নেড়ি শব্দটায় একটু আদর আর প্রশ্রয় মাখানো আছে। আদতে রাস্তার কুকুর, কিন্তু সেই শব্দবন্ধ যে ঘৃণ্যতায় প্রয়োগ করি আমরা, নেড়ির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। ক্লাস নাইনে ফাঁকা ক্লাস শাসন করতে এসে বর্ষীয়ান শিক্ষক যখন বিধ্বস্ত সেনানায়কের মতো হতাশ হয়ে পড়েন, তখন তিনি চিৎকার করে ওঠেন, “তোরা সব রাস্তার কুকুর।” অগত্যা কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হয়। কুকুররা কান ধরতে পারে কিনা এই অর্বাচীনের মতো প্রশ্নের উত্তরে বেত্রাঘাত জোটে।
অথবা, নব্বইয়ের দশক। টিভিতে, কোনও এক চ্যানেলে, প্রথিতযশা এক ভারতীয় মার্গসঙ্গীত গায়ককে প্রশ্ন– বাংলা ব্যান্ডের গান কেমন লাগে? তাঁর সাপাট তানের মতোই তাঁর জবাব– রাস্তার কুকুর চিৎকার করলে যেমন লাগে। এই দুই ঘটনাতেই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ‘নেড়ি’ শব্দটি কেউ ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ কঠোর মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশে ওই শব্দটি এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয়। এইরকম অজস্র উদাহরণ আছে – খেতে না পেয়ে রাস্তার কুকুরের মতো মরবি অথবা আমাকে ছেড়ে যদি ওর সঙ্গে ঘুরিস তাহলে পরের জন্মে রাস্তার কুকুর হয়ে জন্মাবি ইত্যাদি ইত্যাদি। রাস্তার কুকুর হয়ে যদি কেউ জন্মে থাকে, তাহলে তার উত্তরণ পাড়ার নেড়ি একথা হলফ করে বলা যায়।
একবার ‘নেড়ি’ হয়ে যেতে পারলে খাওয়া-পরার অভাব নেই, মরলেও একুশ তোপধ্বনি। রাস্তার কুকুর মা-বাবা নিশ্চয় তাদের সন্তানদের এভাবেই অনুপ্রাণিত করে। বড় হও, মানুষ হও, রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকে পড়। তবে নিজের এলাকার দখলদারি নিতে শিখতে হবে। অনুপ্রবেশের চেষ্টায় অন্য পাড়ার নেড়ি এলে তাকে পত্রপাঠ বিদায় দেওয়ার জন্যে গলার জোর চাই।
কুকুর ও নেড়ি, রাস্তা ও পাড়া, এই আপাত সরল এবং স্থিতিশীল আর্থসামাজিক অবস্থান কিঞ্চিৎ নড়বড়ে হয়ে পড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো আপ্যার্টমেন্ট কমপ্লেক্স গজিয়ে ওঠার পর। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। কমপ্লেক্স তৈরি হওয়ার সময় সদরে আগল থাকে না। সেই সময় বেশ কিছু রাস্তার কুকুর, যারা নেড়ি হওয়ার আশায় এপাড়া-ওপাড়া ছুটে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু প্রবল পরাক্রমী সিনিয়র নেড়িদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না, তারা একপ্রকার নিরুপায় হয়েই এবং কেউ কেউ অজানাকে জানার উদগ্র বাসনায় ওই নির্মীয়মাণ কমপ্লেক্সগুলিতে প্রবেশ করে। এবং অবাক হয়ে দেখে এই ঘেরাটোপে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকটি বেড়ালমাত্র! সুতরাং সমস্যার সমাধান হয়। ধীরে ধীরে চোখের সামনে ঝাঁ চকচকে ইমারত দাঁড়িয়ে ওঠে। রাস্তায় সব দোকান-বাড়িই ছাইরঙা মনে হত যে নেড়ির, সে এদিক সেদিক কিছু নীল মানুষ আর হলুদ পাখি দেখতে পায়। কমপ্লেক্সের সুলতানি ফটক তৈরি হয়ে গেলে তাদের রাস্তায় ফেরার পথও বন্ধ হয়।
আরও পড়ুন: দ্যুতিমান ভট্টাচার্যের কলমে: ইফ আ ডগ লাইকস ম্যান
