সন্ধেবেলা বিষমকুলগড়ের চাতালে বসে সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলছিল বিশ্বনাথ। গভীর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট চোখে মুখে।
— “এই আস্তানাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দিতে হবে আমাদের। পারলে দু-চারদিনের মধ্যেই। কারণ বোদে থেকে শুরু করে জমিদারবাবুদের অনেকেই এই আস্তানাটা চেনে। এবার আর একা নয়, সবাই মিলে দল বেঁধে আসবে ওরা। ওদের সঙ্গে লড়তে আমার ভয় নেই। কিন্তু আশেপাশের ছোট ছোট দুলে বাগদি পাড়াগুলোর লোকজনদের নিয়ে আমার চিন্তা। পাক্কা শয়তান ওই শালা সাহেব-বাবুরা। লড়াই বাঁধলে ওই গরীব নিরীহ মানুষগুলোকেও ছাড়বেনা ওরা। ওদের কথা ভেবেই আমাদের সরে যাওয়া উচিৎ এখান থেকে। এরকম কোন আস্তানার কথা জানা আছে তোদের? যার খবর বোদে আর সায়েবরা জানেনা?”।
শাকরেদদের দিকে তাকাল বিশ্বনাথ।
— “বল্লালগড়ের ডেরার কথা মনে আছে তোর?” পাশ থেকে বলে উঠল মেঘা।
— “বছর পাঁচেক আগে ওখানে বন্যার সময় ডেরা বেধেছিলাম আমরা”।
শোনামাত্র চকচক করে উঠল বিশ্বনাথের চোখজোড়া। সেই বল্লালগড়। রাজা বল্লাল সেনের আমলে তৈরি। এখন ভাঙ্গাচোরা একটা ঢিবিতে পরিণত। লোকে বল্লালঢিবি নামেও ডাকে। এই অবস্থায় আস্তানা গড়ার পক্ষে একদম সেরা জায়গাটা। দুদিকে কুলিয়া আর হোড়ঙ্গর জঙ্গল। জঙ্গলের গায়ে বাগদির খাল। নামে খাল হলেও আসলে ভাগীরথীর শাখানদী একটা। বর্ষায় বান ডাকে। বড় বড় নৌকা চলে। কিন্তু জঙ্গল ভেদ করে কিছুতেই চোখে পড়েনা ঢিবিটাকে। কোনও জনবসতিও নেই আশেপাশে দু-চার ক্রোশের মধ্যে।
— “ঠিক আছে” মেঘার দিকে তাকিয়ে বলল বিশ্বনাথ।
— “ওখানেই ডেরা বাঁধব আমরা। কালকেই আমাদের মধ্যে একদলকে পাঠিয়ে দে বল্লালগড়ে। আগে থেকে সাফসুতরো করে গুছিয়ে রাখবে জায়গাটা।”
বলার সময় ভয়ঙ্কর একটা উথালপাথাল চলছিল মনের মধ্যে। এরকম একটা সময়ে কিছুতেই সঙ্গে রাখা যাবে না দুর্গাকে। কিন্তু সেটা ওকে বলবে কিভাবে? শোনার পর কী বলবে দুর্গা? মনের কী অবস্থা হবে ওর? ভাবতেই কেঁপে উঠছিল বিশ্বনাথের ভেতরটা। এসব উথালপাথাল ভাবনার মাঝখানে চাতালে এসে দাঁড়াল দুখে বাউরি। সামনে বাগদিপাড়ায় বাড়ি। ওর কাছে খবর পাঠিয়েছে নসীবপুরের মুকুন্দ দুলে। মৌজার প্রায় একশ বিঘের ওপর জমি ফেডি সায়েবের কাছে দাদন দিয়েছে নৃপতি রায়। নীলচাষ করতে রাজি না হওয়ায় মণ্ডলপাড়া আর মুসলমান পাড়ার লোকজনের ওপর বীভৎস অত্যাচার করছে ফেডিসায়েব। শোনার পর ধকধক করে জ্বলে উঠল দলের সবার চোখগুলো।
— “ফেডি আর নৃপতির কি হবে বিশে?” বাঘের মত গরগর করে উঠলো প্রেমচাঁদ ডোম।
