বোশেখ জষ্ঠি পেরিয়ে মাঝ আষাঢ়ে আম নিয়ে খানিক আমড়াগাছি করবার ইচ্ছে জেগেছে। এই তো আর কিছুদিনের ওয়াস্তা, তারপর মরশুমি আমের এ যাত্রা বিদায়। কিন্তু তাতে কী? আম অমর, আম অমৃত— আম নিয়ে আমোদ বোধ করে না এমন লোকের সংখ্যা ভারতে কম, বাংলায় আরও কম। সুতরাং শেষবেলায় একখান আমচরিত লেখাই যায়।
আমকে আম জনতার দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে ভারত এগিয়ে। সেই পাঁচ হাজার বছর আগেই সিন্ধু নদের তীরে আমের স্বাদ আস্বাদিত হয়েছিল এমন প্রমাণ নাকি আছে ইতিহাসের পাতায়। বেদ পুরাণে উল্লেখিত ‘রসলা’ বা ‘সহকার’ আসলে আমের পূর্বপুরুষ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায়, পুরু রাজের সাঙ্ঘাতিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও আম দেখে ও খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আমের জন্মবেত্তান্ত নিয়ে ব্যাপক তর্ক–বিতর্ক আছে। আমের জন্মভূমিকে ভারতের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে একদা চেষ্টার কসুর হয়নি। উৎস–সন্ধানে হানা দেওয়া হয়েছে কখনও ব্রহ্মদেশে, কখনও বা আরও পুবে, শ্যামদেশ বা কম্বোজ অথবা মালয়েও। কিন্তু আমবিজ্ঞানী ও বিশারদদের তথ্য–তালাশে সে সব যুক্তিতক্ক তেমন ধোপে টেঁকেনি। ইংরিজি ‘ম্যাংগো’ (Mango) শব্দের জন্মসূত্র তামিল ভাষায় ‘ম্যাংকে‘ থেকে। রামায়ণ–খ্যাত হনুমান কিঞ্চিৎ দায় ও দায়িত্বের ভাগিদার এই ব্যাপারে। সে নাকি লঙ্কায় গিয়ে প্রথম অবিষ্কার করে যে রাবণের অধিকারে অসাধারণ একটি ফল আছে। সেটি হাতিয়ে হনুমান চলে আসে এপারে মূল ভূখণ্ডে। কে জানে হয়তো তার জন্যই তামিল ভাষায় আম-কে বলে ‘ম্যান–কে’। একেই অনুসরণ করে পর্তুগিজরা বলত ‘ম্যাঙ্গা’, চিনেরা ‘ম্যাংকাও’। আবার ওদিকে আমের বৈজ্ঞানিক নাম— ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা–র মধ্যেও ‘ইন্ডিকা অর্থাৎ ভারতের গ্রিক সংস্করণ। সুতরাং আম আমাদের, এ নিছক কথার কথা নয়– একেবারে হক কথা!

চিনে পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে দেখেছিলেন আম নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গ্যাছে। আম খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন তো বটেই, সঙ্গেও নিয়ে গিয়েছিলেন বেশকিছু বেঁধেছেঁদে। তাঁর লেখনী বেয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পায় আম–মাহাত্ম্য। ক্রমশ দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়েছে রসরাজ; স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে অথবা অন্য প্রজাতির সংকর মিলনে হয়েছে তার রূপবদল। আপাতত প্রায় দু’ডজন দেশে তার বাস— রসে বশে। রং ও স্বাদের বৈচিত্রের মাঝেও সে একমেবদ্বিতীয়ম!
