banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: জয়কিষণগঞ্জের গল্প (পর্ব ১)

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

জানুয়ারি ২৫, ২০২৩

Bengali immigrant community story
Bengali immigrant community story
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

“কবুতর হালাল মিট্ গ্রোসারি অ্যান্ড ভিডিও কর্নার”-এর দরজায় দাঁড়িয়ে মেহরীন ডাকলো—“স্টোরের ওই ধারে গিয়া বসো। বাংলা পত্রিকা আছে। চাইলে টিভি দেখতে পারো।”

হাতের ব্যাগ পেছনের তাকে রেখে মেহরীন চাবি দিয়ে দোকানের ক্যাশ রেজিস্ট্রার খুলল। দোকানে তখনও লোকজন আসেনি। দাঁড়িওলা রোগা লোকটা কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে পটল বার করছিল। মেহরীনের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেবীর দিকে চেয়ে হাসল—“দুই দিন হয় নাই, এদেশে আসছে। টিভির ইংরাজি বুঝবো নাকি?”

মেহরীন মাথার কালো ওড়না আলগা করে, চোখে চশমা পরে একটা লিস্ট পড়ছিল। লোকটার কথার জবাব দিল না। দেবী তখনও দোকানের মাঝপথে দাঁড়িয়ে। মাত্র দু’দিন আগে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছে। এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময় আকাশ-ছোঁয়া বাড়িঘর, নানা রঙের বড় বড় গাড়ি দেখে আমেরিকা সম্পর্কে শোনা ওর এতদিনের ধারণাটা প্রায় মিলে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ সকালে ওই পাড়াটায় এসে আমেরিকায় আছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। মেহরীনের সঙ্গে দোকানে ঢুকে আরও অবাক! দেওয়ালে মস্ত পোস্টার লাগানো। ওপরদিকে মাছ আর মুরগির ছবি। নীচে বড় করে লেখা—বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত আপনার পছন্দনীয় মাছ ও মাংসের বিপুল সম্ভার। পদ্মার ইলিশ, সিলেটের ট্যাংরা, ঢাকার বিখ্যাত চানাচুর, আলাউদ্দিনের লাচ্ছি সেমাই, মৈমন সিং-এর খেজুর গুড়। কালিজিরা চাল …

পোস্টার থেকে চোখ সরিয়ে দেবী দেখল দোকানে লোকজন ঢুকছে। দাড়িওলা লোকটা কাউন্টারের পেছনে মেহরীনকে সাহায্য করতে গেল। কেউ পাবদা মাছ চাইছিল। লোকটা মস্ত ফ্রিজার খুলে লম্বা লম্বা মাছের প্যাকেট বার করল। জিনস্ পরা এক মহিলা পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পুঁইশাক কিনছে। তার পেছনে দাঁড়ানো বেঁটে মতো লোকটা কুমড়োর ফালি আর আধখানা নারকেল হাতে নিয়ে কচুর লতির খোঁজ করছে। দেবী মাঝে মাঝে কচু খেয়েছে। তার লতি আবার কি জিনিস? আমেরিকায় এসেও লোকে পুঁইশাক কেনে, কচু খায় দেখে ওর ঠাকুমার কথা মনে পড়ছে। ঠাকুমা বলে আমাদের গরিবের সংসারে কচু, ঘেঁচু, কুমড়ো ছাড়া কি খাবো? দেবী এখন দেখছে বড়লোকেরাও কুমড়ো খায়। 

“কি হইল? খাড়ায়ে আছো ক্যান্? বাংলা ভিডিও চালায়ে দিবো?” দাড়িওলা লোকটা দেবীর গায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। 

ও একটু সরে গিয়ে বলল—“না। একটা নিউজ পেপার দেবেন? ইন্ডিয়ার কাগজ।”

লোকটা মাথা নেড়ে হাসল—“ইন্ডিয়ান কিছু নাই। বাংলাদেশি কাগজ আছে দুই-তিনটা। ওই ধারে রাখা আছে। বইস্যা কাগজ পড়ো।”

দেবী ‘দেশবিদেশ’ নামে একটা পত্রিকা তুলে নিয়ে দোকানের পেছন দিকে প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসল। ওদিকে ক্যাসেটে গান শুরু হয়েছে—“সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী”…

দেবী পত্রিকার পাতা উলটে দেখছিল। বাংলাদেশের খবর, নিউইয়র্কের খবর, এই এলাকার দোকানবাজারের বিজ্ঞাপন। “কবুতর হালাল মিট গ্রোসারীর” বিজ্ঞাপনও আছে। নীচে লেখা—হালাল গোস্ত, খাঁটি সরিষার তেল ও শুঁটকি মাছ। আরও পাইবেন আম ও জলপাইর রকমারি আচার এবং পটল, কাঁকরোল, কাঁঠালবিচি, ডাঁটা ও পানিকচু-সহ দেশি সবজি। ভিসা, মাস্টার্স কার্ড ও আমেরিকান এক্সপ্রেস গ্রহণ করি”…

কাগজ পড়তে পড়তে দেবীর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল। অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে। কালও অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের ভেতর একটু গরম লাগছিল। দেবী উঠে জানলার কাচ তুলে দিতে পেছনের ঝোপঝাড় থেকে অচেনা ফুলের গন্ধ নিয়ে একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এল। দেবী জানলা দিয়ে রাতের নিস্তব্ধ শহর দেখছিল। এত উঁচু বাড়িতে কখনও থাকেনি। সব কিছুই কত দূরে মনে হয়। কখন রাজা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। দেবী নীচু গলায় বলল—“উঠে পড়লি কেন? বাথরুমে যাবি?”