— “চিন্তা করিসনে পেমা। বিচার ওদের হবেই। তার আগে কতগুলো জরুরি কাজ সেরে ফেলতে হবে। তারপর…”
কথা অসমাপ্ত রেখে দোতলার দিকে হাঁটা লাগাল বিশ্বনাথ। মনের মধ্যে চলছেই ঝড়টা। আজ রাতেই মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে দুর্গার। সত্যি কথাটা স্পষ্ট করে বলতেই হবে ওকে। তারপর যা হয় দেখা যাবে। ধিরপায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে লাগল বিশ্বনাথ।
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়েছিলেন অর্জুন সিংহ। ভোরের প্রথম সূর্যের আলো এসে পড়ছে মুখে। এই এক বছরের মধ্যে কিরকম যেন বুড়িয়ে গেছেন ঠাকুরসাহেব। বিশাল চেহারা শুকিয়ে গেছে অনেকটাই। মাসতিনেক আগে সিঁড়িতে পা পিছলে গোড়ালির হাড়ে চিড় ধরেছিল। বৈদ্য এসে লতাপাতা তেল আর জড়িবুটির মলম তৈরি করে দিয়ে গেছিলেন। একমাস ধরে ভাঙা জায়গায় মালিশ করতে হচ্ছে সেটা। দিন পনের হল উঠে দাঁড়াতে পারছেন। লাঠিতে ভর দিয়ে সামান্য হাঁটাচলার অনুমতিও মিলেছে। তবে সিঁড়ি ভাঙা একেবারেই নিষেধ। পিছনে এসে দাঁড়াল বীণা।
ভিড় থেকে দূরে জানলার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্গা। পাথরের মত মুখ। ফাঁকা ভাবলেশহীন একটা চোখের দৃষ্টি। সেদিন খবরটা শোনার পর থেকেই অদ্ভুত রকম একটা শান্ত হয়ে গিয়েছে ও। একটি কথাও বলেনি এতদিনে। ধীরপায়ে গিয়ে দুর্গার সামনে দাঁড়াল বিশ্বনাথ। শীতলচোখে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল দুর্গা। দুচোখের মতই ঠাণ্ডা কন্ঠস্বর।
— “বাবুজি, আপনার নাইবার পানি গরম হয়ে গেছে চলুন।” ভোর ভোর স্নান সেরে নেওয়া অভ্যেস ঠাকুরসাহেবের।
— “চল মা” বলে একহাত বীণার কাঁধে, অন্যহাত লাঠিতে ভর দিয়ে স্নানঘরের দিকে এগিয়ে চললেন অর্জুন। স্নানঘরের একপাশে বিশাল একটা লোহার চারিতে রাখা গরম জল। সামনে একটা কাঠের কেদারা। যত্ন করে ঠাকুরসাহেবকে বসিয়ে দিল বীণা
— “আপনি স্নান করুন। আমি বাইরেই আছি।” বলে হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। ঠাকুর সাহেব জানেন স্নান সারা না হওয়া পর্যন্ত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে বীণা। তারপর বাবাকে নিয়ে যাবে বসার ঘরে। চিরটাকাল বড় স্বাধীনভাবে বেঁচেছেন ঠাকুর সাহেব। এই বয়সে মেয়ের কাছে নির্ভরশীল হতে বড় লজ্জা করে।
— “তোকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না মা। এটুকু কাজ আমি নিজেই সেরে নিতে পারব।”
শোনেনি মেয়ে। উল্টে মৃদু ধমক দিয়েছে-
— “তারপর পড়ে গিয়ে ফের হাত পা ভাঙুন আর কি?”
অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন অর্জুন, এই বুড়ো বয়সে মেয়ের কাছে ধমক খেতে তেমন একটা খারাপ লাগছে না ওর। স্নান সেরে গা হাত পা মুছে পোশাক পালটালেন অর্জুন তারপর হাত বাড়িয়ে টুকটুক করে দরজায় টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে এল বীণা। মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবেন, সামনে এসে দাঁড়াল কানহাইয়া।
— “হুজুর বিশ্বনাথবাবু আয়েঁ হায়। সাথ মে তিন জেনানা আওর ভগবান বাবু।”
বিস্মিত হলেন অর্জুন। এরকম দিনেদুপুরে আসার মানুষ তো সে নয়। পরমুহুর্তেই বিস্ময়ের ভাবটা বদলে গেল উল্লাসে। “আভি উপ্পর লেকে আ সাবকো।”
ঘরে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসা অর্জুন সিংহ। সামনে কেদারায় বিশ্বনাথ। পাশে দাঁড়ানো ভগবান। পিছনে একটা ছোট চৌপাইয়ে পাশাপাশি দুর্গা, বিজয়া আর ভোগলের মা। বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন ঠাকুরসাহেব।
— “কি বিশ্বনাথবাবু শাদি করেছ শুনলাম। দাওয়াত তো পেলাম না?” লজ্জায় অধোবদন হল বিশ্বনাথ।
— “আসলে এত তাড়াহুড়োয় সবকিছু হল…কাউকেই জানাতে পারিনি। এমনকি বাড়ির লোকজনকেও নয়…” জবাব দিল আমতা আমতা করে।
— “আরে ধুর, আমি তো মাজাক করছিলাম তোমার সঙ্গে।” হো হো করে হেসে উঠলেন ঠাকুরসাহেব।
— “এবার বল কি দরকারে এসেছ আমার কাছে।” কেদারাটা টেনে নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে এল বিশ্বনাথ।
— “আপনার কাছে একটি নিবেদন আছে। বিজয়া মা ঠাকুরনকে তো আপনি চেনেন। সম্প্রতি ওনার স্বামী গত হয়েছেন।”
— “আমি জানি খবরটা।” ছোট করে জবাব দিলেন অর্জুন।
— “আমার মনে হয় ওই বাড়িতে দুই সতীনের ঝামেলার মধ্যে মা ঠাকুরনের পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। বাকি রইল দুর্গা। আমার সহধর্মিণী। আমি চাই আপনার আশ্রয়ে ওদের মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা হোক। ওদের ভরনপোষণ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। সেসব ব্যবস্থা করে রেখেছি আমি। আপনার গড়ের মধ্যে না হোক, গড়ের পাশে সামান্য একটুকরো জমির ব্যবস্থা করে দিন আপনি। নিজের খরচে ওখানে ঘর তুলে নেবে ওরা।”
বলতে বলতে কেদারা ছেড়ে হাতদুটো জোড় করে ঠাকুর সাহেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিশ্বনাথ।
— “একমাত্র দেবী মহামায়া ছাড়া জীবনে কারও কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি আমি। আজ আপনার কাছে চাইছি। আমার মনে হচ্ছে শেষ একটা যুদ্ধের জন্যে এবার প্রস্তুত হতে হবে আমায়। এমতাবস্থায় একমাত্র আপনার আশ্রয়ে নিরাপদ থাকবে ওরা। আমার এই প্রার্থনাটুকু মঞ্জুর করুন দয়া করে।”
শোনামাত্র ভয়ঙ্কর উত্তেজিতভাবে উঠে বসে বিশ্বনাথের হাত দুটো চেপে ধরলেন ঠাকুরসাহেব।
— “এরকম একটা তুচ্ছ ব্যাপারে তুমি এভাবে কাকুতিমিনতি করছ? যতদিন ইচ্ছে, চাইলে জিন্দেগিভর এ গরীবখানায় থেকে যেতে পারেন ওরা। নিজেদের ঘরে যে শান আর ইজ্জত নিয়ে থাকতেন তার চেয়ে একবুন্দ কম হবে না এখানে। আর গড়ের বাইরে কোথাও থাকার সওয়ালই নেই। মহলের অর্ধেকের বেশি ঘর তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে সবসময়। সেখানে নিজেদের মত করে সবকিছু গুছিয়ে নেবেন ওরা। আগেই বলেছি এটা তোমারও ঘর। ওরাও যেন তাই মনে করেন। একদিক থেকে ভালোই হল এটা। আমার বীণা মায়ের কথা বলার সাথী জুটে যাবে অনেক। কিঁউ বেটি?” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বীণার দিকে তাকালেন ঠাকুরসাহেব।
— “জরুর বাবুজি।” মিষ্টি হেসে সায় দিলো বীণা।
— “তুই এক্ষুনি নোকরচাকরদের দিয়ে অন্দরমহলের দুটো ঘর খুলিয়ে দে, এনাদের সামানপত্তর যেন সব নিয়ে গিয়ে গুছিয়ে রাখে ওরা।” বীণাকে কথাগুলো বলে বিশ্বনাথের দিকে ঘুরে তাকালেন অর্জুন।
— “এবার বলো। আর কী বলার আছে তোমার? তবে সবার আগে কেদারায় উঠে বসো তুমি। তোমার মত মানুষ এভাবে পায়ের সামনে বসে থাকলে অসম্মান হয় আমার। এটা বোঝনা কেন?”