বাংলায় ফিরি। জামাইষষ্ঠী যদিও মূলত পশ্চিমবঙ্গীয় অনুষ্ঠান, ওপার বাংলায় সেদিনটি পালিত হয় আমষষ্ঠী হিসেবে, জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে। তবে বাঙালি শিশু ভোলানাথের সাক্ষাৎ ‘বর্ণপরিচয়’-এর পাতায় পরিচয় ‘আম’ নামের ফলটির সঙ্গে। “‘অ‘-এ অজগর আসছে তেড়ে, ‘আ‘-এ আমটি আমি খাবো পেড়ে”— কচি রিনরিনে গলায় এ বীজমন্ত্র আউড়ে এগিয়ে চলে তার প্রথম পাঠ। জীবনের ঊষালগ্নে মনোভূমে আমের যে মিষ্টি–মধুর গোড়াপত্তন হয়, তা চিরদিন শিশু ভোলানাথের মনে থাকে অটুট, অক্ষয়। শিশুর বয়েস বাড়ে। সে এখন খোকা; এবার তার সকর্মক হওয়ার পালা। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে এবার সে ছড়া কাটে “আম পাতা জোড়া জোড়া, মারবে চাবুক চলবে ঘোড়া। ওরে বাবু সরে দাঁড়া, আসছে আমার পাগলা ঘোড়া।” সেই যে ঘোড়া ছুটল, তা শত শত বছর পেরিয়ে শাশ্বত বাংলায় আজও ছুটে চলেছে অবিরাম।

“বাসনার সেরা বাসা রসনায়” লিখেছিলেন রসিক সেই মানুষটি যার রসনায় এবং রচনায় বিচিত্র স্বাদের বাহার। তাঁর লেখনীর মধুরসে নানা রচনার পঙক্তি, ছত্র হয়েছে সিক্ত। শৈশবে লেখা, আমসত্ত্ব দুধে ফেলা, কলা সন্দেশ মাখা পিঁপড়ে কাঁদানো, রসসিক্ত মিষ্টি ছড়াটি দিয়ে শুরু হয়ে বেতের ডালায় রেশমি রুমাল টানা সোনার বরণ আমের সুবাসে সুবাসিত হয়েছে রবি ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম। বাদ পড়েনি তাঁর সংগীতও। সেখানেও আমের মঞ্জরী তার গন্ধ নিয়ে “ঘিরে ঘিরে ফিরে সঞ্চরি”!
মহাকবি কালিদাস তাঁর কালজয়ী ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম‘ নাটকে আমের মুকুলকে প্রেমের দেবতা মদনের পঞ্চশরের একটি শর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের লীলাতেও বারংবার ঘুরেফিরে এসেছে চ্যুতবৃক্ষের প্রসঙ্গ। খনার প্রবচনে ধরা পড়েছে বাংলার ঘরে আমের মুকুল ধরা থেকে আম পাকা এবং দুধ–মিষ্টি দিয়ে আম খাওয়ার যে সময়সীমা, তারই বর্ণনা— ‘মাঘে বোল, ফাগুনে গুটি, চৈত্রে কাটিকুটি, বৈশাখে আঁটি, জ্যৈষ্ঠে দুধের বাটি’।
আর সেই নিশ্চিন্দিপুরের সলতে খাগীর আমবাগান মনে আছে? যে বাগানে আমের কুশি কুড়িয়ে বেড়ায় দুগ্গাদিদি আর আম আঁটির ভেঁপু বানিয়ে বাজায় হাঁ করা ছেলে অপু, সেও কীভাবে যেন ঢুকে পড়েছে বাঙালি পাঠকের মনের গভীরে।

বাংলার রাজধানী হিসেবে গৌড় বেশ কয়েক শতাব্দীর রাজনৈতিক পালাবদলের সাক্ষী। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা লক্ষণ সেন গৌড়ের সিংহাসনে। তাঁর সভার পঞ্চরত্নের একজন উমাপতিধর। তাঁর লেখা আম্র প্রশস্তির সারৎসার হল, “কোন কোন বৃক্ষ ফুল ফোটাবার কালে সুগন্ধি হয়, কোন কোন বৃক্ষের কাঁচা ফল হয় সুরভি ও সুস্বাদযুক্ত, কোন কোন বৃক্ষ আবার ফল পাকলে হয় মনোরম, কিন্তু ফুল ফোটাবার কাল থেকে ফল পেকে যাওয়া পর্যন্ত— আগাগোড়া মাধুর্য এ জগতে একমাত্র আম্রবৃক্ষেই প্রকটিত।” এই গৌড় অঞ্চলই পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলার আমবাগানে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নবাবি আমলের নতুন রাজধানী মুর্শিদাবাদ এবং তার সন্নিহিত অংশ। আজ আর নবাব নেই। নেই সেই নবাবিয়ানাও। রয়ে গ্যাছে নবাবি আমলের আম–কথা, আমজনতার মুখে– স্বাদ আর গপ্পো হয়ে। ইতিহাস বলে প্রায় ১৬৫০ জাতের আমের খোঁজ পাওয়া গ্যাছে এই উপমহাদেশ জুড়ে, তার মধ্যে মুর্শিদাবাদ ও মালদার স্কোর প্রায় ৩৫০!!
আমের ভারত তথা বঙ্গে আগমন সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। আবুল ফজলের ‘আইন–ই–আকবরী’ ও ‘আকবরনামা’র সূত্র ধরে বলা যায় ভারতে ফলের চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন মুঘল শাসকেরা। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ মধ্যপ্রাচ্যের একটা বিরাট অংশ জুড়ে ফলের উৎপাদন এবং সমাদর। আর মিষ্টি ফলের লিস্টিতে আমের নাম উপরের দিকে। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বাগদাদের খলিফারা আমের স্বাদ নিতেন বাদশাহি সুরার রসে। আমের রস তাঁদের প্রাসাদে বিশেষভাবে তৈরি কক্ষে ছয় মাস ধরে রাখা হত। সেই রস থেকে তৈরি হত সুরা। খলিফাদের সূত্রে আম–মাহাত্ম্য পারস্য হয়ে পৌঁছয় মিশরে আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারতে এসে আম খেয়ে মুগ্ধ হয়ে তার যে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন তার অনেক পরে ভারতে আমের পরিকল্পিত প্রসার ও পরিচর্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুঘল রাজন্যবর্গ।

‘বাবরনামা’র পাতায় হোম–সিক সম্রাট বাবর আম-কে হিন্দুস্তানের সবসে উমদা ফল বলেছেন। ১৫৭০ থেকে ১৫৮০ সালের মধ্যে সম্রাট আকবর গোটা ভারত থেকে সংগ্রহ করে এনে বর্তমান বিহারের দ্বারভাঙায় রোপণ করলেন বিভিন্ন প্রজাতির এক লাখ আমের চারা। মোটামুটিভাবে দ্বারভাঙা আমের সঙ্গে মালদা আমের প্রকৃতি মেলে। আকবর–পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গিরও এ ব্যাপারে কম যান না। তাঁর স্মৃতিকাহিনি তুজুখ –ই–জাহাঙ্গিরি’তে স্পষ্টই বলেছেন আমের সঙ্গে কাবুলের উৎকৃষ্টতম ফলেরও কোনও তুলনা হয় না। বিভিন্ন সুবা থেকে আম এনে তাদের গুণমান ও স্বাদের মূল্যায়ন করিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই, আমের উৎকর্ষতা বাড়ানো! জাহাঙ্গির-পুত্র শাহজাহানকে আমরা চিনি শিল্প-সংস্কৃতির রসিক হিসেবে। কিন্তু আমের উন্নতিকল্পে তাঁর অক্ষয় কীর্তিটি সত্যিই সংস্কারমূলক। বাদশাহি ফরমান জারি করে তিনি আম চাষ বা আমচর্চার সুযোগ আমজনতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। শাহজাহানের এই কাজটিকে আমের গণতন্ত্রীকরণ বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। ঔরঙ্গজেবও এ ব্যাপারে কম যান না। বুরহানপুরে মামাবাড়ি গিয়ে নবাব দেখলেন সুন্দরী নর্তকী হীরাবাঈ আমগাছের তলায় আম কুড়োচ্ছে। প্রথম দর্শনেই প্রেম। এছাড়াও আমের প্রতি তাঁর আশক্তি ছিল সর্বজনবিদিত!
মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্বাস্থ্যের অবনতির অন্যতম কারণ অতিমাত্রায় আম এবং লাল মরিচে আসক্তি, এ কথা লিখে গ্যাছেন খোদ ইতিহাসবিদ পারসিভ্যাল স্ফিয়ার। লালকেল্লার ভিতরে বাহাদুর শাহ জাফরের বাদশাহি বাগিচা ‘বাগ-ই-হায়াৎ-বক্শ’-এ ছিল দেশি-বিদেশি আমের সম্ভার! এই বাগিচায় নবাবের সঙ্গী হতেন আরেক দিলখোলা কবি মানুষ— মির্জা আশাদুল্লা বেইগ খান ‘গালিব’! দুজনেরই নেশা কবিতা, দুজনেই খাদ্যরসিক এবং দুজনেই আমের রসে বুঁদ! মির্জা সাহেবের বক্তব্য, আমের উৎকর্ষতা বোঝার উপায় দুটি— এক, যদি সে মিষ্টি হয়, আর দুই, পরিমাণে যদি সে হয় অঢেল! আরেকদিনের ঘটনা, মির্জার হেকিমি দোস্ত রাজিউদ্দিন খান দেখলেন একটা গাধা পথের ধারে স্তূপীকৃত আমের দিকে দৃক্পাত না করে পাশের আস্তাকুঁড় ঘেঁটে হাবিজাবি দিব্ব্যি চিবিয়ে চলেছে। এই সুযোগ আমের ব্যাপারে মির্জার মোহভঙ্গ করবার। “দেখুন মির্জা সাহেব, গাধাও আম ছুঁয়ে দেখে না!” গালিবের স্বভাবসিদ্ধ তাৎক্ষণিক জবাব— “হুম দেখছি তো, বুঝলে দোস্ত একমাত্র গাধাতেই আম খায় না!”

মালদা, মুর্শিদাবাদ জুড়ে আমের এই বৈচিত্র্যময়তার পিছনে বাংলার নবাবকুলের অবদান সুপ্রচুর। আমের নামের সঙ্গেও মিশে আছে নবাবি আমলের ইতিহাস আর চমকপ্রদ কাহিনি। আশরাফ আলির বাগানে ফলেছে এক আম। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁ, যার বাবা হুমায়ুন জাঁ-এর হাতে তৈরি হয়েছিল মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি, তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার তক্তে। এই আমের আমেজ নবাবের কাছে পৌঁছনো দরকার। আশরাফ পৌঁছয় দরবারে; “হুজুর গুস্তাকি মাফ করবেন! এগুলি আমার গাছের আম। নবাব নাজিমের যদি পছন্দ হয়…’’
পরের ঘটনা সাঙ্ঘাতিক! নবাব তো আম খেয়ে বেহদ খুশ। এবার তাঁর চাই ঐ গাছের চারা নিজের বাগানে পোঁতবার জন্য। আশরাফের সাহস বলিহারি, “সেটি হবে না হজুর, তাহলে আর আমার বাগানের কী বিশেষত্ব রইল… বাগান কেটে সাফ করে ফেলব তবু ওই চারা আমি দেব না।” দুজনেই নাছোড়বান্দা। শেষে নবাবের যাহানাতের কাছে হার মানতে হল আশরাফকে। নিজের ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে ‘মির্জা’ পদাধিকারী ওই কর্মীর মেয়ে ও ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন নবাব।
বিয়েও হল। মুসলিম বিয়ের রীতি অনুসারে এবার কনের কাছ থেকে বরের প্রাপ্য মোহর বা যৌতুক। কিন্তু অর্থ বা সোনায় নয়, তার বদলে মোহর হিসাবে নিলেন সেই দিলখুশ করা আমগাছের চারা। সেই আমের নাম ‘মির্জা পসন্দ’।
নবাবি আমলের যে আমের উল্লেখ না করলে আমচর্চা অসম্পূর্ণ রইবে সেই আমের নাম কোহিতুর, যাকে বলা হত আমের রাজা। তোয়াজে আর আদরে “মানুষ হওয়া” মুর্শিদাবাদের এই আমের চরিত্রে আছে নবাবি মেজাজের সব ওঠা-নামা, ভালো-মন্দ– খানিক রহিসি চালচলন তার! নবাব আলি মির্জা প্রবর্তিত কোহিতুর ভারি নাজুক চিজ! তুলোর দস্তানা পরে তুলোর বিছানায় শুইয়ে এ পাশ-ও পাশ করানো হত তাদের। গায়ে লেখা থাকত নাম আর খাওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ। সঙ্গে চিঠিতে খানিক টোটকা, নির্দেশ – এক ধরণের ‘ম্যানুয়াল’ বলা যেতে পারে! খোসা ছাড়ানো হত রুপোর ছুরি দিয়ে। আম জাতির কোহিনূর সে!
বাংলার নবাবদের উদ্যোগে দেশের অপর প্রান্ত থেকেও নানা জাতের আমের চারা বপন করা হয়েছিল এই বঙ্গে। ধারাবাহিকতায় তাদের সংকরায়ণ ঘটানো, পরিচর্যা ও রসাস্বাদন জন্ম দেয় এক নিজস্ব সংস্কৃতির— যার পরতে পরতে ছিল রাজকীয়তার ছোঁয়া। আম আসলে একটি ফলমাত্র নয়, আম একটি বিশেষ সময়ের সংস্কৃতির সংজ্ঞাবিশেষ। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, আমচর্চা কাব্যচর্চার মতোই সুস্থ রুচির ব্যাপার। লখনউ-এর এক নবাব নাকি বলেছিলেন, যারা নিজের স্ত্রীকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে সম্মান দিতে পারেন না বা চান না, তাঁরা সূক্ষ্ম আমচর্চার মীড়, গমক, তান কী করে উপলব্ধি করবেন?

আমের চর্চা মুঘলদের পর ইংরেজ আমলেও থেমে থাকেনি। সেই আমলে ভারতের ইংরেজ প্রশাসকদেরও আমের সুলুকসন্ধান নিতে দেখা গেছে। আমাদের দুটি বিখ্যাত আম ‘ল্যাংড়া’ ও ‘ফজলি’র সঙ্গে দুই ইংরেজ সাহেবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রথমটির সঙ্গে পাটনার ডিভিশনাল কমিশনার কর্কবান ও দ্বিতীয়টির সঙ্গে মালদহ জেলার কালেক্টর রেভেনশ সাহেবের অনুষঙ্গ ।
নানা নামের, বিচিত্র স্বাদের, বৈচিত্র্যময় রঙের অজস্র আম নিয়ে বোশেখ থেকে আষাঢ় চলে মাতামাতি। হিমসাগর, গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, মল্লিকা, চন্দনকসা, ফজলি, ল্যাংড়া, গোলাপ খাস, বোম্বাই, চম্পা, শাদুল্লা, আনারস, লক্ষ্মণভোগ, বিমলি, পেয়ারা ফুলি, আম্রপালি, বিড়া— এমনই সব। এর বাইরে যেসব আম বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলো এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয় আম যেমন— বাংলাদেশের রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা, দিনাজপুরের সূর্যমুখী, আসাম দেশের সিন্দুরি, কেতুরি, বিহারের জরদালু, সুকুল, মিঠিয়া, উত্তর প্রদেশের চৌসা, দসেরি, অন্ধ্রের বানাগানাপল্লি, কন্নড়ের তোতাপুরি, গুজরাটের কেশর এবং অবশ্যই মহারাষ্ট্রের আলফান্সো! দেশের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ হল আম উৎপাদনের নিরিখে লেখচিত্রের সবচেয়ে উপরে। দসেরির জন্মভুমি মালিহাবাদ। সেখানেই এবার প্রকৃতির তাণ্ডবে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ ফলন নষ্ট হয়ে গ্যাছে। তথৈবচ অবস্থা গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে। সেখানেও কেশর ও আলফান্সো পড়েছে স্বল্পোৎপাদনের ফাঁদে। যদিও পুব এবং দক্ষিণ ভারত এবার দেশি ও বিদেশি বাজারে ভারতের মুখ রক্ষা করেছে।
এবার খানিক পদচারণা করা যাক শহর কলকাতার রাস্তায়! বিংশ শতাব্দীর এক সকালে ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যায় “চাই আমসত্তর!” সেকালের গরমকালে মানুষ ফল খাবার এক মহা সুযোগ পেত। ফলের ছিল মহাসমারোহ– সবই ছিল খুব সস্তা। ত্রিশের দশক অবধি এক ঝুড়ি (৮০ টা) ল্যাংড়া আম বারো আনা থেকে এক টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। ভাল জাতের ফজলি স্বাদে অমৃত তুল্য, তবু “সুধাগন্ধী ল্যাংড়ার মসৃণ গা, চিকন খোসা, ডাঁশা গতর, সব মিলিয়ে স্বর্গীয় পুলক”। পশ্চিমা ফিরিওয়ালা ঝাঁক মাথায় দুলে দুলে ঘুড়ে বেড়াত আর থেকে থেকে হাঁকত “বেনারস কা ল্যাংড়াই আউউউউউম”…
আমের মরশুমে পশ্চিমে বড়বাজারের ফলপট্টি থেকে পুবে বেলেঘাটার খাল, উত্তরে বাগবাজার থেকে ভবানীপুর বকুলতলা অবধি নানা রঙের গড়াগড়ি যেত। পাড়ার বড়মানুষেরা জষ্ঠি আষাঢ়ে বাজি ধরে আম খাওয়াতেন। একটা পাল্লাদারি খেলার খুব চল ছিল, একজন খাই-এর চোখ বেঁধে দেওয়া হত, আর তিনি খেয়ে খেয়ে নাম বলে দিতেন আমের— এটা পেয়ারাফুলি, এটা ধোনা, বা ইলশেপেটি অথবা কিষেনভোগ ইত্যাদি। মা বাবার বার্ষিক শ্রাদ্ধ জষ্ঠি মাসে পড়লে নানা জাতের দিশি আম পাড়ার পাঁচ জনকে ডেকে খাওয়ানো, আষাঢ়ে পড়লে বোম্বাই বা ল্যাংড়া, শ্রাবণে ফজলি– এই ছিল রেওয়াজ। তাছাড়া নববর্ষ বা ঐ সময়ের সামাজিক অনুষ্ঠানে বাড়ি বাড়ি ভেট পাঠানো হত আমের ঝুড়ি। সে সময়ের প্রথিতযশা মানুষজন— কবি হেমচন্দ্র , অধ্যাপক ললিত বাঁড়ুজ্যে, সম্পাদক ও লেখক পাঁচকড়ি বাঁড়ুজ্যে, ঐতিহাসিক রাখালদাস বাঁড়ুজ্যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, ব্যবসায়ী বটকেষ্ট পাল এবং আরও আরও অনেকে আমভোজন করাতে ভালোবাসতেন। খানিক কলকাত্তাইয়া আদিখ্যেতার ব্যাপার থাকলেও আম-ই ছিল অনেকের জীবনে অন্যতম উপভোগ্য জিনিস।
তারাপদ রায়ের “নস্যি” গপ্পের সেই আমগাছের কথা বলেই শেষ করব এবার । “ এই সব মধুর সম্পর্ক , পাতানো আত্মীয়তা নষ্ট হয়ে যেত কালবোশেখির ঝড়ে । ঝড়ের বাতাসে যখন সীমানার আম গাছ থেকে আম ঝরে পড়ত দু বাড়ির উঠোনে , তুমুল হুলুস্থুল পড়ে যেত দু বাড়িতে । দু পক্ষই দাবি করত সব আম তাদেরই প্রাপ্য । কারণ গাছটা তাদের । একবার আমিন ডেকে জরিপ করে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হয়েছিল । তখন নাকি দেখা যায় দুই বাড়ির সীমানা চলে গ্যাছে আম গাছের বিশাল গুঁড়ির মাঝখান দিয়ে । কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হয় নি । যতদিন গাছে আম থাকতো , জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ অবধি, আম পাড়া নিয়ে তুমুল বচসা চলতো দুই বাড়ির মধ্যে । এই বচসা উত্তরাধিকার সূত্রে আমার ঠাকুমা পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে । অপর পারে নোয়া ঠাকুমাও হয়তো তাই…
তথ্যঋণ : আম্রচরিত – রানা চক্রবর্তী
থোড় বড়ি খাড়া – কল্যাণী দত্ত
কমলালয়া কলকাতা – মিজানুর রহমান
৩০০ বছরের কলকাতা পটভূমি ও ইতিকথা – ডঃ অতুল শূর
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Freepic, crezilla.com
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।