Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ফিরিওয়ালার গল্প

আলপনা ঘোষ

নভেম্বর ৯, ২০২২

street peddler
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

“দই চাই গো, দই চাই, শ্যামলী আমার গাই, তুলনা তাহার নাই”। বা “ওগো, তোমরা যত পাড়ার মেয়ে/ এসো, এসো, দেখো চেয়ে-/ এনেছি কাঁকনজোড়া সোনালি তারে মোড়া”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে ঐ দুই ফিরিওয়ালার উল্লেখ করে ক্ষান্ত হননি, বারবারই তাঁর গল্প,উপন্যাস, কবিতায় তাদের কথা লিখেছেন। যেমন তাঁর ‘ডাকঘর’ নাটকের চরিত্রগুলির মধ্যেও দইওয়ালাকে পাই, যার কাছ থেকে ঘরবন্দী অসুস্থ কিশোর অমল “দই-দই-ভালো দই” ডাকের সুর শিখে নিতে চেয়েছিল। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে এক স্নেহময় পিতার রূপে কাবুলিওয়ালা রহমতকে পাই যে সুদূর আফগানিস্থান থেকে শহর কলকাতায় কিসমিস, পেস্তা বাদাম ইত্যাদি বেচতে এসে তার পরিচয় হয়েছিল কন্যাসম ছোট্ট মিনির সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিচিত্র সাধ’ কবিতাতে লিখেছিলেন, “আমি যখন পাঠশালাতে যাই/আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে,/দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই/ফেরিওয়ালা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে।/‘চুড়ি চা-ই, চুড়ি চাই’ সে হাঁকে,/চিনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে”…। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর লেখাতে ফিরিওয়ালার প্রসঙ্গ এনে ঐ সময়কার ফিরিওয়ালাদের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন।

পৃথিবীর খাদ্যের ইতিহাসের পাতা ওলটালে জানা যাবে সেই খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-এরও আগে মেসোপটেমিয়ার রাস্তায় ঠেলাগাড়িতে মাছভাজা ফিরি হত যা লোকজন রাস্তায়  দাঁড়িয়ে খেত কিংবা বাড়িতে কিনে নিয়ে যেত। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয় তাঁর ‘মাছ আর বাঙালি’ বইতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। বাঙালির মৎস্যপ্রীতির কথা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, যে বাঙালি ‘মৎস্যান্ধ এমনি অন্ধ, অচেতনে সচেতন মানে’। এই সামান্য লেখিকাও জন্মসূত্রে শুধু যে বাঙালি তাই নয়, খাদ্যাভাসেও মৎস্যপ্রেমের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নন। তাই ফিরিওয়ালা প্রসঙ্গে মৎস্য কথা যদি এসে যায়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।     

সেকালে পথেঘাটে মেছুনিরা বাড়ি বাড়ি মাছ ফিরি করে বেড়াত। ঊনবিংশ শতকের খাদ্যরসিক কবি ঈশ্বরগুপ্ত লিখেছেন, নেটা, বেলে, গুড়গুড়ি প্রভৃতি মাছ এক ঝুড়ি তিনি এক আনা পনে মেছুনিদের কাছ থেকে  কিনে আনতেন। ‘হুতোমপ্যাঁচার নকশা’-তে হুতোম মেছুনি প্রসঙ্গে লিখলেন, শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙা বাজারের মেছুনিরা  প্রদীপ হাতে করে “ও গামচা-কাঁদে, ভালো মাচ নিবি? ও খ্যাংড়া-গুঁপো মিন্‌সে চার  আনা দিবি”- ইত্যাদি মিষ্ট ভাষণ প্রয়োগ ক’রে ক্রেতাদের ডেকে নিতেন। বিক্রি করতেন “পচা মাচ আর লোনা ইলিশ”। সন্ধ্যের সময়ে মেছুনি দের ডাকের এমনই চমৎকার এক বর্ণনা  দিয়েছেন হুতোম।  

