(Short Story)
বরিশাল শহরের মূল পথ পেরিয়ে স্টিমার ঘাটের দিকে এগোতে গেলে ধরা দেয় এক লালচে সুরকির রাস্তা। লাল সুরকির রাস্তাটির দু’পাশে সারি সারি উঁচু ঝাউগাছ— যেন নির্জন বীথির মতো নীরব এক লাইন ধরে মিলিয়ে গেছে দিগন্তের দিকে। শীতের রাতে কুয়াশায় ঢাকা সেই দৃশ্য, হয়ে ওঠে আরও রহস্যময়— সবকিছু অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে, আর তখন ঝাউগাছগুলো যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায়, স্তব্ধ প্রাণীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে, চুপচাপ, অচল, অথচ প্রহরায় নিবিষ্ট। (Short Story)
লাল রাস্তাটা যেখানে শেষ, ঠিক সেখানেই স্টিমার ঘাট। রাতের বেলা নদীর জল চোখে পড়ে না তেমন, কারণ ঘাটজুড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে স্টিমার, পানসি, ডিঙি, জেলে নৌকা আর হাটুরে বজরা। সারা রাত নদীর দিক থেকে কন-কনে হিমেল বাতাস বয়ে আসে ঘাটে। সেই বাতাসে কাঁপে ঘাটের পাশে থাকা বড় কাঁঠাল গাছটি, যার ডালে দুটি শালিক জুবুথুবু হয়ে রাত পোহানোর অপেক্ষায় বসে থাকে, নীরবে। (Short Story)

সারারাত অবিরল শিশির ঝরার পর, ভোর হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে কুয়াশা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। হালকা, আদুরে রোদ আলতো করে ভেসে ওঠে চারপাশে। এদিক-ওদিক ঝুলে থাকা ভাতের মতো সাদা কুয়াশার পর্দা সরিয়ে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় নদীর ওই পাড়ের বটগাছ— একটানা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, এখন যেন পূর্ণ অবয়বে জেগে ওঠে। (Short Story)
এই সময়েই রাতভর যাত্রা শেষে স্টিমারগুলো ঘাটে ফিরে আসে। ইল্যান্ড রিভার অ্যান্ড স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির বিশাল বিশাল স্টিমার নোঙর করে এখানে— নামগুলোও যেন গল্পের মতো: ফ্লেমিংগো, ফ্লোরিকান, বেলুচি। বরিশাল থেকে ঢাকা কিংবা কলকাতা যাওয়ার যাত্রীদের একমাত্র ভরসা এইসব রাজকীয় জলযান। (Short Story)
ঘাট থেকে স্টিমারে ওঠার জন্য রয়েছে দুটি ছোট সেতু। একটি কাঠের, আরেকটি লোহার তৈরি। পায়ে পায়ে রং চটে যাওয়া সেতুগুলো এখন ক্লান্ত আর জীর্ণ। গত বর্ষায় নদীভাঙনে দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু এখনও মেরামত হয়নি। তাই যাত্রীরা একটু ভয়ে ভয়েই সেতু পেরোয়, সাবধানে পা ফেলে। (Short Story)
এরই মধ্যে বেশ কিছু কুলি হঠাৎ লাফ দিয়ে স্টিমারের রেলিং টপকে কেবিনের সামনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে— যাত্রীদের মালপত্র আগে পৌঁছে দিতে হবে তো! তাদের ডাকে, টানে আর হাঁকডাকে ঘাটের ভোরবেলা মুহূর্তেই মুখরিত হয়ে ওঠে। (Short Story)
স্টিমার ঘাটের ঝামা সুরকির লাল রাস্তার পাশ ঘেঁষে আরেকটি কাঁচা পথ চলে গেছে শ্মশানঘাটের দিকে। পথের দু’পাশে ঘন হয়ে উঠেছে শটি, শশালতা, শিরীষ, হিঁজল আর হেলেঞ্চা, সবুজে ছেয়ে থাকা নির্জন এক বনানী যেন। রাতভর পাতায় জমে থাকা শিশিরের ফোঁটাগুলো পৌষের নরম রোদে চিকচিক করে ওঠে, টলমল, স্বচ্ছ, শব্দহীন। (Short Story)
