১৮৮২ সাল। তারাবাঈ লিখলেন ‘স্ত্রী পুরুষ তুলনা’। জ্যোতিবা-সাবিত্রী গর্বিত, খুশি তাদের মানসপুত্রীর এই সাফল্যে। জ্যোতিবার প্রতিষ্ঠিত সত্যসোধক সমাজই মহাসমারোহে প্রকাশ করল এই বই, মুদ্রণ সংখ্যা ৫০০। কম কথা নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অবস্থানের আপেক্ষিকতা, মেয়েদের অসংখ্য সামাজিক শৃঙ্খলে জর্জরিত অবস্থাকে প্রাণবন্ত ভাষায় তুলে ধরলেন তারাবাঈ। মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে, জ্যোতিবা সাবিত্রীর সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি, তার ভিত্তিতেই এই কথন। তবে এই অভিজ্ঞতার বারুদস্তূপে অগ্নিসংযোগ করে একটি বিশেষ ঘটনা। যেরকম কারণকে ইতিহাস প্রত্যক্ষ কারণ বলে জানে।
১৮৮২ সালের কাছাকাছি, তারাবাঈকে নাড়া দিয়ে যায় এক বিধবার নিজের শিশুপুত্রকে হত্যার ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে গুজরাটের সুরাট শহরে। ঠিক যেরকম ঘটনার বর্ণনা আমরা আগেও পেয়েছি আমাদের কথনে। বিধবা মায়ের শিশুপুত্রকে কুয়োয় ফেলে মারার চেষ্টা, যা নাড়া দিয়ে গেছিল জ্যোতিবা সাবিত্রীকে, এবং যার ফলেই তৈরি হয় অন্তঃসত্তা বিধবাদের আশ্রয় কেন্দ্র, তাঁদের পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের প্রতিপালন কেন্দ্রও। এই কেন্দ্রে সাবিত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন তারাবাঈও। চোখের সামনে দেখেছেন পরিবারের পুরুষদের হাতে অত্যাচারিত বিধবাদের অবস্থান। তবু সুরাটের বিধবা বিজয়লক্ষ্মীর ঘটনাটি বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে গেল তারাবাঈকে। অবশ্য ঘটনাটি নিয়ে নাড়াচাড়াও তো কম হয়নি, মৃত্যুদণ্ড হয় অসহায় বিধবাটির, নিজের শিশুপুত্রকে হত্যার অপরাধে। এই অমানবিক মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কলম ধরেন জ্যোতিবা-সাবিত্রী। দেশে, বিদেশে নানা মত বিনিময়, লেখালেখি হতে থাকে।

তবে তারাবাঈয়ের জীবনে ও মননে এ ঘটনার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া ঘটে, যা তাঁর জীবন ওলটপালট করে দেয়। একইরকম ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাবিত্রীবাঈ ফুলে বিধবাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলেন আর তারাবাঈ ধরেন কলম। তাঁর ‘স্ত্রী পুরুষ তুলনা’ যে যুগান্তকারী এক গ্রন্থ, ভারতবর্ষের নারীবাদের মাইলফলক তা আগেই বলা হয়েছে। আর অন্যান্য অনেক যুগপরিবর্তনকারী বিষয়ের মতো, এক্ষেত্রেও সামাজিক গিলোটিন নেমে আসে। ছিছিক্কার পড়ে যায়। এমন কোনও বিদ্বজ্জন, সাধারণ মানুষ ছিল না যিনি ‘স্ত্রী পুরুষ তুলনা’-কে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন না। সংবাদপত্রে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ে এ বইয়ের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় লেখা হতে থাকে। এবং সেই তীব্রতা এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে জ্যোতিবা সাবিত্রীকে সত্যসোধক সমাজের পক্ষ থেকে অবশিষ্ট মুদ্রিত বইদের প্রত্যাহার করে নিতে হয়। মৃত্যু হয় শেষ বইটিরও।
ঠিক এই পর্যন্তই, আমরা জানতে পারি তারাবাঈয়ের কথাও। একটি জীবন, প্রতিবাদে ভরা প্রশ্নে ভরা জীবন– তার নিজস্ব সৃষ্টির মৃত্যুর সঙ্গে, বিপ্লবের হাতিয়ারের ধ্বংসের সঙ্গে, হারিয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতা থেকে। বিষয়টি কি চরম দুর্ভাগ্যজনক নয়? সামগ্রিক মানবিকতার পক্ষে অনুশোচনার নয়? যতটা গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম, তার আলোচনা, কীভাবে আবার খুঁজে পাওয়া গেল বই– ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তারবাঈয়ের এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অথচ অবাক করা বিষয়, ঠিক সেই সময় সেই বছরই তৈরি হয় আরও অনেক নারীবাদের ইতিহাস। কই, তাদের তো ভুলে যাইনি আমরা?