আরও পড়ুন: নেতাজিকে দেখতে জনজোয়ার শ্যামবাজারে

রাজা উত্তর দিল না। রোগা শরীরে নতুন কেনা পায়জামাটা ঢলঢল করছে। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকা ওর ম্লান মুখ দেখে দেবীর মায়া লাগছিল। ভাই-এর পিঠে হাত রেখে ডাকল—“চল্ শুয়ে পড়ি। কাল আমাদের সকালে বেরতে হবে।”

রাজা সাড়া দিল না। দূরে অন্ধকার আকাশের বুক চিরে প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল। লাল আলোর বিন্দু মিলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে রাজা বলল—“মা যে এখানে আসবে না তুই জানতিস?”

—“কে বলল মা আসবে না? বোকার মতো এসব ভেবে তুই মন খারাপ করছিস? এত বড় ছেলে। কটা মাস মাকে ছেড়ে থাকতে পারবি না?”

রাজা তখনও গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—“মা আর পাপু যদি না আসে, আমি এখানে থাকব না।”

রাজার গলার আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে শুনে দেবী ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করল—“রাজা, কত খরচ করে বাবা আমাদের নিয়ে এল। তুই ভাল স্কুলে ভর্তি হবি। আমি তো আছি। মা এ-বছরেই পাপুকে নিয়ে চলে আসবে। ঠাকুমার একটা ব্যবস্থা করে আসতে হবে তো।”

neighbourhood in New York

 

অচেনা ফুলের গন্ধ নিয়ে একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এল।

বড় অসহায়, বিপন্ন শোনাল রাজার গলার স্বর—“তুই জানিস না দিদি। বাবা আজ বলল মা নাকি এখানে আসতে চায় না। তাহলে আমাদের নিয়ে এলো কেন?”

মেহরীনের ডাকে দেবীর তন্দ্রার ঘোর কেটে গেল। দোকানের ভেতর গান বাজছে। লোকজনের কথাবার্তা চলছে। ও তারই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল কখন? মেহরীন হাসছে—“আজ বাসায় থাকলে পারতে। জেট্ ল্যাগ হইতাসে। নাও লাঞ্চ আনছি। ধরো. ওদিকে কাস্টমার দাঁড়াইয়া আছে।”

কাগজের প্লেটে খাবার ধরিয়ে দিয়ে মেহরীন কাউন্টারে ফিরে এল। দেবীর ঘুম কাটতে চাইছে না। হাতে প্লেট নিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ পায়ের কাছে ভারী মতো কিছু ঠেকলো। তাকিয়ে দেখলো বিশাল পেঁয়াজের বস্তা। তার ও প্রান্ত ধরে টানতে টানতে দুটো লোক রাস্তায় নেমে যাচ্ছে। দেবী ওর তেরো বছরের জীবনে কখনও একসঙ্গে এত পেঁয়াজ দেখেনি। আমেরিকায় লোকে এত বেশি বেশি বাজার করে কেন? বরফে জমানো রুই মাছ, ইলিশ মাছ, কই মাছ সবই একদিনে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। টাকা থাকলেও কত খেতে পারে মানুষ? দেবী তো বিয়েবাড়িতে গিয়েও দুটোর বেশি মাছ খেতে পারে না। 

কাগজের প্লেট থেকে নানরুটি দিয়ে ঘুগনি খেতে খেতে দেবী ভাবছিল ভাইটা কী খেলো কে জানে? সকালে ও যখন মেহরীনের সঙ্গে বেরলো, রাজা তখনও বালিশ আঁকড়ে ঘুমোচ্ছিল। বাবা বলল, পরে ওকে নিয়ে বেরবে। আজ শনিবারে বাবার বোধহয় ছুটি। হঠাৎ দেবীকে কেন যে দোকানে পাঠিয়ে দিল। সারাদিন একটা দোকানে বসে থাকা যায়? ওর রাজার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। কাল রাতে যা শুনেছে, মনে হয় বাবার কথা রাজা বুঝতে পারেনি। তবু দেবী একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করবে। ও এটুকু বুঝেছে, মা অনেকদিনই মেহরীনের কথা জানে। বাবাও ওদের এতদিন আমেরিকায় আনার চেষ্টা করেনি। মাঝে মাঝে নিজে কলকাতায় ঘুরে আসত। কিছু খরচপত্র দিয়ে আসত। দু’বছর আগে হঠাৎ ঠিক করল, দেবী আর রাজাকে নিয়ে আসবে। ওদের বয়স বেড়ে গেলে বাবা আর স্পনসর করতে পারবে না। পাপু অনেক ছোট। ওকে স্পনসর করার তাড়া নেই। দাদু, ঠাকুমাকে রেখে মার পক্ষে চট করে আসা সম্ভব নয়। বাবা মাকে কি বুঝিয়েছিল কে জানে? মা বোধহয় ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পাঠাতে রাজি হয়ে গেল। তখন তো এটাই ঠিক ছিল, দাদু আর ঠাকুমাকে পরে বারাসতে ছোটকাকার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঠাকুমা অবশ্য রাজি হচ্ছিল না। গত বছর দাদু মারা গেল। দেবী শুনেছে, মা যখন পাপুকে নিয়ে এখানে চলে আসবে, রাঙাপিসি ঠাকুমাকে নিয়ে যাবে। মা যে বাবার কাছে আসতে চায় না, সে দেবীর চেয়ে বেশি আর কে জানে? কিন্তু ওদের ছেড়ে মা থাকবে কী করে?