চার পাঁচ দশক আগেও এই কলকাতায় বর্ষার দিনে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে হাওয়ায় ভেসে আসত ইলিশমাছ  ভাজার গন্ধ। সন্ধ্যের মুখে পাড়ায় পাড়ায় মাছওয়ালা ডাক দিয়ে যেত “ইলিশ চাই ইলিশ- গঙ্গার ইলিশ”। ইলিশের আজকের এই আকালের দিনে এ সব স্বপ্নকথা বলে মনে হলেও, এটাই ছিল কিন্তু সেকালের বাস্তব চিত্র।  

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রসঙ্গীতের আমির খাঁ

এদেশে ফিরিওয়ালা প্রসঙ্গে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা রাই বিনোদিনী শ্রীরাধার কথা মনে করেছেন যিনি মাথায় মাটির হাঁড়ি বসিয়ে দুধ, ক্ষীর, ননীর পসরা নিয়ে বৃন্দাবনের পথে পথে ফিরি করে বেড়াতেন। যোড়শ শতকে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গলে ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’তে প্রাণধারণের জন্য ফুল্লরা কীভাবে মাংস ফিরি করে দিন গুজরান করতেন তার উল্লেখ মেলে। “ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল/নদনদী একাকার আট দিকে জল।/মাংসের পশরা লৈয়া ফিরি ঘরে ঘরে/অনলে পুড়এ অঙ্গ  ভিতরে বাহিরে”। 

হুতোম তাঁর নকশায় মেছুনি বাদে অন্য ফিরিওয়ালাদের কথাও লিখেছেন। রাস্তার বাতিগুলি সন্ধ্যের মুখে জ্বলে উঠলে,  বেলফুলের মালা হাতে ঝুলিয়ে ‘বেলফুল’ ডাক দিয়ে ফুলের মালা বেচতে আসতেন ফুলওয়ালি, ফুলওয়ালারা। বরফমালাই নিয়ে হেঁকে যাওয়া ফিরিওয়ালারও বর্ণনা পাই তাঁর লেখায়। তিনি এক জায়গায় আবার লিখেছেন, গ্রীষ্মের দুপুরে সূর্যের তাপে “ফিরিওয়ালারা  ক্রমে ঘরে ফিরে যাচ্ছে, রিপুকর্ম ও পরামানিকরা অনেকক্ষণ  হোল  ফিরেচে”। এর পাশাপাশি হুতোম আলু পটোল সব্জিওয়ালারও উল্লেখ করেছেন! ‘হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা’র পাতায় পাতায় কত বিচিত্র সব ফিরিওয়ালার কথা আর তাদের বিচিত্র সব ডাকের বর্ণনা পাই। যেমন আছে ‘ঘি চাই, ঘোল চাই, মাখন চাই, ভয়সা দই চাই’ ডাক। আছে তামাকওয়ালা, মালাইদইওয়ালাদের কথা। আছে ওদের কড়ি ও পয়সা “গুন্তে  গুন্তে” ঘরে ফিরে যাওয়ার বর্ণনা। “এখোন কেবল মধ্যে মধ্যে পাণিফল, কাগোজ বদল, পেয়ালা পিরিচ, বিলাতী খেলেনা, বা  ‘বরতন চাই’ ফিরিওয়ালাদের ডাক শোনা যাচ্ছে”।  

