Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

আবির্ভাব

স্বপ্নসোপান দত্ত

আগস্ট ২৮, ২০২৪

Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

অবিনাশ রায়চৌধুরী দীর্ঘ ত্রিশ বছর মার্কিন মুলুকে চাকরি করার পরে সিদ্ধান্ত নেন শিকড়ে ফেরার। পূর্ববঙ্গের জমিদার বংশের ছেলে অবিনাশের বাবা-মা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মতোই ছেলের মনে উঁচু তারে বাঁধা শিল্পের প্রতি অনুরাগ তৈরি করেন। অতি অল্প বয়স থেকেই পরিবারের সকলে লক্ষ্য করেন অবিনাশের সহজাত সঙ্গীত প্রতিভা। বিশেষ করে মার্গসঙ্গীতের প্রতি তার ঝোঁক ছিল দেখার মতো। অনায়াসে শুধুমাত্র রেকর্ড শুনে বড় বড় ওস্তাদের গায়কী অবিকল নকল করতে পারত। এইসব দেখে-শুনে অবিনাশের বাবা মা ঠিক করেন তার লেখাপড়ার পাশাপাশি গানের তালিমের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাই এক খ্যাতনামা ওস্তাদের কাছে তাকে সঁপে দেন। এইভাবে অবিনাশের বৌদ্ধিক ও সঙ্গীত চর্চা এগিয়ে চলে। (Short Story)

তার বিষয় ইঞ্জিনিয়ারিং হলেও সঙ্গীতকেই জীবনের মূলধন করবে বলে ঠিক করে অবিনাশ। তাই তার ওস্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আসরে বা সমাবেশে সঙ্গত করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি সে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী অবিনাশের কলেজে ফলাফল আগাগোড়া ভাল হয় তাই সহজেই বিদেশে স্নাতকোত্তর গবেষণা করার সুযোগ এসে যায়। এত ভাল সুযোগ হাতছাড়া করবে না বলে সঙ্গীত প্রেমকে কিছুটা প্রশমিত করে বিদেশে পাড়ি দেয় সে। তবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে অবসর গ্রহণ করার পরে দেশে ফিরে পুরোনো রেকর্ড শুনে আর বই পড়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
জীবনের এই দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার আগে সে তার বোলপুরের পৈতৃক ভিটেতে ফিরে যায়। তাদের সংগ্রহে যে সকল রেকর্ড ও বই ছিল তা নতুন করে সাজাবে বলে স্থির করে। বাবা মার অবর্তমানে তাঁদের পুরোনো কেয়ারটেকার সঞ্জয় বাড়ির দেখভাল করত। অবিনাশ অকৃতদার। কাজেই সে সঞ্জয়কে বাড়ির যাবতীয় দায়িত্ব দেবে বলে ঠিক করে।


বাড়ির নাম রাখা হল ‘মল্লার’। অবিনাশের খুব প্রিয় রাগ। পূর্বপুরুষদের অ্যান্টিক দিয়ে বাইরের ঘর সাজাল, দেওয়ালজোড়া আলমারিতে পুরোনো বইগুলি রাখল। তবে তার সব চাইতে পছন্দের জায়গা হল গানের ঘর, যেখানে বিভিন্ন তাকে সে সব দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড সাজিয়ে রাখে। এই ঘরটি সে রোজ সকালে নিজের হাতে পরিষ্কার করে। তার অবশ্য একটি কারণ আছে। সে একটি বিশেষ কায়দায় রেকর্ডগুলি সাজায়। এক একটি তাকে এক একটি ঘরানার শিল্পীদের রেকর্ড রাখে। এতে তার গান শুনতে সুবিধে হয়। যেমন আগ্রা ঘরানার জন্য বরাদ্দ ছিল প্রথম তাকটি। সেখানে ফৈয়াজ খান প্রমুখের গাওয়া বিভিন্ন বন্দিশের সংগ্রহ ছিল। পরের তাকে রাখা হয় কিরানা ঘরানার গাইয়েদের রেকর্ড, যেমন ওস্তাদ আব্দুল করিম। সঞ্জয়ের হাতে পড়লে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে পড়বে। তাই তাকে এই গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সঞ্জয়ের প্রতি তার দুর্বলতা থাকলেও সে রেকর্ড ঘেঁটে ফেললে অবিনাশ মাথা ঠিক রাখতে পারবে না।

একদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে আব্দুল করিমের ‘পিয়া বিন নহি আওয়াত চৈন’ গানটি চালিয়ে বারান্দায় অবিনাশ জিরোচ্ছে তখন হঠাৎ লক্ষ্য করল গেটের কাছে একটি কুকুর ছানা ডাকছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে আর পাঁচটা কুকুরের ডাকের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই ছানাটির ডাক। ঠিক যেন করুণ সুরে গান ধরেছে। অবিনাশের খুব মায়া হল। সঞ্জয়কে বলল, “ওকে ঘরে নিয়ে যা, স্নান করা আর কিছু খেতে দে। আমি আসছি।”

ছানাটিকে খাইয়ে দাইয়ে অবিনাশ নিয়ে গেল গানের ঘরে। সেখানে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলির ‘আয়ে না বালম’ চালাতেই ছানাটি উত্তেজিত হয়ে লাফালাফি করতে লাগল। অবিনাশ ওটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কী টিপু সাহেব, বন্দিশ পছন্দ হল না?” রসিক পাঠক বুঝবেন এই ‘টিপু’ নামটি বেছে নেওয়ার সঙ্গেও সাংগীতিক যোগ রয়েছে। ওস্তাদ আব্দুল করিমের পোষা কুকুরের নাম ছিল টিপু। এই কুকুরটিকে তিনি নাকি বিভিন্ন আসরে নিয়ে যেতেন এবং কিংবদন্তিরা বলেন তারও গলায় সুর ছিল। তবে আজকের এই টিপুর দাপাদাপি তাতে একেবারেই কমল না। একই জিনিস হল ফৈয়াজ খানের গান চালানোর পরে। তখন অবিনাশ আব্দুল করিমের ‘যমুনা কে তীর’ গানটি চালাল। এরপরে এক অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল। ছানাটি শান্ত হয়ে গ্রামোফোনের ঠিক তলায় গিয়ে বসল। গানটি চলাকালীন এতটুকুও নড়াচড়া করল না। এই সময়ে অবিনাশের হঠাৎ মনে পড়ল প্রথম বার His Master’s Voice এর লেবেল ছোটবেলায় দেখে বিস্মিত হওয়ার কথা। গ্রামোফোনের রেকর্ডের মুখোমুখি বসে আছে একটি সাদা কুকুর। টিপুর গায়ের রঙ বাদামি হলেও আব্দুল করিমের গান চলাকালীন ওর মুখের অভিব্যক্তি ছিল হুবহু সেই লেবেলের কুকুরটির মতো। গানটি শেষ হওয়ার পরে আরও দু-তিনটি আব্দুল করিমের রেকর্ড চালাল অবিনাশ। তাতেও কুকুরছানার একই প্রতিক্রিয়া। এইসব দেখেশুনে অবিনাশের খুব মজা লাগল। মনে মনে ভাবল, “এতদিন পরে মনের মতো সঙ্গী খুঁজে পেলাম।” তার মনে পড়ল স্কুলে এবং কলেজে সে বন্ধুবান্ধবদের আল্লাদিয়া খাঁ বা আব্দুল করিমের রেকর্ড শুনিয়ে তার মাহাত্ম্য বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তারা জলসায় শোনা শিল্পীদের নিয়েই মজে থাকত। তাই এতদিন বাদে তার দোসর এই ছানাটির মধ্যে খুঁজে পেয়ে সে চমৎকৃত হল।
সেদিনের ঘটনাটি অবিনাশের মনে দাগ কাটে কিন্তু তার চাইতে বেশি কিছু মনে হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয়নি। সেই ভুল ভেঙে গেল হপ্তাখানেক পরে।