হঠাৎ হাসির শব্দে দেবী দোকানের দরজার দিকে তাকাল। সালোয়ার কামিজ পরা সুন্দর দেখতে এক মহিলা খুব হাসছে। যার কথায় এত হাসি সে নিশ্চয়ই ওর বর। সে মজা করে বলছে—“আপনার মাংস যেমনই হোক, আমাদের বিশেষত্ব আপনার মাংস কুচি কুচি করে কাটা এবং কিমা বানানো।”

দোকানের লোকজনও হাসছে। মেহরীন কাউন্টার থেকে বলে উঠল—“মাংসের দোকানের বিজ্ঞাপন দেখে মজা পাইসেন? পানের বিজ্ঞাপন দ্যাখেন নাই? ওই যে সেভেন্টিফোর স্ট্রিটে নতুন একটা পানের দোকান খুলসে, দেখসেন? নাম দিসে পুরস্কার প্রাপ্ত পানের দোকান ‘পানমহল’। ফারুকভাই, পানের নামগুলি বলেন তো।”

দাড়িওলা ফারুক লোহার মই-এর মতো একটা সিঁড়িতে চড়ে উঁচু তাক থেকে প্যাকেট নামাচ্ছিল। মেহরীনের কথায় ওখান থেকেই গলা ফাটিয়ে শুরু করল—“সালিমশাহী পান, শীষমহল, বালুচি পান, দুলহন এক রাত কি, আই লাভ ইউ পান। আরও কত নাম দিসে! স্টুডেন্টরা পরীক্ষা দিবার আগে সাকসেস পান খাইলে ফার্স্ট হইবো। বড় চাকরির ইন্টারভিউতে যাইবার কালে এক খিলি ম্যানেজমেন্ট পান। দাঁতগুলির রং চিন্তা করেন!”

কাগজের প্লেট থেকে নানরুটি দিয়ে ঘুগনি খেতে খেতে দেবী ভাবছিল ভাইটা কী খেলো কে জানে? সকালে ও যখন মেহরীনের সঙ্গে বেরলো, রাজা তখনও বালিশ আঁকড়ে ঘুমোচ্ছিল। বাবা বলল, পরে ওকে নিয়ে বেরবে। আজ শনিবারে বাবার বোধহয় ছুটি। হঠাৎ দেবীকে কেন যে দোকানে পাঠিয়ে দিল। সারাদিন একটা দোকানে বসে থাকা যায়? ওর রাজার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। কাল রাতে যা শুনেছে, মনে হয় বাবার কথা রাজা বুঝতে পারেনি। তবু দেবী একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করবে। ও এটুকু বুঝেছে, মা অনেকদিনই মেহরীনের কথা জানে। 

দেবীর এত হাসাহাসি ভাল লাগছিল না। কতক্ষণ ধরে এখানে বসে আছে। বাইরে মনে হয় বিকেল হয়ে এল। কটা বাজলো এখন? দোকানে একটা ঘড়িও নেই। এরা কত রাত অবধি দোকান খুলে রাখে? অধৈর্য হয়ে দেবী চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দেখলো মেহরীন ফোনে কথা বলছে। ওকে দেখে ফোন ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করল—“বাসায় যাইতে চাও? তারাও এইমাত্র ফিরসে। তোমার ভাইরে লইয়া সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরসে। সে তো এখনই ঘুমায়ে পড়সে।”

দেবী বলল—“ইস্, আজ রাত্তিরেও বোধহয় ভাল করে খাবে না। কাল দেখলেন তো, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কিচ্ছু খেলো না। আমাকে এবার বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন?”

ফারুককে ডেকে মেহরীন দেবীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে বলল। দেবী ইতস্তত করছে দেখে মেহরীন তাড়া দিল—“যাও। বাসায় গিয়া বিশ্রাম করো। রাতের খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। তোমার বাবারে বলবে, মাইক্রোওয়েভে গরম কইরা দিতে।”

মাত্র দু’দিনের চেনা একজন মানুষ ওর বাবার চেয়ে ঢের ভাল ব্যবহার করছে। বাবা তো ওকে সকাল থেকে বাড়ি ছাড়া করার জন্যে ব্যস্ত। রাজাকে বেড়াতে নিয়ে গেল! দেবীর কথা একবারও মনে হল না। মেহরীন ওদের কেউ নয়। তবু ওরা আসার পরে মহিলা একটুও বিরক্তি দেখায়নি। মা তো সেই ভয়টাই পেয়েছিল। 

দেবীর ইচ্ছে করছে মেহরীনও যদি ওর সঙ্গে এখন বাড়ি যায়। সে কথা বলতে মেহরীন হাসল—“আমার তো বাসায় ফিরতে নয়টা বাজবে। তুমি আর দেরি কইরো না।” কাস্টমারদের জিনিস ব্যাগে ভরতে ভরতে মেহরীন ফারুককে তাড়াতাড়ি দোকানে ফিরে আসতে বলল। সন্ধ্যের পরেও ভিড় কমছে না। দেবী ফারুকের সঙ্গে রাস্তায় নেমে এল। 

পথের দু’ধারে ভারতীয়, বাংলাদেশি, পাকিস্তানীদের সারি সারি দোকান। ইন্ডিয়া শাড়ি প্যালেসের আলো ঝলমলে শো-কেসে শাড়ি আর ল্যাহেঙ্গা চোলি পরা মানুষের মতো পুতুলগুলো দেখতে দেখতে দেবী একবার দাঁড়িয়ে পড়ল। গয়নার দোকানের বাইরে শো-কেসে সোনার ঝালরের মতো দেখতে বড় বড় হার। লাল, নীল, সবুজ পাথরের সেট। সাদাগুলো নিশ্চয়ই ডায়মন্ড। দেবী মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। ফারুক এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আবার চলতে শুরু করল। 

Bengali shops in New York

 

পথের দু’ধারে ভারতীয়, বাংলাদেশি, পাকিস্তানীদের সারি সারি দোকান।

ফারুক সমানে বকবক করে যাচ্ছে—“এই রাস্তার নাম জ্যাকসন হাইটস্। অবাঙালিরা নাম দিসে জয়কিষণ হাইটস্। এত বড় দিশি বাজার আমেরিকার কোথাও নাই। এক সময় এ সবই সাহেবপাড়া সিলো। এখন আমরা দখল করসি। কোরিয়ানরাও কম যায় না। ফ্লাশিং-এর দিকটায় যদি যাও, মনে হইবে কোরিয়াতে ঘুরত্যাসো।”

সাব-ওয়ে চড়ে দেবীরা যখন অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছলো তখন আটটা বাজেনি। ফারুক ওকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। অনিল বসে বসে টিভি দেখছিল। রাজা একটা নতুন খেলনার বাক্স খুলে বসেছে। কার্পেটে নতুন একজোড়া জুতো। দেবীকে দেখে উৎসাহিত হয়ে বলল—“তুই কেন আমাদের সঙ্গে গেলি না রে? আজ সারাদিন কত ঘুরলাম। সাব-ওয়ে ম্যানহাটনে গেলাম। বাবা তোকে একবার ফোনও করল…”

দেবী কিছু বলার আগেই অনিল ওকে কাছে ডাকল—“আয়, এখানে এসে বোস। সারাদিন কি করলি? জ্যাকসন হাইটস্-এর দোকান-বাজার দেখলি?”

দেবী মাথা নাড়ল—“হ্যাঁ, আসায় সময় দেখছিলাম।”

—“দুপুরে কী খেলি?”

—“রুটি, ঘুগনি। একটা মিষ্টি।” দেবী ছাড়া ছাড়া উত্তর দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। বেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে চিৎকার করে ডাকল—“রাজা, একবার ঘরে আয় তো।” রাজা আসার পর দেবী গম্ভীর গলায় জানতে চাইল—“

তুমি আজ চান করেছিলে?”

—“নাঃ, কাল করব। সকালে শীত করছিল।”

দেবী ধমক দিল—“বাজে বকিস না! গরম জলে চান করলে শীত করে? এখানে এসেই আমাকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করেছ?” দেবী বিরক্ত মুখে বিছানার ওপর জড়ো করা রাজার সকালের ছাড়া জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেল। 

রাজা বুঝতে পারছিল দিদির কেন রাগ হয়েছে। কিন্তু দিদিই বা সকালে বেরিয়ে গেল কেন? বাবা তো ম্যাকডোনাল্ড থেকে একবার ফোনও করেছিল। দিদি নাকি তখন দোকানে বসে ঘুমোচ্ছিল। কেউ ডেকে দেয়নি। রাজা আবার দিদির চিৎকার শুনতে পাচ্ছে—“রাজা খেতে এসো।”

অনিল ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল। নিজের ছেলেমেয়েকে এত বছর ছেড়ে থাকার পর সহজ হতে সময় লাগছে। ছেলেটা এখনও ছোট। সারাদিন অনিলের সঙ্গে ঘুরে বেরিয়ে, খেলনাপত্র পেয়ে খুশি হয়ে দিদিকে বলতে গিয়েছিল। কিন্তু দেবীর প্রতিক্রিয়া অনিল ভালই বুঝতে পারছে। আজ সকালে বেড়াতে যেতে পারেনি বলে নয়, এ বাড়ির পরিবেশটাই ও মেনে নিতে পারছে না।” অথচ অনিল তো গত বছর দেশে গিয়ে দেবীকে স্পষ্ট বলেছিল—তোমাদের কিছুদিন স্টেপ-মাদারের সঙ্গে থাকতে হবে। সেও চায় তোমরা আমেরিকায় চলে আসবে। তার একটা ছেলে। সে আলাদা যাবে। তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। 

Jackson Heights New York

 

জ্যাকসন হাইটস্-এর দোকান-বাজার দেখলি?

এইসব বুঝিয়ে অনিল ওদের এদেশে এনেছে। মেহরীনও একরকম মেনে নিয়েছে। কোনও দুর্ব্যবহার তো করছে না। তাহলে দেবী সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর করে আছে কেন? এরপর মেহরীন রেগে গেলে অনিল কোনদিক সামলাবে?

দেবী কিচেন থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকল—“মাইক্রো-ওয়েভটা কি করে চালাবো একবার দেখিয়ে দেবে?”

অনিল ব্যস্ত হয়ে বলল—“তুই টেবিলে প্লেট দে। আমি খাবার গরম করে দিচ্ছি।”

—“কেন? আমাকে দেখিয়ে দাও না। আমি সব করছি। রাজার জন্যেই তাড়া করছি।”

রাজাকে খেতে দিয়ে দেবী মেহরীনের জন্যে অপেক্ষা করল। মেহরীন ফেরার পর তিনজনে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে শুতে রাত এগারোটা। পরদিন রবিবারেও মেহরীনের দোকান খোলা। দেবীকে মেহরীন বলল—“কাল সী-বিচে ঘুইরা আসো।” অনিলকে বলল—“ওদের কোনি আইল্যান্ডে নিয়া যান, রাইডগুলি এনজয় করব।”

অনিল বাসনপত্র ধুতে ধুতে উত্তর দিল—“ওরা কি বেড়াতে এসেছে যে এখনই সব দেখাতে নিয়ে যাব? আগে ওদের জামাকাপড় কেনা দরকার। কাল ওদের নিয়ে মেসীতে যাব। ওখানে সেল্ চলছে।”

—“সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করেন না। ওইদিন তো আমার ছুটি। আমিও শপিং-এ নিয়া যাইতে পারি।”

কলকাতার কৃত্তিবাস লেনের ভাঙাচোরা বাড়িটার ঠিকানায় আজকাল প্রায়ই আমেরিকার চিঠি আসে। একেকদিন ডাকবাক্স খুলে দেবীর চিঠি দেখে প্রতিমা অধীর অপেক্ষা নিয়ে থাকেন। জবা টেলারিং শপ থেকে ফিরে মেয়ের চিঠি খুললে তবে নাতি-নাতনীর খবর পাবেন। দেবীর জন্যে, রাজার জন্যে সারাক্ষণ মন কেমন করে। কতরকম চিন্তা হয়। ছেলেমেয়ে দুটো কিসের মধ্যে গিয়ে পড়ল কে জানে? দুঃখী মানুষটা এখানে পড়ে রইল। ওদিকে বাপেরও তেমনি মতিগতি। বাবা, মা, বউ কারোর ওপর ওর ভালবাসা আছে? এতটুকু মায়া-মমতা আছে? শুকনো কর্তব্য ছাড়া কিছু বোঝে? হঠাৎ ছেলেমেয়ে দুটোকে জেদ করে নিয়ে গেল। প্রতিমা আজকাল অনিলের সব কাজের মধ্যে মতলব খুঁজে পান। নিজের টাকাপয়সার জোর থাকলে কখনও ওদের যেতে দিতেন? জবাও বা কোন্ ভরসায় ছেলেমেয়েকে আটকে রাখবে? দর্জির দোকানে সারাদিন সেলাই করে ওই তো রোজগার! অনিলের টাকা বন্ধ হয়ে গেলে সংসার অচল হয়ে যাবে। দেবী বড় হয়ে যাচ্ছে। এখানে মামার ওপর একজন পুরুষ মানুষ নেই। সেও এক চিন্তা হোত। দেবীও তো যেতে আপত্তি করল না। ওই আমেরিকার মোহ। এখানে অভাবের সংসারে মা, ঠাকুমার স্নেহ, ভালবাসা ছাড়া আর কিছু তো তাদের দেওয়ার সাধ্য ছিল না। অনিল একরকম জোর করেই তাদের কেড়ে নিয়ে গেল। অসহায়, নিরুপায় দুটো মানুষের বাধা দেওয়ার শক্তি ছিল না। 

ফারুক সমানে বকবক করে যাচ্ছে—“এই রাস্তার নাম জ্যাকসন হাইটস্। অবাঙালিরা নাম দিসে জয়কিষণ হাইটস্। এত বড় দিশি বাজার আমেরিকার কোথাও নাই। এক সময় এ সবই সাহেবপাড়া সিলো। এখন আমরা দখল করসি। কোরিয়ানরাও কম যায় না। ফ্লাশিং-এর দিকটায় যদি যাও, মনে হইবে কোরিয়াতে ঘুরত্যাসো।”

আজ এক বছর হয়ে গেল, এখন জবা আর পাপুকে নিয়ে গেল না। অনিল কি সত্যিই ওই মুসলমান মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল? এখনও অনিল ওর সঙ্গে থাকে কেন? জবাকে জিজ্ঞেস করলে কথাগুলো এড়িয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির ওপর জবার রাগ, অভিমান আজও যায়নি। জবার ধারণা প্রতিমারা ছেলের স্বভাব, চরিত্র জেনেও বিয়ে দিয়েছিলেন। আশ্চর্য কথা! অনিল জাহাজে কাজ করত। সারা বছর জলে জলে ঘুরছে। সে কোন্ দেশে গিয়ে কবে কি করছে, এখানে বসে জানা সম্ভব ছিল? ওঁরা সত্যিই কিছু বুঝতে পারেননি। আজ তার ফল ভুগতে হচ্ছে। জবার দুঃখ, অপমান, বঞ্চনার মূলে নিজেকে নিমিত্ত ভেবে প্রতিমার বড় কষ্ট হয়। অনিলের স্বভাব শোধরালো না। কত বছর ধরে বউটাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে! জবা সবই বোঝে। বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। তিনটে ছেলেমেয়ে নিয়ে ওরই বা যাওয়ার জায়গা কোথায়? প্রতিমার জীবনেও অবলম্বন বলতে ওরাই। দেবী, রাজা চলে যেতে সে কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। এরপর পাপুকে নিয়ে জবাও যদি চলে যায় এই সংসার শূন্য হয়ে যাবে। তবু জবার কথা ভেবে, নাতি-নাতনিরা ভাল থাকবে ভেবে প্রতিমা সেই একাকিত্বে কষ্ট সহ্য করে নেবেন। এ বয়সে এত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর নিতে পারেন না। 