ই দিকটা বেশ নিরিবিলি। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঝুলে থাকে বাতাসে। সাপের ভয়েই বোধহয় লোকজন সেভাবে আসে না। বরিশালে সাপের ভয় প্রবল, তাই বহু বাড়িতে পোষা বেজি দেখা যায়…
এই দিকটা বেশ নিরিবিলি। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঝুলে থাকে বাতাসে। সাপের ভয়েই বোধহয় লোকজন সেভাবে আসে না। বরিশালে সাপের ভয় প্রবল, তাই বহু বাড়িতে পোষা বেজি দেখা যায়— সাপের প্রতিরোধক হিসেবে তাদের আলাদা কদর আছে। (Short Story)
শ্মশানঘাট পেরিয়ে একটু এগোলেই দেখা মেলে লাশকাটা ঘরের। প্রায় দিনই তা তালাবদ্ধ পড়ে থাকে। তবে যখন খোলা থাকে, তখন ভিতরের সেই লোকটিকে এক ঝলক চোখে পড়ে— নীরব, নিস্পৃহ, যেন জীবনের বাইরের এক ছায়ামূর্তি। বয়স পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছে সে। মুখভর্তি না-কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, চোখ দু’টি যেন চোখের কোটরে বসেই হারিয়ে গেছে ভিতরের দিকে। আধময়লা ধুতি পরে থাকে সারাদিন, আর এই শীতের সকালগুলোতে গায়ে জড়ানো থাকে এক মেরুন রঙের পুরনো চাদর। প্রায়ই দেখা যায়— লাশকাটা ঘরের সামনে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। ঘরের দরজা খোলা থাকলেও ভেতরটা পুরো দেখা যায় না— কেবল অন্ধকারের মধ্যে একটা লম্বা টেবিলের ছায়া যেন জেগে থাকে, সময়ের গভীরতা নিয়ে। (Short Story)
লাশকাটা ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো অশ্বত্থ গাছ। সকালে এই সময়টায় তার ডালে এসে পড়ে রোদের নরম ছায়া। পাতাঝরার শব্দে মাঝে মাঝে টুপটাপ করে পড়ে এক-দুটি বিবর্ণ পাতা। গাছটির একেবারে উপর দিকে বাসা বেঁধে আছে কয়েকটি অন্ধ, ক্লান্ত পেঁচা— সারাদিন নিথর, চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, যেন গাছেরই অংশ। রাত নামলে কেবল কোটর ছেড়ে নড়ে ওঠে তারা। (Short Story)
এই পথ পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে শ্যাওলা ধরা, ভাঙা এক মন্দির। এতই পুরনো, এতটাই অবহেলিত, যে দেখে মনে হয়— পৃথিবীর শুরুর দিন থেকেই মন্দিরগুলো এইখানেই পড়ে আছে। চুপচাপ, একা, আর অতীতের ভারে নত। (Short Story)
বেলা আর একটু বাড়লে দেখা যায়— এই নিরালাপথ ধরে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। গায়ের রং শ্যামলা, গড়ন খানিকটা স্থূল, মুখে নরম রেখার মতো হালকা গোঁফ, চুল পেছন দিকে আঁচড়ানো— নির্বিকার, কিন্তু ভেতরে যেন এক অজানা আলোড়ন। (Short Story)
সাদা পাঞ্জাবি, মোটা মিলের ধুতি, যা হাঁটুর কাছে উঁচু করে পরা— পায়ে একজোড়া পুরনো পাম শু। হাঁটার ছন্দে কোনও তাড়া নেই, যেন প্রতি পদক্ষেপে কিছু অনুচ্চারিত পঙ্ক্তি জন্ম নিচ্ছে। (Short Story)
প্রতিদিন, একই রকম নিঃশব্দে, একই পথে হেঁটে তিনি পৌঁছে যান বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। সেখানে তিনি ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক। কলেজের ছেলেরা তাকে চেনে ‘জে.ডি’ নামে।
প্রতিদিন, একই রকম নিঃশব্দে, একই পথে হেঁটে তিনি পৌঁছে যান বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। সেখানে তিনি ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক। কলেজের ছেলেরা তাকে চেনে ‘জে.ডি’ নামে। (Short Story)
আর আমরা?