ঠাকুরসাহেবের কথায় কেদারায় উঠে বসল বিশ্বনাথ। হাতদুটো জোড় করা রয়েছে তখনও। চোখ সরাসরি ঠাকুরসাহেবের চোখে।
— “ঠাকুরসাহেব, অনেকদিন ধরে চিনি আপনাকে। আপনার অতিথিদের ভরনপোষণের জন্য একটি পয়সাও যে আপনি নেবেন না সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপনার কথা থেকে। তবে আমার এই অনুরোধটা ফেলতে পারবেন না কোনওমতেই। আপনি তো জানেন আমার বিষমকুলগড়ে ফি বছর আশ্বিন মাসে ঘটা করে দুর্গাপুজো করি আমি। আমি বিষমকুল ছেড়ে গেলে আর দুর্গাপুজো হবে না ওখানে”। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বিশ্বনাথের বুক চিরে।
— “আমি চাই এবার থেকে পুজো আপনার এই গড়েই হোক। পুজোর অর্থ বিজয়া মা ঠাকুরণের নামে দেবোত্তর করে দিয়ে গেছি আমি। আপনি এজন্য নিজস্ব তহবিল থেকে কোনও খরচা করবেন না। ছোটভাইয়ের একথাটা রাখতেই হবে আপনাকে। আর এই আমার বন্ধু…” পাশে দাঁড়ানো ভগবানের হাতটা ধরল বিশ্বনাথ।
— “পুজোর সেবায়েত হিসেবে সবকিছু দেখাশোনা করবে। আপনি জানেন ও ধার্মিক মানুষ। বড় নরম মনের। ডাকাতি, মারদাঙ্গা, খুনজখম… কোনদিনই ধাতে পোষায়নি ওর। ওসব ছেড়েও দিয়েছে অনেকদিন। ময়রার দোকান চালিয়ে খায়। আমি খবর নিয়েছি। কোম্পানির তরফে কোনও হুলিয়া নেই ওর নামে। প্রতিবছর পুজোর সময় চলে আসবে ও। আর সবকিছুর পর মাথার ওপর আপনি তো রইলেনই।”
কথা শেষ করে মাথা নিচু করে বসে রইল বিশ্বনাথ। ঝুঁকে পড়ে ওর কাঁধে একটা হাত রাখলেন অর্জুন সিংহ।
— “একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরও না বিশু। কোম্পানির ওপরমহলে আমারও কিছু জানপহেচান আছে। তুমি চাইলে তোমার আত্মসমর্পণের ব্যাপারে কথা বলতে পারি আমি। তোমাকে স্রেফ লাটবাহাদুরের পায়ের সামনে অস্ত্র নামিয়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইতে হবে। অল্প সময়ের সাজা হয়ত হবে। লেকিন বাকি জিন্দেগি বেফিকর নির্ভয়ে বাঁচতে পারবে তুমি।”
ম্লান চোখে ঠাকুরসাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসল বিশ্বনাথ।
— “ঠাকুরসাহেব, একমাত্র মা মহামায়ার শ্রীচরণ ছাড়া আর কারও কাছে কোনওদিন আত্মসমর্পণ করেনি এই বিশে বাগদি। ক্ষমাও চায়নি কখনও। শেষবেলায় এসে আর এই অধর্ম নাই বা করলাম। এবার তাহলে আসতে আজ্ঞা দিন।”
উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ফের একবার অর্জুন সিংহকে নমস্কার করল বিশ্বনাথ। লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একহাতে বিশ্বনাথকে জড়িয়ে ধরলেন ঠাকুরসাহেব। এক এক করে সামনে এগিয়ে এল সবাই। শিশুর মত কাঁদছিল ভগবান। হেসে ভগবানের দিকে তাকাল বিশ্বনাথ।
— “বোকার মত কাঁদছিস কেন ময়ারার পো। আমি কি চিরকালের মত চলে গেলাম নাকি? আর সশরীরে যদি যেতেও হয় তাহলেও তোকে ছাড়বনা আমি। গাঙের মেছোবাজ হয়ে এসে ডানা ঝটপটিয়ে বসব তোর দোকানের চালে। উড়ে বেড়াব মৌমাছি হয়ে তোর মেঠাইয়ের বারকোশের ওপর। সেদিন তুই ঠিক চিনে নিবি আমাকে।”
— “বিশেএএ!” তীব্র আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ভগবান। পাশে দাঁড়াল বিজয়া। ঝুঁকে পড়ে প্রণাম করল বিশ্বনাথ।