জবা বাড়ি ফিরে পাপুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। ক’দিন ধরে মেয়েটার সর্দিজ্বর চলছে। ওষুধপত্র কিনে ওরা বাড়ি ঢোকার মুখে প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। জবার হাতে দেবীর চিঠি আর এক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে প্রতিমা পাপুকে খাওয়াতে বসালেন। জবা চা শেষ করে শোবার ঘরে গেল। প্রতিমা খানিকক্ষণ ওর সাড়া-শব্দ পেলেন না। 

উপর্ঝরণ বৃষ্টি নেমেছে। রান্নাঘরের সামনে উঠোনের ফুলগাছগুলো জলে ভিজে সারা। দেখতে দেখতে জবার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তার জীবনে কখনও এমন বৃষ্টি নামল না। অশান্তির আগুনে সারাজীবন জুড়ে শুধু খরা। আর কতকাল এভাবে কাটবে? আজ দেবীর চিঠি পড়ে বড় দিশাহারা লাগছে। জীবনের জটিল জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা যে কি কঠিন। জবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে রইল। 

প্রতিমা ঘরে এলেন—“কি লিখেছে দেবী? ওদের শরীর-টরীর ভাল আছে তো?”

শব্দহীন কিছু মুহূর্ত পার হওয়ার পর জবার বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর প্রতিমার কানে বাজল—“রাজা ওখানে থাকতে চাইছে না। চলে আসার জন্যে অস্থির হচ্ছে। তবু ওরা পাঠাবে না।” পাপু খেতে খেতে উঠে এসেছিল। মার কথা শুনে বলে উঠল—“দাদা ঠিক চলে আসবে দেখো। ওকে তো ইস্কুলে সবাই মারে।”

প্রতিমা ঘুরে তাকালেন—“রাজাকে ইস্কুলে মারে? সে কি? জবা, রাজা তোমাকে ফোনে একথা বলেছে?”

জবা উত্তর দিল—“না, না অত কিছু নয়। সেদিন ফোনে বলছিল খেলার সময় একদিন ঝগড়া লেগেছিল। রাজা মার খাচ্ছিল দেখে অন্য ছেলেরা থামিয়েছে। যেটা মেরেছিল তার বাড়িতে ইস্কুল থেকে ওয়ার্নিং লেটার দিয়েছে। দেবীর কাছেই সব শুনলাম।” 

—“কি কাণ্ড! রোগা ছেলেটাকে ধরে মারল? আমেরিকানগুলোর গায়ে কম জোর নাকি? তুমি তো আমাকে বলোনি?”

—“বলার কি আছে মা? এখানে থাকলে কি আগলে রাখতে পারতাম? ছেলেকে ওভাবে মানুষ করা যায় না। আমি ওসব নিয়ে ভাবছি না।”

প্রতিমা মনে মনে ভাবলেন ছেলেকে মানুষ করার ব্যাপারে তারা যে ব্যর্থ হয়েছেন, সে কথা জবা তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানাতে ছাড়ে না। ওসব কথায় না যাওয়াই ভাল। কিন্তু রাজা ফিরে আসতে চাইছে কেন? জবার মুখখানা ভার ভার। দেবী যে কি লিখেছে, তাও বুঝতে পারছেন না প্রতিমা। জবা পাপুকে বলল—“যা, ঠাকুমার সঙ্গে গিয়ে খেয়ে নে। তারপর ওষুধ দেবো।”

প্রতিমা তখনও দাঁড়িয়ে আছেন দেখে জবা বলল—“রাজার আসা হবে না। দেবী লিখেছে—ইংরিজি নিয়ে ওদের দুজনেরই অসুবিধা হচ্ছে। গরমের ছুটিতে আলাদা করে ক্লাস করতে হবে। ইস্কুল থেকেই ব্যবস্থা করেছে। রাজা এই সেপ্টেম্বরে ক্লাস সিক্সে যাবে। দেবী যাবে হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে। তার আগে গরমের ছুটিতে দু-মাস মেকাপ কোর্স করবে। দুজনের কারোর পক্ষেই এ বছর আসা সম্ভব নয়।”

—“আর আসবার দরকার কি? এরপর তো তোমরাই চলে যাবে। তার ব্যবস্থা কিছু হচ্ছে? নাকি অনিল সেই গড়িমসি করছে?”

