কলামের অন্যান্য পর্ব: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮]
গেস্টরুমের ক্লসেটটা খুললে এখনও ন্যাপথ্যালিনের হারিয়ে যাওয়া গন্ধ। খাটের পাশে ছোট টেবিলে দু-তিনটে পুরনো বাংলা ম্যাগাজিন। টিভিতে বাংলা চ্যানেল আর আসে না। ড্রেসারের একধারে আধকৌটো ভ্যাসেলিন। মাথায় মাখার বেবি অয়েলের শিশি। প্রায় চার বছর মা এই ঘরে ছিল। নীলার ক্লিনিং লেডি বারবরা এখনও বলে মামাস রুম। নীলা ক্লসেট গোছাতে গিয়ে কয়েক বছর আগের কথা ভাবছিল। কলকাতায় দেবুর সংসার থেকে মা এক সময় নিজেই আমেরিকায় চলে আসতে চেয়েছিল। ফোনে বেশি কিছু জানাতে পারত না। লুকিয়ে লুকিয়ে নীলাকে চিঠিতে সংসারের অশান্তির কথা, দেবুর বউ-এর দুর্ব্যবহারের কথা লিখত। চিঠিপত্র লেখার রেওয়াজ কবেই চলে গেছে। নীলার ডাকবাক্সে দেশ থেকে আসা খাম দেখলে বুঝতে পারত, মা আবার তার দুঃখ-কষ্টের কথা লিখেছে। এত দূরে থেকে ও কী যে সমাধান করবে ভেবে পেত না। দেবু ছোটবেলা থেকে শান্ত, ভালমানুষ। অথচ মা অভিযোগ করত বউ-এর ঝগড়া, চিৎকার, মাকে অপমান করা দেখেও দেবু কোনও প্রতিবাদ করে না। উল্টে আড়ালে মাকে বোঝায় মানিয়ে নিয়ে না থাকলে অশান্তি আরও বাড়বে। নীলা বোঝে, শাশুড়ি-বউ-এর কর্তৃত্বের লড়াইয়ে মা ক্রমশ হেরে গেছে। নীলার চেয়ে দেবু প্রায় আট বছরের ছোট। ফোনে ওকে প্রশ্ন করলে ইদানীং ও যেন মাকেই অশান্তির জন্যে খানিকটা দায়ী করত। মা একবার রাগ করে ছোটমামার কাছে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আবার সেই ফিরতেই হল। পরে মা দুঃখ করে লিখেছিল—নিজের ঘরবাড়ি, টাকা-পয়সা না থাকলে যা হয়। নইলে এত অপমান সহ্য করে ছেলের সংসারে পড়ে থাকতাম না।
এমন যখন পরিস্থিতি, নীলা রূপঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করে মাকে স্ট্যামফোর্ডে নিজেদের কাছে নিয়ে আসাই ঠিক করল। ততদিনে দেবু গল্ফ গার্ডেনে ফ্ল্যাট বুক করেছে। মাস ছয়েকের মধ্যে পুরনো ভাড়াবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। দেবুর বউ মৌমিতা স্পষ্টই বলল ওদের ছোট ফ্ল্যাটে মার জন্যে কোনও ঘর থাকবে না। বারাসতে কোন ওল্ড-এজ হোমের খোঁজ পেয়েছে। বাড়ি ছাড়ার আগে মাকে সেখানে রেখে আসবে। দেবুর পক্ষে চিরকাল মার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। নীলা বলেছিল—“আমরাও চাই না মা আর তোমাদের সঙ্গে থাক। বাবার রেখে যাওয়া টাকাপয়সা, মার উইডো পেনশন, মামার বাড়ি বিক্রির টাকার অংশ, সবই তো তোমাদের সংসারে ঢুকে যাচ্ছে। আমি মার জন্যে এত বছরে কম ডলার পাঠাইনি। দেবু কোনওদিন মার কোনও ফাইন্যান্সিয়াল রেসপন্সিবিলিটি নেয়নি।”
