান্দি, সরের-হাট, মোষমারি, কালনা বা খানাকুল।
মন কেমন যায় কই!
যত দিন যাচ্ছে, মনের একটা ভাগ যেন ঘুমিয়ে পড়ছে। পুজোয় দেবার উপহারের লিস্টি কমতে কমতে এখন শুধু গুটি কয়ে ঠেকেছে। বড়রা তো বটেই, বয়সে ছোটরাও কেমন হুট হাট করে কেটে পড়েছে ! কমে গেছে বিজয়ার পর গুরুজনদের জোড়া-পায়ের সারি। বন্ধ হয়ে গেছে কত যে বাড়ি! আর বন্ধ হয়ে গেছে পোস্টকার্ডে এঁকে শুভবিজয়া লেখা শুভেচ্ছা পাঠাবার চল। শারদীয়া পত্রিকা কিনে পরস্পরকে যে উপহার দেওয়া — সেটাও কেমন উবে যাচ্ছে হু হু করে! হারিয়ে গেছে ঝুড়িভরা শিউলি-ফুল আর বেলপাতার মালা গেঁথে মায়ের পুজোয় পাঠানো; দশমীর জন্য বানানো কুচো নিমকি, এলোঝেলো, নারকেল-ছাপা ও নাড়ু ! আর বড় হাঁড়িতে ঘোঁটা সেই সিদ্ধির শরবৎ-ও! হারিয়ে গেছে পুজোর গান। টুক টুক করে কেমন নেই হয়ে গেছে — সুকন্যা, শৌনক, সুবীর, অরিন্দম, অম্লান, গৌরী, শকুন্তলা, দেবযানী, সুনন্দা, সোমা, নন্দিতাদি, মহাশ্বেতাদি…….এমন আরও কত নাম! সারি সারি আরও কত প্রিয় মুখ!
তবু ভাল লাগে
জো তো শুধু আমোদ নয়, উৎসবের প্রস্তুতিও। পরম্পরায় জেগে থাকা এক আবেশ। বিসর্জনের বাজনাও তো ‘হাসির কানায় কানায় ভরা……নয়নের জল’। তাই এর অবসানটিও আমার কাছে আর এক রকম প্রস্তুতি। শেষ দিনে দোরে দোরে এসে ঢাক বাজাবে ঢাকীরা। বার করে আনবো, তাদের জন্য গুছিয়ে রাখা পুরনো জামা, কাপড়, শাল, চাদরে ঠাসা একটা পুঁটলি; সেই সঙ্গে মিলের একখান নতুন ধুতি ও সামান্য কিছু টাকা ভরা খামটা এগিয়ে দিলেই, আমার সামনেই অকপটে গুণে নিয়ে প্রণাম ঠুকে চলে যাবে তারা। আমিও কপালে হাত ঠেকিয়ে, মনে মনে বলব ‘আসছে বছর আবার হবে’।
যা হারিয়ে গেছে সে সবের ফিরিস্তি না বাড়িয়ে, নিজেকে নতুন করে দেখাই বোধহয় আর এক রকম বোধন; সময় তখন অনায়াসে পাশে এসে বসবে অসময়ের। পুজোর আনন্দে ভেসে যাবে ‘থুড়ি-থুড়ি’ বুড়িদের সঙ্গে জমকালো বুড়োদের দলও।
হৈ-হল্লা মিটে গেলে প্রতি বছরের মতো ভাবতে বসব যে কী বিসর্জন দেব এবারে! ঠিক করেছি যে বিসর্জন দেব আমার অবসাদ, হতাশা আর ক্লান্তি। সেই সঙ্গে অন্তর থেকে বিশ্বাস করব –
‘না হয় তোমার যা হয়েছে তাই হল
আরও কিছু নাই হল, নাই হল, নাই হল’…….
ছবি সৌজন্য: মন্দার মুখোপাধ্যায়, Wikimedia Commons, Pickpik.com
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
One Response
kakima khub valo legeche pore…valo laga, mon kharap er ek anabadya misran….valo theko, sustha theko, amar pronam neo.