অভিষেক চৌবে নির্দেশিত ‘উড়তা পঞ্জাব‘ (২০১৬)-এর সেই দৃশ্যটি মনে পড়ে? পুলিশের তাড়া খেতে খেতে ড্রাগ অ্যাডিক্ট, রক সিঙ্গার তেজিন্দর ‘টমি‘ সিং (শাহিদ কাপুর) ভাটিন্ডার হাসপাতালে এসে পৌঁছয় পিংকির (আলিয়া ভাট) খোঁজে, যাকে সে ভালবেসেছিল।
হাসপাতালে ভর্তি পরিচিত এক আসামীর কাছে পিংকির খোঁজ নিতে চাইলে উল্টে তার কাছে এক অদ্ভুত আবদার রাখে মানুষটি। এক্ষুনি তাকে একটা গান শোনাতে হবে। বাইরে পুলিশ তখন প্রায় দরজা ভেঙে ফেলেছে। তার মধ্যে এই বিচিত্র আবদার। বাধ্য হয়ে গান ধরে টমি সিং। এতদিন পর্যন্ত কোকেন-ড্রাগসের নেশায় বুঁদ হয়ে গাওয়া কোনও হার্ড রক নয়। নির্ভেজাল পঞ্জাবি লোকগান। পঞ্চ অবের মাটি জল হাওয়ায় মিশে থাকা দেশজ সুর, ভালবাসার গান। ‘ইক কুড়ি, জিদা নাম মহব্বত গুম হ্যায়‘। মুগ্ধ হয়ে সেই গান শোনে বন্দি মানুষটি। পিংকির খোঁজ দিয়েছিল সে।
***
১৯৭০ সাল। বম্বের সন্মুখানন্দ হল। কানায় কানায় ভর্তি। সেখানে চলছে তখন পঞ্জাবি সাহিত্য উৎসব। হচ্ছে কবিতাপাঠ। এমন সময় স্টেজে উঠে এলেন বছর তেত্রিশ চৌঁত্রিশের এক যুবক। একমাথা ঢেউ খেলানো চুল, ফর্সা টকটকে গায়ের রঙ, টানা টানা চোখ, নাক, গভীর চাউনি, গায়ে কালো কোট পরা মানুষটি মদের নেশায় তখন টলছেন। সবার নজর তাঁর দিকে। তাঁকে দেখেই কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে, ভয়ে, সম্ভ্রমে মাইক ছেড়ে দিলেন ঘোষক।
টলমলে পায়ে এগিয়ে এসে মাইক ধরে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তিনি। চোস্ত পঞ্জাবিতে জানালেন- “এটা কী কবিতা হচ্ছে? নাকি কবিতার নামে তামাশা?”… যুবকের এমন স্পর্ধা দেখে সবাই অবাক। হলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল গুঞ্জন। কিন্তু সেই দিকে হুঁশ নেই তাঁর। মাইক ধরে তিনি উগরে দিচ্ছেন তাঁর যাবতীয় ক্ষোভ।

– আজকাল সবাই দেখি কবিতা লিখছে! কবিতা বুঝি এতই সোজা? কবিতার অর্থ বোঝে কেউ?
যুবকের এমন খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ শুনে দর্শকাসন থেকে রাগে লাফিয়ে ওঠেন কয়েকজন।
– তাহলে কবিতা কেমন হওয়া উচিত তুমিই শোনাও। দেখি কত হিম্মত তোমার!
জবাবে হাহা করে উন্মাদের মতো হেসে ওঠেন সেই যুবক। যেন এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
– শুনুন তাহলে।
বলে মাইক টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করেন তাঁর নতুন লেখা কবিতা “ইশতেহার।”… সবাই অবাক হয়ে দেখে যুবকটি চোখ বন্ধ করে সুর করে গাইছেন তাঁর লেখা নতুন কবিতা-
ইক কুড়ি জিদা না মহব্বত গুম হ্যায়
সাদ মুরাদি সোহনি ফাবত গুম হ্যায়…!!