মৌমিতা চিৎকার করল—“তা আপনি এতদিন মাকে যাননি কেন? একবার বেড়াতে গিয়ে তো দু-মাসের মাথায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।”
নীলা ওর স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। ফোন রাখার আগে বলেছিল—“আমি কলকাতায় যাচ্ছি। হয় মাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরব, নয়তো মার ভিসা না পাওয়া পর্যন্ত ছোটমামার বাড়িতে রেখে আসব। দেবুকে বলবে আমাকে ফোন করতে।”
মাসখানেকের মধ্যে নীলা কলকাতায় গেল। দেবুর কাছে থাকলে তিক্ততা আরও বাড়বে বুঝে পুরো সময়টা শ্বরশুরবাড়িতে থেকে মাকে ভিজিটর্স ভিসায় সঙ্গে নিয়ে এল।
সেই যে মা স্ট্যামফোর্ডে এসেছিল, তখন মাস চারেক ছিল। তারপর দেশে গিয়ে বেনারসে, ছোটমামার বাড়ি ভবানীপুরে আর জ্যাঠামশাই-এর পাইকপাড়ার বাড়িতে ঘুরে-ফিরে কয়েক মাস করে থাকতে হয়েছিল। নীলা ইমিগ্রেশন ল-ইয়ার-এর সাহায্য নিয়ে মাকে তারপরই পাকাপাকিভাবে নিয়ে এসেছিল। মা চলে আসার পর নীলা রূপঙ্করের সঙ্গে দু’বার দেশে গিয়েছিল। সে সময় মা বস্টনে রূপঙ্করের দিদির বাড়িতে ছিল। প্রথমবার কলকাতায় গিয়ে নীলা দেবুর সঙ্গে দেখা করেনি। দ্বিতীয়বার কোথা থেকে খবর পেয়ে দেবু নিজেই দেখা করতে এল। ও বারবার বলাতে নীলা একদিন ওদের গলফ্ গার্ডেনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। মৌমিতার সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তি ছিল না। ওর মা সেখানে ছিলেন। তাই ভদ্রতা বজায় রেখে আর দেবুর ছেলেমেয়ে অপু-দীপুর সঙ্গে দু-চার কথা বলে নীলা উঠে পড়েছিল। মার নাতি-নাতনিরা একবারও ঠাকুমার কথা জিজ্ঞেস করল না। হয়তো ইচ্ছে থাকলেও ওদের মায়ের সামনে কিছু জানতে চাওয়ার সাহস নেই। অথচ ওদের জন্যে মা কত জামাকাপড়, সোয়েটার, দু’বাক্স চকলেট কিনে পাঠাল। এখনও বাড়িতে কেক, চকলেট আনতে মার মনে হয় অপু-দীপু থাকলে কত খুশি হয়ে খেত।
ফোনে বেশি কিছু জানাতে পারত না। লুকিয়ে লুকিয়ে নীলাকে চিঠিতে সংসারের অশান্তির কথা, দেবুর বউ-এর দুর্ব্যবহারের কথা লিখত। চিঠিপত্র লেখার রেওয়াজ কবেই চলে গেছে। নীলার ডাকবাক্সে দেশ থেকে আসা খাম দেখলে বুঝতে পারত, মা আবার তার দুঃখ-কষ্টের কথা লিখেছে। এত দূরে থেকে ও কী যে সমাধান করবে ভেবে পেত না। দেবু ছোটবেলা থেকে শান্ত, ভালমানুষ।
স্ট্যামফোর্ডে ফিরে আসার পর মা জিজ্ঞেস করেছিল—“দেবুর চেহারা কেমন দেখলি? শরীর ভাল আছে তো? আমার কথা কিছু বলল?”
—“দেখে তো মনে হল ভালই আছে। বউই বরং নিজের শরীর খারাপের সাতকাহন শোনানোর চেষ্টা করছিল। দেবু তোমার কথা আগেই জিজ্ঞেস করেছে। বলেছি তুমি ভাল আছ।”
—“হ্যাঁ রে, ওদের বাড়িটা ঠিক কোথায়? সত্যিই কি খুব ছোট ফ্ল্যাট?”
