গড়ের চাতালে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গীরা। উত্তেজনায় থমথমে মুখ। বিশ্বনাথের কথা শোনার অপেক্ষা করছে সবাই। চাতালের গায়ে তিনদিক ঘেরা চওড়া বারান্দা। সিঁড়ি থেকে নেমে বারান্দার ওপর এসে দাঁড়াল বিশ্বনাথ। সরাসরি চোখ রাখল সঙ্গীদের চোখে।
[the_ad id=”270088″]
— তোদের আজ খোলাখুলি কটা কথা বলার আছে আমার। দলের সামনে আজ বড় কঠিন সময়। প্রথমে মানসুররা, তারপর কালো-দমন, সবশেষে পীতাম্বর, একের পর এক এদেরকে নিকেশ করে আমাদের বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে দুশমনেরা। চাই বা না চাই আমাদের মানতেই হবে সে কথা। এখন এই অবস্থায় কী করব আমরা? কদিন ধরে বারবার নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে চলেছি কথাটা। শেষমেশ পেয়ে গেছি জবাবটা। লড়তে হবে আমাদের। ঘুরে পাল্টা মারতে হবে। লড়াই শেষে হয় ওরা নইলে আমরা। যে কেউ একজন থাকবে ময়দানে। তোরা সবাই আমার পুরনো সাথী। একযুগেরও বেশি সময় একসঙ্গে রয়েছি আমরা। যা করেছি সেটা ধর্ম না অধর্ম জানি না। লোকে বলতেই পারে এটা অধর্ম, পাপ। যদি তাইই হয়, তাহলে পাপ কখনও একা করা যায় না, জুড়িদার লাগে। সেই কারণেই বোধহয় অতগুলো বছর আগে স্বার্থপরের মতো তোদের ডেকে নিয়েছিলাম আমি। যদিও এটা একদমই আমার নিজের কথা। আমার রাস্তা ঠিক করে নিয়েছি আমি। তোরা এবার তোদের কথা বল। আগেই বলেছি সামনে কঠিন সময়। ডাকাতি কম আর দুশমনের মহড়া নেওয়ার পেছনেই বেশি সময় দিতে হবে। ফলে রোজগারের ভাঁড়ারেও টান পড়বে। এই অবস্থায় চাইলে এখনই দল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারিস তোরা। এই এতগুলো বছরে যা কামিয়েছিস তাতে সকলের বাকি জীবনটা দুধে-ঘিয়ে না হোক নুনে-ভাতে চলে যাবে বলে মনে হয়। সময় থাকতে চলে গেলে তোদের ওপর বাবু আর কোম্পানির নজর পড়বে না, কারণ ওদের সব নজর টেনে নেব আমি। নিরাপদ থেকে যাবি তোরা।”
গত কয়েকমাসে একজন বাবুর বাড়িতেও ডাকাতির কথা শোনা যায়নি আশপাশের তিনটে জেলায়। কানাঘুষো এও শোনা যাচ্ছে নাকি দেশান্তরী হয়েছে বিশে। কাশি না হরিদ্বার কোথায় নাকি সাধুর বেশে দেখা গেছে ওকে। তবে এসব উড়ো কথায় কান না দেওয়াই ভাল। মওকা থাকতে থাকতে নসীবপুর মৌজাটা গছিয়ে দেয়া গেছে ফেডি সায়েবের কাছে। সেটাই অনেক।
— আল্লার দোহাই, চুপ কর তুমি!
হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে আর্তনাদ মাখা তীব্র গর্জন। একলাফে বারান্দায় উঠে এল জলিল।
— একথা তুমি বলতে পারলে বিশুভাই। জিন্দেগিভর গরিব লাচার মানুষের ভাল চেয়েছ তুমি। কত জনের কন্যাদায় পার করেছ, কত দুঃখিকে দানখয়রাত, সাহায্য করেছ, গরিব প্রজা রায়তের ওপর কোম্পানি, বেনিয়া আর বাবুদের জুলুম রুখেছ। তোমার ছায়ায় নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারছে বেসাহারা মানুষ… গরিবের ফেরেস্তা তুমি, রাজা বিশ্বনাথ। বড়ে ভাইয়ের এন্তেকালের পরে বেঁচে থাকা হাতেগোনা আমাদের চার পাঁচজনকে চাইলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতে। তা না করে রাজার মতো আগলে রেখেছ দু হাত দিয়ে। গুনে গুনে বদলা নিচ্ছ ভাইয়ার মওতের। এসব যদি গুনাহ হয় তো গুনাহ হি সহি।
বলেই এক ঝটকায় ঘুরে তাকাল পেছনের সঙ্গীদের দিকে।
[the_ad id=”270086″]
— যদি মরদের বাচ্চা হও তো কসম খাও। শরীরে একবুঁদ খুন থাকতে সর্দারকে ছেড়ে যাব না কেউ। বল মঞ্জুর?
— মঞ্জুর! জয় মা ভবানী! আল্লাহ হু আকবর!
চাতাল কাঁপিয়ে পরপর আওয়াজ উঠল ভীমগর্জনে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বুক ঠেলে আসা কান্নার বেগটা সামলাচ্ছিল বিশু। আর ঠিক তখনই দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে অবগুণ্ঠনের আড়ালে জানা অজানা সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর এক বিপদের আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল দুর্গার শরীরটা।
***
ফরাসের ওপর পাতা মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে পা নাচাচ্ছিলেন নৃপতি রায়। মনে বেজায় আনন্দ আজ। গতকালই নসিবপুর মৌজাটা নিয়ে পাকা কথা হয়ে গেছে ফেডি সাহেবের সঙ্গে। বিলি-বন্দোবস্ত, দলিল-কবলিয়ত দস্তখত…সব সেরেটেরে দাদনের কড়কড়ে দশহাজার টাকা ঢুকেও গেছে ট্যাঁকে। এতদিন শালা ওই বিশে বাগদির ভয়ে কিছুতেই কাজটা করে উঠতে পারছিলেন না। বারবার নালিশ জানাচ্ছিলেন কোম্পানির কাছে। অবশেষে কথা শুনেছে কোম্পানি বাহাদুর। কলকেতা থেকে ফৌজ আনিয়েছে বিশেকে মারতে। আর ওই ব্লাকুয়ার সাহেব। কাজের লোক বটে একটা। খোদাবক্সের মত দাপুটে দারোগাকে কাজে নামিয়েছেন। পাঁচু সর্দার, বোদে, ওপরগস্তিরা… বিশের সবকটা দুশমনকে ইঁদুরের গর্ত থেকে টেনে বের করে এনে লাগিয়ে দিয়েছেন পিছনে। খোলা ছুট দিয়ে বলেছেন- “যা ইচ্ছে কর। আমার শুধু বিশেকে চাই।”
[the_ad id=”270085″]
যদিও এই হারামি, রাঁড়ের ব্যাটা অপগণ্ডগুলোকে পোষার খরচ দিতে হচ্ছে তাঁরই মতো জমিদারবাবুদের। তা হোক। ফোঁড়া গালতে গেলে সুঁচ ফোটানোর ব্যথাটুকু সহ্য করতেই হবে। তবে একথা মানতেই হবে কাজও হচ্ছে ব্লাকুয়ার সাহেবের দাওয়াইয়ে। কালো-দমন, মানসুরে, পীতু হাড়ি… বিশের ডাঁয়া বাঁয়া হাত পাগুলো সব খসে পড়ছে এক এক করে। বাকিদের শেয়ালখোঁজা করে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোম্পানির ফৌজ আর বোদে, পাঁচকড়িদের মত হার্মাদরা। দেখে মনে হচ্ছে বিপদ আঁচ করেই বোধহয় গর্তে সেঁধিয়েছে বাগদির ব্যাটা। গত কয়েকমাসে একজন বাবুর বাড়িতেও ডাকাতির কথা শোনা যায়নি আশপাশের তিনটে জেলায়। কানাঘুষো এও শোনা যাচ্ছে নাকি দেশান্তরী হয়েছে বিশে। কাশি না হরিদ্বার কোথায় নাকি সাধুর বেশে দেখা গেছে ওকে। তবে এসব উড়ো কথায় কান না দেওয়াই ভাল। মওকা থাকতে থাকতে নসিবপুর মৌজাটা গছিয়ে দেয়া গেছে ফেডি সায়েবের কাছে। সেটাই অনেক।
