আজ ১৯ আগস্ট, বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস (world photography day)। সেই উপলক্ষ্যে আমার ছবি তোলার কিছু অভিজ্ঞতা শোনাই আপনাদের।
বাঁদর
১৯৯৮। চাকরিসূত্রে গেছি চেন্নাই। সেখান থেকে এক উইকএন্ডে আমার বন্ধু প্রকল্প আর ওর আর দুই বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছি তিরুপতি মন্দির। মন্দিরের কাছে বাস থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছি সবাই। এস এল আর ক্যামেরা Yashica কাঁধে নিয়ে আমি খানিকটা পেছনে। পাহাড়ের ধার থেকে সামনের উপত্যকায় ক্যামেরা তাক করছি, হঠাৎ রাস্তা আর খাদের মাঝে পাঁচিলে এসে বসল এক বাঁদর। বেশ গুছিয়ে আমার দিকে মুখ করে, ভাবখানা যেন— কী হবে পাতি ল্যান্ডস্কেপ তুলে, আমার পোর্ট্রেট তোল্। আমিও বাধ্য ছাত্রের মতন দু কদম পিছিয়ে ফোকাস করছি, আরেকটা বাঁদর এসে একটু পাশে বসল। আরও ভালো সাবজেক্ট। ইতিমধ্যে আমার দেরি দেখে প্রকল্প পিছিয়ে এসে দেখে এই কাণ্ড। আমাকে আরেকটু পেছোতে হবে দেখে ও অভয় দিল, তুই নির্বিঘ্নে তোল। আমি দুদিকের গাড়ি নজরে রাখছি। আমি পিছিয়ে আবার ফোকাস করতে দেখি আরেকটা বাঁদর হাজির পেছনের খাদ থেকে। আমি আরও পেছোলাম। এবারে ফ্রেমে ফুল কভারেজ, শাটার মারতে যাব, একটা নয় দু’দুটো কুচো বাঁদর এসে ওদের সামনে রাস্তায় বসে গেল। আবার কেঁচে গণ্ডূষ! কিন্তু এরকম ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ তোলার আর্জি কি না রেখে পারা যায়! সবাইকে কভার করতে রাস্তায় শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে। ওরাও যেন কিছুটা গুছিয়ে বসল। শাটার স্পিড, অ্যাপার্চার দেখে নিয়ে সলিড ফোকাস করে শাটার টিপতে গিয়ে দেখি রিওয়াইন্ড করা হয়নি ফিল্ম। করলাম। সব ফ্যামিলি মেম্বার আমার দিকে অস্থিরভাবে তাকিয়ে। এদিকে রিওয়াইন্ড করতে গিয়ে দেখি ক্যামেরা জ্যাম। কাউন্টারে দেখি ২১ (তখন কমবেশি ৩৬টা ছবি উঠত ফিল্মের একটা রোলে); রাগে মুখ থেকে গালাগাল বেরিয়ে গেল। একটা কুচোর মনে হয় সেটা পছন্দ হল না। উঠে গেল। আমার ক্যামেরার এই এক রোগ ছিল। একটু তাড়াতাড়ি রিওয়াইন্ড করতে গেলেই আটকে যেত। একটু সময় দিয়ে বাবা বাছা করে আস্তে আস্তে ঘোরালে ঠিক হয়ে যেত। এবারেও হল, কিন্তু আমার চার চোখ আর প্রকল্পর দুচোখের সামনে দিয়ে একে একে ফুল ফ্যামিলি উঠে গেল টা টা বাই বাই করে। সব্বাই…
ঘটনাটা সেদিন আমার মেয়েকে শোনাতে ও বলল
“এই জন্যেই কি কারোর উপর তোমার রাগ হলে তাকে বাঁদর বলে গালাগাল দাও?”

