আধঘণ্টা বাদে কামরার দরজা ঠেলে ঢুকলেন খোদাবক্স খান। বিশালদেহী পাঠান। গৌরবর্ণ চেহারা। গালে সরু চাপদাড়ি। পরনে দারোগার ইউনিফর্ম। খাকি শার্ট আর হাঁটু অবধি ঝুলের হাফ পেন্টুলুন। পায়ে ভারী চামড়ার বুট আর হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া মোজা। ফলে নিম্নাঙ্গের একটুকু অংশও অনাবৃত নয়। মাথার বিশাল পাগড়ির মাঝখানে কোম্পানির পেতলের ব্যাজ জ্বলজ্বল করছে। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এই খোদাবক্স। বহুবছর আগে উত্তরপ্রদেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় চলে এসেছিলেন খোদাবক্সের পূর্বপুরুষরা। খোদাবক্সের বাবা জানবাজ খান আংরেজ ফৌজে সুবেদার ছিলেন। বাংলা আর ফার্সি ছাড়া ইংরেজিটাও মোটামুটি ভালোই বলতে পারেন খোদাবক্স। ফলে এলিয়ট সাহেব-সহ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্তারাও সবিশেষ পছন্দ করেন খোদাবক্সকে। কম কথা বলেন, কিন্তু কাজের মানুষ।
এই গোটা নদে জেলার অপরাধ মানচিত্রটা একেবারে হাতের মুঠোয় খোদাবক্সের। এহেন সবিশেষ দক্ষতার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এই দারোগাটি সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধার ভাবও রয়েছে এলিয়ট সাহেবের। কিন্তু এই মুহূর্তে এই নিয়মের অন্যথা ঘটছে খানিকটা। “কাম খুডাবক্স টেক ইওর সিট।” বিরক্ত চোখে দারোগার দিকে তাকিয়ে সামনে খালি চেয়ারটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন এলিয়ট সাহেব। ঊর্ধ্বতনকে স্যালুট ঠুকে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন খোদাবক্স।
–হোয়াটস দ্য ম্যাটার খুডাবক্স? ক্রুদ্ধ স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন এলিয়ট।
–হোয়াট হ্যাপেন্ড স্যর? প্রশ্নের জবাবে শান্ত চোখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দিকে তাকালেন খোদাবক্স। মুহূর্তে সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো এলিয়টের।
–হোয়াট! এতবড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল অ্যান্ড নাও ইউ আর আস্কিং মি হোয়াট হ্যাপেন্ড?
–প্লিজ লিসিন টু মি স্যর। আমি জানি আপনি নীলের বনে জমিদারবাবুর ওপর বিশ্বনাথের দলবলের হামলার কথা বলছেন। একটু আগেই খবরিরা খবরটা দিয়েছে আমাকে।
–দ্যাট মিনস ইউ নিউ ইট, আর তারপরেও তুমি স্পটে যাওনি! ক্রোধে, বিস্ময়ে কথা আটকে যাচ্ছিল এলিয়ট সাহেবের। শান্ত কণ্ঠস্বর এবার আরও শান্ত খোদাবক্সের
–মেহেরবানি করে আমাকে একটু বলতে দিন হুজুর। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার দু’তিন ঘণ্টা পর কী হবে স্পটে গিয়ে? ঘন জঙ্গলে ঘোড়া চলবে না আর রনপায়ে চড়ে ডাকাতরা ততক্ষণে বিশ ত্রিশ ক্রোশ পথ পেরিয়ে যাবে। আমার মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু বিশদে আলোচনা করা দরকার।
পাশে বসা স্যামুয়েল ফ্রেডি অধৈর্যভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হাত তুলে বন্ধুকে থামালেন এলিয়ট। “লেট হিম স্পিক ফ্রেডি।” চেয়ারটা সামান্য টেনে নিয়ে টেবিলের সামনে ঈষৎ ঝুঁকে পড়লেন খোদাবক্স।
