মালি আলমিডাকে চেনেন? সেই যে ফোটোগ্রাফার? মনে করতে পারছেন না বুঝি? নাহ, খবরের কাগজের পাতায় তাঁকে পাবেন না। কারণ তিনি রক্তমাংসের মানুষ নন, কাগজ কলমের চরিত্র। যে চরিত্রের স্রষ্টা শেহান করুণাতিলকা এবার বুকার পুরস্কার পেলেন। ‘দ্য সেভেন মুনস অফ মালি আলমিডা’ তাঁর দ্বিতীয় বই। গত সোমবার রাতে লন্ডনে, কুইন কনসর্ট ক্যামিলার হাত থেকে পুরস্কার নিলেন শেহান। পুরস্কারমূল্য প্রায় ৫০ হাজার পাউন্ড।
এবার দেখা যাক, কে এই করুণাতিলকা আর মালি আলমিডা-ই বা কে! শেহান করুণাতিলকা শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা। সাহিত্যচর্চা করছেন প্রায় এক যুগ। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চায়নাম্যান: দ্য লেজেন্ড অফ প্রদীপ ম্যাথিউ’ কমনওয়েলথ পুরস্কার পেয়েছিল। ক্রিকেট নিয়ে লেখা বইয়ের তালিকায় তাঁর বইকে একেবারে উপরের দিকে স্থান দিয়েছিল উইসডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাক। এবার দ্বিতীয় বইয়ের জন্য ঝুলিতে এল বুকার। বইয়ের নাম- ‘সেভেন মুনস অফ মালি আলমিডা’। শেহানের জন্ম ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ শ্রীলঙ্কায়। বেড়ে ওঠা কলম্বোতে। পরে অবশ্য শিক্ষাসূত্রে দেশের বাইরেই থেকেছেন তিনি। পড়াশোনা শেষ করেছেন নিউ জিল্যান্ডে। ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি পড়েছেন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও। লন্ডন, আমস্টার্ডাম, সিঙ্গাপুরে ঘুরেছেন। পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ করবার আগে বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করতেন শেহান করুণাতিলকা। সেই সময় নিয়মিত খবরের কাগজে ফিচারও লিখতেন। গার্ডিয়ান, নিউজউইক, রোলিংস্টোন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, কনডে নাস্ট উইসডেন, ইকনমিক টাইমসে লেখালিখি করতেন।

২০০০ সালে দ্য পেইন্টার নামে একটি উপন্যাস লেখেন করুণাতিলকা। কিন্তু সে বই দিনের আলোর মুখ দেখেনি। তাঁর প্রথম বই ছাপা হয় এরও দীর্ঘ দশ বছর পরে, ২০১০ সালে, ৩৫ বছর বয়সে। বইয়ের নাম- ‘চায়নাম্যান: দ্য লেজেন্ড অফ প্রদীপ ম্যাথিউ’। ক্রিকেটের মোড়কে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস নিয়ে লেখা বই। আশির দশকের এক হারিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারকে খুঁজে বের করতে চান মদ্যপ সাংবাদিক ডব্লিউ জি করুণাসেনা। ৬৪ বছরের এই সাংবাদিক বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি কর্মজীবনে। ক্রিকেটের নেশাটা অবশ্য তাঁর রক্তে। তাই পাকস্থলির অসুখে ডাক্তার যখন জবাব দিয়ে দিলেন, করুণাসেনা স্থির করলেন, আশির দশকের হারিয়ে যাওয়া বাঁ-হাতি স্পিনার প্রদীপ ম্যাথিউকে খুঁজে বের করবেন। কারণ প্রদীপই তাঁর দেখা সেরা ক্রিকেটার। সেই যাত্রাপথ নিয়েই শেহানের উপন্যাস। কিছু রহস্য, কিছু ট্র্যাজেডি, কিছু কমেডি আর কিছু অসংলগ্ন প্রলাপ– এই নিয়েই ছিল করুণাতিলকার প্রথম বই, যা বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। কমনওয়েলথ পুরস্কার ছাড়াও ডিএসসি প্রাইজ ফর সাউথ এশিয়ান লিটারেচার. গ্রেশিয়ান প্রাইজে সম্মানিত হয়েছিলেন করুণাতিলকা। তবে দ্বিতীয় বই ছাপিয়ে গেল প্রথমটিকেও। খোদ বুকার জিতে নিলেন ৪৭ বছরের লেখক।
এই বইয়ের বিষয় কী? আদতে এ বই একটি ‘হুডানইট’ গোত্রীয় থ্রিলার। ওয়ার ফোটোগ্রাফার মালি আলমিডা বইয়ের মুখ্য চরিত্র। কিন্তু মালি নিজে বেঁচে নেই। খুন হয়েছেন তিনি। আর খুনের পরে নিজেই নিজের মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে নেমেছেন। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ এই বইয়ের পটভূমি। কীভাবে নানা চ্যালেঞ্জ সামলে নিজের মৃত্যুরহস্য সমাধান করলেন মালি আলমিডা, তা নিয়েই এই বই। বলা যেতে পারে অশরীরী অবস্থায় আটকে পড়া এক আত্মা তার জীবন, সম্পর্ক, লাল ফিতের ফাঁসে আটকা পড়া কাজের জগতের দিকে ফিরে দেখছে নিজের মৃত্যুর কিনারা করতে গিয়ে। কখনও ফিরে দেখছে নিজের কাজের নৈতিক সঙ্কটগুলো, কখনও বা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আবার কখনও বা গোপন সমপ্রেমের কথা। শ্রীলঙ্কার উথালপাথাল ইতিহাসের সেই সময়টায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন মালি, যখন বাতাসে বারুদের গন্ধ, চারদিকে কার্ফিউ, আত্মঘাতী তামিল টাইগারদের পায়ের আওয়াজ, আর গণকবরের মাটি খোঁড়াখুঁড়ির শব্দ। তবে কেউ যাতে তাঁর এই উপন্যাসকে রাজনৈতিক স্যাটায়ার বলে ভুল না করেন, তাই করুণাতিলকা নিজেই বলেছেন, “I hope it is read in a Sri Lanka that learns from its stories and that ‘Seven Moons’ will be in the fantasy section of the bookshop and will… not be mistaken for realism or political satire.”