— “তাহলে আসি মা ঠাকুরণ।” মাথা নিচু বিজয়ার। অবগুণ্ঠনের আড়ালে শরীরটা কাঁপছে চাপা কান্নার দমকে।
— “জানি না কোন নিরুদ্দেশে যাচ্ছ। সারাজীবন মানুষের পাশে থেকেছ তুমি। যদি সেটা ধর্ম হয় তাহলে সারাজীবন সেই পথে হেঁটেছ। সেই ধর্মই যেন তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করে।” কান্নার বেগ বাড়ছিল বিজয়ার।
সামনে তাকাল বিশ্বনাথ। ভিড় থেকে দূরে জানলার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্গা। পাথরের মত মুখ। ফাঁকা ভাবলেশহীন একটা চোখের দৃষ্টি। সেদিন খবরটা শোনার পর থেকেই অদ্ভুত রকম একটা শান্ত হয়ে গিয়েছে ও। একটি কথাও বলেনি এতদিনে। ধীরপায়ে গিয়ে দুর্গার সামনে দাঁড়াল বিশ্বনাথ। শীতলচোখে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল দুর্গা। দুচোখের মতই ঠাণ্ডা কন্ঠস্বর।
— “জানিনা কোথায় যাচ্ছ। এও জানিনা আর ফিরবে কিনা। যাবার আগে শুধু একটা কথার উত্তর দিয়ে যাবে আমাকে? এখানে যে বেড়ে উঠছে…” নিজের স্ফীত গর্ভে আঙুল ছোঁয়াল দুর্গা। “সে বড় হয়ে তার বাপের কথা জিজ্ঞেস করলে আমি কি বলব?”
চুপ করে কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল বিশ্বনাথ। তারপর একলপ্তে অনেকটা নিশ্বাস টেনে নিল বুকে।
— “তাকে বলবি তার বাপ কী ছিল সেটা নিজেই জানত না সে। সারাজীবন সে সেটাই করেছে যাতে তার মন সায় দিয়েছে। আর সে রাস্তায় চলতে গিয়ে কোথাও কারও সামনে মাথা হেঁট করেনি এতটুকু।”
একদমে কথাটা শেষ করেই ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিশ্বনাথ। নিচে সিংদেউড়ির সামনে দাঁড়ানো দুই দ্বাররক্ষী। শিউলাল আর কানহাইয়া। ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল বিশাল, ভারি কাঠের পাল্লাদুটো। দেউড়ি থেকে বেরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বিশ্বনাথ। বন্ধ দরজার ওপারে ফেলে আসা অনেকখানি জীবন… দুর্গা, বিজয়া ঠাকুরণ, বীণা, ঠাকুরসাহেব, ভগবান… একমুহূর্তে সব চলে গেল চোখের আড়ালে। সামনে মাটিতে রাখা পাল্কিটা। এই পাল্কিতেই এসেছে দুর্গা, বিজয়ারা। পাল্কির পাশে দাঁড়ানো চার বেহারা। ব্যস্ত হয়ে উঠল বিশ্বনাথকে দেখামাত্র।
— “ওঠো সর্দার।”
— “না চল আমি হেঁটেই যাই তোদের সঙ্গে” বলল বিশ্বনাথ।
খানিকটা এগোতেই ঘন হয়ে এল জঙ্গল।। বিশাল একটা জারুল গাছের তলা থেকে এগিয়ে এল মেঘা।
— “সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে এলি তো?”
— “হ্যাঁ” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিশ্বনাথ।
এই একটা শব্দ উচ্চারণ করতে যুগ যুগ কেটে গেল যেন। নীরবে সেদিকে তাকিয়ে রইল মেঘা। তারপর টুঁইইই করে মৃদু অথচ দীর্ঘ একটা শিস দিল সামনে তাকিয়ে। আলো আঁধারির মধ্যে প্রত্যেকটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দলের লোকেরা। ঝটপট পায়ে পায়ে রণপা গলিয়ে নিল সবাই। তারপর ঝড়ের গতিতে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
One Response
চিরদিন বেঁচে থাকে এই মমত্ববোধ, এই ভালোবাসা আর এই লেখনী যেখানে মেছোবাজ , মৌমাছি, নারী আর প্রতিস্পর্ধা বাঙালীর ঐতিহ্য হয়ে প্রভাসিত হোক.