বইয়ের নাম: অপরাজিতা
লেখক: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক: কমলিনী
প্রচ্ছদ: দেবাশিস সাহা
প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০২৪
বিনিময় মূল্য: ২৫০ টাকা
ভারত থেকে আমেরিকাতে গিয়ে মিসেস জি অঙ্কের দিদিমণি হন। কিন্তু আমেরিকার উচ্চারণ পুরোপুরি রপ্ত না করতে পারায় শ্বেতাঙ্গ ছাত্রী লোরেনা ব্যঙ্গ করে তাঁকে। ব্যঙ্গ করে তাঁর প্রসাধনহীন চেহারাকেও। মিসেস জি সহ্য করেন সব, এরকম কথা শুনতে তিনি অভ্যস্ত। কিন্তু জি জানেন তাঁর আসল ক্ষমতা কোথায়। সেটা হল – এক, দারুণ অঙ্ক বোঝানোর দক্ষতা। দুই, ওয়েওয়ার্ড টিনএজার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হারাতে থাকা পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা। মূল্যবোধ? এত সহজ? হ্যাঁ সহজ হতে পারে, পিথাগোরিয়ান থিওরেম গল্পে দেখলাম যদি কেউ জীবনের হারিয়ে যাওয়া সুরটা টিনএজারদের ফিরিয়ে দিতে পারে, একটু পরিচ্ছন্নভাবে ভালবেসে, এবং তাদের ভাষায়।
গল্পটা আছে মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়ের লেখা অপরাজিতা বইতে। প্রকাশ করেছে কমলিনী, পরিবেশক দেজ পাবলিশিং। বারোটা গল্প আছে এতে।
আরও পড়ুন: বইয়ের কথা: প্রসঙ্গ ‘গান-গপ্পো’
‘জাপানি পুতুল’ গল্পেও এক অঙ্ক অনার্সের মেয়ে। কিন্তু দুরারোগ্য ওসিডিতে আক্রান্ত সে। বারবার একই কাজ করা, যে নেই তাকে কল্পনা করে তার সাথে কথা বলা। তাই শেষ পর্যন্ত হল না তার সাধের এমএসসি, টিকল না তার বিয়েও। তার অঙ্কজ্ঞান এখন অস্তিত্বহীন কন্যার জন্যে শ্যাম্পুর স্যাচে গোনা, আয়নাতে আটকানো টিপ গোনা এসব কাজে লাগে। সবাই কি কেরিয়ারে সফল হয়? হয়, হতেও পারে, অন্য এক কেরিয়ারে। দেখুন পড়ে।
এক ছিল জুলিয়া, এক ছিল উচ্চাভিলাষী স্টিভ। অ্যাজমাটিক জুলিয়ার কণ্ঠে ছিল লাল পেন্ডেন্ট। অ্যাজমার টান যখন ডাক দিল, তখন সে স্টিভের আলিঙ্গনে। হাত বাড়িয়েও পার্সে রাখা ইনহেলার পেল না জুলিয়া। কিন্তু কি করে সেই পেন্ডেন্ট গেল ভ্যাগাবন্ড বিলের কাছে? উত্তর জানে হার্ট শেপের লাল গ্যাস বেলুন, কিন্তু সুতো কেটে সে তো আকাশে উড়ে যাচ্ছে। ‘ভ্যালেন্টাইন`স ডে’ পড়ে দেখুন ধরতে পারবেন কিনা।
যদি এমন হয় যে মানুষজনকে আর সহ্য হচ্ছে না, সবার থেকে লুকিয়ে পড়লে ভাল হত, তবে বেস্ট হল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। ‘বিলীন’ গল্পে তাই অদৃশ্য হয়ে গেল এরিন আর জেসিকা। তারা বিখ্যাত ছিল না। ফলে কেউ তেমন খেয়াল করল না। কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে? সল উইলিয়ামস যেমন লিখেছিলেন – আমাদের অস্তিত্ব একটা অদ্ভুত বিষয়। আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় তার সবটা আঁচ করতে পারে না। কী আছে দৃশ্যাদৃশ্যের ওপারে?

পাখি ভালবাসেন? নীল যদি হয়? আহা! দেখবেন চারদিকের পাগলামি ছেড়ে প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার নতুন ট্রেন্ড হয়েছে। পাখিও প্রকৃতি। কিন্তু পাখিটা যদি একটা এআই রোবট হয়? গড! সেই পাখি নিশ্চয়ই প্রকৃতি না। কিন্তু তাকে চিনবে কে? কোনও গেম, কোনও অ্যাপ, কোনও চ্যাটবক্স .. ভাবুন ভাবুন আর ‘নীলপাখি’ গল্পটা পড়ে নিন।
‘শব্দ – ওহ’ এই গল্পের আয়োজনটা। বাতাস, জল, মাটি না তাজমহলের মার্বেল – কোন মাধ্যমে শব্দ সবথেকে দ্রুত যায়? আপনার উত্তর আমি জানি। আচ্ছা ধরুন আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েন। সেক্ষেত্রে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ আপনাকে শব্দ পাঠান, আপনি তাঁকে পাঠান পরিতৃপ্তির শব্দ। তাই না? ফলে সিদ্ধান্ত দাঁড়াল এই যে, শব্দ হৃদয়মাধ্যমে সবথেকে দ্রুতগামী। কিন্তু শব্দের দুই ইংরাজি সাউন্ড আর ওয়ার্ড তো আলাদা। বেশ, তাহলে যে আপনার হৃদয়ের শব্দ ভাল আর তাড়াতাড়ি শুনতে পায় সেই কি যাকে আপনি খুঁজছেন?
চিনুয়া আচেবের ‘গার্লস অ্যাট ওয়ার’ যদি পড়েন বা অশোকের ‘ত্রয়োদশ মুখ্য গিরিশাসন’, বা মহাভারতের ‘স্ত্রীপর্ব’, জানতে পারবেন যুদ্ধে না হয় পুরুষরা মারা যায়, বেঁচে থাকা মেয়েদের কী হয়। সব কিছু হারিয়ে ফেলা একটা মানুষ, আবার সে যদি শিশুপুত্র কোলে এক নারী হয়, তাহলে কোথায় গিয়ে জিনিসটা দাঁড়াতে পারে! শিশু, তবু তার স্কুলের কথা নেই। যুদ্ধ আর ইমিগ্রেশনের তলায় শিক্ষা চাপা পড়ে গেছে। যদি ভাবেন আমাদের যুদ্ধটুদ্ধ হবে না, তাহলে চলুন ‘কমোড থেকে লাল বল’ গল্পটা শুরু করা যাক।
যদি এমন হয় যে মানুষজনকে আর সহ্য হচ্ছে না, সবার থেকে লুকিয়ে পড়লে ভাল হত, তবে বেস্ট হল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। ‘বিলীন’ গল্পে তাই অদৃশ্য হয়ে গেল এরিন আর জেসিকা। তারা বিখ্যাত ছিল না। ফলে কেউ তেমন খেয়াল করল না। কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে? সল উইলিয়ামস যেমন লিখেছিলেন – আমাদের অস্তিত্ব একটা অদ্ভুত বিষয়। আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় তার সবটা আঁচ করতে পারে না। কী আছে দৃশ্যাদৃশ্যের ওপারে?
সোশাল মিডিয়ার অপর নাম ‘কুহকজাল’। নিজেকে দেখানোর জায়গা। ধুলোধুলো রঙচটা ফাটল ধরা মেঝে ঢেকে দেওয়ার রঙিন কার্পেট এক। সারাই না আমি মেঝে, লোক এলে কার্পেট পাতি। মনের শান্তি খুঁজে পাইনি, শান্তি খুঁজেছি মল আর পার্টিতে। একদিন দমকা হাওয়ায় সেই কার্পেট সরে যায়, তাও সবার সামনে, তখন কী হয়? ঠিক যেন রাতের ট্রেনের জানলার কালো কাচে নিজেকে দেখা, অন্ধকারে ঢাকা এক সিলুয়েট! আমিও কি আবছা হয়ে গেছি!
‘মাস্কের ওপারে’ গল্পের বিষয় কোভিড, আমাদের লেটেন্ট পোটেনশিয়াল জাগিয়ে তুলেছিল। অনেক মানুষ ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছেন, কিন্তু লড়াই করে গেছেন। কিন্তু সতেরো বছরের লেক্সি অনলাইন স্কুল, ওয়ালমার্টের জব আর বিবাহবিচ্ছিন্না মাকে কী করে একা সামলাবে, যদি নিজেই কোভিড পজিটিভ হয়ে পড়ে?
পিঁপড়ে মানুষের থেকে অনেক আগের প্রাণী। ‘উদ্বাস্তু’ গল্পে এমন এক সভ্যতা এঁকেছেন যেখানে মানুষ আর নেই, পিঁপড়ে আছে। মজা হচ্ছে, তাদের মধ্যেও মানবোচিত প্রজাতিগত বিদ্বেষ, হিংসা। কালো পিঁপড়েদের মেরে ফেলছে লালরা। কালো লাল – রঙে কি বিশেষ কিছু ইঙ্গিত?
সবার মনোযোগ চাই, সবার চোখের মুগ্ধতা চাই, ওটাই আমার খাদ্য। আমি যে সেলেব। আমি ক্ষণিকপ্রভা। সবাই আমাকে দেখবে, কমেন্টের জাবর কাটবে, বহুদূর ছড়াবে ফ্যানদের চর্চা। বিষয় শুধু আমি। এই সেট আপ আমার জীবন। এর বাইরে গেলে আমি জল থেকে তোলা মাছ।
আরও পড়ুন: ব্র্যাডলি কুপারের ‘মায়েস্ত্রো’ – আত্ম-সমীক্ষা ও আত্মা-সমীক্ষার গল্প
‘অপরাজিতা’ হল বইয়ের নামগল্প। মানুষের মধ্যেও বিবর্তন হচ্ছে খেয়াল করেননি বোধহয়। যাদের গায়ের জোর বেশি তারা, না যাদের বুদ্ধি বেশি তারা। স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্সে তারাই টিকবে যারা অভিযোজিত হতে পারবে। বলে গেছেন শ্রীচার্লস। কীভাবে অশান্ত সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অভিযোজিত হতে হয় শিখতে চান? তাহলে যান উপমহাদেশের নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের কাছে। সমাজের যত খারাপ জিনিসে আক্রান্ত এরা। রেপ, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, অ্যাসিড অ্যাটাক পার করে আসছে এরা। এবং পুষ্টি, পড়াশোনা, ড্রপ আউট, বিয়ের বয়স সবেতে গণ্ডগোল। ঠিকমতো খাবার না দিন, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিন, সন্তান নিতে বাধ্য করুন – কিছুতে দমাতে পারবেন না। চড়চড়িয়ে উন্নতির গ্রাফ উঠছে এদের। পরীক্ষার রেজাল্ট চাকরি ব্যবসা সবেতে। এদের প্রাণশক্তির কাছে পেরে উঠছে না কেউ। যে প্রজন্মে এরা শোষিত হচ্ছে, তার পরের প্রজন্ম জন্মাচ্ছে রাগ, করুণা, ভয়, লজ্জা, অনুতাপ সব ফালতু ইমোশন রিমুভ করে দিয়ে। নিজেদের রাস্তা এরা যে দক্ষতায় খুঁজে নিচ্ছে তা পারছে না আর কেউ। এই অপরাজিতাদের চিনবেন এদের চোখের মণিতে বেগুনি রশ্মি দেখে।
মহুয়ার লেখার হাত কেমন? এক কথায় বলতে গেলে আরম্ভ করলে ছাড়তে পারবেন না। কোন বাজে ভণিতা নেই, কথায় অনর্থক প্যাঁচ নেই। তরতর করে লেখা এগিয়ে যায়। সংস্কৃতে এই ধরণটাকে প্রসাদ গুণ বলা হয়। মহুয়ার লেখা পাঠককে প্রসন্ন করবেই।
একটা ব্যাপার তাঁর লেখায় আছে। সেটা হল চমক দেওয়া। সব মিলিয়ে মহুয়ার গল্প এমন, যে কেউ কিছু লিখলেও স্পয়লার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। গল্পের বাঁধনটাই সেরকম না। গল্প কোন বিশেষ বিন্দুর দিকে যায় না। গল্প দাঁড়িয়ে আছে অসামান্য থিম, স্ট্রাকচার আর অতি উৎকৃষ্ট মানের স্টোরিটেলিংএর ওপর। সভ্যতার গল্প তাঁর। আমাদের সভ্যতার অভিমুখ যেদিকে যাচ্ছে, তা তিনি সম্পূর্ণ অবহিত এবং সেই ছাঁদেই সাজিয়েছেন তাঁর লেখা। আরও কিছু ব্যাপার আছে মহুয়ার গল্পে যা আপনি পড়লে বুঝতে পারবেন।
মহুয়ার একটা অতি প্রিয় শব্দ হল ‘সে’। বহু বাক্যের কর্তা হল ‘সে’। আপনি ভাববেন তার নামটা কখন আসবে। আসতে পারে একসময়, কিন্তু নাও আসতে পারে। তারপর মনে হবে, এই সর্বনামের অন্তরালে আছে যারা, তারা আসলে এক একীভূত সত্তা। তারা দেখাতে চেয়েছে, সমাজে এমন এমন সময় আসে যখন ব্যষ্টির হায়ারার্কি বিপদের হয়ে দাঁড়ায়, সমষ্টিগত ভাবনা আর চলাফেরা নতুন সমাধানের সুযোগ করে দেয়।
এই বইয়ের গল্পগুলোও যেন তাই। প্রতিটিই আলাদাভাবে দুর্দান্ত, তবু সব মিলিয়ে বারোটা গল্প যেন এক রত্নমালা তৈরি করেছে, যেখানে মালার দ্যুতি রত্নের আলাদা ঔজ্জ্বল্যকে ছাপিয়ে গেছে।
সংস্কৃত অনুরাগী দীপ্তসুন্দর মুখোপাধ্যায় কয়েক বছর ফেসবুকে লিখছেন। ভালবাসেন সংস্কৃত শাস্ত্র আর সাহিত্যের অধরা তাৎপর্য খুঁজতে, তার সঙ্গে আজকের সভ্যতার যোগসূত্র নতুনভাবে ভাবতে, বিশ্বসাহিত্যে সংস্কৃতের অবস্থান নির্ণয় করতে। যেখানে যান, বই কলম হাইলাইটার আর বুকমার্ক সঙ্গে থাকে।