— আসলে হুজুর, আমরা মনে হয় বিশ্বনাথ বাগদির ক্ষমতা বুঝতে একটু ভুল করছি। আমাদের কাছে, মানে কোম্পানি আর জমিদারবাবুদের চোখে ও ডাকাত হলেও গরিব মানুষ ওকে মসিহা মনে করে। শুধু এই নদে জেলা নয়, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, বর্ধমান, ২৪ পরগণা ধরে সেই সুতোনুটি, গোবিন্দপুর, ডিহি কোলকেতা অবধি ছড়ানো ওর জাগির। বড় বড় প্রায় সবক’টা ডাকাতদলের সর্দাররা ওর অনুগত। ডাকাতি করা টাকার বড় একটা অংশ গরিবগুর্বোদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় বিশে। এর আগেও অনেক থানায় কাজ করেছি আমি। নিজের চোখে দেখেছি মুর্শিদাবাদ থেকে কোলকেতা, কী ভাবে ওর নামে কপালে হাত ঠেকায় আম আদমিরা। আর উল্টোদিকে? আড়চোখে কামরায় বসে থাকা ফ্রেডিসাহেব আর জমিদারবাবুদের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিলেন খানসাহেব।
–ভেরি সরি টু সে স্যর, আমাদের শয়তান বা হ্যায়ওয়ান (পিশাচ) ছাড়া আর কিছুই ভাবে না ওরা। ভয় পায় আমাদের। ফলে বিশ্বনাথের আড্ডার কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই খবর পৌঁছে যায় ওর কাছে। পৌঁছে দেয় ওইসব সাধারণ মানুষরাই। এবার আসি আমাদের কথায়। গরিব মানুষদের মধ্যে যত দানধ্যান করে ও তার দশভাগের একভাগও আমাদের গোয়েন্দাদের পিছনে করি না আমরা। ফলে বিশুকে ধরাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে কোম্পানির পক্ষে। শুনেছি নদে ছাড়াও মুর্শিদাবাদ এমনকি যশোরেও সেই চাঁদ রায়, প্রতাপ রায়… বারো ভূঁইয়ার সব রাজারা, যারা মুঘলদের সঙ্গে লড়াই করেছিল, তাদের বহু পুরনো কেল্লা এখনও রয়েছে এসব জেলায় এদিক ওদিক গভীর জঙ্গলের মধ্যে, চূর্ণী আর ভাগীরথীর লুকোনো চোরা বাঁকে বাঁকে। তার মধ্যে বেশ কিছু নাকি এখন বিশুর দখলে। খুব দুর্গম সে সব জায়গা। ঠিকঠাক রাস্তা জানা না থাকলে কারো সেখানে পৌঁছানো নামুমকিন।
কথা শেষ করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন খোদাবক্স। দমচাপা থমথমে একটা আবহাওয়া বিরাজমান ম্যাজিস্ট্রেট কুঠির বিশাল ঘরটা জুড়ে।
–এগেইন ইউ ওয়ান্ট টু মিন দ্যাট ব্লাডি বিশে বাগডি ইজ ইনভিন্সিবল। নো ওয়ান ক্যান টাচ হিম!
কিছুক্ষণ বাদে হতাশা আর বিরক্তিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন এলিয়ট সাহেব।
–আমি ঠিক তা বলিনি হুজুর। একটা গভীর ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দারোগা সাহেবের চোখের কোণে।
–আসলে আমার মনে হয় পুরো ব্যাপারটাকে একবার ঢেলে সাজা দরকার। বাংলায় একটা কথা আছে। “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।” এই ডাকাতির ব্যবসায় বিশ্বনাথের বন্ধু যেমন অনেক আছে, তেমনি শত্রুর সংখ্যাও কম নয় খুব একটা। আমার কাছে খবর আছে অনেকে ওর একচেটিয়া ক্ষমতা আর আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। ওর দলের মধ্যেও নাকি রয়েছে এরকম কেউ কেউ। ওরাই সেই কাঁটা, যারা বিশুকে উপড়ে ফেলতে পারে। এদেরকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। তাহলেই কিস্তিমাৎ! কিন্তু তার জন্য ঐ বাবা আদমের কাল থেকে চলে আসা কোম্পানির পুরনো বরাদ্দ টাকায় চলবে না হুজুর। প্রয়োজনে নিজের মত করে খরচ করার ছুট দিতে হবে। আমি আমার কথাটা বললাম, আভি কোম্পানিকা মর্জি।
— ও.কে. খুডাবক্স। টেবিলের ওপর একটা মৃদু চাপড় মারলেন এলিয়ট সাহেব। “গো আহেড। আমি দেখছি ব্যাপারটা। দরকারে অনারেবল গভর্নরের সঙ্গে কথা বলবো। অ্যাট এনি কস্ট উই ওয়ান্ট টু গেট রিড অফ দ্যাট মেনাস বিশে ডেকয়েট।”
নিঝুম দুপুর। গড়ের খোলা জানলা দিয়ে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে ছিল বিশ্বনাথ। গত দুমাসের কাঠফাটা গরম কেটে গিয়ে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে গত দুতিনদিন হল। আষাঢ় মাস পড়েছে সবে। মাসের প্রথমেই বর্ষা এসে গেছে এবার। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে একটু দূরে খড়ে চূর্ণী। বর্ষার জল পেয়ে কদিনেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে একেবারে। জানলার একধারে বিশাল আশফল গাছটার পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়েই চলেছে। সবুজে সবুজ চারপাশ। চকচক করছে গাছের পাতাগুলো, যেন পাকা মোমের পালিশ লাগানো হয়েছে। স্রোতে স্রোতে উত্তরপানে ভেসে চলেছে চূর্ণী। দু’কুল ছাপানো জল ঢেউ হয়ে এসে লাফিয়ে পড়ছে মাটিতে। ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সব কিছু। টানছে বিশুকে…সন্ধেবেলা। স্বরুপগঞ্জ গাড়ভাতছালার বাগদিপাড়ায় সেই ছোট কুঁড়েঘরটা…কুলুঙ্গিতে রাধাকৃষ্ণের ছোট যুগলমুরতি…শ্রীখোল বাজাচ্ছে বাবা… বিশুর হাতে খঞ্জনি… ‘বেলা গেল কুঞ্জবনে কেষ্ট এল না…’ মা ভাই বোনেরা গাইছে সবাই মিলে…বাবা নিরাপদ বাগদি। কেত্তনের গলাটি ভারি মিঠে। কথায় বলে গাড়ভাতছালার বাগদিপাড়া, ঘরে ঘরে লাঠি সড়কি আর লেঠেল পাইকের চাষ…গাঁয়ে গাঁয়ে জমিদারবাবুদের ফৌজ সব। নিরাপদর বাপ কানাই বাগদি একা লাঠি হাতে পাঁচশো জোয়ানের মহড়া নিতে পারতো। শিমুলের জমিদারবাড়ির লেঠেল সর্দার।
এহেন কোনও বাগদির ছেলে নিরে সে পথই মাড়াল না। সামান্য দু’চার বিঘে জমি। চাষবাস করে যা হত, তাতেই চালিয়ে নিতো কায়ক্লেশে। আর ওই কীর্তন…অবসর পেলেই বেরিয়ে পড়তো নামগানের দলের সঙ্গে। পাড়ার লোকে টিটকিরি কাটত- “বাগদির ব্যাটা হয়ে বোষ্টমের ভেক ধরেছিস। বাপ ঠাকুদ্দার নাম ডোবালি একেবারে। আর দেরি কেন? মাগকে নিয়ে নবদ্বীপে গিয়ে কণ্ঠিবদল করে ন্যাড়ানেড়ি হ’ গে এবার।” বন্ধুবান্ধবের টিটকিরির জবাবে ভারি মিঠে হাসত নিরাপদ। বলত- “আরে আমার ওই কুঁড়েঘরটাই তো নবদ্বীপ রে ক্ষ্যাপা। রাইকিশোরী আর যশোদাদুলাল যুগলে যে রয়েছেন ওই ঘরে। রোজ সন্ধেবেলা যখন কেত্তন হয়, শ্রীখোলে তাল পড়ে, তখন নিমাই এসে বসেন আমার দাওয়ায়। তোরা চোখ থাকতেও অন্ধ, তাই দেখতে পাস না।”
“নিরে ব্যাটার মাথাটা বিগড়েছে একেবারে।” গজগজ করতে করতে চলে যেত পড়শিরা। বিশু, ছোটবেলা থেকে বাপের ন্যাওটা ভীষণ। ভারি ভালো লাগতো ওই খোল, করতাল, খঞ্জনি, কীর্তন আর কীর্তন শেষে লাল লাল গুড়ের বাতাসার হরির লুট। বাবার বন্ধুবান্ধবদের কথায় খুব রাগ হত ছোট্ট বিশুর। মুখ গোঁজ করে বাবাকে বলত- “ওরা খুব পাজি লোক। চলো আমরা চলে যাই এখান থেকে। নবদ্বীপের আখড়ায় গিয়ে থাকি বরং।” ওকে খুব ভালবাসত বাবা। আদর করে ডাকত কেলেনিমাই। হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিত নিরাপদ। বলত- “বললেই কি সেখেনে গিয়ে থাকা যায় রে বাপ। আসলে সবই মহাপ্রভুর ইচ্ছে। তিনি যেদিন ডাক দেবেন সেদিন নিশ্চয়ই চলে যাবো এখেন থেকে সব ছেড়েছুড়ে।”
পরের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৮)
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৬)
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।