Company art Sophie Charlotte Belnos
সোফি শার্লট বেলনস এর আঁকা বাঁদরওয়ালা।

‘রসরাজ’ অমৃতলাল বসুর স্মৃতি ও আত্মস্মৃতি’ তে তিনি সেকালের কুয়োর ঘটি তোলার কথা লিখেছেন।  “কম্বুলেটোলায় রাস্তার আসল ডাক শুরু হত কু-উ-উ- উ-ও-ও-ওর- ঘ-টি–তো-ও-ও-লা দিয়ে”। এই ডাক কানে গেলেই  লোকজনেরা বুঝে যেতেন যে ভোর হয়ে এসেছে। সেযুগে গৃহস্থের বাড়িতে একাধিক কুয়ো থাকত। শুধু ঘটি নয়, কুয়োর জলে মেয়েদের আঁচলে বাঁধা চাবির রিং, ছোট ছেলেদের খেলনা ইত্যাদিও অনেক সময় পড়ে যেত, তাই কুয়োর  ঘটিতোলার ডাক ছিল গৃহস্থের মুশকিল আসান। আরও অনেক রকমের ফিরিওয়ালার উল্লেখ করেছেন লেখক, যেমন ভরদুপুরে দইওয়ালারা প্রকাণ্ড ধামা মাথায় ‘চাই শুখা দই’ হেঁকে যেত। “তারা এক পয়সায় এক মালসী দই দিত। মালসাঁ উপুড় করে দেখাত যে দই ভূমে পড়ে না”।

অমৃতলাল বসু পরবর্তীকালে ধোপদুরস্ত কাপড়, পরিষ্কার মেরজাই এবং জরি বসানো টুপি পরা দেশলাইওয়ালাদের কথা লিখেছেন। ওরা নাকি ‘লে দেশ্লাই’ হাঁক দিয়ে যেত। এখন ভাবলে অবাক লাগে যে এরা তখন অন্য জিনিসপত্রের মতো দেশলাইও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত।      

সেকালে বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে শখ করে দাঁতে মিশি দেওয়ার চল ছিল। “মিশি লিবে গো” ডাক দিয়ে ফিরি করে বেড়াতেন মিশিওয়ালিরা। এবাদে মুসলমান ফিরিওয়ালারা বিক্রি করতে আসত নানা রঙের বেলোয়ারি চুড়ি, সুগন্ধি সাবান, কাচের পুতুল ইত্যাদি।

রাস্তায় রাস্তায় জিনিস ফিরি করা কবে এদেশে শুরু হয়েছিল, সে কথা স্থির করে বলা না গেলেও সেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির যুগে সাহেব মেমদের কাছে কত  রকমের ফিরিওয়ালা আসত তাদের কথা জানা যায়, বিদেশি সব চিত্রকর শিল্পীর ছবিতে। এরকমই একজন ফরাসি চিত্রশিল্পী ছিলেন সোফি শার্লট বেলনস। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’ বইতে এই শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছেন। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল বেলনসের ‘হিন্দু অ্যাণ্ড ইউরোপিয়ান ম্যানার্স ইন বেঙ্গল‘ বইটি, যেখানে কলকাতার ফিরিওয়ালাদের ছবি ও বর্ণনা আছে। এই সব ছবি থেকে বোঝা যায় সে যুগে বড় বাক্সের মধ্যে আসল ঝুটা মণিমুক্তা, বিলিতি ও ফরাসি সাটিন, সিল্ক, মসলিন ইত্যাদি নানা ধরনের শৌখিন এবং গেরস্থালি জিনিসপত্র তিন-চারজন মুটের মাথায় চাপিয়ে  ফিরিওয়ালারা সাহেবটোলার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফিরি করত। মাদাম বেলনস তাঁর বইতে লিখেছেন যে ফিরিওয়ালাদের পরনে থাকত মসলিনের জামাকাপড় আর মাথায় পাগড়ি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তারা ডাক দিত-  “ফাইন রিবিন গট মেম (ম্যাদাম), সাটিন গট, মুসলিন গট, লিনো, সিল্কো এসটোকিং (স্টকিং), গ্লোবস (গ্লাভস), প্লেনটি ফাইন, ফাইন টিংগস্‌ মেম, ওয়ানটো এনি টিংগস্‌ মেম”। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত আরও জানিয়েছেন যে মাদাম বেলনসের এই দুষ্প্রাপ্য বইটি ১৯৭৯তে ঋদ্ধি-ইণ্ডিয়া অধ্যাপক নিশীথরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন। এই সব ফিরিওয়ালাদের মধ্যে ছিল কাপড়ওয়ালারাও যারা ঢাকাই মসলিন, নয়নসুখ প্রভৃতি ‘মহার্ঘ বস্ত্র’ ইত্যাদি সাহেব মেমদের বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত।