আমরা তাঁকে চিনি জীবনানন্দ দাশ নামে— যিনি হয়তো এই পথেই, একদিন, নিজের ভেতরের “আট বছর আগে একদিন” খুঁজে ফিরছিলেন। (Short Story)
হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ থেমে দাঁড়ান অশ্বত্থ গাছটার নিচে। পাতার ফাঁক গলে নেমে আসা পৌষের রোদে মেঘের গায়ে যেন কারা একটানা তুলির টান মেরেছে। তিনি মৃদু স্বরে, যেন নিজের কাছেই ফিসফিসিয়ে বলে ওঠেন—
আজকের আকাশ নীল… বাতাস নীল… নদীতীরের পাটখেত, শুপুরি-নারকেল বন, এমনকি গ্রামের গাছগাছালিও— সব কিছুই নীল। (Short Story)
এক মুহূর্ত চুপ থেকে, নিঃশ্বাসে মিশে আসে বিস্ময়—
আহ! ভারী সুন্দর আজকের দিনটা।
তারপর যেন কিছু মনে পড়ে যায়, নীরব পায়ে তিনি আবার হাঁটতে শুরু করেন কলেজের দিকে। (Short Story)
কলেজে এসে জীবনানন্দ শিক্ষকদের বিশ্রামাগারে বসে নিঃশব্দে একটু বিশ্রাম নেন। এরপর হাতের কাছে রাখা জেমস জিনস-এর The Dying Sun বইটি তুলে নেন। আজকের ক্লাসে ছাত্রদের এই বই থেকেই কিছু অংশ পড়াবেন। কিন্তু বই হাতে নিলেই যেন চারপাশের জগৎ তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। (Short Story)
হঠাৎ ইংরেজি বিভাগেরই আরেক শিক্ষক নরেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর তাঁর মনোযোগ ফিরিয়ে আনে।
—তা ঘাইহরিণী বাবু কেমন আছেন?
নরেন্দ্রলাল তাঁকে ‘ঘাইহরিণী’বলে ডাকেন— ব্যঙ্গ করে। জীবনানন্দের এক কবিতার পংক্তি থেকে এই নামটি তুলে নিয়েছেন তিনি।
—ভাল!
জীবনানন্দ অস্ফুটস্বরে, মাথা নিচু করে উত্তর দেন। (Short Story)

এই সময় টিপ্পনী কাটেন হেরম্ব চক্রবর্তী, ইংরেজি বিভাগের আরেক শিক্ষক—
—এই বারের শনিবারের চিঠিতে সজনীবাবু কিন্তু আপনার কবিতা নিয়ে চমৎকার লিখেছেন!