গাইছেন আর তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। গোটা হল নিস্তব্ধ। সূচ পড়লেও বুঝি তার শব্দ শোনা যাবে। যেমন সেই কবিতা, তেমনি অদ্ভুত তার সুর। মিনিট কুড়ি পরে যখন যুবক থামলেন, দর্শকাসনে কারুর মুখে কথা নেই, এতটাই আপ্লুত সকলে। দর্শকদের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে আবারও টলমলে পায়ে স্টেজ ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি।
ততক্ষণে উপস্থিত সকলে জানতে পেরেছেন তাঁর পরিচয়। তিনি শিবকুমার বটালভি (১৯৩৬-১৯৭৩)। আধুনিক পঞ্জাবি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। স্বয়ং অমৃতা প্রীতম যাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘বিরহা দা সুলতান‘ নাম দিয়েছিলেন। এই ঘটনার কয়েক বছর পরেই মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে ‘লিভার সিরোসিসে‘ আক্রান্ত হয়ে মারা যান বটালভি।
২৩ জুলাই, ১৯৩৬ সাল। পঞ্জাবf আধুনিক সাহিত্যের রূপকার বটালভি জন্মগ্রহণ করেন পঞ্জাবের শিয়ালকোটের (অধুনা পাকিস্তান) বড়া-পিন্ড লোটিয়ানে। তাঁর বাবা কিষান গোপাল ছিলেন পিন্ডের (গ্রাম) তহসিলদার। মা শান্তাদেবী ছিলেন এক ধার্মিক মহিলা। ১৯৪৭–এ দেশভাগের পর তাঁর পরিবার চলে আসে পঞ্জাবের গুরুদাসপুরের বটালা–তে। শিবকুমার তখন এগারো। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির ভক্ত ছিলেন তিনি। অন্তর্মুখী, লাজুক স্বভাবের ছেলেটির বন্ধু ছিল কম। একা থাকতে বেশি পছন্দ করত সে। সুযোগ পেলেই ডুব দিত ওয়ারিশ শাহ, বুল্লেহ শাহ, নানক শাহ ফকিরের লেখায়।
খুব ছোট বয়েস থেকেই তিনি হাত পাকিয়েছিলেন কবিতায়। ক্লাসে ডুব মেরে নদীর ধারে বসে একমনে পদ্য লিখতেন। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে পঞ্জাবের নদী, খেত, ফসল, প্রকৃতির কথা। এভাবেই একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিলেন তিনি। নিজের নামে সঙ্গে জুড়ে নেন তাঁর গ্রাম বটালার নাম। হয়ে ওঠেন কবি শিবকুমার বটালভি।

একদিন গ্রামের মেলায় এক কিশোরীকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তার নাম ‘ম্যায়না’। ম্যায়নার খোঁজ করতে করতে বহুদূর তার গ্রামেও গিয়ে হাজির হয়েছিলেন বটালভি। আলাপ করেছিলেন তার সঙ্গে। কিন্তু মনের কথা জানানোর সময় পাননি। খুব অল্পদিনের মধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মেয়েটি। শোকে পাগল হয়ে গেছিলেন শিবকুমার। তাঁর কথা ভেবেই লেখেন দীর্ঘ কবিতা- ‘ম্যায়না’। এরপর বারবার প্রেমে পড়েছেন শিবকুমার। অথচ বারবার ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছেন। কোনও প্রেমই তাঁর জীবনে স্থায়ী হয়নি। নিজেকে প্রেমের বিষয়ে ‘শাপিত’ (অভিশপ্ত) ভাবতেন তিনি।
এর পরে আরও একবার প্রেমে পড়েন বটালভি। বিখ্যাত পঞ্জাবি লেখক গুরবক্স সিং প্রীতলরির মেয়ের। তা নিয়েও লিখেছেন বহু পদ্য। কিন্তু সেই সম্পর্কও টেকেনি। ভিন্ন জাতের ছেলে বলে। বিদেশে এক এনআরআইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটির। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রেম হারিয়ে যাওয়ায় ভীষণরকম ভেঙে পড়েন বটালভি। ডুব দেন মদের বোতলে। কিন্তু লেখা থামাননি তিনি। কারণ লেখাই তখন তাঁর একমাত্র আশ্রয়। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় বটালভির প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ‘পীরহান দা প্রাজ্ঞা।’ অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সে বই। গোটা পঞ্জাবে নাম ছড়ায় বটালভির। এরপর আর থেমে থামেননি। একে একে বেরোয় ‘লাজবন্তী’, ‘আতে দিয়া চিড়িয়া’, ‘বিরহা তু সুলতান’, ‘ম্যায়নু ভিদা করো’ ও ‘লুনা’-র মতো কাব্যগ্রন্থ।