এদেশে ফিরিওয়ালা প্রসঙ্গে  রাধাপ্রসাদ গুপ্ত কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা রাই বিনোদিনী শ্রীরাধার কথা মনে করেছেন যিনি মাথায় মাটির হাঁড়ি বসিয়ে দুধ, ক্ষীর, ননীর পসরা নিয়ে বৃন্দাবনের পথে পথে ফিরি করে বেড়াতেন। যোড়শ শতকে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গলে ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’তে প্রাণধারণের জন্য ফুল্লরা কীভাবে মাংস ফিরি করে দিন গুজরান করতেন তার উল্লেখ মেলে। “ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল/নদনদী একাকার আট দিকে জল।/ মাংসের পশরা লৈয়া ফিরি ঘরে ঘরে/অনলে পুড়এ অঙ্গ ভিতরে বাহিরে”।

আমাদের ছোটবেলায় সেই পঞ্চাশের দশকে মনে পড়ে বিচিত্র পোষাক পরা, সাদা টুপি মাথায়, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ঝমঝম আওয়াজ তুলে ‘হরিদাসের বুলবুল ভাজা/খেতে ভারী মজাই মজা…’ গাইতে গাইতে আসত একজন, যার ঝোলার মধ্যে থাকত সেই অতি লোভনীয় বুলবুল ভাজা অনেকে যার নাম দিয়েছিলেন ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। তেকোনা কাগজের মোড়কে ভরে সেই সাড়ে বত্রিশ ভাজা সে বেচত তার ক্ষুদে, বুড়ো ক্রেতাদের কাছে। তার গানের কলি ও সুর ছিল সেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মোহনীয় বাঁশির সুরের মতো যা কানে পৌঁছুলেই পাড়ার কচি কাঁচারা ছুটে আসত। যতদূর মনে পড়ে, চানাচুরের মতো ঝাল ঝাল স্বাদ ছিল সেই ‘বুলবুল ভাজা’র। 

কাঁধে লম্বা থলে ঝুলিয়ে আসত মুসলমান পুরনো খবরের কাগজ বিক্রিওয়ালারা যারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরনো খবরের কাগজের সঙ্গে পুরনো শিশি বোতল, বাড়ির অব্যবহৃত বিকল হয়ে যাওয়া ঘড়ি, পুরনো  মাসিক পত্রিকা ইত্যাদি সের-দরে কিনে নিত। মনে পড়ে বাংলা কাগজ, ইংরেজি কাগজ মায়েরা আলাদা করে রাখতেন। এর কারণ বোধ হয় সে সময়ে ইংরেজি কাগজের দাম ছিল বাংলা কাগজের থেকে কয়েক পয়সা বেশি। এক্ষেত্রে অবশ্য বাড়ির গিন্নিরা ছিলেন বিক্রেতা আর অন্য পক্ষ ছিলেন ক্রেতা। এগুলি বেচে যা টাকা পয়সা পেতেন ওঁরা, তা ছিল ওঁদের একান্ত নিজের। এই সব পয়সা জমিয়ে তাঁরা নিজেদের শখের জিনিসপত্র  কিনতেন, গৃহকর্তার কাছে হাত পাততে হত না।  আমাদের বাড়িতে দেখেছি একজন বাঁধা কাগজওয়ালা আসত,যার নাম ছিল করিম।  মা আমাদের শিখিয়েছিলেন তাকে ‘চাচা’ বলে ডাকতে।  করিম চাচা সুর করে ‘পু-রা-না-কা—আ—গ-অ-জ, শি—শি-বো-ত—ল বলে ডাক পাড়লেই, আমরা ছোটরা তাঁকে হাত ধরে টেনে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসতাম। এখনও আমাদের আবাসনে আসে এক তরুণ মুসলমান খবরের কাগজওয়ালা যাকে দেখলে আমার করিমচাচার কথা মনে পড়ে যায়। তফাত শুধু এই যে তার মুখে অতি পরিচিত সেই ডাকটি শোনা যায় না।   