বারাশিঙ্গা
যাঁরা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, তাঁরা জানেন ভালো ছবি তোলা কত কষ্টসাধ্য। এই ঘটনাটা বলা আমার মতন আমেচারদের জন্যে, যারা অনেকসময় ছবি তোলাটা শৌখিন মজদুরি ভাবেন। উৎসাহ ভালো, তবে সাবধানতা আরও বেশি জরুরি ছবি তোলার ক্ষেত্রে।
মার্চ ১৯৯৬। আমরা যাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর থার্ড ইয়ারের জনা এগারো গেছি হাজারীবাগ। যদ্দুর মনে পড়ে, এদের মধ্যে ক্যামেরা নিয়ে গেছিলাম আমি আর শান্তনু। বাবার ইয়াশিকা ফিল্ম ক্যামেরা, দাদা তখন সদ্য আমেরিকা গেছে বলে ক্যামেরা আমার দখলে। হাজারীবাগ পৌঁছতে বেশ বিকেল হয়ে গেছিল, তাই সেদিন আর ফরেস্ট বাংলোর বাইরে যেতে পারিনি।
আরও পড়ুন- ভ্রমণ: পৃথিবীর ছাদ পামিরে
ফরেস্ট বাংলোর চৌহদ্দি পেরোলেই বাঁদিকে একটা বিশাল উঁচু জালের দেওয়াল। তার ওপারে জঙ্গল। যথারীতি ওদিকে যাওয়া মানা। জঙ্গলে ঢোকার নির্দিষ্ট পথ আছে। ব্রেকফাস্টের পর গাইডের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হয়েছে। সকালে উঠে ব্রাশ করে আমি ক্যামেরা নিয়ে ইতিউতি ঘুরছি, সাথে মনে হয় শান্তনু আর চন্দন। শান্তনু বোধহয় ক্যামেরা নিয়ে বেরোয়নি তখন।
ঘুরতে ঘুরতে দেখি জালের ওপারে জায়গাটা নেমে গিয়েছে কিছুটা, একটা সরু নদী/ঝোরা বয়ে যাচ্ছে। শুনেছিলাম সকালে পশুপাখিরা জল খেতে আসে। কিন্তু সে তো অনেক দূরে, তার উপর জালের পেছন থেকে কীই বা দেখতে পাব! বাঙালির চোখ, ঠিক একটা ফোকর বার করে ফেললাম। এদিক সেদিক দেখে নিলাম। বাংলোর কর্মচারীরা ব্যস্ত অন্যদিকে, এদিকে আমরা ছাড়া কেউ নেই। তরতরিয়ে তিনজনে নেমে গেলাম নীচে। শুকনো পাতায় ভরে আছে চারদিক। ঝোরার ধার দিয়ে একটু এগোতেই দেখি এক বারাশিঙ্গা হরিণ, মাথা নিচু করে জল খাচ্ছে।

ফিল্ম ক্যামেরার সময়, তখন পটাপট ছবি তোলা টেকনিক্যালি অসম্ভব ছিল। তার ওপর বাজেটে কুলিয়েছে একটামাত্র কোডাকের রোল। একটা ছবি নিলাম, একটু সাহস বাড়ল। আরও কাছে গেলাম। চন্দন বা শান্তনুকে বললাম আর একটু কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দে ওর দিকে। হরিণটা বেশ ভদ্র, একভাবে দাঁড়িয়ে রইল— ছবিও তুললাম আবার (যদিও পরে দেখেছিলাম সেটা ঝাপসা)। আরও সাহস বাড়ল। একেবারে সামনে গিয়ে একটা প্রোফাইল শট নেবার জন্য দাঁড়ালাম। এইবার ব্যাপারটা ওঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। ফোঁস ফোঁস করলেন। শান্তনু আর চন্দন বলল— “চল কেটে পড়ি!” ফোঁসটা আরও জোরালো হল। আমি দু’পা পেছোলাম কিন্তু ক্যামেরা ওঁর দিকেই তাক করা…
ফিল্ম ক্যামেরার সময়, তখন পটাপট ছবি তোলা টেকনিক্যালি অসম্ভব ছিল। তার ওপর বাজেটে কুলিয়েছে একটামাত্র কোডাকের রোল। একটা ছবি নিলাম, একটু সাহস বাড়ল। আরও কাছে গেলাম। চন্দন বা শান্তনুকে বললাম আর একটু কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দে ওর দিকে। হরিণটা বেশ ভদ্র, একভাবে দাঁড়িয়ে রইল
