মুর্শিদাবাদ । আমাদের গ্রামের বাড়ি। শ্রাবণ-ভাদ্রের ঘোর বর্ষায় পুকুরগুলো সব উপচে উঠে আশেপাশের জলা-জমি-বাগান থইথই জলের তলায়। মাঝেমধ্যে এক আধটা ঝুপসি গাছ । আর ধু-ধু ফেনাফেনা জল।
আমাদের পোষা একঝাঁক হাঁসেদের তখন ভারি ফূর্তি। সকালে খাঁচা খুলে দেওয়ামাত্র হইহই করে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই অনন্ত জলরাশিতে। ভেসে যায় কোন এক দিকশূন্যপুরে। শামুক গুগলি আর কুচো মাছ গলা পর্যন্ত। গলা উঁচু করে দুলিয়ে দুলিয়ে পেটে পাঠায়।
সকালে খাঁচায় বড় বড় ডিম। গাঢ় কমলা কুসুম। ভারী তার স্বাদ।
আমার কাজ ছিল বিকেলে তাদের ঘরে ফেরানো। আয় আয় .. চই চই…। সবসময় গলার আওয়াজে কাজ হয় না। তাড়িয়ে তাড়িয়েও আনতে হয় মাঝেমধ্যে। কোথাও কোমরজল কোথাও বুকজল ঠেলে, কখনও সাঁতরে। পাশ দিয়ে সাঁতরে যায় মস্ত জলঢোঁড়া। ভয় ? হ্যাঁ, তাও করতো বইকি। তবু, কেন জানিনা, ভালোই লাগতো ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে ওদের ফিরিয়ে আনতে। সে এক অপূর্ব আস্বাদ।
প্রতিটি হাঁস তাদের আলাদা নিজস্বতা নিয়ে বন্ধু ছিল আমার। তিলি, ক্যাম্বেল, লালমাথা, সাদাকালো, আরও কত সব মন ভালো করা নাম।
বাড়িতে হাঁসের বাচ্চা তোলা হ’ত। তখন সবার সে কী আনন্দ। তুরতুর করে রংবেরঙের তুলোর বলগুলো ছুটেছুটে বেড়াতো উঠোনময়। ময়দা গুলে, গুগলি ছেঁচে তাদের খাওয়ানো যেন এক উৎসব তখন আমাদের ছোটদের দলটার।
ক্লাস নাইন সেবার। আমার নতুন বন্ধু হয়ে উঠল এক ঝলমলে সাদাকালো। কি তার জেল্লা! কি তার রূপ! আগলে আগলে রাখি, যতক্ষণ বাড়িতে থাকি। বেশি বেশি করে খাওয়াই। মাত্র মাসতিনেক। ছোট্ট নরম দুটো ডানা। মায়াবী চোখ।
একদিন। ছুঁইছুঁই বিকেল। স্কুল থেকে ফিরে দেখি উঠোনে নিথর শুয়ে আছে আমার সাদাকালো। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। গলা থেকে মাথা পর্যন্ত দগদগে লাল। ছোট্ট শরীরটার সমস্ত পালক বীভৎসভাবে ছিন্নভিন্ন। বুকটা কোনওরকমে উঠছে নামছে। একচিলতে ফাঁক হচ্ছে হলুদ দুটো ঠোঁট।
বেচারি ভুল করে কখন ঢুকে পড়েছিল বড় হাঁসেদের ঝাঁকে ।
সদ্য কিশোরী ছিল আমার সাদাকালো। শক্তিমান বড় বড় নর হাঁসগুলো মুহুর্তে তাদের ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলে। সাদাকালো জানতো না কী করে বেরোতে হয় এই চক্রব্যূহ থেকে।
সাদাকালো বাঁচেনি। টগরগাছের নীচে ওকে শুইয়ে দিয়েছিলাম ঝিরিঝিরি মাটির নীচে। সূর্য তখন অস্তরাগে।
পরদিন, সকালে গিয়ে দেখি, কবরটার ঠিক ওপরে, কখন আপনা থেকেই ঝরে পড়েছে, একটা টগরফুল। সাদা।
সাদাকালো কিশোরী সেই হাঁস। আমার স্মৃতির প্রথম নির্ভয়া।
জয়দীপ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৭২ সালে, মুর্শিদাবাদ জেলার আমতলা গ্রামে। আমতলা হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক, নীলরতন সরকার ও রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা থেকে ডাক্তারির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠ। পেশায় চক্ষুরেগ বিশেষজ্ঞ। শেওড়াফুলিতে গত ১৪ বছর ধরে কর্মরত। নেশা বলতে দেশবিদেশের ফুটবল খেলা, নাটক, গান, বাংলা সাহিত্যচর্চা, ছাদের ফুলবাগান, লেখালেখি এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো। এবং আজন্ম আমৃত্যু কোহলবর্জন।