১৯৬৫ সাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নরেন্দ্রপুরের কাছে জগদ্দল নামে এক জায়গায় ক্লাবের সরস্বতীপুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাস গাইতে আসবেন। দেবব্রতর তখন খুব নামডাক। চারের দশকের মাঝামাঝি থেকে গাইলেও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে হিন্দুস্তান কোম্পানিতে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গেয়ে আপামর মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। তারপর ‘যেতে যেতে একলা পথে’, ‘গায়ে আমার পুলক লাগে’ প্রভৃতি গানের মধ্য দিয়ে অব্যাহত জয়যাত্রা। তো সেই অনুষ্ঠানে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের ইংরেজি বিভাগের এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রও আমন্ত্রিত, শিল্পী হিসেবে। সে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান বাজায়, অল্পস্বল্প গানও করে।
দেবব্রতবাবুর আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই অ্যাকর্ডিয়ান বাজানোর পর সংগঠকদের অনুরোধে যখন গান ধরলেন সেই তরুণ, তার মধ্যেই এলেন দেবব্রত। ছাত্রের গান শুনে দেবব্রত উদ্যোক্তাদের দিয়ে তাকে বলে পাঠালেন যদি তাঁর গাওয়া কোনও গান জানা থাকে, তাহলে সে যেন গায়। শুনে তো ছাত্রটি ভয়েই অস্থির। সে তো কোনও স্বীকৃত শিল্পী নয়। যা হোক, দুরুদুরু বক্ষে তার প্রিয় গান দেবব্রতর বিখ্যাত ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গাইল। গানের পর দেবব্রত জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় শেখ? সে অকপটে বললে, রেকর্ড বা রেডিও শুনে গান তোলে, শেখে না কোথাও। তখন দেবব্রত তাকে গান-শেখানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করেন।
যুবক যেন হাতে চাঁদ পেল। শুরু হল দেবব্রতবাবুর ১৭৪,ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে তার গানের তালিম। প্রথম প্রথম অনেকের সঙ্গে রবিবার, কিছুদিন বাদেই তাকে একলা শেখাতে শুরু করলেন দেবব্রত বিশ্বাস। বছরখানেক পর নিজেই বেতারের অডিশন-ফর্ম নিয়ে এসে প্রিয় শিষ্যকে বললেন পূরণ করে জমা দিতে। অডিশনে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭-তে প্রথম বেতারে গাইবার সুযোগ হল নরেন্দ্রপুরের সেই তরুণ ছাত্রের। পরের বছরেই ডিস্ক রেকর্ড। এইচএমভি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হল মায়া সেনের প্রশিক্ষণে: ‘লুকালে বলেই খুঁজে বাহির করা’ আর ‘ আমায় থাকতে দে-না আপন-মনে’। জন্ম হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক বিশিষ্ট শিল্পীর: স্বপন গুপ্ত।
অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে তাঁর জন্ম। স্বাধীনতার পর তাঁরা কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৬৫-তে স্নাতক এবং ১৯৬৭-তে স্নাতকোত্তর ইংরেজি সাহিত্যে। ১৯৬৫-তে দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ স্বপনের জীবনটাকেই বদলে দেয়। কোনওদিন ভাবেননি তিনি গায়ক হবেন। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে সুরের দীক্ষার সঙ্গে স্বপন পেলেন এক একান্ত আশ্রয়। সংগীতের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। তাঁর মুক্তি হল সুরের আকাশে। দেবব্রতবাবুকে ‘মাস্টারমশায়’ বলে সম্বোধন করতেন স্বপন। কীভাবে সুর-বাণীর শুদ্ধতা বজায় রেখে যথাযথ অভিব্যক্তির প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মবাণীকে প্রকাশ করা যায়, তাই স্বপন অনুভব করলেন তাঁর ‘মাস্টারমশায়’-এর সংগীত-রূপায়ণে। আর এটাই তাঁর সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা।