—কী বলেন মশাই? শুধু আপনি পড়বেন, আমাদের একটু শোনান না! —ফোঁড়ন কাটে অন্য একজন।
হেরম্ব পাঞ্জাবির পকেট থেকে ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাটি বের করেন এবং সজীব কণ্ঠে পড়তে থাকেন—
“কবি বলিতেছেন যে, বনের যাবতীয় ভাই হরিণ, তাহাদের হৃদয়ের বোন ঘাইহরিণীর আঘ্রাণ ও আস্বাদের জন্য ডাকিতেছে। ভাইয়েরা না হয় তাহাদের বোনের কাছে আসিল—মানিলাম—আটকাইবার উপায় নাই—কবির না হয় ঘোর লাগিয়াছে—কিন্তু মেয়ে মানুষ কী করিয়া নোনা হইল? নোনা ইলিশ খাইয়াছি বটে, কিন্তু কবির দেশে মেয়েমানুষেরাও কি জারকে প্রস্তুত হয়? কবি যে এতদিনে হজম হইয়া যান নাই, ইহাই আশ্চর্য! কিন্তু এ তো মেয়েমানুষ নয়—এ যে ঘাইহরিণী!” (Short Story)
শিক্ষক মিলনায়তনে হাসির রোল পড়ে যায়।
জীবনানন্দ মাথা নিচু করে থাকেন। বহুবার ভেবেছেন, কবিতা সম্পর্কে কিছু লিখবেন— বিশেষ করে সজনীবাবুর মতো বিদ্রূপকারীদের জবাব দেবেন। পরে নিজেই থেমে গেছেন। তাঁর মনে হয়, কবিতা আসলে মুহূর্তের অনুরণন, যার ব্যাখ্যা চলে না, বোঝানো চলে না। কারো কটাক্ষ বা ব্যঙ্গ কবিতার গভীরতাকে ছুঁতে পারে না।
ধীরে ধীরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে তিনি ক্লাসের দিকে হাঁটতে থাকেন। (Short Story)
তাঁর ক্লাস, ছাত্ররা খুব একটা পছন্দ করে না— তিনি তা জানেন। পেছনের বেঞ্চে ফিসফাস, চাপা হাসি; মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের রেখা। তিনিও আর আগের মতো মন দিয়ে পড়াতে পারেন না— শুধু কর্তব্যবোধই টেনে রাখে তাঁকে। (Short Story)
শিক্ষকতার এই জীবন— বিশেষ করে বেসরকারি কলেজের অনিশ্চিত চাকরি, অপ্রতুল বেতন, আর সামাজিক মর্যাদার অভাব— তাঁর কাছে একরকম বিষণ্ণ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। অনেক সময় মনে হয়, এই পেশায় থেকে কেউ আর তৃপ্ত নয়।
শিক্ষকতার এই জীবন— বিশেষ করে বেসরকারি কলেজের অনিশ্চিত চাকরি, অপ্রতুল বেতন, আর সামাজিক মর্যাদার অভাব— তাঁর কাছে একরকম বিষণ্ণ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। অনেক সময় মনে হয়, এই পেশায় থেকে কেউ আর তৃপ্ত নয়। যাঁরা সত্যিকারের আনন্দ পেতেন পড়াতে গিয়ে, এমন শিক্ষক যেন আজকের দিনে ডোডো পাখির মতো— বিলুপ্ত।
ক্লাস শেষে দুপুরের পর ফেরার পথে তিনি আবার পেরিয়ে যাচ্ছিলেন সেই লাশকাটা ঘরের পাশ দিয়ে। ঘরের দরজা খোলা। বাইরে দাঁড়িয়ে লোকটি বিড়ি টানছে। ঘরের ভেতরে টিমটিমে হারিকেনের আলো— আলো নয়, যেন আধোছায়া। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, টেবিলের উপর কেউ শুয়ে আছে। (Short Story)
জীবনানন্দ থমকে দাঁড়ালেন।
লোকটা স্বগতোক্তির মতো বলল—
—দুই দিন আগে গলায় দড়ি দিয়েছিল। আজ মর্গ থেকে এল।
জীবনানন্দের মনে হল, ওই আলো-আঁধারির ভেতরে কোথা থেকে যেন কিছু অলেখা শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ, যেন সেই শব্দগুলি তাদের চূড়ান্ত জায়গা খুঁজে পেল:
কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর।
শবকাটা ঘরে শুয়ে থাকা সেই মানুষটির কথা ভাবতে ভাবতে, যূথচারী আঁধারে ডুবে যেতে যেতে, কবি জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরের উপকণ্ঠে, নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। (Short Story)
বাড়িটি বাংলো ঘর— পশ্চিম ও দক্ষিণে দুটি কক্ষ। মাটির মেঝে, শনের চাল। চারপাশে অর্ধেক ইট, অর্ধেক বাঁশের বেড়া। চারদিকে ছড়ানো জমিতে আনারস ফল, কাঁঠালগাছ, আমগাছ। রাতে শোনা যায় সুপুরি নিয়ে ইঁদুরের লড়াই, কিংবা শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে এক সরু খাল। (Short Story)
এইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৃশ্য, শব্দ, গন্ধের ভেতরে আশ্রয় নেন কবি। ফিসফিসিয়ে কথা বলেন নিজের সঙ্গে, যেন প্রাচীন মিশরের কোনও রহস্য ফাঁস করতে চান। (Short Story)
ঘরের সামনে একটি সতেজ কৃষ্ণচূড়া। তার পাতার ফাঁক গলে ঝকঝকে আকাশ চোখে পড়ে। সেই মুগ্ধতায়, অনেক সময় কিছু না লিখেই বসে থাকেন তিনি— চুপচাপ। মানুষ বলে, তিনি ঘরকুনো, অসামাজিক। হয়তো বলে ঠিকই। অনেক মানুষের ভিড়ে তিনি স্বস্তি পান না। নির্জনে থাকতে ভালবাসেন, নিজের ভাবনায় নিমগ্ন থাকতে ভাল লাগে। (Short Story)
আর বই— ভাল বই পেলেই তাঁর আর কিছু লাগে না। পাঠের মধ্যে ডুবে থাকা তাঁর জীবনের একমাত্র আরাম। হাফ ইজিচেয়ারে বসে থাকেন, পাশে পুরোনো অক্সফোর্ড ডিকশনারি, ইংরেজি দৈনিক, সঙ্গে ‘আনন্দবাজার’ কিংবা ‘যুগান্তর’।
আর বই— ভাল বই পেলেই তাঁর আর কিছু লাগে না। পাঠের মধ্যে ডুবে থাকা তাঁর জীবনের একমাত্র আরাম। হাফ ইজিচেয়ারে বসে থাকেন, পাশে পুরোনো অক্সফোর্ড ডিকশনারি, ইংরেজি দৈনিক, সঙ্গে ‘আনন্দবাজার’ কিংবা ‘যুগান্তর’। সামনে ফুট রেস্ট হিসেবে একটা খালি চেয়ার— তেমনই এক নিঃসঙ্গ পাঠক জীবনানন্দ। (Short Story)
জীবনানন্দ তাঁর ঘরে একা থাকেন। একটি লেখার টেবিল, সাধারণ একটি খাট। খাটের তলায় ঝকঝকে মেঝেতে স্তূপীকৃত বই আর পত্র-পত্রিকা। এলোমেলো বা ধূলিমলিন নয়— পরিপাটি, পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো। (Short Story)
পাশের ঘরে থাকেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য, মেয়ে মঞ্জুশ্রীকে নিয়ে। ঘরটি বেশ বড়। লাবণ্যের ছোঁয়ায় গুছানো, যে কেউ দেখলেই ভাল লাগে। দেওয়ালে ঝুলছে কয়েকটি ছবি—
একটি লাবণ্যের বাবার, অন্যগুলো লাবণ্যের কলেজ জীবনের স্মৃতি। জানালায় পরিপাটি পর্দা, পাশে একটি চালতা গাছ। এক কোণে কাঠের আলমারি আর দুটি চেয়ার। অন্য কোণে সেগুন কাঠের খাট, পুরু গদি আর তোশক।
তাতে নীল চাদর সবসময় টানটান করে বিছানো। এই খাটেই দু’জন ঘুমায়— লাবণ্য আর মঞ্জুশ্রী। (Short Story)
২.