এই শহরে সবে মেয়েরা তখন স্টেনলেস স্টিল বাসনের ব্যবহার শুরু করেছেন। রাজস্থানি মেয়েরা  আসত পুরনো কাপড়ের বদলে নতুন বাসন বেচতে। রংচঙে ঘাগড়া থাকত তাদের পরনে। ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে তার উপরে  বেতের চুপড়ি ভরতি ঝকঝকে নানা মাপের, নানা ডিজাইনের বাসন নিয়ে বাসনওয়ালিরা হাঁক দিত “বাসন লিবে, বা-আ-আ-স-অ-অ-ন”। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলা তাদের কথা ভারী মিষ্টি লাগত সবার কানে। এর সঙ্গে গৃহস্থবাড়ির মেয়েবৌদের কাছে ঝকঝকে সে সব বাসনের আকর্ষণ তো ছিলই। তাঁরা পুঁটুলি করে পুরনো কাপড় গুছিয়ে রেখে বাসনওয়ালিদের ডাকের অপেক্ষায় বসে থাকতেন। প্রচুর দরদস্তুর চলত দু’পক্ষের মধ্যে। যেদিন আমার মা কম কাপড় দিয়ে বেশি বাসন রাখতে পারতেন সেদিন তাঁর আনন্দ দেখে কে! 

কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে কারিগরেরা শহরে এসে ফিরি করত। আমাদের বাড়ির বসবার ঘরের কাচের আলমারিতে শোভা পেত সেসব মাটির তৈরি আতা ফল, আম, কলা, বর-বৌ, রাম-রাবণ ও গণেশ মূর্তি।

গৃহস্থের কাজে আসত ‘শিল-কা-টা-বে গো’ ডাক দিয়ে আসা ফিরিওয়ালারা। মধ্যবিত্ত বাঙালির হেঁশেলে তখন মিক্সির  তেমন চল ছিল না, শিলনোড়াই ছিল তাঁদের একমাত্র ভরসা। অতি ব্যবহারে শিল মসৃণ হয়ে গেলে গোটা শুকনো লঙ্কা, হলুদ,  জিরে, ধনে বাটতে  শিলকাটাওয়ালারাদের শরণাপন্ন হতে হত। ছেনি- বাটালি ছোট পুঁটুলিতে নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াত গৃহস্থের দোরে দোরে। মাটিতে বসে শিল খোদাই করে দিত ওরা। তবে রান্নাতে গুঁড়ো মশলা ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভোজনরসিক বাঙালি সম্প্রদায়ের একটি অংশ এযুগেও সাবেকি প্রথা মেনে শিলনোড়াতে মশলা বেটে রান্না করাতে বিশ্বাসী। আজও তাই শহরের বহুতল আবাসনগুলিতেও কখনও সখনও শিলকাটাওয়ালাদের দেখা মেলে।

company art by Balthazar Solvyns
ফ্রাঁসোয়া বালথাজার সলভিনস-এর আঁকা দুধ-দইওয়ালা।