স্বপনের কাছে মাস্টারমশায় ‘সংগীত-আত্মার একমাত্র অধীশ্বর’। দশ বছর একাদিক্রমে দেবব্রতর কাছে তালিম নিয়েছিলেন স্বপন। স্বপনকে একেবারে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন দেবব্রত। শেষদিকে দেবব্রত যখন রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাধীন, তখনও একদিন স্বপন দেখা করতে গেলে তাকে সেখানেই গান শিখিয়েছেন–‘তোমার কাছে এ বর মাগি’। এই গান তারপর বহুবার স্বপন গেয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করার সূত্রে মায়া সেনের প্রশিক্ষণেও সমৃদ্ধ হলেন।
‘লুকালে বলেই’ বা ‘আমায় থাকতে দে-না’– এই প্রথম রেকর্ডেই নিশ্চিত প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর ছিল। শ্রোতারা পেলেন এক নতুন জোয়ারিদার পুরুষকণ্ঠ যার মধ্যে দীপ্রতা ও নম্রতার এক আশ্চর্য সহাবস্থান। গায়নে দেবব্রত বিশ্বাসের একটু স্বাভাবিক প্রভাব থাকলেও কখনওই তা অনুকরণের পর্যায়ে নয়। দেবব্রত প্রায়শই স্বপনকে বলতেন স্বকীয়তার ব্যাপারে, স্বপনও একটা নিজস্বতা তৈরি করে নিয়েছিলেন। গান বারবার পড়ে গানের ভেতরে ঢুকতে হবে, তার ভাবটা হৃদয়ঙগম করতে হবে— বলতেন দেবব্রত। গান-পরিবেশনে এ-কথা সবসময় মনে রেখেছেন স্বপন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে মায়া সেনের নিবিড় প্রশিক্ষণও খুব কাজ দিয়েছিল। শীলিত কণ্ঠ, সুমিত বোধ ও নাটকীয়তার সুসমন্বয়ে স্বপন রবীন্দ্রনাথের নানা স্বাদের, বিভিন্ন ভাবের গান, যেমন- ‘তোমায় কিছু দেব বলে’, ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু ‘, ‘ছি ছি চোখের জলে’, ‘আজি নির্ভয় নিদ্রিত ভুবনে’, ‘কাছে ছিলে দূরে গেলে’ বা ‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল’ ইত্যাকার গানকে বান্ময় করে তোলেন। তাঁর নিজেরই অন্তরের উচ্চারণ হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান। এক সাক্ষাৎকারে স্বপন বলেছিলেন, ‘ যে গান গাইছে সে যদি নিজে আনন্দ না পায় সে কীভাবে অন্যকে আনন্দ দেবে?’ স্বপন নিজে রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবেসেছেন, তাতে আনন্দ পেয়েছেন আর সহজেই তা সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছেন শ্রোতাদের মধ্যে।
গ্রামোফোন কোম্পানিতে দশ-এগারো বছর পরপর রেকর্ড করার পর ‘পলিডর’-এ গেয়েছেন। আরও পরে ‘ভাবনা’, ‘বাহার মিউজিক’ থেকেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গান। গ্রামোফোন কোম্পানিতে একক রেকর্ড ছাড়াও কয়েকটি গীতিনাট্যে (লং প্লে) অংশ নিয়েছিলেন, যেমন, ‘বিরহ মিলন কথা’ বা ‘যায় দিন শ্রাবণ দিন যায়’। দু’একটি ছবিতে প্লেব্যাকও করেছেন। শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে শৈবাল মিত্রের ‘চিত্রকর’ ছবিতে স্বপনের গাওয়া ‘যারা বিহানবেলায় গান এনেছিল’ বহুদিন মনে থাকবে।

দেশে-বিদেশে গান শুনিয়েছেন স্বপন গুপ্ত। পুরস্কার পেয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সংগীত মহাসম্মান ২০১৫’। বেশ কয়েক বছর ধরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত-চর্চায়, পরিবেশনে কিছু যথেচ্ছাচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে কিছুটা হতাশ স্বপন গুপ্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে বিকৃত করছেন যাঁরা, তাঁরা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করছেন। এতে আর কিছু নয়, তাঁদের ঔদ্ধত্য, ধৃষ্টতাই প্রকাশ পাচ্ছে। স্বপন যথার্থই বলেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি বিকৃত করার, পরিবর্তন করার অধিকার কারুর নেই। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তাকে সম্যক উপলব্ধি করে সেইভাবেই রূপায়িত করলে অনাবিল আনন্দ মিলবে।
