আমার বড় হওয়া দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে। ফলে মাছ আর সবজির বাজার বলতে মূলত জানতাম যদুবাবুর বাজারকে। পোশাক বা সাজ সরঞ্জাম কেনাকাটির জন্য কাছাকাছি ছিল দেশবন্ধু মার্কেট তবে তা অত চোখ ধাঁধানো নয়। কাছাকাছির মধ্যে চোখ ধাঁধানো বাজার বলতে ছিল ‘গড়িয়াহাট মার্কেট’। হ্যাঁ, গড়িয়াহাটের চমক আমাদের কাছে এমনই ছিল যে তা সহজেই ‘বাজার’ থেকে ‘মার্কেট’ হয়ে যেত। ছোটবেলায় একটা কথা খুব চলতি ছিল, তা হল ‘মার্কেটিং’, এখন যেমন ‘শপিং’। ‘শপিং’ শব্দটার সঙ্গে খানিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিরিবিলি জায়গায় কেনাকাটির ছবি ভেসে ওঠে, কিন্তু ‘মার্কেটিং’ শব্দটির সঙ্গে মিশে থাকে দরদাম, প্রচণ্ড ভিড়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের ধাক্কা লেগে যাওয়া আর পরিশ্রমের ঘাম! সেই ঘাম যেমন বিক্রেতার তেমন ক্রেতারও। গড়িয়াহাট বাঙালির সেই ঘামের, স্পর্শের আবার দরদামেরও ‘মার্কেট’।
[the_ad id=”270088″]
আমার একাদশ দ্বাদশ শ্রেণি কার্মেলে (কার্মেল হাই স্কুল) পড়াকালীন আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পুরো সময়টাই আমাকে প্রতিদিন পেরোতে হত এই গড়িয়াহাট মার্কেট। যাদবপুর থেকে ফেরা মানে হয় ই-ওয়ান বাসে চেপে সোজা ভবানীপুর, তা নাহলে ছিল আমার প্রিয় অন্য একখানা ফেরার উপায়। অটো করে গোলপার্কে নেমে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গড়িয়াহাটের ঘিঞ্জি দোকানগুলোর রঙ আর গন্ধ নিতে নিতে চার মাথার মোড়টায় গিয়ে বাস ধরা। গড়িয়াহাট আমার চাকরি জীবনেরও শুরুর পাঁচ বছর। সুইনহো স্ট্রিটে আমেরিকান ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিসে বিদেশিদের বাংলা শিখিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গড়িয়াহাটের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে বুঝে নিতে চাইতাম, কীভাবে আলাদা হয়ে যাচ্ছে ক্লাসরুমের আর দোকানের দরদামের বাংলা। মনে করে টুকে রাখতাম শব্দ আর শব্দের ভিন্ন ব্যবহার। ক্লাসে হয়ত শেখালাম “কত দাম?” বলতে, কিন্তু দরদামের ফুটপাথে চলতি বাংলা কথা কানে এলে বুঝতাম, সে বাংলা অন্য। “কত দাম?” হয়ে যায় “দাদা, কত করে?”। ভেবে বলা বাংলা ভাষা, আর পথ চলতি কেনাকাটার বাংলা ভাষা যে আলাদা সেই বোধের শিক্ষকও এই মার্কেটগুলোই। গড়িয়াহাট আমার কাছে ‘যোগাযোগ’ অফিসে গিয়ে কৃত্তিবাসের জন্য কবিতা জমা দেওয়া আবার পারিজাতে কৃত্তিবাসের মিটিঙও, কিংবা পুজোর সময় যাদবপুরের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার স্পট। কিন্তু আমার এই ব্যক্তিগত সমস্ত অনুসঙ্গ পেরিয়ে গড়িয়াহাট আসলে আপামর বাঙালির এক স্বপ্নের উড়াল। ওই চত্ত্বরে হেঁটে যেতে যেতে কেউ চাক বা না চাক ওই স্বপ্নের ভিতর ঢুকে পড়তেই হবে তাকে।

গড়িয়াহাট মানে এক আশ্চর্য মানচিত্র। রাস্তার উপর দিয়ে জিগজ্যাগ অটো রুট কিংবা বাসেদের সারি। রাস্তার একদিকে সার দেওয়া দোকানে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে বিছানার চাদর, কোনওটায় হাতি ছাপ, কোনওটায় ফুলছাপ আবার কোনওটায় বা গুজরাটি এমব্রয়ডারি। কিছু চাদরের সঙ্গে বালিশের ওয়াড়ও থাকছে। দোকানদারেরা বারবার হাত দিয়ে সেই চাদর ছুঁয়ে জানান দিচ্ছেন, “ভালো কাপড়”, আর সেইসব দোকানের সামনে ভিড় জমাচ্ছেন