এ বই লিখতে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে শেহানকে। অনেকগুলি সংস্করণ লিখেছিলেন আলাদা আলাদা নামে। ২০১৫-তে যে সংস্করণটি গ্রেশিয়ান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়, তার নাম দিয়েছিলেন ‘ডেভিল ডান্স’। ততদিনে ভারতের প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন তাঁর ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়ে বই প্রকাশে সম্মতি জানিয়েছে। এদিকে তখন পুরোদমে চলছে অতিমারী। তারমধ্যেই ২০২০ সালে ভারতে বইটি প্রকাশিত হয়। নাম ছিল- ‘চ্যাটস উউথ দ্য ডেড’। এবার আন্তর্জাতিক কোনও প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই ছাপাতে উদ্যোগী হন শেহান। কিন্তু কোনও সংস্থাই এ বই ছাপতে রাজি হচ্ছিল না। সকলেরই মত, শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট অতি জটিল, রহস্যময়, এমনকী ইংরিজিতে যাকে বলে কনফিউজিং, তেমনটাও বটে। তার ওপর রয়েছে উপমহাদেশীয় পুরাণের অনুষঙ্গ। ফলে পাশ্চাত্যের পাঠকদের কাছে তা নাকি মোটেই গ্রাহ্য হবে না। এত প্রত্যাখ্যানেও অবশ্য হাল ছাড়েননি করুণাতিলকা। ভাগ্যিস! অবশেষে শিকে ছেঁড়ে। ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা ‘সর্ট অফ বুকস’ তাঁর বইটি ছাপতে রাজি হয়। শর্ত ছিল, বইটিকে পাশ্চাত্যের পাঠককুলের মনের মতো করে নতুনভাবে সাজাতে হবে। অতিমারীর কারণে শেহানের হাতে সময় ছিল। দু বছর ধরে সেই ঢেলে সাজার কাজটি করেন তিনি। অবশেষে এ বছর অগাস্টে সারা বিশ্বে প্রকাশিত হয় ‘সেভেন মুনস অফ মালি আলমিডা’।
শেহান করুণাতিলকা কিন্তু ছোটদের জন্য লিখতেও সমান আগ্রহী। ইতিমধ্যেই ২০১৯ সালে লিখে ফেলেছেন ছোটদের জন্য বই- ‘প্লিজ ডোন্ট পুট দ্যাট ইন ইয়োর মাউথ’। তাতে ছবি এঁকেছেন শেহানের ভাই ললিত করুণাতিলকা, যিনি তাঁর প্রথম উপন্যাসেরও প্রচ্ছদ-অলঙ্করণ করেছিলেন। নাম দেখেই বুঝতে পারা যায়, বাচ্চাদের সব জিনিস মুখে দেবার বিষয়ে বইটি লেখা। লাইভমিন্ট পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে কথা নিজেই বুঝিয়ে বলেছেন করুণাতিলকা। জানিয়েছেন, তাঁর কন্যা একবার দেয়াল রং করার তুলিকে আইসক্রিম ভেবে মুখে দিতে যাচ্ছিল। মরা পোকামাকড় পেলেই মুখে পোরার স্বভাব ছিল তাঁর পুত্রের। ফলে এসব নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন লেখকমশাই। তারই ফল এই বই। আপাতত আরও দুটি বাচ্চাদের বই লেখার কাজে নিমগ্ন তিনি। একটি ছোটগল্পের সংকলন এবং একটি উপন্যাস। শেহানের আশা, এই বই প্রকাশের জন্য তাঁকে দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। আমাদের আশাও অনেকটা সেরকমই!
*তথ্যসূত্র: Livemint, The Guardian, Aljazeera, CNN
*ছবি সূত্র: Thebookerprizes.com
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।