যে ফোকরটা দিয়ে আমরা নেমেছিলাম, সেটা বেশ পেছনে ফেলে এসেছি। চন্দন আইডিয়া দিল – সবচেয়ে কাছাকাছি যেখানে জালটা, ওখানে গিয়ে জাল বেয়ে উঠে ওপারে চলে যাব। ওরা দুজনেই রোগা, ব্যাপারটা ওদের সহজসাধ্য। এদিকে ইনি পেছনের একটা পা দুবার ঠুকলেন, খানিক ধুলো উড়িয়ে জানান দিলেন— অনেক হয়েছে, এবার এস। এবার বেশ ভয় হল। পেছনে তাকিয়ে দেখি দুজন অলরেডি ঢালু পেরিয়ে উপরে; জালের গা বেয়ে কাঠবিড়ালিদের মতন উঠছে। এদিকে ইনি আমার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন। আনফিট আমি কোনোরকমে একহাতে ক্যামেরা নিয়ে আরেক হাতে হাঁচড় পাঁচড় করে ওপরে উঠলাম। মোটা তারের জাল বেয়ে ওঠার সময় বেশ একটা জেল পালানো ক্রিমিনাল ফিলিং হচ্ছিল। উনি কিন্তু আমার ঠিক নীচেই দাঁড়িয়ে আমার জিমন্যাস্টিক্স দেখছেন। পড়লে নির্ঘাত ওঁর বাহারি শিঙের ওপর পড়ব। যাইহোক, কোনরকমে জালের মাথায় উঠে ক্যামেরাটা ওপাশে দাঁড়ানো বন্ধুদের হাতে দিলাম। এবার নামা আরও কঠিন কাজ। চন্দন বলল— লাফিয়ে পড়, শুকনো পাতায় বেশি লাগবে না। কী আর করি! লাফালাম…কিন্তু মাটি আর ছুঁলাম কই! নিজেকে দেখলাম উল্টে ঝুলছি জাল থেকে। কোনও এক বেয়াড়া তার আমার সদ্য কেনা বেয়ার জিন্সের হাঁটুর কাছে বিঁধে গেছে। আমার তখনকার উনসত্তর কিলোর সাধের শরীর ঝুলে আছে একটা তারে। তারটা হরিণটার মতোই ভদ্র, তাই আমার গা ছোঁয়নি। বেয়ার জিন্স বেশিক্ষণ আর আমার ভার ধরে রাখতে পারল না, আমি মাটি ছুঁলাম। তখন গানশট কনসেপ্টটা সবে উঠেছে, তাই জিন্সটা অনেকদিন ব্যবহার করা গেছিল।

পাখিসব
“বাবা, তুমি তো এত ছবি তোল, পাখিদের ছবি তোল না কেন?”
“আমার কাছে অত ভালো ইকুইপমেন্ট নেই মাম্মাম।“
“আরও বড় লেন্স লাগে?”
২০১৯ এর মাঝামাঝি এই কথাগুলো বেশ ভাবালো। পক্ষে বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি আছে। অফিসে আমার টিমের দু’জন— সৌরভ আর রোদিন বার্ড ফটোগ্রাফির কোহলি আর রোহিত। ওদের সেরকম উপযুক্ত গিয়ার আছে। জানতে চাইলাম টুকিটাকি টিপস্। কয়েকদিন কথা বলে যা বুঝলাম তাতে ফটোগ্রাফির এই জগতটা সম্পূর্ণ আলাদা। এরপর পুজো পেরিয়ে কলকাতা তখন পৌঁছেছে শীতের দোরগোড়ায়। একদিন প্রাক্তনীদের মিটিংয়ে রবিবার গেছি স্কুলে। কথা বলছি আমাদের স্কুলের সিনিয়র অশোকদার সাথে। ফটোগ্রাফির যতটুকু জানি বা শিখেছি তার প্রায় সবটুকুই অশোকদার অনুগ্রহে। এই প্রসঙ্গে মতামত চাইলাম। মত তো এলোই। তার সঙ্গে জুটল উৎসাহ – “চেষ্টা করে দেখই না, কী দাঁড়ায়। দ্য ম্যান বিহাইন্ড দ্য ক্যামেরা ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান দ্য ক্যামেরা!”