যেমন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, যেমন চন্দ্রমুখী বসু! ঠিক এমনই সময়, ১৮৮২ সালেই একত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন দুজনে– প্রথম মহিলা পরিক্ষার্থিনী হয়ে। দু’জনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কে প্রথম মহিলা পরিক্ষার্থিনী তা নিয়ে অনেক বিতর্ক, অনেক তথ্যের তত্ত্বতলাশ হয়েছে। কাদম্বিনী না চন্দ্রমুখী কে প্রথমা, তার মধ্যে থেকে উঠে এসেছিল মহিলাদের শিক্ষাজগতের আরও সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন, কেন চন্দ্রমুখী বসু বেথুন স্কুলে ভর্তি হতে পারলেন না, অথচ কাদম্বিনী পারলেন?
গবেষকদের মতভেদ আছে। তবু মোটামুটি দু’রকম মত বলা চলে। চন্দ্রমুখী বসুর জন্ম দেহরাদুনে ১৮৬০ সালে, জন্মপরিচয়ে তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। ১৮৭৬ সালে দেহরাদুন থেকে কলকাতায় চলে আসেন উচ্চশিক্ষার জন্য এবং বেথুন স্কুলে ভর্তি হতে চান। কিন্তু তাকে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয় না। কেন চন্দ্রমুখীকে অনুমতি দেওয়া হল না, সে বিষয় আজও বিতর্কিত। গবেষকদের একাংশের মত, সেই সময়ের নথি ও বয়ান থেকে জানা যায়, বেথুন স্কুলে তখন হিন্দু ও ব্রাহ্ম বাদে অন্য ধর্মের মেয়েদের ভর্তি হওয়ার অনুমতি ছিল না। সেই কারণেই খ্রিস্টান চন্দ্রমুখী স্থান পান না সেই স্কুলে, কিন্তু ব্রাহ্ম কাদম্বিনী ভর্তি হন। পাশ করেন এফএ পরীক্ষা।

চন্দ্রমুখীকে ভর্তি হতে হয় ডাফ কলেজে, এবং কাদম্বিনীর এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৭৭-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও মহিলাদের পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি ছিল না, বিশেষ অনুমোদনে পরীক্ষা দিয়েছিলেন চন্দ্রমুখী, প্রথমও হয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ পরীক্ষার্থী হওয়ায় তাঁর নাম উত্তীর্ণদের তালিকায় প্রকাশিত হয় না– তাই প্রথম পরিক্ষার্থিনী হয়েও ইতিহাসে হারিয়ে যায় তাঁর নাম। ১৮৭৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম পরিবর্তিত হয়, পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান কাদম্বিনী এবং তারপর একই সঙ্গে বেথুন কলেজে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা করেন দু’জনে, ১৮৮২ সালে হন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা স্নাতক।

তবে এখানে বড় কথা এটাই যে, ঠিক যে সময় ‘স্ত্রী পুরুষ তুলনা’র মৃত্যু নির্ঘণ্ট রচিত হচ্ছে মহারাষ্ট্রে তখনই দেশের অপর প্রান্তে রচিত হচ্ছে ইতিহাস। এই ১৮৮২ সালেই, মহারাষ্ট্রের আনন্দীবাঈ যোশি তৈরি হচ্ছেন প্রথম মহিলা ডাক্তার হবার জন্য। কলকাতায় পৌঁছে গেছেন তিনি স্বামীর সঙ্গে, বিলেতে চিঠিপত্র আদানপ্রদান শেষ, জাহাজে উঠবেন কিছুদিনের মধ্যেই। চিকিৎসার অভাবে নিজের