সত্যি বলতে কি, তারা যেতেও চায় না, কারণ নিশ্চিন্ত ঘুম আর তিনবেলা খাওয়া। এর ফলে অবিশ্যি একটি জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। রাস্তার কুকুরদের ছানাপোনারা বড় হয়ে আর পাড়ার নেড়ি হতে চায় না, তারা কমপ্লেক্সের নেড়ি হতে চায়। পোলাও-কালিয়ার কারণে শুধু নয়, ওদের নামগুলোও কেমন স্মার্ট। পাড়ার নেড়ির নাম কেলো-ভুলোর মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। কেলো-ভুলো বাবা-মা হলে তাদের ছেলে বা মেয়ের নামও হয় কেলো বা ভুলো। তখন তারা কেলোর বাবা কিংবা ভুলোর মা হিসেবে পরিচিতি পায়। এ তো দস্তুরমত আইডেন্টিটি ক্রাইসিস! অন্যদিকে কমপ্লেক্সের নেড়িরা সবাই অসাধারণ– কুকি, স্কচি, স্পটি ইত্যাদি। সেখানে নিয়মিত নির্বীজকরণ হয়, তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। সুতরাং খাদ্যসমস্যাও নেই। আর বিলুপ্তির ভয়ে ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই।
এই তো সেদিন নিখিল বঙ্গ রেসিডেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটির প্রেসিডেন্ট বললেন, যে নেড়িরাই তাঁদের সুরক্ষাবলয়। যদিও প্রচুর খরচ করে হাই-টেক সিকিউরিটি সংস্থাকে মোতায়েন করা হয়েছে, যত্রতত্র ডাণ্ডা পুঁতে তার মাথায় লাগানো হয়েছে তিনশো ষাট ডিগ্রি ক্যামেরা, তবু ওই নেড়ি না থাকলে কি ধরা পড়ত পিঙ্কির সাইকেল চোর? একবার গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলে কোন ভিডিওতে চেনা যেত তাকে? মুখে মাস্ক থাকলে ক্যামেরা অসহায়। ভাগ্যিস পিঙ্কি বিস্কুট খাওয়ায় স্পটিকে রোজ, সকালে বারান্দা থেকে ছুড়ে এবং বিকেলে সাইকেল চালানোর সময়ে নিজে হাতে। সুতরাং বিলুপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হলেই কমপ্লেক্সের গেট খুলে উদীয়মান কিছু রাস্তার কুকুর বা পাড়ার নেড়িকে কমপ্লেক্সে পাকাপাকি থাকার আহ্বান জানানো হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা বা শীত তারা নিশ্চিন্তে গড়িয়ে নেয়।

তবে রাজনীতি একটা আছে। রাজপাট যদিও সরকারি মতে অনেকদিন আগেই লোপ পেয়েছে, তবুও আছে। রাজনীতি ছাড়া প্রজাদের, থুড়ি নেড়িদের ভাত-মাংস হজম হয় না। বিশেষ করে সামাজিক কাঠামোয় যখন একটি নতুন, তথাকথিত উন্নত শ্রেণী আবির্ভূত হয়। মনুষ্যকুল এই শ্রেণিসংগ্রাম প্রতি দিন-রাত মালুম পায়। কমপ্লেক্সের ভিতর, এক ব্লক থেকে অন্য ব্লক নেড়িদের সংগঠনের রং পাল্টায়। সন্ধ্যে হলেই তারা একে অপরের দিকে ধেয়ে আসে, গণ্ডি কেটে নেয়। মাঝে মাঝে সারজিকাল স্ট্রাইক, নিজের এলাকা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এক ব্লকের বাসিন্দারা সান্ধ্যহন্টনের সময় অন্য ব্লকের সামনে পৌঁছলে, বিশেষ করে তাঁদের সঙ্গে যদি পোষ্য থাকে, নেড়িরা চেঁচিয়ে ওঠে। ওঁরা বলেন, “অসভ্য”। আবার এই বাসিন্দারাই নিজেদের ব্লকের নেড়িদের গলা জড়িয়ে “তুতুতুতু” করেন।
মানুষের মন বড় বিচিত্র। রাত বাড়লে পাশের পাড়ার নেড়িরা গালাগাল দিতে আরম্ভ করে। যেহেতু ঢিল পাটকেল ছুঁড়তে পারে না, তাই তারস্বরে চেঁচায়। তখন কমপ্লেক্সের সব ব্লকের নেড়িরা এককাট্টা। শীতকালে ভোররাত অবধি চলে এই বুক্কন সিম্ফনি। পাবলিক তার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হয় সাহেবদের। সুদূর জার্মানি থেকে যে ছেলেটি এসেছে কলকাতা দর্শনে, সে প্রথম রাতে জেট ল্যাগের কল্যাণে কিছু ঠাহর করতে পারে না। কিন্তু পরের রাত থেকেই পাবলো নেড়িদার কবিতা পাঠ চলে তার জানলার নীচে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ লাল, “দ্য ডগস অয়্যার হাউলিং”, তার অনুযোগ।