১৯৬৭ সালে ‘লুনা’-র জন্য পেলেন সাহিত্য আকাদেমি সম্মান। তিনিই সর্বকনিষ্ঠ লেখক বা কবি যিনি মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে পান সেই সম্মান। সে বছর বিয়েও করেছিলেন শিবকুমার। অরুণা নামের এক ব্রাহ্মণকন্যাকে। সন্তানও হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু মদের নেশা ততদিনে পুরোপুরিভাবে গ্রাস করেছিল তরুণ কবিকে। গ্রাস করেছিল জীবন, প্রেম, ভালবাসা নিয়ে ঘোর বিষাদ।
কবি অমৃতা প্রীতম ছিলেন তাঁর কবিতার গুণগ্রাহী। “বিরহা দা সুলতান” উপাধি তাঁরই দেয়া। গোটা পঞ্জাব তাঁর পদ্যের ভাষায়, আবেগে ম্যুহমান। মারা যাবার আগেও লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা যা আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বিদেশে ‘ইয়ং পোয়েটস মিটে‘ও গেছিলেন শিবকুমার। কিন্তু দেশে ফিরে প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে হয়ে পড়েন রগচটা, দুর্মুখ, আগ্রাসী। বটালভি মনে করতেন, তাঁর প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি। তাঁর চেয়ে কম প্রতিভাবানেরা তাঁর আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তিনি রয়ে গেছেন ব্রাত্য, বঞ্চিত, অবহেলিত। তাই সারাক্ষণ বিষাদে ডুবে থাকতেন। জীবন সম্পর্কে ছিল বাঁধভাঙা ক্ষোভ আর অভিমান। সঙ্গী ছিল শুধু কবিতা আর মদের বোতল। এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি তিনি। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে (৬ মে, ১৯৭৩ সাল) ‘লিভার সিরোসিস‘ হয়ে মারা যান আধুনিক পঞ্জাবী সাহিত্যের এই অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন কবি।
আজ “ইক কুড়ি” শুনতে শুনতে বারবার মনে পড়ছিল বটালভির কথা। তিনি নেই, কিন্তু অমর হয়ে আছে তাঁর সেই গান যা গেয়েছেন মহেন্দ্র কাপুর, নুসরত ফতে আলি খান, জগজিৎ সিং বা মহম্মদ রফির মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা। পঞ্জাবের আধুনিক কাব্যসাহিত্য তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। সেই বটালভি, যিনি সোচ্চারে বলেছিলেন, “এই জীবন ধীরস্থির এক আত্মহত্যার দোসর। আমি একে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করি আমার কবিতার মাধ্যমে…”

আজ, ২৩ জুলাই ৮৫ বছরে পা দিলেন অমর কবি শিবকুমার বটালভি। তাঁর মতন এত সুন্দর, সহজ সরল করে বোধহয় কেউ আগে লেখেননি প্রেমের ভাষ্য, আগামীতেও কেউ লিখবেন কিনা সন্দেহ। কেউ তাঁকে মনে রাখুক না রাখুক, তাঁর লেখা অজস্র গান ও কবিতার ছত্রে ছত্রে আজও বেঁচে আছেন তিনি। ভবিষ্যতেও থাকবেন। আর আমাদের মনে করিয়ে দেবেন সেই মেয়েটির কথা:
“সুরত ওসদি পরিয়া ওয়ারগি
সিরত দিও মরিয়াম লাগদি-
হাসদি হ্যায় তা ফুল ঝড়দে নে
তুরদি হ্যায় তাঁ গজল হ্যায় লাগদি…”
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Twitter, Indiatimes
পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।