দুঃখের কথা, এই আদ্যন্ত শিল্পী মানুষটি আজ বেশ অসুস্থ। আমরা সকলে তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।
কৃতজ্ঞতা : তপতী গুপ্ত, পুণ্যশ্লোক দত্ত
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, uvm.edu, savefromnets
স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l
8 Responses
খুব ভালো লাগলো ।বহুদিন পরে এই মানুষটিকে নিয়ে কিছু লেখা হলো।ত তথাকথিত সংগীত বিশারদ বা সমালোচক রা তো আজ অন্তত 15 বছওরের সময় পাননি কাজে লেখার।আমার সৌভাগ্য রাঁচিতে ওনার একক রবীন্দ্র সংগীত 2 বার শোনার সুযোগ হয়েছিল।মন ভরে শুনিয়েছিলেন গান আর আমরা উপভোগ করেছিলাম।ওনার দ্রুত সুস্থতা প্রার্থনা করি।
অনেক কিছু জানলাম আপনার এই লেখনী থেকে! আপনি তাঁর সানিধ্য পেয়েছেন এটা আপনার সুভাগ্য! উনি আমাদের এখানে গান করতে এসেছিলেন, সে এক অনবদ্য সন্ধ্যা, মনে রাখার মতো! তখন আলাপ হয়েছিল! এক প্রচার বিমুখ মানুষ! আজকে যা বড়ই বিরল!
উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠান এই আমার একান্ত কামনা ও আন্তরিক প্রার্থনা !!
আমি ও চাই স্বপনবাবু সুস্থ হয়ে উঠুন ্্শী্ঘ্র
স্বপন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজে ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন আমার খুব কাছের মানুষ ছিল। আমরা দু’জনেই ব্রম্ভানন্দ ভবনে থাকতাম। ওর ছিল ইংরেজি সাবজেক্ট আর আমার ইকোনমিকস। আমিও ওখানে সঙ্গীত শিখতাম প্রতি রবিবার। ক্লাসিক্যাল শেখাতেন। স্বপন পিয়ানো একর্ডিয়ান বাজাতো নিজের সখ হিসাবে। হারমোনিয়াম খুব ভালো বাজাতো। আমাকে অরগ্যান বাজানো শিখিয়েছিল।
সত্বর দশকের মাঝামাঝি দূর্গাপূজা উপলক্ষে নিউ দিল্লি কালীবাড়িতে সঙ্গীত অনুষ্ঠানে এসেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হতে ঠিক চিনতে পারলে। আমার কর্মস্থল দিল্লি হবার জন্য এরপর বেশ কয়েকবার নরেন্দ্রপুরে রিইউনিয়নে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে সময় সবাই আমরা স্বপনের গান শুনতে সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম। দু-তিন বছর আগেও আমাদের ঐ দিন ২৫শে ডিসেম্বর নরেন্দ্রপুরে দেখা হয়েছে। হঠাৎ স্বপনের অসুস্থ হবার খবর শুনে আমরা পরিচিত সকলেই খুব মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। এখন ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হয়ে উঠুক ঠাকুরের কাছে এই প্রার্থনা।
গুণী শিল্পী স্বপন গুপ্তের শারীরিক অসুস্থতার খবরে খুব উদ্বিগ্ন হলাম। প্রার্থনা করি উনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
স্বপন গুপ্তর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি
স্বপনদা তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন– আমরা সকলে এই প্রার্থনা করি। ষাটের দশকে তো স্বপনদার বাজনা আর গান শুনেই রা. মি. বি. নরেন্দ্রপুরে বড় হয়েছি।
বড়ই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ আমাদের সকলের প্রিয় স্বপন গুপ্ত চলে গেল গতকাল চিরতরে। পরলোকে চির শান্তি লাভ করুক স্বপন এই আমাদের প্রার্থণা। স্ত্রী তপতি গুপ্ত ও তাদের একমাত্র কন্যাকে জানাই আন্তরিক সমবেদনা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তারা যেন এই আত্মজন হারানোর মর্মান্তিক ব্যথা সহ্য করতে যথেষ্ট শক্তি ফিরে পায়। ওঁ শান্তি।