গ্রীষ্মকালে আমার মা, পিসিরা সন্ধ্যের সময়ে ছাদে মাদুর পেতে বসে গল্প করতেন। সেই আড্ডায় প্রতিবেশী গিন্নিরাও যোগ দিতেন। সন্ধ্যের মুখে পাড়ায় বেলফুলের মালা নিয়ে ‘চাই বেলফুল’ হাঁক দিয়ে আসত ফুলওয়ালা। সেই ডাক কানে গেলেই পিসিরা দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসতেন। দু-তিন পয়সা দামের সেই মালা কিনতেন। এখনও মনে পড়ে পেতলের রেকাবিতে রাখা বেলফুলের মালার সুবাসে মায়েদের ছাদের আড্ডা হয়ে উঠত আমোদিত। আর যেদিন  কুলফিওয়ালার দেখা মিলত, সেদিন আমাদের ভারী আনন্দ হত। লাল শালুতে ঢাকা মস্ত মাটির হাঁড়ি মাথায় নিয়ে “কুলফি চাই” হাঁক দিয়ে সে কুলফি ফিরি করে বেড়াত। এখনও মনে পড়ে সে হাঁড়ির মধ্যে থেকে কুলফির টিন বের করে, তাকে দুহাতে চেপে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিভাবে কলাপাতায় উপর কুলফি বের করে দিত সে। মায়েদের সান্ধ্য আড্ডাও সেদিন জমে উঠত কুলফি আর বেলফুলের মালার যুগলবন্দীতে। আমরা ছোটরাও খুশি থাকতাম কারণ আমরাও সেই কুলফির ভাগ থেকে বঞ্চিত হতাম না।

“আলতা পরবে গো” হাঁক দিয়ে যেত নাপিতবৌ। আমাদের বাড়িতে এরকম একজন নিয়মিত আসতেন মা, পিসিদের আলতা পরাতে যাকে আমরা ছোটরা ডাকতাম ‘আলতাদিদি’ বলে। শুধু আলতা পরানো নয়, নরুন দিয়ে নখ কেটে, ঝামা দিয়ে পা ঘসে পরিস্কার করে তবে আলতা পরাতেন তিনি। তার আগে গা-সওয়া গরম জলে পায়ের পাতা ডুবিয়ে খানিকক্ষণ বসতে হত মায়েদের। একটি হাতবাক্সের মতো ছোট বাক্স থাকত ওর সঙ্গে যার মধ্যে নরুন, ঝামা, আলতা ইত্যাদি সরঞ্জাম রাখা থাকত। তবে ‘আলতাদিদির আনা আলতা অবশ্য মায়েরা ব্যবহার করতেন না। ওঁদের পছন্দ ছিল জবাকুসুম কোম্পানির আলতা যা আগে থেকে কেনা থাকত আর সেই আলতাই পরতেন ওঁরা।

আমাদের স্কুলে পড়বার দিনগুলিতে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত নানা মুখরোচক সব টুকিটাকি খাবার নিয়ে ফিরিওয়ালারা। ছুটি হলেই আমরা পছন্দমতো খাবার কিনে খেতাম, দুচার পয়সা যা থাকত আমাদের কাছে তা দিয়ে। কাচের বাক্সে করে গোলাপি রঙের ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ আনত এক ফিরিওয়ালা যা ছিল আমাদের সকলের কাছে সব চাইতে প্রিয়। কাঠির মাথায় লাগানো ফোলানো বলের মতো চটচটে মিষ্টি  স্বাদের জিনিসটা মুখে দিলেই গলে যেত। আর একজন ফিরিওয়ালা আসত ঝালমুড়ি নিয়ে। আরও কত রকমারি মুখরোচক খাবার যে থাকত ওদের কাছে! কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব তা ঠিক করা ছিল কঠিন ব্যাপার। 

গৃহস্থের কাজে আসত ‘শিল-কা-টা-বে গো’ ডাক দিয়ে আসা ফিরিওয়ালারা। মধ্যবিত্ত বাঙালির  হেঁশেলে তখন মিক্সির তেমন চল ছিল না, শিলনোড়াই ছিল তাঁদের একমাত্র ভরসা। অতি ব্যবহারে শিল মসৃণ হয়ে গেলে গোটা শুকনো লঙ্কা, হলুদ,  জিরে, ধনে বাটতে  শিলকাটাওয়ালারাদের শরণাপন্ন হতে হত। ছেনি- বাটালি ছোট পুঁটুলিতে নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াত গৃহস্থের দোরে দোরে। মাটিতে বসে শিল খোদাই করে দিত ওরা।তবে রান্নাতে গুঁড়ো মশলা ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভোজনরসিক বাঙালি সম্প্রদায়ের একটি অংশ এযুগেও সাবেকি প্রথা মেনে শিলনোড়াতে মশলা বেটে রান্না করাতে বিশ্বাসী। আজও তাই শহরের বহুতল আবাসনগুলিতেও কখনও সখনও শিলকাটাওয়ালাদের দেখা মেলে।