[the_ad id=”270084″]
শুধু ঝামেলা করছে মণ্ডল আর মোচলমানপাড়ার কয়েকটা ত্যাঁদড়া রায়ত। বাপপিতেমোর জমিতে নাকি কিছুতেই নীল চষবে না শালারা। ইল্লি রে! নিজের মনেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন নৃপতি। তোরা চষবি না তোদের ঘাড় চষবে। সকাল সকাল লেঠেল পাইক সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন নসীবপুর। যদিও ফেডি সায়েবের সঙ্গে নায়েবমশাই। একে মা মনসা তায় ধুনোর গন্ধ। দুটো কাঁচাখেগো অপদেবতা একেবারে। রক্তবাহ্যি হয়ে যাবে। আবার বলে কিনা বিশ্বনাথবাবু। আদিখ্যেতার আর শেষ নেই শালাদের। এখন কোথায় তোদের বাপ? এসে বাঁচাক তোদের। দাঁত কিড়মিড় করলেন নৃপতি। একবার মরুক বিশেটা। নিজে গিয়ে মায়ের মন্দিরে একশো একটা পাঁঠা চড়াবেন। বিষমকুলগড়ে বিশের ওই ডেরায় মদের ভাঁটি খুলবেন। ওর সুন্দরী রক্ষিতাটাকে তুলে নিয়ে এসে নিজের দাঁড়ে বাঁধবেন। নীলকর আর কোম্পানির সব সায়েবসুবোদের নেমন্তন্ন করে এনে জলসা লাগাবেন একটা। শেরি আর ব্র্যান্ডির ফোয়ারা উড়বে। শান্তিপুর থেকে রাঁড় আর খ্যামটার দল আসবে। সঙ্গে বর্ধমানের নাচনী আর জানবাজারের বাঈরা… রামযাত্রার দলের যে কচি কচি ছোঁড়াগুলো সীতা আর সখি সেজে নাচে, সেগুলোকেও নিয়ে আসতে হবে কয়েকটা। সায়েবসুবোদের কারও কারও আবার ওসব বেজায় পছন্দ। রাতভর বিরাট জলসা লাগাবেন একটা… এসব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার আওয়াজ। দরজা ফাঁক করে উঁকি মারল রাসু।
— নিয়ে এসেছি হুজুর।
— ভেতরে নিয়ে আয়, গম্ভীর গলায় বললেন নৃপতি।
দরজার সামনে থেকে সরে গেল রাসুর মুখটা। ঘরের চারদিকে তাকালেন নৃপতি। দেয়ালে দেয়ালে ছড়ানো নগ্নিকা নারীর ছবি। চার কোণে ছড়ানো কাঠের স্তম্ভের ওপর সাজনো শ্বেতপাথরের অনুরুপ চারটি নারীমূর্তি। আজকাল অন্দরমহলে আর বিশেষ যান না নৃপতি। স্ত্রীর ঘোর শুচিবায়ু রোগ। দিনে কমপক্ষে পঞ্চাশবার হাত পা ধোন। সঙ্গে বার ছয়েক স্নান। কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই সিঁটিয়ে ওঠেন কোণঠাসা বিড়ালির মতো।
— খবরদার! হাজারও মেয়েমানুষ ঘাঁটা ওই হাতে আমাকে ছোঁবে না তুমি।
শুধু ঝামেলা করছে মণ্ডল আর মোচলমানপাড়া কয়েকটা ত্যাঁদড়া রায়ত। বাপপিতেমোর জমিতে নাকি কিছুতেই নীল চষবে না শালারা। ইল্লি রে! নিজের মনেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন নৃপতি। তোরা চষবি না তোদের ঘাড় চষবে। সকাল সকাল লেঠেল পাইক সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন নসীবপুর। যদিও ফেডি সায়েবের সঙ্গে নায়েবমশাই।
তিতিবিরক্ত হয়ে শেষমেশ প্রাসাদের পিছনের এই মহলটি বানিয়েছেন। দিনরাতের আড়াল আর নেই। ফুসলে ফাঁসলে গাঁ থেকে মেয়েমানুষ নিয়ে আসে আড়কাঠিরা। মহলে তাদের পৌঁছে দেয় রাসু। উত্তেজনায় ফরাসে উঠে বসলেন নৃপতি। উত্তেজনার কারণ, পাশের মকুন্দপুর গাঁয়ের ওই মেয়েটা। বালবিধবা। পনেরোয় পা দিয়েছে সবে। অনেকদিন ধরে চার ফেলে বসেছিল আন্নাকালি নাপতেনি। পুরনো আড়কাঠি। অবশেষে মাছে টোপ গিলেছে। মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে আন্নাকালি।
কিন্তু ওদের আসতে দেরি হচ্ছে কেন?
ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে ঢুকল রাসু। পিছনে আন্নাকালি। সঙ্গে সাদা থান পরা একটি মেয়ে।
— এসো এসো আন্না, খবর কী?
কথাটা আন্নার উদ্দেশ্যে বললেও নৃপতির চোখজোড়া আঠার মতো সেঁটে রয়েছে মেয়েটির ওপর। সেদিকে তাকিয়ে ঠসকি একটা হাসি হাসল আন্নাকালি।
— আমাদের মত পাতকীদের খবর ভালোই কী আর মন্দই বা কী। দরকারে না পরলে এই আবাগির বেটির খোঁজ কি আর কেউ নেয়? তা এবার কিন্তু বেছে দশ গাঁয়ের মধ্যে সেরা জিনিসটি এনেছি তোমার জন্য। আমাকে কিন্তু খুশি করে দিতে হবে।
— আরে তা তো দেবই, তবে জিনিসটি কেমন আনলে একটু দেখে শুনে নিতে হবে তো।
চোখ নাচালেন নৃপতি। ইশারা পাওয়ামাত্র কনুই দিয়ে মেয়েটির কোমরে একটা ঠোনা মারল আন্নাকালি।
— আরে ও মাগি, বলি অতো লজ্জাশরম করলে চলবে? ঘোমটাখানা একটু তোল। বাবুর আমার দয়ার শরীল। পছন্দ হয়ে গেলে পাটরানি হয়ে থাকবি আজেবন।
গুঁতো খেয়ে ঘোমটাটা সামান্য তুলল মেয়েটি। গোলগাল ঢলানি মুখ। শাড়ির আবরণ ভেদ করে ফেটে বেরনো যৌবন। হুঁড়ারের মত চোখে মেয়েটার সর্বাঙ্গ লেহন করছিলেন নৃপতি। সে চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে একমুহূর্ত দেরি হল না আন্নাকালির।
— বাবুর জিনিস পছন্দ হয়েচে তাহলে। নাও এবার জলদি জলদি কুটনি বিদেয় কর দিকিনি।
ট্যাঁক থেকে বেশ কয়েকটা মুদ্রা বের করে আন্নাকালির হাতে ফেলে দিলেন নৃপতি। তারপর ঘুরে তাকালেন রাসুর দিকে।
— তোরা এখন যা।
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো রাসু। আন্নাকালিকে খিড়কি দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে চাদরটা পেতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল চাতালে। এখন ঘণ্টা দুয়েকের নিশ্চিন্ত ঘুম। কোথায়, কখন, কোন কাজে কতটা সময় লাগে সেটা এতদিন বাবুর সঙ্গে থাকতে থাকতে নখদর্পণে ওর। কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা হাই তুলল রাসু। পরমুহূর্তেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
[the_ad id=”270088″]
***
— বহেনচোড! হল নেহি চালায়েগা? তুমহারা বাপ চালায়েগা!