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর অনেক আগেই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু জীবনানন্দ জেগে আছেন। রাত জেগে অনেকক্ষণ লেখালেখির পর মাত্রই শুতে এসেছেন, কিন্তু ঘুম আসছে না। বরিশাল শহরে বেশ শীত। রাত দশটার পর পুরো শহরটা ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝেই এমন হয়— কিছুতেই ঘুম আসে না। পুরনো কত ভাবনা, না চাইলেও এসে ভিড় করে মনে।
শীতের মাঝরাতে, দূর হিজলবনের ওপার থেকে ভেসে আসে বাউল সুর, আসর শেষে ফেরা কোনও বাউলের কণ্ঠে। কুয়াশায় স্থির হয়ে থাকা ধানসিঁড়ি নদীর ধারে, মাঠের চারদিকে নুয়ে পড়া রূপশালী ধানভানাদের শরীরের ঘ্রাণ, পৌষের রাত্রে রুক্ষ ডালে বসে থাকা নিমপেঁচার সকরুণ ডাক, আর শিশির ভেজা চালতা পাতার ফাঁকে ক্ষীণ চাঁদের কোলাজ— সব মিলিয়ে আজ রাতে যেন সামনে খুলে যাচ্ছে এক নিঃশব্দ দৃশ্যপট। অতীত আর বর্তমানের স্মৃতি সুরেলা বিবাদে সহাবস্থান করছে তার মগজের গভীরে। (Short Story)
ঘড়িতে বাজল প্রায় চারটা। তবু ঘুম নেই। শুধু ভাবনার পর ভাবনা— যেন ঘুড়ির লাটাই, ভাবনার অফুরান সুতো, যার কোনও শেষ নেই। আস্তে আস্তে তিনি উঠে বসেন বিছানায়। ঠিক তখনই জাহাজঘাট থেকে ভেসে আসে জাহাজের সাইরেন, প্রথমে তীব্র, তারপর মৃদু হয়ে মিলিয়ে যায়। শেষরাতে তাঁর মনে হয়— সে ভীষণ একা। বুকটা ভার হয়ে আসে। এই একা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি অসহ্য লাগে তাঁর। পাশের ঘরে থাকা স্ত্রী আর মেয়েকে দেখার এক তীব্র, অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে বুকের ভেতর। (Short Story)

হাত বাড়িয়ে নিবু নিবু হারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পাশের ঘরে আসেন। নিঃশব্দে খানিকটা এগিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখেন— মশারির ভেতর তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে, লেপে ঢাকা তাদের শরীর। স্ত্রী আর মেয়ের পরিতৃপ্ত ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনানন্দ যেন অদেখা ঘুমের স্বাদ পেলেন। (Short Story)
যে জন্য এসেছিলেন, তা তো দেখে নেওয়া হয়েছে— এখন চাইলে ফিরে যেতে পারেন নিজের ঘরে। কিন্তু তিনি গেলেন না। তাঁর ইচ্ছে হল— এই উষ্ণতা-মাখানো ঘরে প্রিয়জনদের পাশে কিছুক্ষণ থাকতে, চুপচাপ। মেয়ের কপালে আলতো করে হাত বুলিয়ে হারিকেনটা খাটের পাশে রেখে মশারিটা তুলে স্ত্রীর পাশে বসে পড়লেন। (Short Story)
খাটে বসার সময় সামান্য শব্দ হওয়ায় তাঁর স্ত্রী জেগে উঠল। প্রথমে ভয় পেল, তারপর বিরক্ত হয়ে বলল—
—তুমি?
—ঘুম আসছিল না।
—তাই বলে আমাদের ঘুম ভাঙাতে হবে?
—ঘুম ভাঙাতে তো আসিনি, তোমাদের দেখতে এসেছিলাম।
—মেয়েকে দেখতে এসেছ? যাও, মেয়েকে নিয়ে যাও।
—না, শুধু মেয়েকে না… তোমাকেও…
—রাতদুপুরে এসব ঢং করছ? ঘর থেকে বেরোও— এখনই!