পুরনো কালিঘাটের পটে আমরা দেখেছি এক বঙ্গবালা মেঝেতে বসে আঁশবঁটিতে মস্ত মাপের একটি আস্ত মাছ কুটছেন। মাছ কুটবার জন্য থাকত চওড়া চোখ আঁকা মস্ত আঁশ বঁটি। সুলেখিকা কল্যাণী দত্ত তাঁর ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইতে এই বঁটির উল্লেখ করেছেন। বঁটির শান  ভোঁতা হয়ে গেলে আমাদের মা-খুড়িমাদের দেখেছি ‘শানওয়ালা’র শরণাপন্ন হতে।  পরবর্তী কালে আমিও ছুরি, কাঁচিতে শান দিতে ওদেরই ডেকে নিতাম। গত শতকের আট-নয়ের দশক পর্যন্ত  কলকাতার পথেঘাটে দু’চাকার সাইকেলে লাগানো মস্ত চাকা নিয়ে ‘বঁটি-দাঁ-ছুরি-কাঁচি শান’ ডাক দিয়ে  ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য ছিল যথেষ্ট পরিচিত। এখনও মাঝেসাঝে ওদের দেখা মেলে যদিও মিক্সি, ব্লেণ্ডার ও গ্রেটারের যুগে ওদের প্রয়োজনীয়তা বেশ খানিকটা কমে গেছে। 

সময়টা পাঁচের দশক। আমাদের বাস ছিল দক্ষিণ কলকাতার আনোয়ার শাহ রোডের এক ভাড়া বাড়িতে। আমার ঠাকুরদার পছন্দের জায়গা ছিল ওই বাড়ির গ্যারেজ ঘরটি যেটি গাড়ি না থাকায় খালি পড়েছিল। ওখানেই দাদু পড়াশুনো করতেন, আর বাকি সময়টা কাটাতেন তাঁর দুই ছোট নাতনি আমার আর দিদির সঙ্গে ‘বাঘবন্দি’ খেলে, গান করে, দেশবিদেশের গল্প শুনিয়ে। শীতের দুপুরে রাস্তা দিয়ে কত ফিরিওয়ালার যাতায়াত ছিল আর ছিল তাদের কত বিচিত্র সব ডাক! তবে অনেক সময়েই সেসব ডাকের মাহাত্ম্য বুঝতাম না। বুঝতাম না তারা কোন পসরার কথা বলে ক্রেতাদের ডাকছেন। দাদুই আমাদের চেনাতেন সেসব ডাক, শোনাতেন তার ইতিহাস, গল্প! এমনই এক ডাক ছিল ‘ধুনুরি’ওয়ালার। শীত পড়ার মুখে সে আসত ধোনাই যন্ত্র নিয়ে। সরু বাঁশের তৈরি একটা ঝাঁ ঝকঝকে লাঠি থাকত তার সঙ্গে যার থেকে ঝুলত লাল শালুতে মোড়া এক মস্ত নতুন তুলো ভর্তি পুঁটুলি। মা-ঠাকুমারা তাদের ডেকে নিতেন। আমাদের বাড়ির ছাদে বসে ধুনুরি টং টং আওয়াজ তুলে তুলোগুলি ধুনে ধুনে পেঁজে ফেলত। তারপরে সেই তুলো দিয়ে তৈরি করত লেপ, তোষক, বালিশ ইত্যাদি বিছানার জিনিসপত্র।