বলতে বলতে উন্মত্তের মত চাবুক চালাচ্ছিলেন ফেডি সাহেব। খোলা ধানক্ষেতের ওপর সপাং সপাং চাবুকের মার খেতে খেতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গলাফাটা আর্তনাদ করছিল মোবারক আলি, নরোত্তম মণ্ডল আরও পাঁচ সাতজন। হাউমাউ করে কাঁদছিল বিকট স্বরে। হাতজোড় করে মিনতি করছিল বারবার।
— আমাদের ছেড়ে দিন গো হুজুর। মরে গেলেও বাপ পিতেমোর জমিতে ও বিষ চাষ করতে পারব না আমরা।
আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে চাবুকের মারের মাত্রাও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। মার খেতে খেতে একসময় জ্ঞান হারাল সবাই।
— ব্লাডি নেটিভস!
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো রাসু। আন্নাকালিকে খিড়কি দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে চাদরটা পেতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল চাতালে। এখন ঘণ্টা দুয়েকের নিশ্চিন্ত ঘুম। কোথায়, কখন, কোন কাজে কতটা সময় লাগে সেটা এতদিন বাবুর সঙ্গে থাকতে থাকতে নখদর্পণে ওর। কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা হাই তুলল রাসু। পরমুহূর্তেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
হান্টারটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসে ধপ করে ধানক্ষেতের ধারে পেতে রাখা একটা বেতের কেদারায় বসে পড়লেন ফেডি সাহেব। ফর্সা মুখখানা পাকা কামরাঙার মতো লাল। হাঁফাচ্ছেন বেদম। ফাল্গুনের মিঠে রোদেও দরদর করে ঘাম পড়ছে গা দিয়ে। পেছনে দাঁড়ানো করালী সরকার। কানাইপুর ছোট তরফের নায়েব। দুজনকে ঘিরে সশস্ত্র পাইক পেয়াদার দল। কেদারার পাশে রাখা ভেজানো খড়ে মোড়া একটা ছোট কুঁজো। এগিয়ে গিয়ে নিজেহাতে কুঁজো থেকে ঠান্ডা কেওড়াজলের শরবত গেলাসে ঢেলে বাড়িয়ে ধরলেন ফেডির দিকে।
— এহে, হুজুর তো ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছেন একেবারে। আরে হুজুর, এ শালারা হল ছোটলোক চাষাভুষোর জাত। জন্মে ইস্তক মার খেতে চামড়া গন্ডারের মতো মোটা হয়ে গেছে শালাদের। মেরে মেরে হাল্লাক হয়ে যাবেন, আক্কেল হবে না ব্যাটাদের। অনুমতি দিলে একটি কথা নিবেদন করি। প্রথমে মুখে জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরান আহাম্মকগুলোর। আস্তাবল থেকে গোটা দু’য়েক তাগড়াই ঘোড়াকে এনে ওদের পেছনে বেঁধে দিন শালাদের। ধানকাটা খড়খড়ে মাঠজুড়ে পাক খাবে ঘোড়া। দু’চার পাকের পরেই বাপ বাপ করে কবুল করে নেবে সম্মুন্ধির পো-রা।
শোনামাত্র চকচক করে উঠলো ফেডি সাহেবের চোখজোড়া।
— ভেরি গুড আইডিয়া বাবু! থাঙ্ক ইউ! এই কওন হ্যায়!
পিছন ঘুরে পাইকদের দিকে তাকিয়ে হেঁকে উঠলেন ফেডি,
— মেরে আস্তাবল সে দো ঘোড়েকো লাও জলডি।
শশব্যস্ত হয়ে আস্তাবলের দিকে দৌড়ল সহিস আর পাইকের দল। দূরে একটা বিশাল ঝাঁকড়া আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে দৃশ্যটা দেখছিল সফিকুর। বয়েস বছর আটদশেক। বাপচাচাদের মাটিতে ফেলে চাবুকপেটা করছে ওই শালা ফেডিসায়েব। এক্ষুনি খবরটা পৌঁছে দিতে হবে বিশু সর্দারের চরদের কাছে। আল ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগালো সফিকুর।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।