কয়েকদিন একটু বার্ড ফটোগ্রাফি নিয়ে ভিডিও, ব্লগ এসব চর্চা হল। সাহস আর পাই না। নিজেকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বছরের শেষ দিনে ভোরে চলে গেলাম রবীন্দ্র সরোবরে। ইতিউতি ঘুরছি জলের ধারে, আলোর তেজ বেড়েই যাচ্ছে। কয়েকটা পানকৌড়ির ছবি তুললাম, কয়েকটা ফিঙে, কয়েকটা বক। যেন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি তুলছি! মাছরাঙা তো কোন ছাড়, একটা টিয়াপাখিও জোটে না।

ন’টা বাজে। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে একটা দোকানে টোস্ট, অমলেট, চা খেয়ে ভাবলাম অনেক তো হল, এবার বাড়ি যাই। তারপর মনে হল লোকজন তো এখনও হাঁটাহাঁটি, দৌড়াদৌড়ি করছে; কোনও ভাল ক্যান্ডিড শট পেলেও পেতে পারি। একবার ভেতরে ঢুকে দেখিই না। ভেতরে ঢুকে লায়ন্স সাফারি পার্ককে ডানদিকে রেখে এগোচ্ছি, দেখি একজন ছবি তুলছেন, আপাদমস্তক যাকে বলে বার্ডিং গিয়ারে। জংলা ছাপ জ্যাকেট, কার্গো প্যান্ট, হুড, ক্যামেরার ব্যাগ, এমনকি বিশাল প্রাইম লেন্স পর্যন্ত ঢাকা একইরকম কাপড়ে। মুখটা খালি বাদ। চশমা পরা, বুদ্ধিদীপ্ত গোলগাল মুখ, আমাদের থেকে বয়সে খানিক বড় মনে হল। আমার হাতে যা আছে তা নিয়ে বেশ কুণ্ঠা বোধ হল ওঁর সামনে যেতে। তবুও গেলাম।
“গুড মর্নিং দাদা। মনে কিছু করবেন না। একটু ডিস্টার্ব করব।”
একগাল হেসে আমাকে বললেন— “বলুন, বলুন। গুড মর্নিং।” কথায় একটু প্রবাসী টান।
“এখন কি আর কিছু পাখি দেখতে পাব?”
“পাওয়া তো লাকের ব্যাপার। আমি তো এইজন্যেই ঘুরছি। কোনও স্পেসিফিক স্পিসিস খুঁজছেন?”
“না মানে… এখন তো বেলা হয়ে গেছে।”
“ওই জন্যেই তো এদিকে এলাম। এদিকটায় ছায়া, এখানেই সব আসবে একে একে।”
তারপর মনে হল লোকজন তো এখনও হাঁটাহাঁটি, দৌড়াদৌড়ি করছে; কোনও ভাল ক্যান্ডিড শট পেলেও পেতে পারি। একবার ভেতরে ঢুকে দেখিই না। ভেতরে ঢুকে লায়ন্স সাফারি পার্ককে ডানদিকে রেখে এগোচ্ছি, দেখি একজন ছবি তুলছেন, আপাদমস্তক যাকে বলে বার্ডিং গিয়ারে। জংলা ছাপ জ্যাকেট, কার্গো প্যান্ট, হুড, ক্যামেরার ব্যাগ, এমনকি বিশাল প্রাইম লেন্স পর্যন্ত ঢাকা একইরকম কাপড়ে। মুখটা খালি বাদ। চশমা পরা, বুদ্ধিদীপ্ত গোলগাল মুখ, আমাদের থেকে বয়সে খানিক বড় মনে হল।
এবার একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললাম যে পায়রা আর চড়াই ছাড়া কোনও পাখির ছবি তোলার চেষ্টা কখনও করিনি। একটু যদি গাইড করেন।
কথায় কথা বাড়তে লাগল। জানলাম উনি পেশায় ডাক্তার, কলকাতার এক বিখ্যাত হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। ডঃ সেন (নাম ও ফোন নম্বরটাও নিলাম, কিন্তু এত ব্যস্ত মানুষকে আর বিরক্ত করিনি কোনওদিন) রবিবার আর ছুটির দিনে রবীন্দ্র সরোবরে বার্ডিংয়ের নেট প্র্যাক্টিস করতে আসেন। কিছু ছবি দেখালেন, যার যে কোনও একটা যেকোনও ইন্টারন্যাশনাল স্যালনে কিছু না কিছু অ্যাওয়ার্ড পেতেই পারে। যদিও উনি কোথাও ছবি পাঠান না। নিজের একটা ওয়েবসাইট আছে, কিন্তু সময়ের অভাবে মেন্টেন করা হয়ে ওঠে না। বছরে তিন চারবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় বার্ডিং ট্রিপ-এ যান। ওঁর ক্যামেরায় বার্স্ট মোডে যখন ছবি তুললেন তখন প্রায় মেশিনগানের মতন শোনালো। ট্রাইপডটাও কাস্টমাইজড। লেন্স, বডি এগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। উনি সেইসময় নর্মাল বার্ডিং ফটোগ্রাফি নয়, করছেন বার্ডিং স্টোরি। একটা পাখির শিকার ধরার বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি।

একটা অরিওল বা বেনেবউকে দেখলাম সামনের একটা গাছে এসে বসতে। আমি এক্সাইটেড হয়ে— “ওই দেখুন” বলে ওঁকে দেখিয়ে আবার পেছন ফিরতেই দেখি বেনেবউ ফুড়ুৎ। একে একে প্রাথমিক শিক্ষাগুলো সব পেলাম ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে— যতটা কম সম্ভব শব্দ করা, পারফিউম না মাখা, জামাকাপড়ের হালকা রং ইত্যাদি। জানলাম যে পাখিরা এরকম জায়গায় (যেখানে মানুষ আছে) গাছের পাতার আড়ালে থাকতে বেশি পছন্দ করে। দিনের এই সময়ে পোকারা মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসে, তাই যেখানে একটু আলো কম সেখানে পাখিরা মাটিতেই মিটিং বসায়। কিচিরমিচির গল্পও চলে, সঙ্গে ব্রেকফাস্টও। একজোড়া টিয়া প্রেম করছিল গাছের একটা কোটর থেকে বেরিয়ে, তাদের ছবি তুলতে গিয়ে পা পিছলে যাচ্ছিল। কোনওমতে সামলে উঠে বুঝলাম এখানে রোদ তখনও ঢোকেনি বলে ঘাসে শিশির জীবন্ত।
এর মধ্যে আরেকজন ভদ্রলোক এলেন। ইনি রিটায়ার্ড ব্যাংক অফিসার মিঃ সাহা। শ্রীরামপুর থেকে আসছেন। একটা ট্রেন মিস করায় অনেক দেরি করে ফেলেছেন বলে আফশোস করছেন। ডাক্তারবাবু অভয় দিলেন— “হবে হবে।” এরপর কয়েকটা টুনটুনি, ফিঙে, তিলা ঘুঘু, বেনেবউয়ের দেখা মিলল আমাদের। ডাক্তারবাবু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক শুনেই বুঝে যাচ্ছেন, আমাকে আর সাহাদাকে দেখাচ্ছেন। কিন্তু সাহাদা কিছুতেই আর ঠাওর করতে পারছেন না সেগুলোকে। ওঁরও ক্যামেরা আর লেন্স আমার থেকে অনেকটা উঁচুদরের। দেখতে পেলে নিশ্চিত ভাল ছবি হত। কিন্তু দুর্ভাগ্য সকাল থেকেই সাহাদার পিছু ছাড়েনি। খালি বলছেন, “এবার চলে যাই, কিছুই তো পাচ্ছি না।”
ডাক্তারবাবু বলে যাচ্ছেন, “এখনও হতে পারে। পরশু এই সময়ে গ্রিন বি-ইটারের দেখা পেয়েছি।”
কিছুক্ষণ পরে দেখি একটা ছোট্ট সাদা-কালো পাখি একটু দূরে লেজ নাচাচ্ছে। আমার ক্যামেরার লেন্সে আশানুরূপ কিছুই ধরা পড়বে না। ডাক্তারবাবু নিপুণ হাতে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন। আমার চোখমুখ দেখে বুঝলেন কী সমস্যা। বললেন, “আস্তে আস্তে আরেকটু কাছে যান।” সেই চেষ্টা করতেই এও ফুড়ুৎ। এবারের শিক্ষা– “সোজাসুজি গেলে ওরা বুঝবে বিপদ। একটু ঘুরপথে যেতে হবে। সুন্দরী মেয়েকে নিশানা করার মতন। শরীর অন্যদিকে যাবে কিন্তু চোখ থাকবে ঠিক ওখানেই।” এই শিক্ষার জোরে উল্টোদিকে জলের ধারে ফিরে একটা মাছরাঙার বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। ছবি তুলে পেছন ফিরে দেখি সাহাদা হাসছেন। দিনের প্রথম শিকার জুটেছে ওঁর। এর পরের চল্লিশ মিনিট ওঁর ভাগ্য ভালই বলতে হবে। একে একে এল কোয়েল, দু’ধরনের ময়না আর দু’ধরনের মৌটুসি বা সানবার্ড।
ঘড়িতে বাজে প্রায় একটা, খিদের চোটে আর থাকতে পারছিলাম না। ক্যামেরা গুটিয়ে দু’জন দাদাকে টা-টা করে বেরিয়ে আসছি, তখনই উড়ে এল চার চারটে গ্রিন বি-ইটার বা বাঁশপাতি। ধন্য ডাক্তারবাবুর প্রজ্ঞা! বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। বাঁশপাতিদের লক্ষ করে তখন মেশিনগান চলছে। সাহাদার ক্যামেরার পেছন থেকে উঁকি মারছে ওঁর স্বস্তির হাসি…
প্রান্তিক বিশ্বাসের জন্ম কলকাতায়। স্কুলে থাকতে লেখা শুরু। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কালান্তর সংবাদপত্র, সময় ও গ্রন্থন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও রম্যরচনা। তারপর ২০০০ সাল থেকে দীর্ঘ পনেরো বছরের বিরতি লেখায়। ফিরে আসা ছোটগল্প, অণুগল্প, নিবন্ধ ও উপন্যাসে। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, বর্তমানে কর্মরত কলকাতায়। লেখা ছাড়া ঘুরতে, ছবি তুলতে আর আঁকতে ভালোবাসেন।
8 Responses
খুব ভাল
অনেক ধন্যবাদ দাদা 🙏
A mix of many spices….captivating, mind blowing ….simply unputdownable !
Glad you liked it, appreciate your encouraging words
Good read. সঙ্গে লেখকের নিজের তোলা কটি ছবি থাকলে জমে যেত আরও।
খুব আনন্দ পেলাম দাদা, অনেক অনেক ধন্যবাদ! আমার তোলা ছবি তো এত ভাল হত না 🙂
Daruun laglo !!
অজস্র ধন্যবাদ দাদা, সবসময় উৎসাহ দেওয়ার জন্য