মোটা দড়ি বাঁধা টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে আসত এক শোনপাপড়িওয়ালাও যার শোনপাপড়ির স্বাদ ছিল এক কথায় লা-জবাব। কাঠের গাড়ি ঠেলে আসত এক ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিমওয়ালা। কাঠি লাগানো গোলাপি, সবুজ রঙিন সেসব আইসক্রিম ছিল আমাদের বড্ড প্রিয়। 

শীতের দিনে আমাদের সুরেন ঠাকুর রোডের পাড়ায় কালো টিনের বাক্স নিয়ে আসত এক কেকওয়ালা। তার ডাক শুনতে পেলে, আমাদের আবদার রাখতে কেকওয়ালা দাদাকে ডেকে নিতেন মা। বাক্সের ঢাকা খুললেই কেকের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যেত। নানা রঙের ক্রিম দেওয়া পেস্ট্রি থাকত তার বাক্সে, থাকত ফ্রুট কেক। আমার পছন্দ ছিল গোলাপি পেস্ট্রি- যার স্বাদ মনে হয় এখনও মুখে লেগে আছে।  

https://www.youtube.com/watch?v=WvxR0M6gpwQ

দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে পাড়ার বারোয়ারি পুজোর মণ্ডপ থেকে ভোর হতে না হতে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত। গ্রাম থেকে ঢাকিদের বরাত দিয়ে আনা হত। পুজোর শেষে ঘরে ফেরার আগে ঢাকিরা সারা পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ঢাক বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি আসত বকশিসের আশায়। আমার মাকে দেখেছি ওদের টাকাপয়সার সঙ্গে নতুন ধুতি দিতে। এখনও অবশ্য আমাদের বহুতল আবাসনের পুজোয় ঢাকিরা আসেন। বিজয়া দশমীর সকালে ঘরে ফেরার আগে ঢাক বাজিয়ে ওঁরা ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঘুরে যান, আমরাও খুশি মনে ওদের হাতে কিছু টাকাপয়সা তুলে দিই। 

সত্তর দশকে আমার ছ’মাস বয়সের শিশুপুত্রকে নিয়ে আমি তখন আছি বালিগঞ্জের সুরেন ঠাকুর রোডে, আমার বাপের বাড়িতে। পুত্র অসুস্থ, টিনের দুধ সহ্য হচ্ছিল না। আমার চিকিৎসক বাবা বললেন ছাগলের দুধ খাওয়াতে হবে। খুব ভোরবেলায় আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দুটো-তিনটে ছাগল নিয়ে যেত এক দুধওয়ালা। ছাগলগুলোর গলায় বাঁধা থাকত ছোট ছোট ঘন্টা। সেই ঘন্টার আওয়াজ কানে গেলে আমার মা তাঁর নাতিবাবুর জন্য পিতলের ঘটি নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এক ঘটি দুধ নিতেন চার আনা দিয়ে। সেবার কিন্তু সেই ছাগলের দুধ খেয়েই আমার পুত্র সুস্থ হয়ে উঠেছিল।

কলকাতার ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়লে জানা যাবে যে সেই ইতিহাসের এক মুখ্য অংশ জুড়ে আছে ফিরিওয়ালাদের কথা। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ফিরিওয়ালারাই আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যে অল্প সংখ্যক ফিরিওয়ালা এখনও অবশিষ্ট আছে তারা আজও কলকাতার অলিগলিতে ডাক দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের পসরা নিয়ে। তাদের ভরসা বাড়ির বয়স্কা গৃহিণীরা যাঁরা এখনও অনলাইন বাজার করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। বুড়োবুড়ির সংসারে আজও তাঁদের মুশকিল-আসান প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই মুষ্টিমেয় ফিরিওয়ালারাই।

ছবি সৌজন্য: Wikisource.org, Amarpix.com।

Author Alpana Ghosh

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

Picture of আলপনা ঘোষ

আলপনা ঘোষ

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
Picture of আলপনা ঘোষ

আলপনা ঘোষ

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস