আমি প্রথম এক দুষ্টু ছাত্র ও এক ছাত্রীর মুখোমুখি হই, আমার কলেজ বেলায়। একটি কিশোর আর একটি কিশোরীকে পড়াতাম, হাত খরচ তোলার জন্য। অবশ্য পড়াবার সময় হাতখরচের কথা মাথায় থাকত না। মাথায় থাকত বাচ্চাদুটিকে আমায় শেখাতে হবে। কিশোরটি ভীষণ অমনোযোগী ও দুষ্টু ছিল, কিশোরীটি শান্ত, এখনও মনে আছে। তাদের দুজনেরই এখন বিয়েসাদি হয়ে তারা পিতামাতাও হয়ে গেছে এতদিনে। সেটা ছিল শিক্ষক ছাত্র বা ছাত্রীর মুখোমুখি হওয়ার এক পর্ব।
যতদূর মনে পড়ে কিশোর ছেলেটির মা আমাকে চা ও চায়ের সঙ্গে বিস্কুট বা অন্য ভাল খাবার দিয়ে গেলে, আমি যখন ওদের খাতা কারেকশনে ব্যস্ত, মুখ তুলে দেখতাম চায়ের প্লেট থেকে ছেলেটি নয় বিস্কুট বা শিঙাড়া বা নিমকি তুলে খেয়ে নিয়েছে। শুধু ঠান্ডা চা-টুকু পড়ে আছে সাদা কাপে একা হয়ে, নিঃসঙ্গ হয়ে।
আমি ছেলেটিকে কিছু বলতাম না, ছেলেটির সাহস বা লোভ দেখে আমি অবাকই হতাম। লোভ সে তো আমারও আছে খাওয়ার প্রতি। একদিন গরম শিঙাড়া, আমি দেখলাম, ছেলেটির মা প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার ভিতরে অল্প অল্প ‘শিঙাড়া খাওয়ার লোভ’ উঁকি দিচ্ছে। আমি অনেকক্ষণ নজরে রেখেছিলাম। মনে মনে মজাও পাচ্ছি, ছেলেটির আর অঙ্কে মন নেই। লসাগু গসাগু ভুলে সে শিঙাড়ার ওই ত্রিকোণ জ্যামিতির দিকে তাকিয়ে। আমি প্লেটটা সরিয়ে একটু দূরে করে দিলাম। ছেলেটি কিশোর হৃদয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিল। আমিও হাসলাম, তবে মনে মনে। আসলে একটা দুষ্টুমির খেলা আমিও খেলছিলাম ওই বালকটির সঙ্গে। ওর জ্যাঠতুতো দিদির খাতা দেখতে দেখতে একবার চোখ তুলে তাকে বললাম, ‘শিঙাড়া খাবি?’ বালক আবার দুষ্টুমি মেশানো হাসি হেসে বলল, ‘খাবো।’ আমি, ‘কটা খাবি? দুটোই?’ সে বলল, ‘দুটোই!’ আমি তাকে বললাম, ‘আমি একটা খাব না!’ সে বলল, ‘না’।
এইবার আমি তাকে মাস্টারসুলভ জ্ঞান দিতে লাগলাম। ‘একা সবটা খেতে নেই, সবাইকে দিয়ে-থুয়ে খেতে হয়। যে সবটা নিজে খায়, বা নিজে ভোগ করে তাকে স্বার্থপর বলে’ ইত্যাদি।
সে অত কিছুর মানে বুঝল কিনা জানি না। কিন্তু সে বলল, ‘না আপনি খান, আমি খাব না।’ এতে আমি আবার চাপে পড়ে গেলাম। নিজেকে ওর থেকেও লোভী মনে হল। আমি বললাম, ‘না না তুই খা না, আমি তো খাইই।’ কিন্তু সে আর কিছুতেই শিঙাড়া খেতে রাজি হল না। পরে সেই শিঙাড়া মুখে তুলতে আমার একধরণের গ্লানি হচ্ছিল, ইচ্ছে করছিল না খেতে। ওকে শেখাতে গিয়ে নিজে শিখলাম। কেউ চাইলে তাকে অকাতরেই দিতে হয়।
একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা যখন তাঁর ছাত্রদের মুখোমুখি হন, আমার ধারণা তিনিও ওই ছাত্রদের কাছ থেকেও শেখেন কিছু না কিছু প্রতিনিয়ত।
ব্ল্যাকবোর্ড, চক, ডাস্টার, বেঞ্চি, হাইবেঞ্চ, ‘স্যার জল খেতে যাব’, ‘স্যার সৌরভ আমার পেনসিল নিয়ে নিয়েছে’, ‘স্যার অঙ্কিতা পিছন থেকে আমার চুল ধরে টানছে।’
আমার এখন ক্লাস ফোরের অঙ্ক ক্লাস। নতুন নিয়ম হয়েছে, রোজ টিচার্স ডায়রি লিখতে হবে। আমার হাতে টিচার্স ডায়রি, আজ কী পড়াব, কোন লেসন থেকে অঙ্ক করাব, তার বৃত্তান্ত (তিস্তা পারের বৃত্তান্ত নয়) লিখব।
ঈশিকা অঙ্ক বই দিল। ঈশিকা খুব ভাল মেয়ে। শান্ত। ইসস আমার যদি এমন একটা মেয়ে থাকত। মনখারাপের সময় কাছে বসিয়ে গল্প করতাম। হঠাৎ আমি, আবেগে, ‘ঈশিকা তোরা কয় ভাইবোন রে!’ অবান্তর প্রশ্ন। ঈশিকা একটু থমকে যায়। ঈশিকা মনে মনে হিসেব করে। বলে আমরা দুই বোন। পাস থেকে অমৃতা বলে, ‘স্যার ওর একটা বুন হয়েছে।’ আমি, ‘ওটা বুন নয়, বোন!’ হাসির রোল। ঈশিকা লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা কেন? আমি ভাবি। নতুন বোন হওয়া তো আনন্দের। আমি, ‘ঈশিকা তাহলে আমাদের একদিন খাওয়াবে। আমরা, মানে রুদ্র আমি শৌমিক রাজু বৃষ্টি প্রিয়াঙ্কা আমরা সবাই ঈশিকাদের বাড়ি যাব। ঈশিকার মা আমাদের মাংস, লুচি, পায়েস, রসগোল্লা, মিহিদানা, বোয়ালমাছ এইসব খাওয়াবে।’
হাসি। হাসি থেকে হল্লা। ‘এটা কি মাছের বাজার!’ অথচ মাছের বাজার আমিইই মজা করতে গিয়ে বানালাম। ঈশিকা – এত খাওয়া কি করে তার মা খাওয়াবে, তার ওপর স্যারের মতো মহামান্যমান একজন যাবেন, সে ভেবেই দুশ্চিন্তায় কুঁচকে যাচ্ছে। পিছনের বেঞ্চে রপ্তান-বিশাল বোস-নীল গুহ হল্লার সুযোগে হল্লাকে আরও বাড়িয়ে – পুরো ক্লাসকে ভুনো খিচুড়ি বানিয়ে ছাড়ছে।
আমি ‘হেইইই’! ক্লাস খুব জোরে ব্রেক কষল। ক্লাস স্তব্ধ। সবাই আমার দিকে চেয়ে। তার মধ্যেই রনি ঘুড়ির সুতো ব্যাগে লুকোচ্ছে। আমি, ‘এইই অঙ্ক বই দাও!’
আমার বয়স ৯ বছর ৭ মাস, আমার মাসতুতো দিদি আমার থেকে ৪ বছর ৩ মাসের বড়, আর আমার ছোটবোন আমার থেকে ২ বছর ৬ মাসের ছোট। অঙ্কটা সবাই ভাল করে পড়। রপ্তান ‘স্যার পেচ্ছাপ করতে যাব?’ আমি, ‘এখানেই কর!’ হাসি হাসি হাসিদের ওঠানামা। দু’একজন অঙ্কটা পড়ছে। বোঝার চেষ্টা করছে।
উফফ মাসতুতো দিদি। মায়ের দূর সম্পর্কের লতায়পাতায়, বোনের মেয়ে, রুমকিদির কথা আমার হঠাৎ মনে পড়ল। রুমকিদি! আমার কলেজবেলায়, আকাশবাতাস যে তরুণী এক করে দিত সেই রুমকিদিকে মনে পড়ল। আমি অঙ্কে ফেরার চেষ্টা করছি। ক্লাস কন্ট্রোল একটা ব্যাপার। একটা বাইক খুব শব্দ করে রাস্তা দিয়ে গেল, খুব জোরে, মুহূর্তে বাইক সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে, বাইকে কোনো এক শাহরুখ খান পিছনে মানালি নাম্মী এক বান্ধবীকে নিয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে ছুটছে।
লাস্ট বেঞ্চ, তার আগের বেঞ্চ, হল্লা থামায়নি – হল্লা, মারপিট, নালিশ। শিশুদের এক আনন্দের উত্তাল ঢেউ। আমি, ‘আমার বয়স ৯ বছর ৭ মাস, আমার সামনে কুচকুচে কালো এবং শান্ত ব্ল্যাকবোর্ড, হাতে নিরীহ চক, আমি আর কালো ব্ল্যাকবোর্ড মুখোমুখি। পিছনে বিশাল বোস শানুকে কনুই মারল। আমি অঙ্ক করাতে করাতে পিছনে কারো হঠাৎ কান্নার আওয়াজ পেলাম।
মাস্টারের মারা বারণ, আমি ঘুরে দাঁড়াই। ক্লাস চুপ।
‘বিশাল তুমি বড় হয় কী হবে?’ বিশাল, বিশাল বিশাল চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশাল জানে না বড় হওয়া কাকে বলে। ‘সৌরভ রপ্তান তুমি বড় হয়ে কী হবে?’ স্যার ‘তুই থেকে হঠাৎ তুমি’ করে বলাতে সৌরভ রপ্তান একটু ঘাবড়ে যায়। তুই মানে, নিজের। তুমি মানে দূরের। সৌরভ কাছের হতে চায়। সৌরভও জানে না বড় হয়ে কী হতে হয়। আমি, ‘ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার মাস্টার (আমার মতো) বাড়ি বাড়ি চিঠি দেওয়ার পিয়ন, নাকি টোটোওলা, নাকি রিক্সাওলা? টোটো অটো শুনে হাসি ফোয়ারার মতো হঠাৎ পুরো ক্লাসকে ভিজিয়ে দেয়। আমি, ‘কোনও কাজই ছোট নয়, টোটো অটো চালানো কোনও ছোট কাজ নয়।’
আমার বয়স ৯ বছর ৭ মাস। মাসতুতো দিদি আমার থেকে ৪ বছর ৩ মাসের বড়। তাহলে কী করতে হবে? ‘স্যার ঘণ্টা পড়ে গেছে।’ পিছন থেকে আনন্দ-র গলা ভেসে এল। আমি, ‘পড়ুক, পুরো অঙ্ক শেষ করে তবে যাব।’ ‘স্যার জল খেতে যাব?’ আমি, চোখগরম। জল তেষ্টা উধাও।
রাস্তা দিয়ে খুব জোরে বাজনা বাজাতে বাজাতে বিয়েবাড়ির দল নাচতে নাচতে মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছে। পুরো ক্লাস জানলার দিকে ধেয়ে গেল। আমিও কৌতূহলে জানলার দিকে। অল্প বয়সী মেয়ে-বৌয়েরা নাচছে। আমার চোখ লোলুপ। বাচ্চারা স্যারের লোলুপ চোখের মানে বোঝে না। তারা কিছুই বোঝে না। ওরা শিশু। আমি বুঝি। সব বুঝি। আমি পাপ আর পূণ্যের মাঝামাঝি এক নিষ্পাপ চটি পরে রাস্তার মেয়েবৌয়েদের নাচ দেখছি।
বাজনা মিলিয়ে গেল। টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। অ্যাই সবাই ভাত খাবে কিন্তু। আজ আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ানো হবে। আয়রন ট্যাবলেট, ওষুধ।
আমরা এই বয়সে ওষুধ খাইনি কোনওদিন। আমাদের ফুটবল খেলার মাঠ ছিল। পুকুর ছিল সাঁতার কাটার। এদের মোবাইল আছে। আছে মোবাইল গেম। এরা কারও বাড়ির পেয়ারা চুরি করে না, এরা শুধু বড়দের স্মার্ট ফোনে লোলুপ চেয়ে থাকে।
এইভাবে আমরা মুখোমুখি মাস্টার-ছাত্র প্রতিদিন নিজেরা নিজেদের চিনে নিই, বুঝে নিই, মেপে নিই। দিন এগোয়। দিন মেঘলা হয়। রোদ ওঠে। পূজো এসে পড়ে আনন্দের কাশফুল নিয়ে।
ছুটির ঘণ্টা বাজে। ছুটি। ছুটি সবাই চায়। আমিও চাই। জীবনের ছুটির ঘণ্টা আমি শুনতে পাচ্ছি, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। আমি এই ইস্কুলে আর মাত্র কয়েকদিন পড়াব। মাত্র কয়েকটা দিন ভালবাসতে পারব এইসব শিশুদের।
রানা রায়চৌধুরীর জন্ম ষাটের দশকে উত্তর ২৪ পরগনায়। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের স্নাতক রানা পেশায় স্কুলশিক্ষক। তবে প্যাশন বলতে মূলত লেখালিখি। এ যাবৎ প্রকাশিত বারোটি কাব্যগ্রন্থ ও তিনটি গদ্যগ্রন্থ। লিখেছেন একটি উপন্যাসও। তাঁর কবিতার বই লাল পিঁপড়ের বাসা, অগাস্ট মাসের রাস্তা, একটি অল্পবয়সী ঘুম পাঠকমহলে সমাদৃত। লেখকের সদ্য প্রকাশিত গল্পের বই দ্রাবিড়ের ভাঙা উইকেট।