চলমান অশরীরী মিঃ ওয়াকারের ছদ্মবেশে বলে ওঠেন, ওরা কুকুর নয় নেকড়ে। সাহেব আরও ভেঙে পড়েন যখন শোনেন পরিবারের আর কোনও সদস্যেরই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি। তাঁকে একজোড়া ইয়ার প্লাগ উপহার দেওয়া হয়। আলোচনা হয়, তাঁকে নিয়ে শান্তিনিকেতন চলে যাওয়া হবে কিনা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাতিল হয় ওই নেড়ি সংক্রান্ত জটিলতার কারণেই।

বঙ্গদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত পাড়া বোধহয় গোয়ালপাড়া। কারণ ওই স্থান শান্তিনিকেতনের কাছেই এবং কবিগুরুর পদধূলি-ধন্য। স্থানের নাম এক থাকলেও, কাল ও পাত্র পাল্টেছে। বেড়েছে ধূলি এবং পদের সংখ্যা। শহর নেমে এসেছে কোপাইয়ের জলে, সর্ষের ক্ষেতে। শোনা গেল, নেড়িদেরও বংশবৃদ্ধি ঘটেছে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে, সমানুপাতে। তারা বিস্কুট খেতে চায় না আর। মোড়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কচুরি আর জিলিপির অপেক্ষায় ল্যাজ নাড়ায়। গুরুদেব যে সময় আশ্রম স্থাপন করেন, তখন যেক’টি নেড়ি ছিল আর আজ যতগুলি হয়েছে, এই সংখ্যাতত্ত্ব জাতি হিসেবে আমাদের সার্বিক মূল্যায়নের একটি মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ একথা জানি। নেড়ির ব্যাপারে কোন নিদান নেই।
সত্তরের দশকের শেষ দিক। টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এক নিমেষে নেড়ি থেকে রাস্তার কুকুর হয়ে গেল একটি জীব। তাকে পাগল প্রতিপন্ন করে থান ইট ছুড়তে থাকে পাড়ার মাতব্বরেরা। সেই নেড়িকে, যে কয়েকদিন আগেও সারারাত টহল দিয়েছে পাড়ার এ মাথা থেকে অন্য মাথা। দোষের মধ্যে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল অজ্ঞাত কারণে, তার ল্যাজ গুটিয়ে ঢুকে গিয়েছিল পিছনের দু’পায়ের ফাঁকে। দু’দিন ধরে সে চুপ করে বসেছিল পাড়ার জলের কলের পাশে, উঁচু জমিতে। কর্পোরেশনে খবর দেওয়া অনেক ঝক্কি, তাই থান ইট। বছর দশেকের একটি ছোট ছেলের স্মৃতিতে আঁকা হল একটি গণহত্যা, যার বিচারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না সেই যুগে।

একটা নেড়ির মতো, সংবেদনশীল মানুষের জীবনও কত ঠুনকো সেই উপলব্ধি হল, ওই ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর পর। নেড়িপ্রেমী, অবসরপ্রাপ্ত এক আর্মি অফিসার তাঁর বৈঠকখানায় চা পান করছিলেন পরিবারের সঙ্গে। তখন বিকেল। কলিং বেল বাজলে দরজা খুলে দেখলেন সিকিউরিটি গার্ড, একটু ঘাবড়ে আছে। জানা গেল, পুর-কর্তৃপক্ষ এসেছেন জাল লাগানো ভ্যান নিয়ে। তাঁরা কমপ্লেক্সের সব নেড়িদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাবেন। ভদ্রলোক চমকে গেলেন, পরক্ষণেই এক দৌড়ে সিঁড়ির মুখে। প্রায় লাফিয়ে নামলেন। লবিতে পৌঁছেছেন, হয়তো জল পড়েছিল, টাল সামলাতে পারলেন না। মার্বেল বাঁধানো মেঝেয় ঠুকে গেল তাঁর মাথা। আর উঠলেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় সিকিউরিটি গার্ডরা স্তম্ভিত। কর্তৃপক্ষও। তাঁরা ভ্যান নিয়ে চলে গেলেন। দরজার বাইরে কয়েকটি নেড়ি জড়ো হল প্রথমে, তারপর আরও কয়েকজন মানুষ।
*লেখার ভিতরের ছবি: লাবণী বর্মণ
অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।
One Response
bhalo laglo.