আসলে মা বোধহয় জানতে চাইছিল ওখানে মাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জায়গার অভাবটাই সত্যি ছিল কিনা। নীলা বলতে পারেনি দেবুর তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট। বলেছিল—“ওদিকটা তুমি চিনবে না। তিনতলার ওপরে খাঁচার মতো গ্রিল দিয়ে ঘেরা ফ্ল্যাট। লিফ্ট নেই। তুমি ওখানে ঘরের ভেতর বন্দি হয়ে থাকতে।”
মা হঠাৎ বলে উঠল—“এখানেও তো তাই। কোথায় আর বেরোই বল্?”
নীলা কেমন দমে গেল। মা যেন অচেনা গলায় কথা বলছে। যে মানুষ এসে থেকে ঘুরে-ফিরে বলত, আমার এত সুখ সহ্য হলে হয়, তার কথাবার্তার মধ্যে ইদানীং যেন মৃদু অনুযোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই যে মাকে কখনও রান্নাবান্না করতে হয় না। ওরা “মন্দিরাস্ কিচেন” থেকে সারা সপ্তাহের রান্না ডেলিভারি নেয়, মার তাতেও আপত্তি। খেতে বসে মন্তব্য করে—“ব্যবসা করছে বটে তোদের মন্দিরা। এটা মোচার ঘণ্ট হয়েছে? কেন যে পয়সা নষ্ট করিস! ছুটির দিনে কটা পদ রেঁধে রাখতে পারিস না? আমি তো এসে থেকে একটু রান্নাবান্না করতে চেয়েছিলাম। তোরা রাজি হলি না।”

রূপঙ্কর উত্তর দিয়েছিল—“আমাদের এটা কনভিনিয়েন্ট মনে হয়। নীলা সারা উইক অফিস করে। উইক এন্ডে বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাই। ক্লাবের মিটিং, ফাংশান, রিহার্সাল নিয়ে ব্যস্ত থাকি। রান্না তো সুপারমার্কেট, মাছের দোকান, ইন্ডিয়ান গ্রোসারি, হালাল মিট। পর্বটা কিন্তু কম নয়। আপনিই বা কষ্ট করবেন কেন? হাঁটুর ব্যথা নিয়ে রেস্ট করুন।”
মা বলেছিল—“কত আর রেস্ট করব? সারাদিনে তো সময় কাটে না। ছুটির দিনে তোমরা পার্টিতে চলে যাও। বাইরে গিয়ে বসলে কাকপক্ষীর মুখে দেখি না। এদেশে বুড়ো মানুষদের বড্ড একা থাকতে হয়।”
খাবার টেবিলে হঠাৎই গল্প-টল্প থেমে গেল। নীলা পরে টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বলল—“এখানে সিনিয়র সিটিজেন সেন্টার আছে। দিনের বেলা গাড়ির রাইড-এর ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু ওখানে বয়স্ক অ্যামেরিকানরা আসে। হয়তো কয়েকজন ইন্ডিয়ান থাকতে পারে। তুমিও মাঝে মাঝে যেতে পারো।”
—“নাঃ। বাঙালিদের কিছু থাকলে যেতাম।”
—“কানেটিকাটে এত বাঙালি সিনিয়র সিটিজেন কোথায়, যে তাদের আলাদা সেন্টার থাকবে? গুজরাটিদের এরকম কিছু খুলেছে কি না খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি। তুমি হিন্দি তো বুঝতে পারো?”
মা মাথা নাড়লো—“তা পারি। তবে মন্দির-টন্দির হলে ভাল হত। তোদের ধারেকাছে রামকৃষ্ণ মিশন নেই?”