মূলত গৃহিনীরা যাঁরা মনে মনে স্বপ্ন দেখছেন সমস্ত ক্লান্তির শেষে ইচ্ছেমতো একটা ফেব্রিক করা কিংবা বাটিক প্রিন্টের চাদরের উপর ক্লান্তির পিঠ এলিয়ে দেবেন। হয়ত সকালের রোদ এসে পড়লে বিছানার দিকে ফিরে তাকাবেন একবার। এই চাদরের পাশেই রয়েছে শাড়ির পসরা। দেওয়ালে এক আশ্চর্য কায়দায় দড়ি থেকে ঝোলানো থাকে শাড়ি। কী নেই সেখানে- টাঙাইল, ধনেখালি, জামদানি, বাদ নেই কিছুই। আবার একটু এগিয়ে গেলে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে নানান কায়দার জুতো, চটি। স্টাইল আর ফ্যাশনে দিব্যি টেক্কা লাগাতে পারে যে কোনও ব্র্যান্ডেড জুতোকে। কম বয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়, মূলত মেয়েদের যারা শাড়ির সঙ্গে কিংবা নতুন ড্রেসের সঙ্গে ম্যাচিং করে কিনে নিয়ে যাচ্ছে স্যান্ডেল কিংবা কায়দার জুতো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মিহি কোনও কন্ঠে আপনি শুনতে পাবেনই “আর পঞ্চাশটা টাকা কমাও কাকু”।
[the_ad id=”270086″]
টিউসনির টাকা জমিয়ে, কিংবা বাবা মায়ের দেওয়া হাতখরচ থেকেই হয়ত সামনের কোনও উৎসবের জন্য এই কিনতে আসা। আর এই জুতো জামা কিনতে কিনতে গড়ে তোলা এক আত্মীয়তাও। বড় দোকানে, কিংবা শপিং মলে আমরা এই আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারিনা কিছুতেই। কাউকে ‘দাদা’, ‘দিদি’, ‘কাকু’ এসব ডাকতে পারি না সেখানে । এইসব ডাক সেখানে অচল। অথচ গড়িয়াহাটের এই রাস্তায় জিনিস কিনতে কিনতে আমিও কত সময় এই আত্মীয়তায় ভর দিয়ে হয়ত কমিয়ে নিতে চেয়েছি কুড়ি কিংবা তিরিশ টাকা, আবার দোকানদারও হয়ত ‘আর দশটা টাকা দাও বোনটি’ বলে চেয়ে নিয়েছেন তাঁর প্রাপ্য। অনেক ভেবে দেখেছি এই দরদামও খানিকটা অভ্যেস। চাইলেই হয়ত দোকানগুলোয় ঠিকঠাক একখানা নির্দিষ্ট দাম স্থির হতে পারে, কিন্তু কেমন মনে হয় যে সেক্ষেত্রে হারিয়ে যাবে গড়িয়াহাটে কেনাকাটির নিজস্ব চরিত্র। ওই দরদামের মধ্যেও যেন লুকিয়ে আছে খানিক সময় ধরে বাক্যালাপ এবং কেনাকাটির মজা। যেমন সম্পর্কে একটু মতবিরোধ আর একটু ঝগড়া হলে সম্পর্কের আমেজ বাড়ে, এও তেমন।
এগোতে এগোতে দেখা যাবে একের পর এক অসম্ভব ভিড়ে ঠাসা দোকানগুলি। মেয়েদের ঢেউ খেলানো চুল সামনে থেকে সরে গেলে, ফাঁকা দোকানে একটু নজর বোলাতে পারলে দেখা যাবে ঝুমকো কিংবা পাথর বসানো, রূপোলি, সোনালী, তামাটে, অক্সিডাইজড সমস্ত রকমের দুল। দেখা যাবে উঠতি স্টাইলের কাপড়ের বিডসের গয়না সঙ্গে প্যাঁচা বা দুর্গার মুখ আঁকা পেন্ডেন্ট।
গড়িয়াহাটের জুতোর ফ্যশন নিয়ে কোনও কথাই চলবে না। কম বয়সি মনগুলো যাদের বারবার তাকাতে হয় পোশাকের পকেটের দিকে, কিংবা ব্যাগের পার্সের ভিতর, তাদের স্বপ্নপূরণের জন্য গড়িয়াহাটের ফুটপাথের কোনও জুড়ি নেই। অবশ্য কেবল কম বয়স কেন, বেশি বয়সের মানুষদেরও যাঁদের হয়ত মনগুলো ততখানি সতেজ রয়েছে, এই রঙিন পৃথিবী তো তাঁদেরও। এইসব দোকান ছাড়িয়ে আর একটু হাঁটতে শুরু করলে দেখা যাবে হাল ফ্যশনের প্রায় সমস্ত জামা কাপড়ই ঝুলছে একের পর এক রিঙে। র্যাপ আরাউন্ড, প্লাজো, কিউলটস, শিফট ড্রেস কিংবা ক্রপ টপ, বাদ নেই কিছুই। এমনকী রয়েছে বড় ডিজাইনারের কায়দায় তৈরি রেডিমেড ব্লাউজ! পিঠে এমব্রয়ডার করা, কিংবা অফ শোল্ডার। এগোতে থাকলে দেখা যাবে বাচ্চাদের খেলনা, নানাবিধ সফট টয়। বড় দোকানের চাইতে অনেক কম দামের এই খেলনার দোকানের সামনে মায়েদের সঙ্গে কখনও দেখা যাবে বাবাদেরও। শোনা যাবে বাচ্চাদের বায়না। এই পরিক্রমায় আরও খানিক এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে ছবি বাঁধানোর দোকান। হ্যানো কোনও ফ্রেম নেই যা পাওয়া যাবে না সেখানে। জীবনের যে কোনও মুহূর্তকে বাঁধিয়ে দিতে পারেন এঁরা।

এগোতে এগোতে দেখা যাবে একের পর এক অসম্ভব ভিড়ে ঠাসা দোকানগুলি। মেয়েদের ঢেউ খেলানো চুল সামনে থেকে সরে গেলে, ফাঁকা দোকানে একটু নজর বোলাতে পারলে দেখা যাবে ঝুমকো কিংবা পাথর বসানো, রূপোলি, সোনালী, তামাটে, অক্সিডাইজড সমস্ত রকমের দুল। দেখা যাবে উঠতি স্টাইলের কাপড়ের বিডসের গয়না সঙ্গে প্যাঁচা বা দুর্গার মুখ আঁকা পেন্ডেন্ট। এইখান থেকে আরও এগিয়ে বাসন্তী দেবী কলেজের ঠিক সামনে সার বেঁধে বসে থাকতে দেখা যাবে মেহেন্দি শিল্পীদের। যাদের শৈল্পিক ক্ষমতা দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। হাতের তালুতে, কিংবা উলটো পিঠে, কী আশ্চর্য কায়দায় নকশা বা কলকা এঁকে চলেন ওঁরা। প্লাস্টিকের টুলে বসে শিল্পীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে এমনকী আমিও বসেছি বার দুয়েক, সে কেবল ওই নকশাদের ফুটে উঠতে দেখার লোভে আর বাড়ি ফিরে হাত ভরে সেই নকশাদের গায়ে লেগে থাকা মেহেন্দির গন্ধ নেওয়ার আকাঙ্খায়।
গড়িয়াহাট জুড়ে ছড়িয়ে আছে, গানের কিংবা ছবির সিডির দোকান , ছড়িয়ে আছে আচারের,হজমির, রান্নাঘরের বাসনপত্র থেকে ছুড়ি কাঁচি বেলুন চাকির দোকান। এমনকি কুশন কভার থেকে সোফা কভার, মাইক্রোওয়েভ কভার থেকে ফ্রিজের হ্যান্ডেল কভার, সব। অটো ধরতে যাওয়ার ঠিক আগের মোড়ে সাজিয়ে রাখা কাচের জিনিসের সরঞ্জাম। ডিনার প্লেট, সার্ভিং বোউল,কী নেই সেখানে। সুতরাং, গড়িয়াহাট আসলে বাঙালির উইকেন্ডের কিংবা পুজোর আগের ‘মার্কেটিঙ’-এর তীর্থ স্থান যেখান থেকে ঘুরে এলে নিজেকে এবং নিজের বাড়িকে সাজিয়ে রাখার সমস্ত গোপন মন্ত্র জেনে নেওয়া যায়, পকেট আর পার্সের দিকে তাকিয়েও।
[the_ad id=”270085″]
এ বছর পুজো নেই, আর তাই টিমটিম করে জ্বলছে গড়িয়াহাটের বাজার। তবে ফুল বিক্রেতাদের অল্প হলেও খরিদদার আছে । সে খানিক আনন্দের কারণে, খানিক বিষণ্ণতারও। আশার কথা এই, যে ঘুমিয়ে পড়া গড়িয়াহাট আবার একটু একটু করে জেগে উঠছে। ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে শুধুই কি থাকে টাকার লেনদেন ? উঁহু। থাকে চোখের চাওয়া, থাকে সংলাপ, থাকে আয়নায় দেখে নেওয়া কানের দুলে দোকানদারের আড় চোখের দৃষ্টি, থাকে মেহেন্দির গন্ধ আর থাকে মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হওয়া।
গড়িয়াহাট সেই অলীক মানচিত্র যেখানে পুঁজিবাদ আর পণ্যের গায়েও কেমন প্রেমের গন্ধ লেগে থাকে।
কবি ও গদ্যকার। পত্র পত্রিকার জন্য লেখালেখি ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লেখেন। ওঁর লেখা 'খেলনাবাটির দিন শেষ', 'বৃষ্টিরাশির মেয়ে', 'বেহায়া একুশি' পাঠকদের মধ্যে সমাদৃত।
3 Responses
aha opurbo laglo
এই মুগ্ধতাই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। গড়িয়াহাট। গমগমে ভিড়। ঘাম ও হইচই। দরদাম। এই বিকিকিনি। ভারি সুন্দর। ঠান্ডা সপিং মলে তা নেই। এক্কেরে নেই..
khub valo likhechen,,, shopping and marketing er difference ta awesome!