প্রতিবারের মতো অবিনাশ বিকেল নাগাদ গানের ঘরে বসেছে গান শুনবে বলে। তার একটু স্বাদ বদল করতে ইচ্ছে হল বলে মল্লিকার্জুন মনসুরের একটি রেকর্ড চালাল। যথারীতি পাশে বসে টিপু। আলাপের মিনিট দুয়েক পরই টিপু অবিনাশের পায়জামা কামড়ে টানাটানি করতে লাগল। অবিনাশ সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বলল, ” কীরে ওকে খেতে দিসনি?’ সঞ্জয় টেবিল পরিষ্কার করতে করতে জানাল, “হ্যাঁ বাবু সকালেই তো দুধ রুটি দিলাম’। এদিকে টিপু পায়জামা ছাড়ে না। অগত্যা অবিনাশ “এই কী হয়েছে কী?” বলে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে পায়জামা ছেড়ে টিপু জিভ বের করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গেল রেকর্ডের তাকের দিকে। তারপরে, একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিরানা ঘরানার তাকে রাখা আব্দুল করিমের ছাপ মারা রেকর্ডের দিকে। শাবকটির চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল অবিনাশ। আগের দিনের ঘটনা আর এই ঘটনা মিলিয়ে অবিনাশের মনে হল টিপু যেন সত্যিই তার ‘Master’ এর ‘voice’ খুঁজে পেয়েছে। আব্দুল করিমের টিপু বহু যুগের ওপার হতে যেন এসেছে বোলপুরে তার মনিবের সন্ধানে।
অবিনাশের টিপুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল সেদিনের ঘটনার পরে। সে বুঝতে পারল যে টিপুর প্রতি তার মায়া মমতা কেবলমাত্র অবলা জীবের প্রতি স্নেহ না। তার জীবনে টিপু আসার আগে সে কতগুলো প্রাণহীন অ্যাান্টিক আর রেকর্ড নিয়ে মজে ছিল। প্রাণী বলতে ছিল শুধু সঞ্জয়। তার সঙ্গে কতটুকুই বা আদান প্রদান করা সম্ভব। পড়শির সংখ্যা কম। তাদের সঙ্গে অবিনাশের সম্পর্ক খারাপ না হলেও বিশেষ প্রণয় ছিল না। টিপু তার জীবনে আসার পরে সে তার মনপ্রাণ ঢেলে দিল পোষ্যকে দেখাশোনা করা আর গান শোনানোর ব্যাপারে।
টিপু বড় হতে লাগল আর আব্দুল করিমের প্রতি তার আনুগত্যও বাড়তে থাকল। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। অবিনাশের মাঝেমধ্যে মনে হত টিপু তাকে মনিবের মর্যাদা দেয় না। তাকে টানা চার পাঁচ ঘণ্টা তার master এর গান না শোনালে টলানো যায় না। তবে এটি মেনে নিতে অবিনাশের খুব একটা অসুবিধে হয়নি যেহেতু তার আর তার পোষ্যর পছন্দ এ ব্যাপারে এক।