পাপুর দিকে একবার তাকিয়ে জবা বলল—“এখন শুনছি বছর দুইয়ের আগে আমাদের স্পনসর করতে পারবে না। প্লেনভাড়া, নতুন সংসারের খরচ, এত কিছু এখন দিতে পারবে না। দেবীকে এসব কথা বুঝিয়েছে। দেবী আশা করেছিল আমরা এ বছর চলে যাব। বাবার কথায় মন-মেজাজ ভাল নেই। চিঠিতে সেসব লিখেছে। কাল কাজে যাওয়ার পথে একবার ফোন করব।”

letter writing story of Bengali community

 

চিঠিতে সেসব লিখেছে।

নিউইয়র্কে রাত প্রায় দশটা। দেবী হোমওয়ার্ক শেষ করে জামাকাপড় ইস্ত্রি করছিল। রাজা অনিলের সঙ্গে কম্পিউটারে বসেছে। মেহরীনের জ্বর। দোকান থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল। রাতে ভাত খেল না। দুধ-সেরিয়াল খেয়ে শুয়ে পড়েছে। ওদের শোবার ঘর অন্ধকার। 

বসার ঘরে ফোন বাজছিল। অনিল ধরেছে। দেবী ওর ঘর থেকে রাজার গলা শুনতে পাচ্ছিল। নিশ্চয়ই মার ফোন। মা মাঝে মাঝে ফোনবুথ থেকে অল্পক্ষণের জন্যে কথা বলে। দেবী ইস্ত্রি বন্ধ করে বসার ঘরে গেল। রাজা তখন মাকে ওর জন্মদিনের খবর দিচ্ছিল। দেবী হাত বাড়াল—“অ্যাই, এবার আমাকে দে। মার কত বিল উঠছে না?” 

দেবী কর্ডলেস ফোন হাতে বাবার দিকে তাকাল—“তোমার কি কথা বলা হয়ে গেছে?”

অনিল কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে উত্তর দিল—“হ্যাঁ। ব্যাঙ্ক ড্রাফট পেয়ে গেছে।”

দেবী ফোন নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। এখন বাবার নামে নালিশ শুরু হবে। যা প্রাণ চায় মাকে বলুক। অনিল তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। এটা বুঝে গেছে, দেবী এদেশেই থাকতে চায়? রাজাকে ও বুঝিয়ে-শুনিয়ে রেখেছে। শুধু জবা আর পাপুকে আনানোর জন্যে অনিলকে উদব্যস্ত করে তুলছিল। অনিল পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে দেড়-দু’বছরের আগে ওদের আনতে পারবে না।

শুনে দেবী গুম মেরে রইল। মেহরীনের কাছে কি বলেছে কে জানে? তারও কি সহানুভূতি! আশ্চর্য! মেহরীন কি অনিলের পরিস্থিতি জানে না? নাকি এই সুযোগে নিজে থেকে একটা বোঝাপড়া করতে চাইছে? কেন? জবাকে দয়া দেখানোর জন্যে তাহলে এত বছরের সম্পর্কের কোনও দাম নেই? ইদানীং কেমন যেন আলগা আলগা ব্যবহার করছে। অনিল আজও যেন মেহরীনকে বুঝে উঠতে পারল না।

পরদিন ভোরবেলা মেহরীনের ঘুম ভেঙে গেল। মাথা ভার, গলায় ছুঁচ ফোটার মতো চিনচিনে ব্যথা। নাইটির ওপর দিকটা ঘামে ভিজে গেছে। খানিক এপাশ-ওপাশ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। দু-তিনদিন ধরে জ্বর হচ্ছিল। এটা-ওটা ওষুধ খেয়ে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল। কাল থেকে একদম কাহিল অবস্থা। আজ আর দোকানে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। ক্লান্ত শরীরে মেহরীন রান্নাঘরে চা করতে ঢুকল। তখনই চোখে পড়ল বারান্দার কাচের দরজাটা খোলা। ফুলগাছের ছোট ছোট টবের পাশে দেবী টুল পেতে বসে আছে।   

—“এত সকালে উইঠা পড়ছো? আজ তো স্কুল নাই?”

—“না, আজ ছুটি। কাল থেকে সামার স্কুল। আপনি কেমন আছেন? এখনো জ্বর আছে?”

—“আছে বোধহয়। একটু রেস্ট দরকার। আজ আর স্টোরে যাব না।”

অনিল ম্যানহ্যাটনে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি করে। সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে গেল। দেবীকে, খানিকক্ষণ রাজাকে পড়ালো। কাল থেকে রাজারও সামার স্কুল আরম্ভ হবে। দেবী ওকে একটা ইংরিজি বই পড়তে দিয়ে বলে গেল—সারাক্ষণ টিভি দেখবি না। দুপুরে পল্-এর মা এসে তোদের পার্কে নিয়ে যাবে।”

—“তুই যাবি না?”

—“না। মেহরীন আন্টির জ্বর। আমি আজকে ডিনার বানাবো। তুই বইটা পড়ছিস না কেন? স্টোরিটা কিন্তু পুরো শুনতে চাইব। নয়তো, পার্কে খেলতে যেতে দেব না।”

দেবীর সামনে রাজা বই খুলে বসল। খানিক বাদে দেবীকে মেহরীনদের ঘরে যেতে দেখে আবার টিভি চালাল। 

প্রতিমা মনে মনে ভাবলেন ছেলেকে মানুষ করার ব্যাপারে তারা যে ব্যর্থ হয়েছেন, সে কথা জবা তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানাতে ছাড়ে না। ওসব কথায় না যাওয়াই ভাল। কিন্তু রাজা ফিরে আসতে চাইছে কেন? জবার মুখখানা ভার ভার। দেবী যে কি লিখেছে, তাও বুঝতে পারছেন না প্রতিমা। জবা পাপুকে বলল—“যা, ঠাকুমার সঙ্গে গিয়ে খেয়ে নে। তারপর ওষুধ দেবো।”

দেবী মেহরীনের সঙ্গে এদের শোবার ঘরে বসে কথা বলছিল। সারাদিনের পরে অল্প সময়ের জন্যে ওদের দেখা হয়। আলাদা করে কোনও কথাই হয় না। ছুটির দিনেও তাই। সোমবার মেহরীন বাড়ি থাকে। দেবী বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখে মেহরীন সারা সপ্তাহের রান্নাবান্না সেরে রাখছে। গাদা গাদা মাছ ভাজছে। চিকেন, গোটমিট-এর ঝোল বানাচ্ছে। দেবীও সাহায্য করে। কাজের ফাঁকে কথাবার্তা চলতে থাকে। মেহরীন ওদের পড়াশোনার খবর নেয়। কিন্তু তাড়াহুড়োর মধ্যে দেবী তার নিজের কোনও কথা বলার সুযোগ পায় না। অথচ তার মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। ইচ্ছেও করে না। দেবী বোঝে ওর মাকে এ বাড়িতে কেউ চায় না। অজানা আশঙ্কায় দেবীর বুক কেঁপে ওঠে। তাহলে কি মাকে এরা কোনওদিনও আমেরিকায় আনবে না? পাপুও বা কি করে আসবে? মার জন্যে, ছোট্ট বোনটার জন্যে সারাক্ষণ মন কেমন করে। মা আর কত কষ্ট করবে?  টেলারিং শপ থেকে ফেরার পথে বাজার করে আনতো। গরমের মধ্যে ঘুপটি রান্নাঘরে বসে, রান্না করে ওদের খেতে দিত। তখন দেবী একটা রুটি বেলে দিয়েও সাহায্য করেনি। আজ ভাবলে এত কান্না পায়। 

দেবী ভাবে মেহরীন আন্টিকে কয়েকটা কথা বলবে। মেয়েদের মন অনেক নরম হয়। যদি মেহরীন আন্টি বাবাকে একটু বোঝাতে পারে। 

ক্লান্ত শরীরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মেহরীন একটা ম্যাগাজিন দেখছিল। দেবী একটু ইতস্ততভাবে কথা শুরু করল—“আন্টি, কাল আমার মা ফোন করেছিল। আপনি তখন শুয়ে পড়েছেন।”

মেহরীন চশমার কাচের ভেতর দিয়ে চেয়ে আছে। কোনও কথা বলছে না। দেবীর ভয় হল। মেহরীন আন্টি কি প্রসঙ্গটা পছন্দ করছে না? বিরক্ত হচ্ছে? কিন্তু দেবী তো শুধু মার ফোনের কথা বলেছে। এতেও যদি মেহরীন আন্টি রেগে যায়, তবে আর বাকি কথাগুলো বলবে কী করে?

দেবী প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে ফেলছিল। 

—“কী কথা হল মায়ের সাথে? উনারা ভাল আছেন? তোমার বাবার ব্যাঙ্ক ড্রাফট্ পৌঁছায় নাই?”

দেবী মাথা নাড়ল—“ড্রাফট পেয়ে গেছে। মা সেজন্য ফোন করেনি। আমার বোনের খুব জ্বর। মা একা একা আর পারছে না। আমরাও চলে এলাম। আন্টি, মার জন্যে এত কষ্ট হয়…”

দেবী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রাজার সামনে নিজেকে শক্ত রাখে। বাবার মেজাজ দেখে মার কথা তুলতে ভয় পায়। দেড় বছর ধরে ঘরে বাইরে অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। শুধু একটাই আশা। এবার পাপুকে নিয়ে মা আসবে। কিন্তু সেখানেও যেন সন্দেহ জাগছে। দেবী কান্না জড়ানো গলায় বলছিল—“আন্টি, মা আর পাপুর প্লেনভাড়া কি অনেক বেশি? আপনিও দিতে পারবেন না?”

মেহরীন দেবীর পিঠে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে রইল। বিদেশ-বিভুঁইয়ে ছোট একটা মেয়ে ভেতরে ভেতরে কত দুঃখ চেপে রেখেছে। অনিল ওদের যাই বোঝাক, মেহরীন কিছুতেই মিথ্যে কথাগুলো মেনে নিতে পারে না। অশান্তির ভয়ে চুপ করে থাকে। অথচ দেবী আজ ওর কাছেই সাহায্য চাইছে। মেহরীন ওকে কিভাবে বোঝাবে? চোদ্দ বছর বয়সে এদেশের মেয়েরা জীবন সম্পর্কে যতখানি জানে, বোঝে, দেবীকে ঠিক সেরকম মনে হয় না। তবু ওর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সময় হয়েছে। মিথ্যে আশা দিয়ে অনিল আর কতদিন ভুলিয়ে রাখবে? অশান্তি হয় হোক, মেহরীন আজ দেবীকে সত্যি কথা বলবে। 

দেবীকে দু-এককথায় শান্ত করে মেহরীন ওদের সঙ্গে লাঞ্চ সেরে নিল। জ্বরের মুখে সবই বিস্বাদ লাগছে। যা হোক করে খাওয়া শেষ করল।

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons

আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com