নীলা উত্তর দিল—“না। মিশনের দুটো সেন্টারই নিউইয়র্কে। তাছাড়া দুপুরে বন্ধ থাকে। সিনিয়র সিটিজেন সেন্টারের কিন্তু নানারকম অ্যাক্টিভিটি আছে। যোগ শেখায়। মেডিটেশন-এর ক্লাস হয়। হাল্কা এক্সারসাইজ, হাতের কাজ, নানা ধরনের খেলা যাতে ব্রেইন-এর স্টিমুলেশন হয়, মিউজিক সেশন…”
মা থামিয়ে দিয়েছিল—“ওই মিউজিক শিখে আর কী হবে? আমি যে গান গাইতে পারতাম, কত প্রাইজ, মেডেল পেয়েছিলাম, সেসব এখন গল্প কথা হয়ে গেছে।”
—“তুমি তো ভালই গাইতে মা। এখন এত সময় পাও। মাঝে মাঝে গান নিয়ে বসতে পারো। স্টাডিরুমের শেলফে গীতবিতান আছে।”
—“কিন্তু হারমোনিয়াম কোথায় পাব? শুধু গলায় কি রেওয়াজ হয়? রাগপ্রধান, ভজন-টজন কত কিই তো গাইতাম।”
হারমোনিয়ামের অভাবে নয়। শ্রোতার অভাবে মার গান গাওয়া আর হয়নি। রূপঙ্করের ইচ্ছে ছিল ওদের ক্লাবের “কবিজয়ন্তী”র প্রোগ্রামে মাকে একবার গাইতে বসিয়ে দেবে। মা নিজেই ভরসা পেল না। বলল—“অনেকদিন চর্চা নেই। দম কমে গেছে। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের শাশুড়ি বলে স্টেজে উঠে লোক হাসাব নাকি? তার চেয়ে তোদের ঘরোয়া আসরে বরং একদিন গাইব।”
নীলা কেমন দমে গেল। মা যেন অচেনা গলায় কথা বলছে। যে মানুষ এসে থেকে ঘুরে-ফিরে বলত, আমার এত সুখ সহ্য হলে হয়, তার কথাবার্তার মধ্যে ইদানীং যেন মৃদু অনুযোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই যে মাকে কখনও রান্নাবান্না করতে হয় না। ওরা “মন্দিরাস্ কিচেন” থেকে সারা সপ্তাহের রান্না ডেলিভারি নেয়, মার তাতেও আপত্তি। খেতে বসে মন্তব্য করে—“ব্যবসা করছে বটে তোদের মন্দিরা। এটা মোচার ঘণ্ট হয়েছে? কেন যে পয়সা নষ্ট করিস! ছুটির দিনে কটা পদ রেঁধে রাখতে পারিস না?
একদিন গেয়েওছিল মা। নীলাদের বাড়িতে শনিবারের নেমন্তন্নে আসা বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে মা শুনিয়েছিল
—যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু। তারপর নিজে থেকেই গাইল—এ পরবাসে রবে কে?
মার গলায় বিষণ্ণতার সুর। গানের কথা যেন মার প্রবাস-জীবনের একাকিত্বের বেদনার প্রতিধ্বনি হয়ে নীলার কানে বেজেছিল। ও অনুভব করছিল আজন্মের পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে মা ক্রমশ বড় একা হয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন দেবুকে দেখতে পায় না। ওর ওপর মার রাগ, অভিমান ধীরে ধীরে ধুয়েমুছে গেছে। এখানে নিজস্ব সমাজ নেই। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী নেই। শুধুমাত্র নীলার কাছে থেকে মার প্রতিদিনের নিঃসঙ্গতা ঘোচে না। মার কাছে এদেশ আজও বিজন বিভূঁই।
নীলা ভেবেছিল কয়েক মাসের জন্যে মাকে দেশে পাঠিয়ে দিলে হয়। হয়তো একবার ঘুরে এলে মনটা ভাল থাকবে। কিন্তু মা থাকবে কোথায়? দেবুর বাড়িতে থাকার প্রশ্ন ওঠে না। আত্মীয়-স্বজন থাকলেও তাদের কাছে বেশিদিনের জন্যে রাখা যায় না। ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার, গ্যাস-অম্বল, হাঁটুর ব্যথা, দাঁতের যন্ত্রণা এখানে মার যখন যা উপসর্গ হয়, নীলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সময়মতো চেক-আপ করায়। দেশে কার ভরসায় সে সব দায়িত্ব দিয়ে আসবে? রূপঙ্কর একদিন বলল—“মাকে জিজ্ঞেস করো সত্যিই কি উনি কয়েক মাস দেশে থাকতে চান? তাহলে পুনেয় আমার বিজনেস ট্রিপের সময় ওঁকে কলকাতায় পৌঁছে দিতে পারি। কিন্তু অতদিন থাকবেন কোথায়?”
—“সেটাই সমস্যা। আগে মাকে জিজ্ঞেস করে দেখি।”
মা সব শুনে বেশ খুশি—“যেতে তো খুব ইচ্ছে করে। বছরখানেক থেকে এলে পারি। বেনারসে তোর মেজমাসির কাছে, ভবানীপুরে বিশুর ওখানে…”
নীলা বিরক্ত হল—“অতদিন কী করে থাকবে? তোমার বয়স হচ্ছে। শরীর ভাল থাকে না। দেশে অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন তো আমাকেই ছুটতে হবে। এ জন্যেই তোমাকে একা পাঠানোর ডিসিশন নিতে পারি না।”
মার মুখ গম্ভীর হল—“তাহলে আর মিছিমিছি যাওয়ার কথা তুলছিস কেন?”
নীলা বোঝাল—“তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে নভেম্বরে ঘুরে আসবে চলো। যদি মাসখানেক বেশি থাকতে চাও, ছোটমামাকে বলে দেখব।”
মা অবুঝের মতো মাথা নাড়ল—“আমি ওই শীতের মধ্যে ফিরে আসব না। ওই সময়টা এখানে আমার বড় কষ্ট হয়। সারাদিন বাড়ির মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আসে। কেমন যেন পাগল পাগল লাগে রে।”
নীলা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল—“তুমি কি আর এখানে ফিরতে চাইছ না? কিন্তু দেশে তোমাকে দেখবে কে? সব জেনে বুঝেই তো এসেছিলে মা।”
মার গলার স্বর কান্নায় বুঁজে এল—“জানি, কত ব্যবস্থা করে তোরা আমাকে নিয়ে এলি। খরচের শেষ নেই। দুজনে কত দেখাশোনা করছিস। তবু, এদেশে থাকতে আর ভাল লাগে না রে।”

আকস্মিক আঘাতে স্তব্ধ নীলা যেন সোনার খাঁচায় বন্দি এক অসহায় পাখির আর্তস্বর শুনতে পেল। কয়েক মুহূর্ত থেমে থাকার পর মাকে জড়িয়ে ধরে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করল—“আমি বুঝতে পারি মা। এখানে তোমার কোনও জগৎ নেই। আমার কোনও ছেলেমেয়েও নেই যে, তাদের নিয়ে তোমার সময় কাটবে।”
—“ও কথা বলছিস কেন? কলকাতার বাড়িতে কি অপু-দীপু ছিল না? তবু কি থাকতে পারলাম? আসলে সে সব কথা নয় রে নীলা। আমাদের এই বয়সে একটু সমবয়সী মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। ওই দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলা। তবে, সত্যি তো। দেশে থাকব কোথায়? আত্মীয়-স্বজনরা ঘরবাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাটে উঠে যাচ্ছে। সেখানে বাড়তি লোকের জায়গা হয় না। ভাইবোন বলতে আমার বেঁচে আছেই বা ক’জন? কোথায় আর যাব।”
নীলা দৃঢ় স্বরে বলল—“একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে মা। ক’টা মাস অপেক্ষা করো। আমি নিজে গিয়ে তোমায় ভাল জায়গায় রেখে আসব। তাহলে আমারও আর চিন্তা থাকবে না।”
সেদিনই রূপঙ্কর নিউইয়র্কে ডঃ অরিন্দম মিত্রকে ফোন করে মার কথা জানাল। ডঃ মিত্র কলকাতায় মুকুন্দপুরের কাছে তিন বছর হল “এল্ডার কেয়ার” নামে সিনিয়র সিটিজেন হোম তৈরি করেছেন। প্রায় আমেরিকার স্টাইলে তৈরি বিশাল বাগানঘেরা তিনতলা বাড়িতে রিটায়ার্ড লোকেদের থাকার বন্দোবস্ত। কলকাতা, বম্বে, দিল্লির কিছু অবসরপ্রাপ্ত উচ্চবিত্ত বাঙালিরা ছাড়াও ওখানে আমেরিকা-কানাডার কয়েকজন বয়স্ক বাঙালিও রয়েছেন। রূপঙ্করের ডঃ মিত্রের কাছ থেকে “এল্ডার কেয়ার”-এর খরচপত্র, বোর্ডারদের ঘর, খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা, এন্টারটেনমেন্টের কথা সব কিছু জেনে নিল। আরও খবর পেল, নিউইয়র্ক, বস্টন, অ্যাটল্যান্টায় থাকা চেনাশোনা বাঙালিদের কয়েকজনের বাবা, মা ওই ওল্ড-এজ হোমে আছেন।
নীলা মার সঙ্গে আলোচনা করে ডঃ মিত্রর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে ফেলল। কিন্তু জায়গাটা না দেখেই ওরা মার সিঙ্গল রুম উইথ অ্যাট্যাচড্ বাথ অ্যান্ড ব্যালকনি বুক করার জন্যে ‘অ্যাডভ্যান্স’ দিতে চাইছে জেনে ডঃ মিত্র বারণ করলেন। ঠিক হল, ডিসেম্বরে গিয়ে পেমেন্ট করলেই হবে।
বস্টনে রূপঙ্করের দিদিকে ফোন করে জানা গেল ওখানে যাদের মা মুকুন্দপুরের ওই হোমে থাকেন, তারা তো বলছে ব্যবস্থা বেশ ভাল। বাইপাসের ধারে তিনটে হাসপাতালের সঙ্গে হোমের অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা আছে। হোমের নিজস্ব ডাক্তার, নার্স আছে। বোর্ডারদের নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপ হয়। খবরগুলো পেয়ে মার জন্যে নীলা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল।
মা একদিন জিজ্ঞেস করল—“হ্যাঁ রে, দেবুকে জানাবি না?”
নীলা হাসল—“ও, তোমাকে বলা হয়নি। দেবুকে সব জানানোর পরে জিজ্ঞেস করলাম ও মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে যেতে পারবে কিনা। ইমিডিয়েট ফ্যামিলি হিসেবে ওর তো একটা দায়িত্ব থাকা উচিত। তবে খরচপত্রের জন্যে ওকে কিছু ভাবতে হবে না। সেরকম অসুস্থ হলে হাসপাতালে গেলে, আবার তুমি ওই হোমেই ফিরে যাবে। আয়ারা থাকবে। নার্স দেখবে। তোমার চিকিৎসার জন্যেও দেবুকে চিন্তা করতে হবে না।”
—“দেবু শুনে কী বলল?”
—“ও এত কথা শুনতেই চাইছিল না। বলছিল আমি তো আছি। তুই দূরে থেকে মার জন্যে বেশি টেনশন করবি না।”
আজ প্রায় দেড় বছর হল মা মুকুন্দপুরে “এল্ডার কেয়ার”-এ আছে। মাঝে একটু অসুস্থ হলেও মোটামুটি ভালই আছে। মাঝে মাঝে ফোনে জানতে চায়—“তোরা আবার কবে আসবি?”
গতকাল মাদার্স-ডে তে নীলা ফোন করেছিল।
মা বলল—“হারমোনিয়ামের আওয়াজে ভাল করে শুনতে পাচ্ছি না।”
—“হারমোনিয়াম আবার কে বাজাচ্ছে?”
বাজনা বন্ধ হতে মা উত্তর দিল—“কাল এখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী। তার ফাংশানের জন্যে নীচের হলঘরে রিহার্সালে এসেছি। আমাকেও বুড়ো বয়সে গাইতে হবে।”
—“ভাল তো মা। এই সব নিয়ে আনন্দে থাকো।”
হারমোনিয়ামের আওয়াজে আবার ওদের কথা চাপা পড়ে গেল। নীলা ফোন রেখে দিল। মাকে আর মাদার্স ডে-র প্রণাম জানানো হল না। এখানে ওইদিন মাকে নিয়ে ডিনারে যেত। মা বারণ করলেও গিফট কিনে আনত। মার সঙ্গে নীলার সেই ছোট ছোট মুহূর্তের স্মৃতি মার হয়তো আর মনেও থাকবে না।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।