শিশুপুত্রের মৃত্যু মেনে না নিতে পেরে আনন্দীবাঈ যোশি চোদ্দো বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার হওয়ার। ১৮৮০ সালে আনন্দীর স্বামী গোপালরাও যোশি চিঠি লেখেন বিখ্যাত মার্কিন মিশানারি রয়্যাল উইল্ডারকে, তাঁর স্ত্রীর মার্কিং যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তারি পড়ার সুযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করে– যেহেতু তখনও ভারতের বুকে মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার অনুমোদন ছিল না। সেই চিঠি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরের কাগজে প্রকাশিত হয় এবং পড়ে থিওডোসিয়া কার্পেন্টারের হাতে, যিনি আনন্দীকে চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানান ফিলাডেলফিয়া উইমেন্স কলেজ অফ মেডিসিনে। সেই চিঠির ভরসায়, ১৮৮২ সালেই জাহাজে চড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন আনন্দীবাঈ, প্রথম মহিলা ডাক্তার হতে।
আর আছেন রুকমা বাঈও। স্বামীর সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্তের পক্ষে লড়েছেন, ইংরেজ সরকারের কারাগারেও দিন কাটিয়েছেন। সময় সেই ১৮৮২ সাল। রুকমাবাঈয়ের বিয়ে হয় এগারো বছর বয়সে। কিন্তু তাঁর পালকপিতা ডঃ সখারাম অর্জুন, রুকমাবাঈকে স্বামীর সঙ্গে না পাঠিয়ে আরও পড়াশোনায় উৎসাহিত করেন। এদিকে স্বামী ভিকাজি দেনায় জর্জরিত হয়ে রুকমাবাঈকে নিয়ে যেতে চান তাঁর সঙ্গে, পণের অর্থ দিয়ে দেনা শোধ করার প্রয়োজনে। রুকমাবাঈ আসতে রাজি হন না। এই ১৮৮২ সালে। এবং ১৮৮৩ সালে ভিকাজি, রুকমাবাঈয়ের বিরুদ্ধে ‘রেস্টিটিউশন অফ কনজুগাল রাইটস’ ধারায় মামলা করেন, যে মামলায় ভিকাজিকে সমর্থন করে খবরের কাগজে লেখেন স্বয়ং বালগঙ্গাধর তিলক।

দেশে বিদেশে এই মামলা নিয়ে মত বিনিময় হয়, রুকমাবাঈয়ের সমর্থনে এগিয়ে আসেন ম্যাক্সমুলার-সহ আরও অনেকে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী রুকমাবাঈকে বলা হয় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে। নতুবা কারাদণ্ডের শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়। রুকমাবাঈ সিদ্ধান্ত নেন, তিনি কারাবাস করবেন তবু মত পরিবর্তন করবেন না। কারাবাসের শেষে, বিদেশে পাড়ি দেন রুকমাবাঈও– হয়ে ওঠেন কাদম্বিনীর পর ভারতের দ্বিতীয় প্র্যাক্টিসিং মহিলা ডাক্তার। সাবিত্রীবাঈ, ফতিমা শেখ, রুকমাবাঈ, আনন্দীবাঈ, কাদম্বিনী, চন্দ্রমুখী– ১৮৮২ সাল তাঁদের মনে রেখেছে। তারাবাঈ, তাঁর ‘স্ত্রী পুরুষ তুলনা’ বইটি হাতে নিয়ে ইতিহাসের পাতায়, অলক্ষ্যে হেসেছেন।
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Wikimedia commons, Pinterest
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
One Response
Thank you so much for sharing such great content. Hats off to these legends.