গোড়ার দিকে অবিনাশের বিষয়টা মজার লাগলেও টিপুর আব্দুল করিমের প্রতি এই আনুগত্য তাকে ভাবাতে থাকল। টিপু প্রথমটাতে অন্য ঘরানার গাইয়ে বাজিয়েদের বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেও হিংস্র মনোভাব দেখায়নি। কিন্তু কিছুদিন ধরে এক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে। কোন তাকে অন্য ঘরানার রেকর্ড আছে সেটা মোটামুটি চিনে গেছে টিপু, বিশেষ করে আগ্রা আর কিরানা। তাই, কিরানার তাক বাঁচিয়ে আগ্রার তাক থেকে টেনে টেনে রেকর্ড মাটিতে ফেলতে থাকে। এই ঘটনা প্রথম যেদিন ঘটে সেদিন অবিনাশ মারের ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় কিন্তু এতদিনে তার মনে এই ধারণা প্রায় বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে এই কুকুর যে সে কুকুর নয়। সে নিজেকে কিছুটা সৌভাগ্যবান মনে করত টিপুর মতো অভিনব পোষ্য পেয়ে। তার ভাবতে ইচ্ছে করত আব্দুল করিম যেন তার শ্রদ্ধা ভক্তিতে খুশি হয়ে উপহার হিসেবে টিপুকে পাঠিয়েছেন। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে মাটি থেকে রেকর্ড গুলি যথাস্থানে আবার সাজিয়ে রেখে আব্দুল করিমের রেকর্ড চালিয়ে দিল। টিপু যথারীতি শান্ত হয়ে গেল। আব্দুল করিমের গান যতই ভাল লাগুক না কেন, কিছু সময়ে ব্যাপারটা একঘেয়ে লাগত। তার সংগ্রহে একাধিক রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার একই গান বাজাতে বাধ্য হত টিপুকে ঠান্ডা রাখতে। আগ্রা ঘরানার রেকর্ড গুলির প্রতি টিপুর বিশেষ রাগ লক্ষ্য করে অবিনাশ সেগুলিকে Music Room থেকে সরিয়ে তার খাটের পাশে একটি তাকে ঢুকিয়ে দিল। এরপরে অবশ্য অনেকদিন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। মোটামুটি একই ছন্দে জীবন কাটতে থাকল অবিনাশ, সঞ্জয় আর টিপুর। শুধু টিপুর ব্যবহার অবুঝ শিশুর মতো হতে থাকল। তাকে তার master এর গান না শোনালে সঞ্জয় খাওয়াতে পারে না। সঞ্জয় ঠাট্টা করে একদিন বলল, “এই প্রথম দেখলাম বাবু কেউ তোমার থেকে বেশি গান পাগল!” অবিনাশ মৃদু হেসে কথাটা মেনে নিল।

একদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবিনাশ একটি বই পড়ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। যখন চোখ লেগে আসছে ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে উঠল। রাত সাড়ে দশটার সময়ে ফোন পেয়ে একটু চমকে উঠল অবিনাশ। তুলে দেখল তার এক দূর সম্পর্কের ভাই নিখিলেশ।
অবিনাশ: “হ্যালো কে বলছেন?”
নিখিলেশ: “আরে আমি নিখিলেশ। এখন তো দেশে কারো সাথেই প্রায় যোগাযোগ নেই। তোমার নম্বরটা পেলাম অনেক কষ্ট করে। শুনলাম তুমি বোলপুরে থাক।”
অবিনাশ: “হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তোরা তো বস্টনে থাকিস যদ্দূর মনে পড়ছে। তা হঠাৎ বুড়ো দাদাকে কী মনে করে?”
নিখিলেশ: “আসলে কদিনের জন্য দেশে যাব। ভাবছিলাম মধুরিমা আর টুবাইকে শান্তিনিকেতন দেখাব। তুমি যখন বোলপুরেই তখন…

অবিনাশের ইঙ্গিতটা ধরতে দেরী হয় না। মনে মনে ভাবল আমি মরে না বেঁচে সেটা খোঁজ রাখার প্রয়োজন বোধ করে না অথচ দাদার ঘাড় ভেঙে থাকবে কটা দিন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে বড্ড ভাল। তাই নিজেকে সংযত করে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। চিন্তা করতে হবে না। আয় তোরা।”
আয় তোরা বলল বটে, কিন্তু বেশ কিছু বছর নিরিবিলি জায়গায় একা জীবন কাটানোর ফলে অন্য লোকের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয় তার। অবিনাশের জীবনে চাহিদা খুবই কম। সঞ্জয় ভালোই রাঁধে, তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয় না। এছাড়া কাজ বলতে গান শোনা আর বই পড়া। তাই হঠাৎ এই ফোন পাওয়ার পরে কিছুটা বিরক্ত হল অবিনাশ।


পরের দিন সকালে উঠেই সঞ্জয়কে অবিনাশ বাজারে পাঠাল। শত হলেও সম্পর্কে ভাই। তাও আবার সপরিবারে এসে উঠবে। এক সপ্তাহের মধ্যে এসে হাজির হবে। তাই সময় মতো সব ব্যবস্থা করে রাখা চাই। কী রান্না করতে হবে সঞ্জয়কে বুঝিয়ে দিয়ে ঘরদোর সাজানোর কাজে নিজেও হাত লাগাল সে। এইসব করতে করতে একটা কথা মনে পড়ায় সে আরও কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠল। টুবাইকে শেষ দেখেছিল অবিনাশ যখন টুবাইয়ের বয়স বছর তিনেক। বিদেশে থাকাকালীন। সেই সময়েই সে বেশ বুঝেছিল টুবাইকে তার বাবা মা কোনওরকম শাসন করে না। আজ নিশ্চয় সে আরও ডানপিটে হয়ে উঠেছে। তাকে কিছুতেই গানের ঘরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। নিখিলেশ না বললেও তাকে এ ব্যাপারে কড়া হতে হবে। বিশেষত, টিপু গান শোনাকালীন কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
দেখতে দেখতে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। নিখিলেশ আর তার পরিবার এসে হাজির হল। টুবাই যথারীতি যেখানে সেখানে দামী দামী জিনিসে হাত দিতে থাকল। তার বাবা-মা মৃদু বকুনি দিলেও, কথা শোনার ছেলে সে নয়। অবিনাশের নিখিলেশ আর মধুরিমাকেও বিশেষ পছন্দ নয়। আর পাঁচটা প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মতো ভীষণ দাম্ভিক। এরকম হাবভাব অবিনাশের সহ্য হয় না। সে নিজে কর্মজীবন মার্কিন মুলুকে কাটানোর পরেও বাংলার প্রতি তার টান এতটুকুও কমেনি। কিন্তু সবই হাসি মুখে মেনে নিচ্ছল সে। দিনেরবেলায় নিখিলেশ বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে বেরোয়, কাজেই চিন্তা কম। সন্ধ্যেবেলায় ফিরে এসে বিদেশী ট্যুরিস্টদের মতো, “Splendid, splendid” করে আর আদিবাসীদের দুরবস্থা নিয়ে খুব দুঃখ প্রকাশ করে। তার স্ত্রী ‘Cute little santal girl’ দের টাকা দিয়ে দেশোদ্ধার করেছে এমন একটা ভাব করে। অবিনাশ সহ্য করতে থাকে আর রোজ রাতে অতিথিদের মুখে লাল শাক থেকে শুরু করে কাতলা মাছ সবই “delicious” শুনতে শুনতে তার মাথা গরম হয়ে যায়। সঞ্জয় তার রান্নার তারিফ শুনে হাসি মুখে হাত জোড় করে, কিন্তু সেও বেশ বোঝে তার বাবুর রাগ বাড়ছে। একদিন অতিথিরা ঘুমোতে যাওয়ার পরে সঞ্জয় বলল, “বাবু বেশি চিন্তা করো না। টুবাই ও ঘরে ঢুকবে না।” টিপুকে দুপুরের দিকে গান শুনিয়ে খাইয়ে অতিথিরা আসার আগে ঘরে শুইয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তাদের মধ্যে মেলামেশা যতটা সম্ভব কমানো গেছে।

দিন চারেক পরে নিখিলেশ জানাল তারা পরের দিন আরেক বন্ধুর বাড়ি যাবে। অবিনাশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। খালি রাত্রের খাওয়ার আগে বলল, “আমার কুকুরটা দুপুরের দিকে গানের ঘরে গান শোনে নইলে ও খায় না। টুবাইকে বলিস ও ঘরে না ঢুকতে। আমায় একটু বেরোতে হবে। সঞ্জয়ও থাকবে কিন্তু ও স্নানে বা অন্য কোথায় গেলে একটু খেয়াল রাখিস।” অবিনাশের একটি বিশেষ দরকারে ব্যাঙ্ক যেতেই হবে তাই সঞ্জয়কেও বলে রাখল নজর রাখতে। নিখিলেশ যত খারাপ অভিভাবক হোক এক বেলার জন্য সামলে নিতে পারবে আশা করেছিল অবিনাশ। নিখিলেশ ‘sure দাদা do not worry’ বলে আশ্বাস দেয়।

পরের দিন কথা মতো কাজ। অবিনাশ বেরিয়ে যায়। মধুরিমাও শাড়ি কিনতে বেরিয়ে গেল। সঞ্জয় নিখিলেশকে চা দিয়ে টিপুকে গান চালিয়ে দিয়ে রুটি খাওয়াল। কোন রেকর্ডটা চালাতে হবে অবিনাশ বলে দিয়েছিল তাই অসুবিধে হয়নি। এর কিছু পরে নিখিলেশ বারান্দায় গিয়ে জিরোতে লাগল আর সঞ্জয় স্নানে গেল। এরপরে এক কাণ্ড ঘটে গেল। নিখিলেশ কিছু বোঝার আগে “দেখো বাবা doggy টা গান শুনছে” বলতে বলতে গানের ঘরে ঢুকে পড়ল টুবাই। টিপু শব্দ করার আগেই সে গ্রামোফোনের আর্মটিকে ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ভেঙে ফেলল। টিপু হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপরে তার বীভৎস চিৎকার শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এল সঞ্জয়। নিখিলেশ পুরো ব্যাপারটা জানাল তাকে।

অবিনাশ ফিরে এসে সব শুনল সঞ্জয় আর নিখিলেশের কাছে। নিখিলেশের ‘very sorry দাদা’ সঞ্জয়ের “ঠিক হয়ে যাবে বাবু”, কিছুই কানে গেল না তার। তার মন পড়ে আছে তার পোষ্যটির দিকে। ভাঙা গ্রামোফোনের তলায় বসে সে তখন গোঙানির মতো আওয়াজ করছে।
সন্ধ্যাবেলায় নিখিলেশরা বেরিয়ে পড়ল। বাবা মা মিলে ছেলেকে অবিনাশের সামনে বকা দেওয়ার নাটক করল। অবিনাশকে সব আবারও সহ্য করতে হল। তাদের বিদায় জানানোর পরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল অবিনাশ। এদিকে টিপু ঘটনাটি ঘটার পর থেকে মুখে কিছু তোলেনি।

পরের দিনই অবিনাশ যোগাযোগ করল কলকাতায় তার বহুদিনের চেনা এক দোকানদারের সঙ্গে। অবিনাশ যখন সঙ্গীতচর্চা করত, তখন এই দোকানে প্রায়ই যেত তানপুরার আওয়াজে কোনও অসুবিধে হলে। দোকানের তৎকালীন মালিক নবীন মণ্ডলের যন্ত্র সারানোর হাত ছিল চমৎকার। তিনি অপঘাতে মারা যাওয়ার পরে তাঁর ছেলে, সন্তোষ, দোকানের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ইনিও খারাপ নন, তবে বাবার হাতের ধারে কাছে নয় এঁর। তবুও, কানার মধ্যে যে ঝাপসা দেখে তাকেই ভরসা করতে হবে আজকের বাজারে কারণ গোটা শহরে এরকম দোকান এখন হাতে গোনা। অবিনাশ ফোন তুলে জানতে চাইল সন্তোষের কাছে সে পুরোনো আর্মের পরিবর্তে নতুন আর্ম জোগাড় করে দিতে পারবে কী না। সন্তোষ জানিয়ে দিলেন, “না দাদা। ও জিনিস তো আমরা বিক্রি করি না সারাতেও পারি না। বাবার কাছে কিছু লোক আসত ঠিকই তবে আমার কাছে এখন আর নেই। কজনের আর ওই যন্ত্র আছে বলুন?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবিনাশ ফোন নামিয়ে রাখল। এদিকে টিপু চোয়াল শক্ত করে বসে রইল। সঞ্জয় তাকে জলও খাওয়াতে পারছে না।

এভাবে তিনদিন কেটে গেল। টিপু খাবার আর জল না খেয়ে শুকিয়ে আধমরা হয়ে গেল। গায়ে হাত বুলিয়ে, ধমকে, সামনে খাবারের থালা রেখে লোভ দেখিয়ে, কোনও কিছুতেই লাভ হল না। টিপুর হাবেভাবে এতটুকু বদল হল না। সঞ্জয় কান্নাকাটি করতে লাগল, অবিনাশ গালে হাত দিয়ে নিজেকে দুষতে লাগল। মনে মনে বলল, “পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন ওস্তাদজি।”

চতুর্থদিনে সকাল আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙার পরে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে অবিনাশ আর সঞ্জয় থমকে গেল। টিপুর প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে গ্রামোফোনের তলায় আর সে চেয়ে রয়েছে গানের ঘরে দ্বিতীয় তাকে রাখা আব্দুল করিমের রেকর্ডে তার master এর পাগড়ি পরা ছবির দিকে। অবিনাশের মনে পড়ল আব্দুল করিমের মৃত্যুর আগের মুহূর্তের কথা। বইয়ে পড়েছিল তিনি একটি স্টেশনে গাইতে গাইতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই ঘটনার সাথে টিপুর মৃত্যুর আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করল অবিনাশ।

অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

Author Swapnasopan Dutta
স্বপ্নসোপান দত্ত

স্বপ্নসোপান দত্ত এখন রসায়নে পি এইচ ডি'র জন্য গবেষণারত। কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে প্রখর আগ্রহ, তার একদিকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত,স্বর্ণযুগের বাংলা গান ও সংস্কৃতি আর ফিল্ম, বিশেষ করে সত্যজিতের সৃষ্ট ছবি, আবার অন্যদিকে য়ুরোপের ইতিহাস ও তার বিভিন্ন দেশের রন্ধনশৈলী, আর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু। এইসব নিয়ে একাধিক লেখা বেরিয়েছে 'সমতট', 'জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার', 'সাম্পান' ইত্যাদি পত্রিকায়।

Picture of স্বপ্নসোপান দত্ত

স্বপ্নসোপান দত্ত

স্বপ্নসোপান দত্ত এখন রসায়নে পি এইচ ডি'র জন্য গবেষণারত। কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে প্রখর আগ্রহ, তার একদিকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত,স্বর্ণযুগের বাংলা গান ও সংস্কৃতি আর ফিল্ম, বিশেষ করে সত্যজিতের সৃষ্ট ছবি, আবার অন্যদিকে য়ুরোপের ইতিহাস ও তার বিভিন্ন দেশের রন্ধনশৈলী, আর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু। এইসব নিয়ে একাধিক লেখা বেরিয়েছে 'সমতট', 'জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার', 'সাম্পান' ইত্যাদি পত্রিকায়।
Picture of স্বপ্নসোপান দত্ত

স্বপ্নসোপান দত্ত

স্বপ্নসোপান দত্ত এখন রসায়নে পি এইচ ডি'র জন্য গবেষণারত। কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে প্রখর আগ্রহ, তার একদিকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত,স্বর্ণযুগের বাংলা গান ও সংস্কৃতি আর ফিল্ম, বিশেষ করে সত্যজিতের সৃষ্ট ছবি, আবার অন্যদিকে য়ুরোপের ইতিহাস ও তার বিভিন্ন দেশের রন্ধনশৈলী, আর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু। এইসব নিয়ে একাধিক লেখা বেরিয়েছে 'সমতট', 'জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার', 'সাম্পান' ইত্যাদি পত্রিকায়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com