—তুমি ঘুমোচ্ছিলে, ঘুমোও। আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।
—শুধু এই চেয়ারটায় একটু বসে থাকব।
—না, না! আমি ঘুমোতে পারি না, যদি কেউ পাশে চুপচাপ বসে থাকে।
—দয়া করে বের হও। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও। এই বলে লাবণ্য লেপ তুলে মাথা ঢেকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।
জীবনানন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকলেন। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে মশারির ফাঁক গুঁজে দিয়ে হারিকেনটা হাতে নিজের ঘরের দিকে ফিরে গেলেন। (Short Story)
এই গভীর রাতে, জীবন আর প্রেমে একধরনের ব্যর্থতার ভার বুকে নিয়ে তাঁর মনে পড়ে গেল বিকেলে মর্গে দেখা সেই মৃতদেহটির কথা। কিছুটা বিচ্ছিন্ন তন্ময়তায় ভাবেন— লোকটা আত্মহত্যা করল কেন?
এই গভীর রাতে, জীবন আর প্রেমে একধরনের ব্যর্থতার ভার বুকে নিয়ে তাঁর মনে পড়ে গেল বিকেলে মর্গে দেখা সেই মৃতদেহটির কথা। কিছুটা বিচ্ছিন্ন তন্ময়তায় ভাবেন— লোকটা আত্মহত্যা করল কেন? একজন মানুষ, যে নিজের জীবন নিজেই শেষ করল— কেন? আর যদি মানুষকে জীবিত অবস্থাতেই মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, তবে সে কেন বাঁচতে এসেছিল? (Short Story)
পরক্ষণেই তাঁর মনে হল— চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর, সব কিছু আঁধারে ঢেকে গেলেও অন্ধ পেঁচা হৃদয়ে আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। অর্ধমৃত ব্যাঙও, কয়েক মুহূর্ত সময় কিংবা আরেকটি ভোরের প্রার্থনা করে। এমনকি দুষ্ট বালকের হাতে ধরা অসহায় ঘাসফড়িং— সে-ও একাকী লড়ে যায় মৃত্যুর বিরুদ্ধে। (Short Story)
তবে কি, শ্রান্ত, অন্ধ হয়ে আসা জীবন— তবুও এখনও এত সুন্দর? কিছুটা বিচ্ছিন্ন তন্ময় হয়ে ভাবেন, তাহলে লোকটা আত্মহত্যা করল কেন?
তবে কি, শ্রান্ত, অন্ধ হয়ে আসা জীবন— তবুও এখনও এত সুন্দর? কিছুটা বিচ্ছিন্ন তন্ময় হয়ে ভাবেন, তাহলে লোকটা আত্মহত্যা করল কেন? (Short Story)
জীবনানন্দ উপলব্ধি করেন— মানুষের রক্তের ভেতর স্পর্শাতীত কিছু আছে, যা মানুষকে ক্লান্ত করে। অন্তর্গত এক নিঃশব্দ যন্ত্রণা যা কোনও অর্থে, কোনও কীর্তিতে, সচ্ছলতায় শান্ত হয় না। (Short Story)
কবি— যিনি শব্দের জাদুকর, যিনি তাঁর কলম ডুবিয়ে দিয়েছেন অকথিত জগতের কোনও গোপন পোর্টালে— তিনি আজ এই শেষ রাতে ঘোরের মধ্যে নিরবধি লিখে চলেছেন—
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে—
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত… ক্লান্ত করে।
অলংকরণ- লেখক
তথ্য সূত্র:
১.অনন্য জীবনানন্দ- ক্লিন্টন বি সিলি
২.মানুষ জীবনানন্দ – লাবণ্য দাশ
৩.বরিশাল বিভাগের ইতিহাস-সিরাজ উদদীন আহমেদ
৪.বাঙালনামা-তপন রায়চৌধুরী
৫.শনিবারের চিঠি -সজনীকান্ত দাস
৬.জীবনানন্দ- আবদুল মান্নান সৈয়দ
বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দা ও বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠক। তথ্য বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়।